#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_২৬
#Tabassum_Kotha
মেহমানে ভর্তি খান বাড়ি তবুও পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। নজরুল সাহেব অন্দরমহলের এক কোণায় সোফায় বসে আছেন। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ কিন্তু তবুও চোয়াল শক্ত করে চুপ করে আছেন। মেহমানদের মধ্যে অনেকেই কানাঘুসা শুরু করে দিয়েছেন। কানাঘুসার শব্দ নজরুল সাহেবের কানেও আসছে। কিন্তু এই মুহূর্তে মৌনতা অবলম্বন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। নজরুল সাহেব সোফা ছেড়ে উঠে নিজের ঘরের দিকে অগ্রসর হলেন। ঘরে তাহেরা বেগম আর নয়নতারা বেগম আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন।
নয়নতারা বেগম এতোক্ষণ চুপ করে থাকলেও স্বামীকে দেখে বাজখাই গলায় চেচিয়ে উঠলেন,
— আমি আগেই বলেছিলাম ঐ মেয়েকে এ বাড়ির বউ করিয়েন না। কিন্তু আপনারা আমার একটা কথাও শুনেন নি। এখন দেখেন বংশের মুখে চুনকালি মেখে দিলো এই মেয়ে।
— আহা নয়ন শান্ত হ। এখনও তো সবকিছু প্রমাণ হয় নি। হতে পারে ডাক্তার ভুল বলেছে। (তাহেরা বেগম)
— আপা তুমি এখনও বলছো ডাক্তার ভুল বলেছে! ঐ মেয়ে না জানি কোথায় থেকে পেট বাঁধিয়ে নিয়ে এসে এখন আমার নীল এর ঘাড়ে চেপেছে। আমি আগেই বলেছিলাম মুনতাহা কে নীল এর বউ বানানোর কথা। মুনতাহা বাড়ির বউ হলে অন্তত আজ এই দিন দেখতে হতো না।
.
নয়নতারা বেগমের যুক্তির সামনে তাহেরা বেগমও চুপ হয়ে যায়।
.
.
কিছুক্ষণ আগে বউভাতের অনুষ্ঠানে বাড়ি ভর্তি মেহমানের সামনে কথা মাথা ঘুড়ে নিচে পরে যায়। তাড়াহুড়া করে নজরুল সাহেব ডাক্তার আনালে, ডাক্তার কথার চেকআপ করে জানায় কথা অনঃসত্ত্বা। যদিও কথার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ব্যাপার টা শুধু পরিবারের মানুষ জানে। কিন্তু বাড়ির থমথমে পরিবেশ দেখে মেহমানরা তাদের মন মতো কাহিনী রটতে শুরু করে দিয়েছে।
.
তাহেরা বেগম নিচে নেমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন। মেহমানদের বুঝিয়ে শুনিয়ে খাবার খাওয়াতে পাঠিয়ে নীরব আর রাজীব কে দায়িত্ব দিলেন তদারকীর।
”
”
”
এদিকে কথা তার ঘরের দরজায় খিল এটে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে। যেই ভয়টা সে পাচ্ছিল সেটাই সত্যি হয়ে গেলো। কালই ভেবেছিল হয়তো সে মা হতে চলেছে। কিন্তু এই কথাটা যে এভাবে সবার সামনে বেরিয়ে আসবে সেটা কে জানতো। নীলও বাসায় নেই। কিছু কাজে গেছে। কখন ফিরবে কেউ জানে না। নীল পাশে থাকলে কথার নিজেকে এতোটা অসহায় মনে হতো না। নয়নতারা বেগম আর মুনতাহার গা জ্বালানো কথা বার্তা সহ্য করার শক্তি পেতো কথা, নীল তার পাশে থাকলে। কিন্তু নীল নেই, অবশ্য নীল এর দোষ দেওয়া যায় না। সে জানতো না যে কথা প্রেগন্যান্ট। নীল জানলে হয়তো পরিস্থিতি এতো বিগড়ে যেতো না!
