শ্রাবণের মেঘ পর্ব_২৫

0
1168

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_২৫
#Tabassum_Kotha

??

বিউটিশিয়ানরা এসে কথাকে সাজিয়ে দিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। লাল বেনারসি শাড়ি সাথে ভারী গয়না আর মানানসই সাজ,, সব মিলিয়ে কথাকে এতোটা সুন্দর লাগছে যে আজ যেকোনো অপ্সরীও কথার সৌন্দর্যের সামনে হার মানতে বাঁধ্য।

নিতু কথার মাথায় লাল ভারী কাজ করা ওড়না টা পরিয়ে দিতে দিতে বললো,
— আজ তো নীল ভাইয়া পাগল হয়ে যাবে আমার ননদিনীকে দেখে।

পাশে বসে থাকা তুলি কথাকে হালকা চিমটি কেটে বললো,
— আহারে বেচারি কথা! বর বিয়ের দিনই পাগল হয়ে যাবে।

কথা ভ্রুঁ পাকিয়ে বলে,
— চুপ করবি তোরা? এমনিতেই শরীর ভালো না, তার ওপর তোরা এমন করছিস!

নিতু অনেক ঘাবড়ে গিয়ে কথাকে জিজ্ঞেস করলো,
— শরীর ভালো না মানে কি হয়েছে?

— সকাল থেকে বমি হচ্ছে মাথা ঘুরাচ্ছে। ভীষণ অস্থিরতাও বোধ হচ্ছে।

— গ্যাসট্রিক হলো নাকি আবার! (তুলি)

কথা আর নিতু নাক ছিটকে বললো,
— কি বলছিস! গ্যাস! (নিতু)

— আর নয়তো কি? কথা তো আর ম্যারিড না। তোর আমার মতো ম্যারিড হলে বুঝে নিতাম যে কথা মা হতে চলেছে। (তুলি)

— মা! হি হি হি! কি যে বলিস না তুলি। কথা কিভাবে প্রেগন্যান্ট হবে! নীল ভাইয়া তো ওকে আগে পাত্তাই দিতো না। এখন কিভাবে আমার ভাই টা পাগল হলো কে জানে!

নিতু আর তুলি নিজেদের মধ্যে মজা করছে আর হাসাহাসি করছে। কিন্তু এদিকে কথার মুখে মুহূর্তেই অন্ধকার নেমে এসেছে। ঘর পর্যাপ্ত পরিমাণে ঠান্ডা কিন্তু কথার কপাল বেয়ে চিকন ঘাম দিচ্ছে। চোখে মুখে দুশ্চিন্তা ফুঁটে উঠেছে।

কথা নিতু আর তুলির মাঝে থেকে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার। কাল থেকেই তার শরীর খারাপ। আর লক্ষণগুলোও অনেকটা ওরকমই।

.
” নিতু আর তুলি প্রেগনেন্সির কথাটা মজা করে বললেও বিষয়টা মোটেও মজার না। আমার পিরিয়ডও এই মাসে মিস গেছে। তবে কি আমি সত্যি মা হতে চলেছি! কিন্তু এটা কি করে সম্ভব! অসম্ভবেরও কিছু দেখছি না। জানি না কি হচ্ছে। একটু পর বিয়ে আর এখন কি না এই সন্দেহ ঢুকে গেলো মনে! যদি সন্দেহ টা সত্যি প্রমাণিত হয়! যদি সত্যি আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে থাকি! আর যদি সবাই জানতে পেরে যায়!”

কথার ভাবনার সুঁতো ছিড়ে নিতুর ডাকে। নিতু ওয়াশরুমের দরজায় টোকা দিচ্ছে আর কথাকে ডাকছে।

— কথা! এতোক্ষণ ধরে কি করছিস ভিতরে? বেরিয়ে আয় বরযাত্রী এসে পরেছে।

— তুলি চল আমরা বাইরে যাই। বরযাত্রী এসে পরেছে। একটু আনন্দ করে আসি।

নিতু আর তুলি কথার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে কথা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। খুব টেনশন হচ্ছে কথার। এতো সাধনার পর এসেছে আজকের দিনটা। এখন যদি সবাই জানতে পারে তার প্রেগন্যান্সির কথাটা! কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।

.
.
.
.

