শ্রাবণের মেঘ পর্ব_২৪

0
1312

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_২৪
#Tabassum_Kotha


Mehndi Hai Rachnewaali,
Haathon Mein Gehri Laali
Kahe Sakhiyaan, Ab Kaliyaan
Haathon Mein Khilnewaali Hain
Tere Mann Ko, Jeevan Ko
Nayi Khushiyaan Milnewaali Hai

কথাদের বাড়ির উঠোনে রাখা সাউন্ড বক্সে গানটা বাজছে। কয়েকটা বাচ্চা গানের তালে তালে নেচে যাচ্ছে।

দুপুর পেরিয়ে বিকেল শুরু হয়েছে। অনেকদিন একটানা বৃষ্টি থাকার পর আজ মেঘ ভাঙা রোদে ঝলমল করছে পুরো পৃথিবী। স্নিগ্ধ রোদের কিরণের সাথে পাল্লা দিয়ে আনন্দ এসে উঁকি দিচ্ছে কথার জানালা দিয়ে। এতোদিনের অপেক্ষার প্রহরের আজ সমাপ্তি ঘটতে চলেছে।

হলুদ শাড়ি আর কাঁচা ফুলের গয়না দিয়ে সাজানো হচ্ছে কথাকে। কোমড় পর্যন্ত ছড়ানো চুল গুলোকে তুলি খোঁপায় বেঁধে দিচ্ছে। নিতু নিজের হাতে কথাকে সাজিয়েছে। শাড়ি আর গয়না পরানো শেষ এখন শুধু হালকা মেকআপ করা বাকি আছে।

আতিকা বেগম কথার ঘরের দরজায় উঁকি দিয়ে দেখে গেলেন কথার সাজ কতোদূর বাকি। হলুদের অনুষ্ঠান দ্রুত শুরু করতে চান তিনি। এমনিতেই বৃষ্টি বাদলার দিন। কখন বৃষ্টি নামে কে জানে! তাই দ্রুত অনুষ্ঠান শেষ করতে পারলেই ভালো। ছেলের হলুদ লাগানো সম্পূর্ণই বাকি এখনও।

আতিকা বেগম কথার ঘর থেকে বেরিয়ে কলি বেগমের কাছে গেলেন।

— কলি! নিতুকে জলদি পাঠাও। নিতু গেলেই তো হলুদ শুরু হবে। বৃষ্টি শুরু হলে ঝামেলা হয়ে যাবে যে।

— সত্যি তো আপা। আমি তো ভেবেই দেখি নি কথাটা। আচ্ছা আমি নিতুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

কলি বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে নিতুকে খান বাড়ির উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিলেন। নিতু ওখানে যাওয়ার পরেই নীল এর হলুদ শুরু হবে। নীলকে হলুদ ছোঁয়ানোর পরেই তো কথার জন্য হলুদ পাঠাবে!

.
.
দেড় মাস আগে যেদিন নীল নজরুল সাহেব কে কথার ব্যাপারে বলেছিল, সেদিন নজরুল সাহেব নিজেই কিশোর রহমান কে রাজি করান নীল আর কথার বিয়ের জন্য। হয়তো সময়টা কিছুদিন আগের হলে কিশোর সাহেব কিছুতেই রাজি হতেন না। কিন্তু কাব্য তো আগেই খান পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করে ফেলেছে। এখন শুধু শুধু নিজেদের সন্তানদের কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না। কিশোর সাহেব আগেই জানতেন কথা আর নীল এর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক আছে।

দুই পরিবারের প্রায় সবাই এই বিয়েতে রাজি হলেও নয়নতারা বেগম এখনও এই বিয়ে মেনে নিতে পারেন নি। যদিও স্বামীর স্বীদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি যেতে পারেন নি বলেই সবার সামনে রাজি হওয়ার অভিনয় করে গেছে। এই বিয়েতে আরও দুইজন মানুষ বেশ নাখুশি। তারা হলো নীরব আর মুনতাহা। নীরব কথাকে পছন্দ করতো যার কারণে সে বিয়েতে তেমন একটা খুশি না। তবুও সে বাস্তবতা টা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

নীল আর কথার বিয়েতে সবচেয়ে বেশি সমস্যা যদি কারো থেকে থাকে তাহলে সে হলো মুনতাহা। তার এতো বছরের সাধনা নীল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই নীল এখন অন্যকারো হয়ে যাচ্ছে। মুনতাহা চাইলেও কিছু করতে পারছে না। শুধু একটু পর পর কথাকে প্রাণ খুলে অভিশাপ দিচ্ছে।

.
.
কাব্য আর নীরব নীল কে তৈরি করছে। যদিও ছেলেদের তৈরি হওয়ার মতো কিছুই থাকে না। তবুও হলুদ বলে কথা। একটু তো তৈরি হতেই হয়।

— শেষ পর্যন্ত তুইও গলায় দড়ি দিতে প্রস্তুত মামা! (কাব্য)

— তোর বোন কেই তো বিয়ে করছি। তুইই ভালো জানিস বিয়ের পর আমার কি হবে!

— জানি বলেই তো আফসোস হচ্ছে। দুনিয়াতে আর মেয়ে পেলি না।

— তোর বোন কি এতো ডেঞ্জারাস নাকি?

— আর নয়তো কি!

কাব্য আর নীল নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টা করছে। নীরব সেখানে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। কেনো যেনো তার কাছে এসব ঠাট্টা মস্করা বিষের মতো লাগছে। হয়তো কথা কে পাওয়ার যেই আকাঙ্ক্ষাটা ছিল সেটা পূর্ণ হয় নি বলেই এমন তিক্ততা ছেয়ে আছে তার মনে!

নিতুর জন্যই নীল এর হলুদ ছোঁয়ার অনুষ্ঠান থেমে ছিল। নিতু খান বাড়িতে পৌঁছালে খুব তোরজোরের সাথে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়।

.
হলুদ শাড়িতে মুড়িয়ে বসিয়ে রেখেছে সবাই কথাকে। কথার আশে পাশে সবাই আনন্দ করছে কিন্তু কথার ভীষণ অস্থিরতা বোধ হচ্ছে। চোখের সামনে কেমন ঘোলা ঘোলা লাগছে সব। এই দেড় মাস ফাইনাল পরীক্ষা ছিল তার। দিন রাত এক করে পড়াশোনা করেছে সে। সারাদিন রাত খাটুনিতে শরীরের উপর অনেক চাপ পরেছে। তাই হয়তো শরীর এতো দুর্বল হয়ে পরেছে। গরমও পরেছে অনেক। হয়তো এজন্যই এতো অস্থির লাগছে!

.
অনেক আনন্দ আর হৈ হুল্লোর এর মধ্য দিয়ে নীল এর হলুদ পর্ব শেষ হয়। নীল এর হলুদ শেষ হলে সবাই কথাকে হলুদ ছোঁয়াতে আসে। সবাই এলেও নীরব আর মুনতাহা আসে নি কিশোর রহমানের বাড়িতে কথাকে হলুদ ছোঁয়াতে।

?

কথার হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে যায়। কাব্য সব কাজ তদারকিতে থাকায় তার কাজ শেষ করে ঘরে ফিরতে প্রায় ১২ টা বেজে যায়। কাব্য ঘরের ভিতর প্রবেশ করে বেশ অবাক হয়। সে ভেবেছিল নিতু এতোক্ষণে ঘুমে বিভোর হয়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও নিতু এখনও ঘরেই ফিরে নি। কাব্য দরজার বাইরে বের হয় নিতু কোথায় দেখার জন্য। সচরাচর নিতু এতো রাত জাগতে পারে না। বাসর রাতেও বারোটা নাগাত ঘুমিয়ে পরেছিল।

কাব্য ঘরের বাইরে বেরিয়ে আশেপাশে তাকাতেই নিতুকে কিচেনে দেখতে পায়। নিতু এখনও কাজ করছে দেখতেই কাব্য এর মনে অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করে নিতুর প্রতি। পিচ্চি মেয়েটা হঠাত করেই বড় হয়ে গেছে, নিজের সব দায়িত্ব বুঝতে ও পালন করতে শিখে গেছে। কাব্য হালকা মুচকি হেসে ঘরে চলে যায়।

কিছুক্ষণ পর কাব্য ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখে নিতু দুইটা কফি মগ হাতে দাড়িয়ে আছে। কাব্য আরও বেশি অবাক হয় কারণ এতোটুকু সময়ের মধ্যেই নিতু কাপড়ও পাল্টে নিয়েছে। বিকেলে পরা হলুদ শাড়িটা পাল্টে সে এখন একটু বেগুনী রঙের শাড়ি পরে আছে। নিতুর ফর্সা শরীরে রং টা বেশ সুন্দর মানিয়েছে। সেই সাথে খোলা চুলে একটু অন্যরকম সুন্দর লাগছে নিতুকে আজ। কাব্য মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে নিতুর দিকে। বিয়ের প্রায় দুই মাস পর নিজের বউ এর প্রেমে পরতে ইচ্ছে করছে তার!

.
কাব্য ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে নিতুর দিকে। এভাবে তাকিয়ে থাকায় কাব্য এর কোনো সমস্যা না হলেও, তার স্থির দৃষ্টি নিতুকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলছে। অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে নিতু গলা ঝাড়া দেয়।

হঠাত নিতুর গলা ঝাঁড়া দেওয়ার শব্দে ধ্যান ভাঙে কাব্য এর। এভাবে নিতুর দিকে সে তাকিয়েছিল টের পেতেই লজ্জায় পরে যায় কাব্য। কাব্য তার দৃষ্টি বাইরের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হাতে রাখা কফি মগ টা কাব্য এর দিকে এগিয়ে দেয় নিতু।

— নিন।

— এতো রাতে এতো কষ্ট করার কি দরকার ছিল!

— জানি আপনার আজ রাতে আর ঘুম হবে না। তাই আর কি!

— কিভাবে বুঝলি?

— হুহ জানি আমি। কথার কালকে বিয়ে হয়ে যাবে। দশটা পাঁচ টা না, একটা মাত্র বোন আপনার। কাল শ্বশুড় বাড়ি চলে যাবে। কষ্ট হওয়া স্বাভাবিক নয় কি!

কাব্য কিছু না বলে কফির মগে ঠোঁট ছুয়ালো। নিতু নিশ্বব্দে কাব্য এর দিকে তাকিয়ে আছে। এই দেড় মাসে কাব্য আর নিতুর মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক না হলেও ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। কাব্য নিতুকে বুঝতে শুরু করেছে। নিতু মনে প্রাণে বিশ্বাস করে কাব্য খুব দ্রুত তাকে ভালোবেসে কাছে টেনে নেবে।

কাব্য কফি শেষ করে মগ হাতে নিয়ে নিতুর দিকে ঘুরতেই ঘরের ভিতরে রাখা তার মোবাইল টা বেজে উঠলো। ফোন রিসিভ করার জন্য কাব্য ঘরের ভিতর চলে যেতেই জোরে বজ্রপাত হয়ে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। কাব্য ঘরের ভিতর দাড়িয়েই ফোনে কথা বলছে। ডেকোরেশনের লোকদের ফোন এসেছে, কিছু জরুরি প্রয়োজনে। নিতু এখনও ব্যালকোনিতেই দাড়িয়ে আছে আর বৃষ্টির পানিতে শরীর ভিজাচ্ছে। ব্যালকোনির ছাওনির বাইরে দাড়িয়ে থাকায় নিতু সম্পূর্ণ ভিজে গেছে।