” কথা দরজা টা খোল। প্লিজ দরজা টা খোল।”
বাইরে থেকে অনবরত দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে কথা কে ডাকছে নিতু।
নিতুর কন্ঠ শুনে কথা তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে দিয়ে নিতুকে ঝাপটে ধরে কান্না শুরু করে দিলো। নিতু কথাকে সামলানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কথা থামছে না।
” নিজের পাপ পেটে নিয়ে ঘুরার আগে বুঝি মনে ছিল না যে এখন কান্না করছো?”
দরজার সামনে দাড়িয়ে মুনতাহা মুখে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি নিয়ে কথাটা বললো।
— মুনতাহা আপু তুমি এসব কি বলছো? (নিতু)
— কেনো নিতু ডাক্তার যখন বললো কথা অনঃসত্ত্বা তখন তো তুই সামনেই ছিলি শুনিস নি বুঝি?
— শুনেছি। কিন্তু সেই সাথে এটাও শুনেছি যে ডাক্তার ল্যাবে নিয়ে টেষ্ট করতে বলেছে। তার ধারণা ভুলও হতে পারে।
— ওহ তাই নাকি। আচ্ছা তাহলে ওই প্রেগনেন্সি টেষ্ট কিট টা? ওটাও ভুল তাই না।
— এসব কিট অনেকসময় ভুল রিপোর্ট দেয়।
— আর কতোভাবে ডিফেন্ড করবি এই চরিত্রহীন মেয়ে টাকে? কালকে বিয়ে হয়েছে আর আজকেই ম্যাডাম প্রেগন্যান্ট। না জানি কার পাপ নীল এর ঘাড়ে চাপানোর ফন্দি এটেছে।
— মুনতাহা আপু তুমি চুপ করবা!
” ওকে চুপ করাচ্ছিস কেনো? মিথ্যা কিছু তো আর বলে নি মুনতাহা।”
পিছন থেকে নয়নতারা বেগম চেচিয়ে উঠলেন।
— মা তুমিও! তোমরা শুরু টা করেছো কি বলোতো? একবার কথার অবস্থা টা তো দেখো।
— তোর এতো বুঝতে হবে না। জামাই বাবাজি নিচে আছেন। তার কাছে যা। বেচারা নিজের বোনের কুকর্মের কথা শুনে কেমন আছে কে জানে!
নিতু কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো।
— এই মেয়ে! নিজের এই পাপী মুখ নিয়ে আমার ছেলের জীবন থেকে চলে যা। যেদিন থেকে আমার ছেলের দিকে নজর দিয়েছিস সেদিন থেকে তুফান শুরু হয়ে গেছে নীল এর জীবনে। কোন তাবিজ-কবজ করে আমার ছেলের মাথা খেয়েছিস কে জানে। সেসব কিছু মেনে নিলেও এখন অন্যের পাপ আমরা মানতে পারবো না। চলে যা আমার ছেলের জীবন থেকে।
নয়নতারা বেগমের কথায় কথার কান্নার বেগ আরও বেড়ে যায়। নয়নতারা বেগম কথার চোখের পানিকে নাটক ভেবে নাক ছিটকে সেখান থেকে চলে যায়।
— দেখো কথা তুমি বয়সে আমার কতো ছোটো কিন্তু তুমি যে একটা পাক্কা খেলোয়ার এটা আমি মেনে গেছি। (মুনতাহা)
— মানে?
— এইযে রূপের জাল বুনে ছেলেদের ফাঁসাও। এতোদিন ভাবতাম তুমি শুধু মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ছেলেদের হাত করো, যেমনটা নীল কে করেছো। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পেরেছি তুমি তো শরীর দেখিয়ে ছেলেদের বশ করো। বাহ! বাহ! কতো ভালো বিদ্যা শিখেছো এতোটুকু বয়সেই।
— আপনার সামনে হাত জোর করে বলছি এসব বলবেন না। আমি ওমন মেয়ে নই।
— তুমি যে কেমন মেয়ে সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। বিয়ের আগেই পেট বাঁধিয়ে ফেলেছো, কিন্তু বাচ্চাটা কার তার তো কোনো ঠিকই নেই। আচ্ছা কথা এমন নয়তো যে এতো গুলো পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছো যে তোমার গর্ভে কার সন্তান সেটা তুমি নিজেই জানো না!
— প্লিজ থামুন।
— ওহ তাহলে এটাই আসল কথা! তা কয়টা পুরুষের সাথে ছিল তোমার শারীরিক সম্পর্ক? নীল কেও কি এভাবেই ফাঁসিয়েছো? বিয়ের আগে কতোবার শুয়েছো নীল এর সাথে?
— চুপ করুন দয়া করে।
— সরি চুপ করে থাকতে পারছি না। অনেক কিউরোসিটি হচ্ছে জানার। কয়জনের সাথে বেড শেয়ার করেছো? হিসেব আছে নাকি কয়জনের বিছানার খোরাক হয়েছো? নাকি হিসেবের বাইরে ছিল সব?
কথাটা বলার সাথে সাথে মুনতাহার গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় পরলো। থাপ্পড়ের বেগটা এতোটাই তীব্র ছিল যে মুনতাহা ছিটকে মেঝেতে পরে যায়।
.
এতোক্ষণ চোখ মুখ খিচে কান্না করছিল কথা। আচমকা থাপ্পড়ের শব্দে চোখ খুলে তাকাতেই দেখে নীল তার সামনে দাড়িয়ে। রাগে নীল এর মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করে আছে। চোখ দিয়ে মনে হচ্ছে আগুন ঝরে পরছে। কথা নীল কে দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। নীল এর বুকের উপর আঁছড়ে পরলো। নীল কে পেয়ে যেনো কথার কান্না আরও বেড়ে গেলো।
— মুনতাহা আমার হাতে খুন হতে না চাইলে বের হও আমার ঘর থেকে। নেক্সট্ টাইম কথার সাথে এভাবে কথা বললে তোমার জিভ আমি টেনে ছিড়ে ফেলবো। আমাদের ধারে কাছেও যেনো না দেখি আর তোমাকে। যাও। আই সেইড গেট আউট!
নীল এর ধমকে মুনতাহা ভয়ে কুঁকড়ে সেখান থেকে পালায়। মুনতাহা চলে গেলে নীল কথার মুখ তার দুহাতের আজলে তুলে ধরে।
— কি হয়েছে তুই কাঁদছিস কেনো? মুনতাহা তোকে এতো বাজে বাজে কথা বলছিল আর তুই কি না মুখ বন্ধ করে শুধু শুনে যাচ্ছিলি! একটা কথার উত্তরও কেনো দিস নি? তুই তো এতো দুর্বল ছিলি না। তাহলে আজ কেনো উত্তর দিতে পারলি না?
কথা কিছু বলার আগেই নয়নতারা বেগম পিছন থেকে বলে উঠেন,
— কিছু বলার মুখ থাকলে তো বলবে! যেই কুকর্ম করেছে তারপর আবার উত্তর দেবে কোন মুখে!
— এসব কি বলছো মা?
— যা বলছি ঠিক বলছি। একটা চরিত্রহীন মেয়ের কাছ থেকে কি উত্তর আশা করা যায় তুই বল।
— মা কথার সম্পর্কে আমি একটা বাজে কথা সহ্য করবো না।
— বাজে কথা না বাবা। তুই সত্যি টা জানিস না তাই ওকে দুধে ধোয়া তুলসীপাতা মনে করছিস। কিন্তু এই মেয়ে তো,, ছিঃ ছিঃ ছিঃ আমার তো মুখে আনতেই গা ঘিনঘিন করছে।
— কি এমন হয়েছে যার জন্য তোমরা সবাই কথার সাথে এমন ব্যবহার করছো?
নয়নতারা বেগমের পাশেই মুনতাহা দাড়িয়ে ছিল। হঠাত সে সামনে এসে বলতে শুরু করে,
— কথা মা হতে চলেছে নীল। না জানি কার পাপের ফসল পেটে নিয়ে তোমাকে ফাঁসিয়ে নিজের বাচ্চার বাবা বানাতে চেয়েছিল।
মুনতাহার কথায় যেনো নীল এর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো। কথা মা হতে চলেছে! মুহূর্তের জন্য নীল থমকে গেছে। কথা প্রেগন্যান্ট!
নীল একবার কথার দিকে তাকালো কথাটার সত্যতা যাচাই করার জন্য।
নীল এর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে কথা ফুপাতে ফুপাতে ঘাড় উপর নিচ করে হ্যা সম্মতি দিলো যে সে সত্যি মা হতে চলেছে।
নীল এর যা বোঝার সে বুঝে গেছে। আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই তার। নিঃসন্দেহে বাচ্চা টা তার। লুকিয়ে বিয়ে করার পর টানা এক মাস সে কথার সাথেই থেকেছে। কিন্তু আজ তার একটা ভুলের জন্য সবার সামনে কথাকে চরিত্রহীন উপাধি পেতে হলো! নীল এর এখন বোধ হচ্ছে যে, সেদিন নজরুল সাহেব কে বিয়ে করার কথা না বলে সে কতো বড় ভুল করেছে।
— শুনেছিস? শুনেছিস তুই তোর সতীসাদ্ধী বউ কি করেছে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ এলাকার মানুষজন জানতে পারলে আমাদের পরিবারের কতো থু থু হবে ভাবতে পারছিস তুই নীল? নয়নতারা বেগম পুনরায় গর্জে উঠলেন কথার উপর।
নয়নতারা বেগম কে থামানোর উদ্দেশ্যে নজরুল সাহেব বলতে শুরু করলেন,
— নয়ন তুমি থামো। নীল! দেখো, ঘটনা টা এতো দ্রুত ঘটে গেছে যে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না কি বলা উচিত বা করা উচিত।
.
নীল কিছু বলতে যাবে তার আগেই কাব্য হন্তদন্ত হয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে পরলো। কাব্যকে দেখে কথার মনে একফোঁটা আশার আলো ফুঁঠে উঠলো। আর যে যাই বলুক তার ভাইয়া তাকে ভুল বুঝবে না কখনও। তার কাব্য ভাইয়া তার সব কথা শুনবে, বাকি সবার মতো তাকে অপবাদ দেবে না। কথা নীল কে ছেড়ে কাব্য এর সামনে এগিয়ে যেতেই কাব্য ঠাস্ করে কথার গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়।
এমনিতেই শরীর দুর্বল তার ওপর চড় টা সহ্য করতে না পেরে কথা নিচে পরে যায়।
— কাব্য!! তোর সাহস কি করে হয় কথার গায়ে হাত তোলার! (নীল)
— নীল তুই এই ব্যাপারে প্লিজ আমার আর কথার মধ্যে আসবি না। আমাকে কথা বলতে দে!
কথা দুচোখের পানি মুছে নিজেকে সামলে উঠে দাড়ালো।
— ভাইয়া তুই আমাকে মারলি! একটা বারও আমাকে জিজ্ঞেস করলি না কি হয়েছে! বাকি সবার মতো তুইও আমাকে অবিশ্বাস করে অপবাদ দিয়ে দিলি!
— বিশ্বাস করার মতো আর কি বাকি আছে কথা? তুই অনঃসত্ত্বা তাও আবার বিয়ের আগে,, এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে যে তুই একটা খারাপ মেয়ে!
— ভাইয়া!
— আজ তোকে বোন বলে পরিচয় দিতে আমার লজ্জা হচ্ছে। এই বাচ্চার কোনো পিতৃ পরিচয় আছে নাকি নেই? উত্তর দে!
কথা বাকরুদ্ধ হয়ে কাব্য এর দিকে তাকিয়ে আছে। কথা ভেবেছিল কাব্য তাকে সাপোর্ট করবে। কিন্তু না কাব্যও বাকি সবার মতোই বলছে! আজ কথার নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে। তার সন্তান জন্ম নেওয়ার আগেই সকলের চোখে তার পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে। মা হিসেবে সে কলঙ্ক। তার অনাগত সন্তানকে সবাই পাপের ফসল বলছে, আর সে মূর্তির মতো সব মুখ বুজে দেখে যাচ্ছে!
— এই মেয়ে আমার বাড়িতে আর থাকতে পারবে না। জামাই বাবাজি, তুমি তোমার বোনকে নিয়ে যাও। যার পাপ গর্ভে নিয়ে ঘুরছে, তার কাছেই দিয়ে দিও। আমার ছেলেকে মুক্তি দাও এখন। (নয়নতারা বেগম)
চলবে..