খুব ধুমধামের সাথে নীল আর তার পরিবার বরযাত্রী নিয়ে এসেছে কথার দুয়ারে! কথার লাল বেনারসি শাড়ির সাথে ম্যাচ করে অফ হোয়াইট শেরোয়ানি পরেছে নীল। মারাত্মক হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে তাকে। হয়তো সব মেয়েরা আজ জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। কেননা এই হ্যান্ডসাম ছেলেটা আজ কারো জামাই হতে চলেছে!

কিশোর সাহেব আর কলি বেগম হাসিমুখে নীল আর তার পরিবারকে বরণ করে নিলো। খুব ভালোভাবে চলছে বিয়ের কাজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজী সাহেব এসে হাজির হবেন। কথা তৈরি হয়েছে কি না সেটা দেখার জন্য কলি বেগম কথার কাছে চলে গেলেন।

কথার ঘরের দরজা ঠেলে কলি বেগম ঘরের ভিতর ঢুকতেই তিনি থমকে গেলেন।

বধু বেশে কথা তার বিছানার উপর বসে আছে। কথাকে এই রূপে দেখে কলি বেগমের যতোটা না খুশি হচ্ছে তার থেকেও দ্বিগুণ কষ্ট হচ্ছে ভেবে যে আজ কথা তাদের সবাই কে ছেড়ে চলে যাবে।

মেয়েদের নিয়তিও বড্ড অদ্ভুত। সমাজের ঠুনকো নিয়মের উপর ভিত্তি করে প্রতিটি মেয়েকে তার বাবা-মার বুক খালি করে অন্যের ঘরে যেতে হয়! জন্মের পর থেকে যে মেয়েকে এতোটা আগলে রেখে বড় করে বাবা-মা, কিন্তু মুহূর্তেই সেই কলিজার টুকরো মেয়েকে পর করে দিতে হয়!!

কলি বেগমের চোখ ইতোমধ্যে পানিতে টইটুম্বুর হয়ে গেছে। না চাইতেও আজকে এই খুশির দিনে তার চোখে পানি এসে পরেছে।

কথা দরজার সামনে কলি বেগমকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভিতরে ডাকে,
— আম্মু, ওখানে কি করছো? এখানে এসো।

কলি বেগম মেয়ের দৃষ্টির আড়ালে চোখের পানি মুছে ঘরের ভিতর প্রবেশ করে।
কথা চিন্তা করছে বমি হওয়ার কথাটা কলি বেগমকে জানাবে। কিন্তু পরক্ষণেই সে তার স্বীদ্ধান্ত পাল্টে নিলো। যেহেতু নীল আর তার বিয়ের কথাটা কেউ জানে না তাই এসব বলাও ঠিক হবে না। কথা তার শংঙ্কাটা নিজের মধ্যেই দাফন করে ফেললো।

.
নয়নতারা বেগম আর মুনতাহা বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন বটে কিন্তু তারা যে বিয়েতে খুশি নয় সেটা তাদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। নয়নতারা বেগম যদিও স্বামীকে দেখানোর জন্য মাঝে মধ্যে খুশি হওয়ার নাটক করছে কিন্তু মুনতাহা এখনও বিয়ে ভাঙার সুযোগ খুঁজছে।

.
তানিয়া আর তার স্বামী রাজীবও এসেছে বিয়েতে। রাজীব নীল এর সাথে বসে কিছু কথা বলছে, আর তানিয়া একটু দূরে একা বসে আছে। নিতু আর কাব্য দুজনেই একসাথে মেহমানদের দেখাশোনা করছে। কাব্য দের আত্মীয়রা যারা নিতুকে প্রথম বার দেখছে, সবাই মন খুলে কাব্য আর নিতুর সুখী জীবনের জন্য দোআ করছে।