নিতু দুচোখ বন্ধ অবস্থায় দুই বাহু প্রসারিত করে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো উপভোগ করছিল। আচমকা পিছন থেকে কেউ জরিয়ে ধরলে চমকে উঠে সে। চট করে চোখ খুলে পিছন দিকে ঘুরতেই চোখ কপালে উঠে যায় নিতুর। কাব্য তাকে জরিয়ে ধরে আছে। বিয়ের পর এই প্রথম বার কাব্য নিজেকে থেকে নিতুর এতো কাছে এসেছে। নিতুর চোখ বড় বড় করে কাব্য এর দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না কাব্য নিতুর কোমড় জরিয়ে ধরে দাড়িয়ে আছে।

— আপনি এএভাবে আমাকে,,, (অনেকটা কাঁপতে কাঁপতে কথাটা বললো নিতু)

— হুশ!!! এতো কথা বলো কেনো তুমি!

কাব্য এর মুখ থেকে “তুমি” কথাটা শুনে আরেক দফা বিস্মিত হলো নিতু। নিতু পুনরায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই কাব্য নিতুর ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁট দিয়ে দখল করে নিলো। এবার নিতুর চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে পরার উপক্রম। কাব্য যে এমন কিছু করবে এটা নিতুর কল্পনার বাইরে ছিল। নিতু নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। নিতুর ধস্তাধস্তিতে বিরক্ত হয়ে কাব্য আরও শক্ত করে নিতুকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।

বেশকিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর কাব্য নিতুকে ছেড়ে দেয়। নিতু হতভম্ব হয়ে কাব্য এর দিকে তাকিয়ে আছে। কিভাবে কি হয়ে গেলো সব তার মাথার উপর দিয়ে গেলো!

নিতু কিছু বলতে যাবে তার আগেই কাব্য নিতুকে কোলে তুলে নিলো।

— কি করছেন? নিচে নামান আমাকে। আমার ভীষণ ভয় করছে!

— কিহ! কোলে তুললে ভয় করে?

— হ্যাঁ ভীষণ ভয় করে। নামান প্লিজ।

— চুপ। মুড টা নষ্ট করিস না। আজ তোর সব ভয় ভাঙিয়ে দেবো।

— না প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আম্মুর কাছে যাবো! (একহাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে কান্না করছে নিতু)

নিতুর কান্না দেখে বিস্ময়ে কাব্য এর চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম।

— কি বলছিস তুই!

— আমাকে ছেড়ে দিন।

— চুপ! একদম চুপ।

কাব্য এর ধমকে খানিকটা কেঁপে উঠে কান্না বন্ধ করে দিলো নিতু। কাব্য নিতু কোলে নিয়ে ঘরের দিকে হাটা ধরলো!



?

?


রাতের আঁধার তার দায়িত্ব শেষ করে চলে গেছে অনেকক্ষণ আগে। নতুন সকাল নতুন সব আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এক নতুন সূর্যের উদয় ঘটিয়েছে। সেই সাথে ব্যস্ততায় ভরিয়ে তুলেছে কিশোর রহমানের বাড়িকে। আজ তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। নিজের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ করতে চায় সে।

দুপুরের পর দিয়ে বরযাত্রী চলে আসবে। হাজার টা কাজ পরে আছে। এদিকে কথাকে বউ রূপে সাজাতে হবে। প্রথমে নিতুকে সাজানোর দায়িত্ব দিলেও পরে নীল এর কথামতো বিউটিশিয়ান দিয়েই সাজানোর জন্য রাজী হয় কথা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বিউটিশিয়ানরা এসে পরবে কিন্তু কথা বিছানা ছেড়েই উঠতে পারছে না। ভীষণ শরীর খারাপ তার। সকাল থেকেই মাথা ঘুরাচ্ছে, সেই সাথে বমি। বমি করতে করতে অবস্থা এমন যে সে এখন বিছানার সাথে লেপ্টে আছে। শরীরে একবিন্দু শক্তি নেই নড়ার তার!

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে