#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_১৯
#Tabassum_Kotha
আচমকা কেউ একজন নীল এর হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে নীল কে একটা ঘরের ভিতর টেনে নিয়ে গেলো। এই আকস্মিক আক্রমণে নীল খানিকটা ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে সামনে থাকা ব্যক্তিটির দিকে তাকায়।
নীল এর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে বিশ্বজয় করা হাসি দিচ্ছে কথা। নীল ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ কথার দিকে তাকিয়ে থেকে ঘরের বাইরে যেতে নিলে কথা আবার নীল এর হাত টেনে ধরে।
ঘরের দরজা ভিতর থেকে আটকে দিয়ে নীল এর বুকে নিজেকে চেপে ধরে ফিসফিস করে কথা বললো,
— চলে যাচ্ছেন কেনো? এতোদিনে একটা খবর নেন নি, উল্টো আমি ফোন করেছি সেটাও ধরেন নি।
— ব্যস্ত ছিলাম। তুই তো জানিস নিতুর বিয়ের জন্য ব্যস্ততা ছিল।
কথাটা বলতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নীল।
নীল এর অবস্থা বুঝতে পেরে নীলকে ছেড়ে দিয়ে কথা বললো,
— আমি আপনাকে অনেক ফোন করেছিলাম। নিতু আর কাব্য ভাইয়ার কথা বলার ছিল আপনাকে। নিতু কাব্য ভাইয়াকে ভালোবাসে। এই কথাটা জানানোর জন্য আপনাকে অনেকবার ফোন করেছি কিন্তু আপনি ফোন ধরেন নি।
কথার কথায় বেশ অবাক হয়ে নীল জিজ্ঞেস করলো,
— এক মিনিট! তুই জানতি কাব্য আর নিতুর কথা?
— হ্যাঁ জানতাম। আর আপনাকে বলতেও চেয়েছিলাম কিন্তু পারি নি। তারপর আমি নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে ভাইয়া আর নিতুর বিয়ে করিয়েছি।
— কিহ? তুই করিয়েছিস ওদের বিয়ে?
— হ্যাঁ! কেনো?
— কথা তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? এটা কি করেছিস? নিতুর বিয়ে কাব্য এর সাথে করিয়েছিস! তাও এভাবে। কথা সব কিছুতে তোর বাচ্চামো স্বভাব টা আনার কি দরকার বলতো? এতোটা বড় হয়েছিস কিন্তু ম্যাচিউরিটি আসে না কেনো তোর? এই বাচ্চামো স্বভাবের জন্য আর কতো ঝামেলায় পরতে হবে বলতো!
— এভাবে বলছেন কেনো? আমি যা করেছি নিতু আর ভাইয়ার ভালোর জন্যই করেছি। সবদিক বিবেচনা করেই আমি এভাবে বিয়ের প্ল্যান করেছিলাম।
— সবদিক? তা কোন দিক বিবেচনা করেছিস তুই আমাকে একটু শোনা তো! আমার বেষ্টফ্রেন্ডের সাথে আমার বোনের বিয়ে করিয়েছিস কোন দিক বিবেচনা করে? তাও আবার এভাবে পালিয়ে?
— কি বলতে চাইছেন আপনি? আপনি নিজেও তো আপনার বেষ্ট ফ্রেন্ডের বোনকেই বিয়ে করেছেন। আর পালিয়ে বিয়ে করার কথা বলছেন! আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন আমাদের বিয়ে টা কোন পরিস্থিতিতে হয়েছে! এটা কেমন কথা নীল নিজের বোঝ ষোলো আনা অন্যের এক আনাও না। যেই কাজ গুলো আপনি নিজে করেছেন সেগুলো আমার ভাইয়া করলে দোষের কি আছে?
— ওকে ফাইন। সব মানছি। কিন্তু এভাবে দুই পরিবার কে জানিয়ে ঝামেলা বাড়ানোর কি দরকার ছিল?
— দুই পরিবারকে জানানো তে ঝামেলা বাড়ে নি। বরং কমেছে। আদনান ভাইয়া আর নিতুর বিয়ে ভেঙেছে। কাব্য ভাইয়া জীবনে সুখী হওয়ার নতুন কারণ পেয়েছে। আর আমার বিশ্বাস দুই পরিবারের সবাই এই বিয়েটা মেনে নেবে।
— ইয়াহ রাইট!
— হ্যাঁ। আমার তো মনে হয় এটাই সুযোগ, সবাইকে আমাদের বিয়ের কথাটাও বলে দেওয়া উচিত। একই সাথে আমার আর নিতুর দুজনেরই শশুর বাড়ি যাওয়া হয়ে যাবে। কি বলেন?
— মাথা খারাপ তোর? এমনিতেই যেই আগুন লাগিয়েছিস এখন আবার সেই আগুনে ঘি ঢালতে চাস! আমাদের বাবা-মা যদি এখন আবার আমাদের বিয়ের কথা জানতে পারে তাহলে বুঝতে পারছিস কি হবে?
— কি হবে??
— ছাগলি। আস্ত একটা ছাগলি তুই?
— সব ভালো আর বুদ্ধিমান তো আপনি একাই তাই না?
— এখন যদি সবাইকে বলি যে আমরাও বিয়ে করেছি হয় তোর বাবা হার্ট ফেল করবেন না হয় আমার মা!
— কিন্তু কতোদিন এভাবে লুকিয়ে রাখবেন বিয়ের কথা? আমি আপনার স্ত্রী হয়েও আপনার প্রতি কোনো অধিকার দেখাতে পারি না। অধিকার নিয়ে বড় মুখ করে বলতে পারি না আমি আপনার বউ!
— আর একটু ধৈর্য ধর। আমি কিছু একটা চিন্তা করি, তারপর সুযোগ বুঝে বাবা কে সব বলে দেবো।
— আপনি আসলেই একটা মেরুদন্ডহীন। আপনাকে ভালোবাসা টাই আমার অন্যায় হয়েছে। বিয়ে করেছেন কিন্তু বাড়িতে সেই কথা বলার সাহসটুকু নেই আপনার। আপনার চেয়ে হাজার গুণ ভালো আমার ভাইয়া। আমি একপ্রকার জোর করে তার বিয়ে করিয়েছি তবুও সে সেই বিয়েটা সবার সামনে এক্সেপ্ট করেছে। আপনার মতো মুখ লুকিয়ে পালিয়ে যায় নি।
কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে দম ছাড়লো কথা। বড়বড় কতোগুলো নিশ্বাস নিয়ে নিলো। অনেকটা হাপিয়ে গেছে সে। কিন্তু নীল কে এই কথা গুলো না বললেই না। বিয়ে করতে পেরেছে কিন্তু বলতে পারছে না কাউকে!
নীল কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে একটা দম টেনে কথাকে জরিয়ে ধরলো।
এভাবে কোনো কথা বার্তা ছাড়াই হুট করে কথাকে জরিয়ে ধরায় কথা পুরোই থ মেরে গেছে। আবার রাগও হচ্ছে, বিয়ের কথা কাউকে বলছে না কিন্তু চিপকাচিপকি ঠিকই করছে।
নীল কথা গলায় আস্তে আস্তে মুখ গুঁজে দিচ্ছে। যার কারণে কথার ভীষণ সুরসুরি লাগছে। লজ্জাও করছে অনেক। লজ্জায় কথা তার চোখ দুটো বন্ধ করে নিয়েছে। নীল কথার গলায় আলতো করে কয়েকটা চুমু খেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
এবারও কথা বেকুব বনে দাড়িয়ে আছে, সে কি ভেবেছিল আর কি হয়ে গেলো!
?
?
?
রাতে কাব্য এর ঘরে কলি বেগমের দেওয়া লাল একটা শাড়ি পরে মাথায় ঘুমটা টেনে দাড়িয়ে আছে নিতু। দাড়িয়ে আছে বললে ভুল হবে পায়চারি করছে সারা ঘরে।
.
কিশোর সাহেব আর নজরুল সাহেব কথা বার্তা বলে নিজেদের মধ্যে নিতু আর কাব্য এর বিয়ের ব্যাপার টা মেনে নিয়েছেন। যদিও খুশি কেউই হতে পারে নি, তবুও এখন বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর কোনো ঝামেলা করা মানে লোক হাসানো। যেটা নজরুল সাহেব একদমই চান না। সামনেই চেয়ারম্যান পদের নির্বাচন। আর এই পারিবারিক ঝামেলার জন্য সে তার অতি কাঙ্ক্ষিত চেয়ারম্যান পদটা হারাতে দেবেন না কিছুতেই।
.
ঘোমটা খানিকটা খুলে যাওয়াতে নিতু সেটা টেনে মাথায় উঠাচ্ছিল তখন খট করে দরজা খুলার শব্দ হলো। দরজার ঠিক উল্টো দিকে ঘুরে দাড়ানো ছিল নিতু। সেখানে দাড়িয়েই একপ্রকার কাঁপা শুরু করে দিলো সে।
বিয়ের প্রথম রাত বলে কথা! এই রাত টা নিয়ে সবারই কম বেশি ভয় ভীতি থাকে। নিতুর তো হয়তো একটু বেশিই ভয় করছে, কারণ যেই পরিস্থিতিতে বিয়ে হয়েছে। না জানি কাব্য কিভাবে রিয়েক্ট করে!
.
পিছনে কারো উপস্থিত টের পাচ্ছে নিতু। দরজা খুলে লোকটা ঘরে ঢুকেছে। এই সময় ঘরে কাব্য ছাড়া অন্য কেউ আসবে না, মানে লোকটা কাব্য। কাব্য ঘরে এসেছে ভাবতেই যেনো নিতুর কাঁপাকাপি কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
নিতু তার ঘুমটা আরও খানিকটা নিচে টেনে ঠিক করতে গেলে ঘারে কারো গরম নিশ্বাস পরে তার। নিতু ভয়ে আর সংকোচে চোখ বন্ধ করে আছে। ঠিক তখনই পিছনে দাড়িয়ে থাকা লোকটা নিতুর কোমড় জরিয়ে ধরলো। নিতু যেনো লোকটার এই কাজে পুরোই ফ্রিজ হয়ে গেছে। লোকটার হাত ধীরে ধীরে শাড়ির ভিতর দিয়ে নিতুর পেট স্পর্শ করে। পেটে হাত দিতেই লোকটা জোরে একটা চিমটি কেটে দেয় নিতুর।
লোকটার এহেম কান্ডে নিতুর চোখ কপালে উঠে গেছে। নিতু ঘোমটা খুলে চোখ বড়বড় করে পিছন দিকে ঘুরতেই আরেক দফা থ মেরে যায়।
.
নিতুর সামনে দাঁতের পাটি বের করে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে কথা। আর নিতু বেকুবের মতো দাড়িয়ে আছে।
নিতু আর কাব্য এর বাসরঘর সাজানো হয় নি, তাই কথা কিছু ফুল নিয়ে এসেছিল ঘরটা কোনোরকম সাজাতে। ঘরের ভিতরে এসে নিতুকে ওভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে একটু মজা করার জন্যই কাব্য এর অভিনয় করেছে।
নিতু বাজখাই গলায় চেচিয়ে কথার উদ্দেশ্যে বললো,
— চুপ পেত্নি হাসবি না একদম বলে দিলাম। এমন করলি কেনো? আমি কি না কি ভেবেছিলাম!
কথা দুষ্টুমি ভঙ্গীতে চোখ মেরে বললো,
— কি ভেবেছিলে ভাবি? যে ভাইয়া বুঝি একটু দুষ্টু দুষ্টু কাজ করছে তাই না?
— ইশ পেকে গেছিস অনেক মনে হচ্ছে! তুই পুচকি এখনও বুঝলি। আমি তোর ভাবি হই।
— এহহ আমিই বানিয়েছি তোকে আমার ভাবি। নয়তো পুরো এলাকার মেয়েদের ক্রাশ ছিল আমার ভাই।
— সে থাকতেই পারে। কিন্তু জামাই তো আমার হয়েছে।
— থ্যাংক্ মি লেটার বেবস্।?
— যা দূর হ। এখনও পর্যন্ত নিজের বিয়ে টার কিছু করতে পারলি না কিন্তু আমাদের বিয়ে ঠিকই করিয়ে দিলি।
নিতুর কথা শুনে কথা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সে আর নীল বিয়ে করেছে, তারাও পালিয়ে বিয়ে করেছে। কিন্তু তার স্বামী সেটা কাউকে বলার সাহস রাখে না। কথাটা চিন্তা করতেই কথার বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
কথা টপিক চেঞ্জ করে, হাতে করে নিয়ে আসা ফুলগুলো দিয়ে কাব্য আর তানিয়ার ঘরটা কোনোমতে সাজিয়ে দিয়ে গেলো।
কথা বেরিয়ে যেতেই নিতু আবারও ঘুমটা টেনে বিছানার মাঝ বরাবর বসে পরলো।
.
.
.
.
কথা নিজের ঘরে এসে আলমারি খুলে লাল একটা শাড়ি বের করে। গতবছর ঘুরতে গিয়ে লুকিয়ে শাড়িটা কিনেছিল সে। শাড়িটা হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে শাওয়ার শেষ করে শাড়িটা পরে বের হয় কথা। যদিও আজকে তার শাড়ি পরার কোনো কারণ নেই। তবুও কেনো যেনো সে শাড়িটা পরেছে।
মানুষের মনে হুট হাট অনেক ইচ্ছা জাগে। যেসব ইচ্ছা সম্পূর্ণই ভিত্তিহীন। তবুও সেই ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে পারলে মনে এক ধরণের ভালো লাগা কাজ করে।
আয়নার সামনে দাড়িয়ে শাড়ির আঁচল পেচিয়ে বুকের কাছে নিয়ে কথা তার ভেজা চুল গুলো পিঠে এলিয়ে দিলো। আজ কোনো কারণ ছাড়াই তার সাজতে ইচ্ছে করছে। ড্রেসিং টেবিলে রাখা কাজল টা হাতে নিয়ে চোখে দিতে শুরু করলো সে। হঠাত পিছনে একটা ছায়ামূর্তি দেখে ভয়ে কেঁপে উঠলো কথা। এতো রাতে এভাবে কে দাড়িয়ে আছে!
.
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই বেশ অবাক হয় কাব্য। বিছানার মাঝ বরাবর নিতু বড় একটা ঘোমটা টেনে বসে আছে আর ঘরটাও ফুল দিয়ে সাজানো। যদিও সাজানো টা অনেক জাকজমপূর্ণ নয়। কিন্তু সুন্দর লাগছে দেখতে।
কাব্য দরজা আটকে দিয়ে আলমারি খুলে কাপড় বের করে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো।
ওয়াশরুমের দরজা লাগানোর শব্দে নিতু ঘোমটা উঠিয়ে দেখলো সবটা। কিছুক্ষণ সে চিন্তা করলো কাব্য এখন কি করবে? হয়তো ঝগড়া করবে, নয়তো নাটকের নায়কদের মতো বালিশ নিয়ে সোফায় শুয়ে পরবে! কাব্য কোনটা করবে?
নিতুর ভাবনার সুতোয় টান পরে ওয়াশরুমের দরজা খুলার শব্দে। নিতু পুনরায় ঘোমটা টেনে বসে পরে। কাব্য একনজর নিতু কে দেখে টেবিলের ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করে হাতে নিয়ে ব্যালকোনিতে চলে যায়।
চলবে..