দূর থেকে তানিয়া এই সবকিছু আঁড়চোখে দেখে যাচ্ছে। নিতু তার বোন, নিতুর সাথে তার কোনো শত্রুতা নেই। তবুও কেনো যেনো কাব্য এর এতো কাছে নিতুকে সে সহ্য করতে পারে না। তাদের দুজন কে একসাথে দেখলে তানিয়ার বুকের পা পাশের চিনচিনে ব্যথা টা বৃদ্ধি পায়। এই ব্যথার অস্তিত্ব প্রকাশ পেয়েছিল সেদিন, যেদিন কাব্য বিয়ে করেছিল। তানিয়া নিজেও অন্য কারো স্ত্রী, তবুও সে কাব্য কে অন্যকারো সাথে সহ্য করতে পারে না। ভীষণ কষ্ট হয় তার। বুকের বা পাশটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায় প্রতিবার কাব্য আর নিতুকে একসাথে দেখে। আচ্ছা কাব্য এর ও কি এতোটাই কষ্ট হয় তানিয়াকে তার স্বামীর সাথে দেখলে!

.
কোনো ঝামেলা ছাড়াই কথা আর নীল এর বিয়ে খুব ভালোভাবে হয়ে যায়। দুই পরিবারের প্রায় সবাই বিয়েতে সম্মত ছিল। কবুল পর্ব শেষে বিদায়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। কথার দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরে যাচ্ছে। আজ সে তার পরিবার, তার অস্তিত্ব, তার বাবা-মা, ভাইয়াকে ছেড়ে একটা নতুন সংসারে নতুন মানুষের ভীরে যাচ্ছে। নতুন জীবন শুরু করার সুখের চেয়ে নিজের পরিবারকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট টা অনেক বেশি বোধ করছে কথা।

অতঃপর বিদায় পর্বও শেষ হলো। বাহারি ফুল দিয়ে সাজানো নীল এর গাড়ি চলতে শুরু করে দিয়েছে। গাড়িতে বসে কথা ঝাপসা চোখে গাড়ির কাচ ভেদ করে তার বাবা-মা কে দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। গাড়ির তীব্র গতির সামনে কথার বাবা-মা, ভাইয়া অনেক পিছিয়ে যায়। ধীরে ধীরে তারা অদৃশ্য হতে থাকে। আঠারো বছরের চেনা বাড়িটা, ছোট বেলায় থেকে খেলে বড় হওয়া গলি টা মুহূর্তেই অপরিচিত হয়ে যায়। ভালোবাসার মানুষটাকে পাওয়ার লোভে কথা তার নিজের মানুষগুলো থেকে কতো দূর হয়ে গেলো!



?

?


হাজারো ফুল দিয়ে অত্যন্ত সুন্দর করে সাজানো একটা ঘরে বসে আছে কথা। নীল এর ঘর এটা, আর এখন কথারও ঘর। ঘরটা এতো সুন্দর করে সাজানো হয়েছে যে দেখেই কথার মন ভরে গেছে। কাঠগোলাপ আর লাল গোলাপ দিয়ে সাজানো হয়েছে ঘরটা,, কারণ আজ যে কথা আর নীল এর বাসর রাত! এই সময়টার জন্য কতো অপেক্ষা করেছে কথা। কতোটা সাধনার ফল আজকের এই বিয়ে, এই সংসার কথার!

মাথার ঘোমটা টা আরেকটু টেনে ঠিক করে একটু নড়ে চড়ে বসলো কথা। বেড সাইড টেবিলে একটা কাচের গ্লাস রাখা, যেটা এক গ্লাস দুধে ভর্তি। পাশেই একটা পানির বোতল আর গ্লাস রাখা। কথা একটু এগিয়ে গিয়ে গ্লাসে খানিকটা পানি ঢেলে ঢকঢক করে গিলে ফেললো। তার শরীর ভালো লাগছে না। ভীষণ অস্থিরতা বোধ হচ্ছে। সেই সাথে বমিও পাচ্ছে। ভারী ভারী শাড়ি গয়নাগুলো আরো অস্বস্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলো তখন কথা উঠে পরলো। স্যুটকেস থেকে একটা লুজ টিশার্ট আর প্লাজো বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে।

.
.
বেশকিছুক্ষণ পর খট করে দরজা খুলে নীল ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলো। ঘরের সব লাইট বন্ধ শুধু একটা মাত্র ডীম লাইট জ্বালানো, যার ফলে খুবই মৃদুভাবে ঘরের সবকিছু দেখা যাচ্ছে। নীল দরজা ভিতর থেকে আটকে সোজাসুজি আলমারির কাছে গিয়ে একটা টিশার্ট আর ট্রাওজার বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো। বেশ অনেকক্ষণ ধরে লম্বা একটা শাওয়ার নিলো সে। সারাদিনের ক্লান্তি একবারেই ধুয়ে ফেলে বেরিয়ে পরলো।

ঘরের ভিতর ঢুকে নীল এর একটা বিষয় খটকা লাগলো যে এখনও ঘরের সব বাতি বন্ধ। কথা এতোক্ষণ শান্তিমতো বসে থাকার মেয়ে নয়। নিজের শংঙ্কা দূর করতে ঘরের লাইট জ্বালালো নীল। লাইট জ্বালাতেই নীল এর চোখ ছানাবরা। কথা পুরো বিছানা জুরে এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে। প্লাজু হাটুর উপর পর্যন্ত উঠে আছে, পরনের টিশার্ট টা লং সাইজ হওয়াতে পেটের বেশ খানিকটা বেরিয়ে আছে। ভেজা চুলের পানিতে একটা বালিশ সম্পূর্ণ ভিজে আছে কিন্তু কথার কোনো নড়নচড়ন নেই। হে দিব্যি মনের সুখে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। কথার অবস্থা দেখে আপন মনেই হেসে ফেললো নীল।

” কথা তুই আসলেই একটা পাগলী! আর এই পাগলীর পাগল আমি। কেনো আমাকে এতো মায়ায় জড়ালি বল তো! এই ছ্যাঁচড়া মেয়েটাকে আমি এতো ভালোবেসে ফেলেছি আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না মাঝে মাঝে।
অনেক কষ্ট দিয়েছি না তোকে! ওয়াদা করছি আমি থাকতে আর কোনো কষ্ট তোকে স্পর্শও করতে পারবে না। ভীষণ ভালোবাসি তোকে।”
নিজের মনেই কথাগুলো আওড়াতে থাকে নীল।

কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে কথার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। কথা ঘুমের ঘোরেই হালকা নড়ে উঠলে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় নীল। ভেজা বালিশ টা সরিয়ে কথাকে বুকে জরিয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পরে নীল।

.
সকালের মিষ্টি রোদ চোখে পরাতে ঘুম ভেঙে যায় নীল এর। কথা এখনও নীল এর বুকের উপর ঘুমিয়ে আছে। সামনের চুলগুলো বরাবরের মতো চোখে এসে পরেছে। নীল মুচকি হেসে চুলগুলো সরিয়ে কথার কপালে একটা চুমু এঁকে দিয়ে আস্তে করে বিছানা ছেড়ে উঠে পরে।

.
.
.
.
.
.
.
.
.
পার্লার থেকে বিউটিশিয়ানরা এসে কথাকে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই বউভাতের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে। পুরো খান বাড়িতে হৈ হুল্লোর লেগে আছে। কাজের চাপে নয়নতারা বেগম আর তাহেরা বেগমের জীবন যায় যায় অবস্থা। যেই কারণেই বিয়েটা হোক, এখন কথা খান বাড়ির বড় বউ এজন্য সবকিছু নিখুঁত হতেই হবে। নজরুল সাহেবের কড়া আদেশ, পান থেকে চুন যেনো না খসে।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে