#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_১৭
#Tabassum_Kotha
পানির বোতল হাতে ঘরে ঢুকতেই একটা ছায়ামূর্তিকে ব্যালকোনির সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ঘাবড়ে যায় কাব্য।
— কে ওখানে!
— আমি কাব্য ভাইয়া!
— কে?
— নিতু!
— তুই এতো রাতে এখানে কি করছিস?
— তোমার সাথে অনেক জরুরি কথা ছিল। তাই এতো রাতে এসেছি।
— নিতু তুই কি পাগল হয়েছিস! যতো জরুরি কথাই থাকুক না কেনো এতো রাতে তোর এখানে আসা ঠিক হয় নি! তুই চলে যা।
— যাবো না। অনেক বড় ভুল করেছি আমি। আগেই তোমাকে বলে দেওয়া উচিত ছিল। আগে যদি বলে দিতাম তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না।
— কি কথা বলতে চাস তুই যার জন্য এই রাতের অন্ধাকরে লুকিয়ে এসেছিস?
— আমি,, আমি,,
— ভনিতা না করে জলদি বলে চলে যা!
— আমাকে তাড়াতে পারলে বুঝি অনেক খুশি হবে! কিন্তু আমি যাবো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
— কিহ!!
— হ্যাঁ। আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তোমাকেই বিয়ে করবো। আদনান কে আমি বিয়ে করতে পারবো না। আমাকে ফিরিয়ে দিও না। (কাব্য এর হাত দুটো চেপে ধরে নিতু কথাগুলো বললো)
— তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস নিতু! কি সব আবোল তাবোল বকছিস! (কাব্য নিজের হাত দুটো এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলো)
— হ্যাঁ আমি পাগল হয়ে গেছি। যা ইচ্ছে তাই বলো। কিন্তু তবুও বলবো আমি ভালোবাসি তোমাকে!
— নিতু তুই যা তো এখান থেকে!!
— যাবো না,, ততোক্ষণ পর্যন্ত যাবো না যতোক্ষণ না তুমি আমাকে আপন করে নিচ্ছো! (কাব্য কে পুনরায় জরিয়ে ধরে)
এবার আর কাব্য সহ্য করতে পারলো না। ঠাস্ করে একটা চড় মেরে বসলো নিতুর গালে। আচমকা চড় পরায় নিজেকে সামলাতে না পেরে মেঝেতে ছিটকে পরে নিতু। থাপ্পড় মারার পর হঠাত করেই চরম অনুশোচনায় পরে যায় কাব্য। এভাবে নিতুকে চড় মারা তার ঠিক হয় নি। ভালোবাসা তো অন্যায় না, হয়তো নিতুর ভালোবাসার মানুষটা আর সময় টা ভুল।
মেঝে থেকে নিজেকে সামলে উঠে দাড়ালো নিতু। কাব্য এর চড়ের ফলে ফর্সা গালটা লাল হয়ে আছে। হাতের আঙুলের ছাঁপ ফুটে উঠেছে গালে। মনে হচ্ছে রক্ত জমাট বেঁধেছে সেখানে। নিতুর দুচোখ পানিতে টলমল করছে। কেনো যেনো কাব্য নিতুর মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার, সেই সাথে অপরাধবোধও কাজ করছে!
— মারো, আরও মারো। পারলে মেরে ফেলো! যেখানে আমার নিজের মা আমার কষ্ট টা বুঝে নি, সেখানে তোমার কাছে আশা করাটাই আমার অন্যায় ছিল। একটা কথার উত্তর দেবে? ভালোবাসা কি অন্যায় কাব্য ভাই?
নিতুর প্রশ্নের কাব্য এর কাছে কোনো উত্তর নেই। ভালোবাসা অন্যায় না, সে নিজেও তো ভালোবাসে। এমন একজন কে সে ভালোবাসে যে কি না অন্যকারো। তবুও তো সে ভালোবেসেই যাচ্ছে। তাহলে নিতুর ভালোবাসা,,,,
— এই ধরনের প্রশ্নের তো কোনো মানেই হয় না নিতু। আজ বাদে কাল তোর বিয়ে, এই তুচ্ছ আবেগকে ভুলে মন ভালো কর। আদনানের সাথে অনেক সুখে থাকবি তুই!
— আমার সুখের চিন্তা তুমি না করলেই খুশি হবো! লাগবে না তোমার ভালোবাসা,, কিন্তু আমার ভালোবাসাকে তুচ্ছ আবেগের নাম দিয়ে অপমান করতে পারো না। যতোটা ভালোবাসলে একটা মেয়ে বিয়ের আগে চরিত্রহীন উপাধি নিতে প্রস্তুত থাকে তার চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসি আমি তোমাকে।
হঠাত কিছু পরে যাওয়ার শব্দে নিতু আর কাব্য দুজনেই চমকে পিছনে তাকায়। অন্ধকার ঘরে কেউ একজন দাড়িয়ে এতোক্ষণ নিতু আর কাব্য এর কথা শুনছিল টের পেতেই কপাল বেয়ে চিকন ঘাম দেয় কাব্য এর। সে বুঝতেই পারছে কতোবড় ঝামেলার সৃষ্টি হতে চলছে!
অন্ধকার ভেদ করে সামনে এগিয়ে আসতেই মানুষটার মুখে চাঁদের আলো পরে। এতোক্ষণ কথা দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাব্য আর নিতুর আলাপ সবটা শুনছিল। কথা বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে নিতুর দিকে, হয়তো সে আশা করে নি তার ছোটবেলার এতো ঘনিষ্ট বান্ধবী এতো বড় একটা কথা তার কাছে থেকে লুকাবে। কথার দৃষ্টির মানে নিতু বেশ ভালোই বুঝতে পারছে, তার উচিত এখন কথাকে সব বুঝিয়ে বলা। কিন্তু তার মুখ দিয়ে কথা সরছে না। কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আছে। নিতু ভালো-মন্দ কিছু না বলে চোখের পানি হাত দিয়ে মুছে যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই চলে গেলো।
পরিস্থিতি এতোটাই জটিল রূপ ধারণ করেছে যে কাব্য আর কথা দুজনেই মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে আছে। হয়তো আজ রাতে এই ব্যাপারে তাদের মধ্যে আর কোনো কথা হবে না!
?
?
খান বাড়িতে খুব জোরে সোরে শুরু হয়ে গেছে বিয়ের কাজকর্ম। সবাই ব্যস্ততায় দিন পাড় করছে। দুই ছেলের উপর বিয়ের সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে আছেন নজরুল সাহেব।
নিশ্বাস নেওয়ার মতো সময়টুকুও পাচ্ছে না নীল। সকাল থেকে এই কাজে ঐ কাজে ছুটে চলছে। কিন্তু সকাল থেকেই যে তার ফোন টা অনবরত বেজে চলছে সেদিকে তার কোনো হুশ নেই। অস্থির হয়ে ফোন করে চলছে কথা নীল কে। কম করে হলেও বিশটা কল করেছে কিন্তু একবারের জন্যও ফোন ধরে নি নীল। কাল রাতে নিতুর বলা সব কথাই নীল কে বলার জন্য এতোবার করে ফোন করছে। কিন্তু নীল কাজের ব্যস্ততায় মোবাইল ঘরে রেখে দিয়ে ভুলে গেছে।
.
.
.
.
বাইশ বারের মাথায় কল টা কেটে দিয়ে মোবাইলটা বিছানায় ছুড়ে মারলো কথা। বিরক্ত হয়ে গেছে সে নীল কে ফোন করতে করতে। অস্থির চিত্যে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেও কিছু একটা ভেবে বিছানা ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে ছুট লাগালো কাব্য এর ঘরের দিকে। কাব্য তার ঘরেই কিছু একটা করছিল, কথা ঘরের ভিতর ঢুকে দরজা ভিতর থেকে লাগিয়ে দিলো। কাব্য কথাকে দেখেও তেমন কোনো রিয়েক্ট না করে পুনরায় তার কাজে মন দিলো।
— তুই এতো রিলাক্স ভাবে কিভাবে বসে আছিস?
কথার প্রশ্নে কাব্য খানিকটা বিচলিত হলেও কথাকে বুঝতে না দিয়ে স্থির কন্ঠে জবাব দিলো,
— আমার কি এখন খুব বেশি বিচলিত হওয়ার কথা ছিল?
— তোর এমন গা ছাড়া ভাব দেখে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে ভাইয়া!
— যা বলার বলে চলে যা।
— নিতু কে তুই বিয়ে কর।
— হয়ে গেছে বলা? চলে যেতে পারিস!
— ভাইয়া তুই বুঝতে পারছিস না। আমার মনে হয় তোর নিতুকে বিয়ে করে নেওয়া উচিত। এভাবে আর কতোদিন দেবদাসের মতো জীবন কাটাবি?
— কথা তুই এখনও অনেক ছোট। তাই এসব কথা তোর মুখে মানায় না।
— আমি ছোট হতে পারি কিন্তু অবুঝ নই। ভালো মন্দ বোঝার বয়স আমার হয়েছে।
— আমি তোর কোনো কথার উত্তর দিতে চাই না। তুই যা এখান থেকে।
— কেনো উত্তর দিতে চাস না? নিতু কে ভালোবাসতে পারবি না কেনো? তানিয়া আপুর জন্য? তুই যে এখনও তানিয়া আপুর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছিস সেটা আমার অজানা নয়।
— কথা আমি একবার বলেছি এই বিষয়ে কোনো কথা আমি বলতে চাই না। তারপরেও কেনো তুই!
— কেনো জীবনে আগাতে পারছিস না ভাইয়া? নিতুকে তো আমরা ছোটবেলা থেকে চিনি। নিতু যে একটা ভালো মেয়ে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে কেনো নিতুকে ভালোবাসতে পারবি না তুই?
— নিতুকে ভালোবাসার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। নিতু নীল এর বোন। আমার বেষ্টফ্রেন্ডের বোন। ওকে ভালোবাসা বা বিয়ে করার কথা আমি ভাবতেই পারি না।
— তাহলে তানিয়া আপুকে কেনো ভালোবেসেছিলি? সেও তো নীল স্যারেরই বোন। তখন তোর মনে হয় নি তুই অন্যায় করছিস।
— ভালোবাসার উপর কারো জোর চলে না কথা। ভালোবাসা অন্যায় নয়।
— ঠিক তাই। নিতুর ভালোবাসাও কোনো অন্যায় নয়। আর আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি তুই আর নিতু অনেক সুখী হবি একসাথে।
— এই বিষয়ে আমি ভাবতেও চাই না।
— কেনো ভাইয়া? তুই ভাবতেও পারবি না একটা মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার বিয়ে হওয়াটা কতোটা কষ্টের। আজ যদি নিতু আর আদনান ভাইয়ার বিয়ে হয়ে যায় নিতু কখনই সুখী হবে না। কারণ নিতুর মন জুরে তুই আছিস। একমাত্র তোর সাথেই নিতু সুখী হবে। আর তানিয়া আপুর শোক পালন করা বন্ধ কর। সে তো তার স্বামী নিয়ে দিব্যি সুখে সংসার করছে। তাহলে তুই কেনো দেবদাস হয়ে নিজের মন কে পুড়াচ্ছিস?
— কথা প্লিজ চুপ কর। আমার একদম ভালো লাগছে না।
— আজ রাত টুকু সময় দিলাম তোকে, তুই নিতুর কথা ভালো মতো ভেবে দেখ। আমি আবারও বলছি, নিতু তোকে ছাড়া অন্য কারো সাথে সুখী হতে পারবে না। আর বিশ্বাস কর, নিতু নিজের ভালোবাসা দিয়ে তোর জীবন সুখে ভরিয়ে তুলবে। এটা আমার বিশ্বাস।
কথা কাব্য এর দিকে তাকিয়ে আছে কোনো একটা উত্তরের আশায়। কিন্তু কাব্য মুখে তালা লাগিয়ে ব্যালকোনির কাচে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকেও কোনো লাভ না হলে চরম বিরক্তি নিয়ে কথা বেরিয়ে যায় কাব্য এর ঘর থেকে। নিজের ঘরে এসে ঠাস্ করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে ব্যালকোনিতে গিয়ে দাড়ায় কথা। কাব্য এর উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে কথার। এখনও তানিয়ার ভালোবাসা নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে কাব্য এটা ভাবতেই কথার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। তানিয়া চাইলেই সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে কাব্য এর হাত ধরতে পারতো। কিন্তু তানিয়া সমাজ টাকেই প্রাধান্য দিয়েছে, এখন স্বামী সংসার নিয়ে বেশ ভালোই দিন কাটাচ্ছে। তাহলে কাব্য কেনো পারছে না তানিয়া কে ভুলে এগিয়ে যেতে? নীল কে সব কিছু জানাতে হবে।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে পুনরায় নীল কে ফোন করা শুরু করলো কথা। সৌভাগ্যক্রমে এবার ফোনটা রিসিভও হয়ে গেলো ওপাশ থেকে। কিন্তু কথা হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে একটা মেয়ে কন্ঠ কথা বলে উঠলো। ফোন রিসিভ হওয়াতে কথার মুখে যেই হাসি টা ফুটে উঠেছিল মুহূর্তেই সেটা গায়েব হয়ে গেলো।
— হ্যালো কে বলছেন? (ওপাশ থেকে)
— নীল স্যার কোথায়? আর আপনি কে?
— জি আমি মুনতাহা, নীল এর! সে যাই হোক আপনি কে?
— আমি কথা! নীল স্যারের ফোন আপনার কাছে কেনো? নীল স্যার কে ফোনটা দিন।
— নীল এখন কথা বলতে পারবে না। নীল শাওয়ার নিচ্ছে। আর মোবাইলটা আমার কাছে কারণ নীল নিজেই আমার কাছে দিয়েছেন।
— আপনি নীল কে ডেকে দিন। আই মিন নীল স্যার কে ডেকে দিন।
— কথা তুমি পরে ফোন করো। নীল শাওয়ার নিচ্ছে। এখন ডাকা সম্ভব নয়।
কথা কিছু বলার আগেই মুনতাহা ফোনটা কেটে দিলো। এভাবে ফোন কেটে দেওয়াটা কথার রাগের আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে। এমনিতেই নীল সারাদিন কথার ফোন ধরে নি, তার ওপর মুনতাহা ফোন ধরেছে এটাও কথার ভালো লাগছে না।
মুনতাহা পেত্নি টা কেনো ধরলো নীল এর ফোন? আর আমার এতোগুলো ফোন কি সে দেখে নি? একটা বার ফোন কল ব্যাক করার প্রয়োজন মনে করেন নি। দুই দিন যাবত না কোনো ফোন না কোনো কথা! তার ওপর মুনতাহাকে দিয়ে গেছে ফোন!! হ্যাঁ আমি তো এখন পুরোনো হয়ে গেছি তাই আমার কথা আর মনে পরে না।
চলবে..