#শ্রাবণের_এক_সন্ধ্যায়
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_আট
হঠাৎ করে বাইরের ঝুম বৃষ্টি’তে বুকে হাত গুঁজে দাড়িয়ে থাকা ছেলে’টার দিকে নজর যেতে’ই থমকে গেলো তারিন। কি নেশাময় চোখে তাঁকিয়ে আছে ছেলে’টা ওর দিকে। এত ক্ষনে খেয়াল হলো তারিনের ছেলে’টা আর কেউ না স্বয়ং তাজওয়ার। তাজওয়ার’কে দেখেই তারিনের মুখের হাসি’টা আরো চওড়া হলো। ছুটে চলে এলো রুমে। তারিন’কে ভেতরে ঢুকে যেতে দেখে তাজওয়ারের হাসি মুখ’টা চুপসে গেলো। তৃষ্ণার্ত কাকের মতো চেয়ে রইলো বেলকনির দিকে। এই বুঝি মেয়ে’টা আবার বৃষ্টি বিলাশ করতে আসবে। এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ সামনের দিকে নজর যেতে’ই তাজওয়ারের হার্টবিট থেমে গেলো। হৃদ যন্ত্র’টা অসম্ভব লাফালাফি শুরু করলো। চোখ দুটো এক ভয়ংকর দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো। তারিন শাড়ি’টা একটু উঁচু করে ধরে দৌড়ে আসচ্ছে তাজওয়ারের দিকে। খোলা চুলগুলো একদিকে বাতাসের ঝাপটায় উড়ছে। অন্যদিকে, বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। পায়ের পায়েল গুলোর ঝুমঝুম শব্দ হয়তো বৃষ্টির শব্দের সাথে মিশে গিয়েছে। দুটো শব্দ একসাথে মিশে এক সুমধুর শব্দ সৃষ্টি করছে। হাতের চুড়ি ও গুলো তাল মিলিয়ে শব্দ তৈরি করছে। মুখের হাসি’টা যেনো মন কাড়া। তাজওয়ার নেশা’ময় চোখে তাঁকিয়ে আছে। এই সৌন্দর্য প্রকাশের ভাষা জানা নেই ওর। কি আছে মেয়ে’টা ওই চোখে? যে চোখে তাঁকালে আর দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়না। কি আছে মেয়ে’টা ওই ঠোঁটে? যেই ঠোঁটের ভাজে চিলতে হাসি কাছে টানে তাজওয়ার’কে। কি আছে মেয়ে’টার মাঝে? এইসব প্রশ্নগুলো মনে মনে আওড়াচ্ছিলো তাজওয়ার। এর মধ্যে খেয়ালে’ই করে’নি তারিন ওর কাছে চলে এসেছে। তারিনের জোরে নিশ্বাস ফেলার শব্দে তাজওয়ারের ধ্যান ভাঙে। থমকে যাওয়া চাহনি দিলো তারিনের দিকে। তারিনের মুখপানে জমে আছে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফোটা। মুখ’টা কেনো যেনো লাল হয়ে আছে? চোখের দৃষ্টি তাজওয়ারের দিকে। তারিন তাজওয়ার’কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। হঠাৎ স্পর্শে কেঁপে উঠলো তাজওয়ার। গভীর ঘোরের অতলে ডুবে যাচ্ছে ও। মেয়ে’টা কি ও’কে জাদু করলো? কি নেশায় জড়িয়ে নিলো মেয়ে’টা? দুইদিনের পরিচয়ে কেনো মেয়ে’টার প্রতি এত দূর্বল হয়ে গেলাম? ভালোবাসি নাকি শুধুই ওর মোহে আটকে যাচ্ছি? এইসব প্রশ্ন গুলোর উওর জানতে ইচ্ছে করলো তাজওয়ারের। তারিন তাজওয়ারের বুকের সাথে লেপ্টে রয়েছে। তাজওয়ার ও স্মিত হেসে তারিনের ভেজা চুলে মুখ ডুবালো। তারিন অন্যরকম কন্ঠে বলতে লাগলো……
–কি আছে আপনার মাঝে হিরো? কেনো আমি বারংবার আপনাতেই মগ্ন হয়ে যাই? কেনো আমি সব ভুলে আপনার কাছেই ছুটে আসি? জীবন’টা এক ধোয়াশায় আটকে যাচ্ছে বারবার। আর সেই ধোয়াশা হলো আপনি। বার বার আপনাকেই কেনো কাছে পেতে ইচ্ছে করে? আপনাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে? উওর দিতে পারবেন হিরো……
তারিনের কথাগুলো যেনো তাজওয়ারের কানে ঢুকলো না। সে তার বৃষ্টি কন্যার ভেজা চুলের ঘ্রান নিতে ব্যস্ত। তাজওয়ার’কে নিশ্চুপ দেখে তারিন নড়ে উঠলো। প্রশ্নত্তুর চোখে তাঁকালো তাজওয়া’রের দিকে। তাজওয়ার হয়তো তার বৃষ্টি কন্যার প্রশ্নত্তুর চাহনির ভাষা বুঝতে পারলো। কপালের উপর লেপ্টে থাকা ভেজা চুলগুলো সরিয়ে দিলো। ঠোঁটে’র লিপস্টিক’টা বৃদ্ধা আঙ্গুলী দ্বারা ঘষে মুছে দিলো। আলতো করে হাত রাখলো তারিনের তুলতুলে গালে। তারিনের চোখে দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রেখে উওর দিলো…….
—আমার প্রতি জমানো অভিযোগ, অভিমান, রাগ, ক্ষোভ সব মিটিয়ে ফেলো। সেটা প্রতিশোধ নিয়ে হোক বা ভালোবেসে।
তাজওয়ারের কথা শুনে তারিন কিছু না বলে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। তাজওয়ারের কলার শক্ত করে চে’পে ধরে তাজওয়ারের একদম মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে উঠলো…..
–মিস্টার হিরো আমাকে দূর্বল ভেবে সস্তার জ্ঞান বিলাতে আসবেন না। আপনার এই জ্ঞানমূলক দুইটা সস্তা বানী’তে তারিন গলবে না।
বলে হুট করে তাজওয়ারের থুতনির তিল’টার উপর গভীর ভাবে চুমু খেলো। তারপর তাজওয়ার’কে একপ্রকার ধাক্কা মে’রে ভেতরে চলে গেলো। এই মেয়েটা এমন অদ্ভুত চরিত্রের কেনো? মেয়েটা নিজেই কাছে আসবে। আবার নিজেই দূরে ঠেলে দিবে। নিজেই ভালোবাসবে। আবার নিজেই ঘৃনা করবে। তারিনের এমন উদ্ভট আচরণে তাজওয়ার মাঝে মাঝে ভেবে পায়না তারিন আসলে কি চায়? তারিনের যাওয়ার দিকে তাজওয়ার কিছুক্ষন বিচলিত চোখে তাঁকিয়ে থাকলো। বৃষ্টি কিছু’টা কমতে শুরু করেছে। অনেক ক্ষন একনাগাড়ে বৃষ্টি’তে ভিজে তাজওয়ারের মাথা’টা ঝিম ধরে আছে। কেমন যেনো ভার ভার লাগছে। শরীর’টাও তুলনা মূলক ভাবে দূর্বল লাগছে। নাকের ডগা’টা লাল হয়ে আছে। তাজওয়ার পরপর দুইটা হাচি দিয়ে উঠলো। তারিন দূর থেকে তা লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে বলে উঠলো……
–এখান থেকে চলে গেলে খুশি হবো। শুধু শুধু আমার বাড়ির নিচে দাড়িয়ে থেকে নিজের এটিডিউট, পারসোনালিটি নষ্ট করবেন না।
তারিনের কথা শুনে তাজওয়ার কিছু বলতে যেয়েও পারলো না। তৎক্ষনাৎ হাচি দিয়ে উঠলো। হাচির জন্য একটা শব্দ ও বলতে পারলো না। তারিনের দিকে এক নজর তাঁকিয়ে গাড়িতে উঠে গেলো। তা দেখে তারিন মুচকি হেসে শিষ বাজাতে বাজাতে রুমে ঢুকলো।
____________________________________________
তাজওয়ার বাসায় এসে শাওয়ার নিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। শরীর’টা আর চলছে। মনে হচ্ছে শরীরে জ্বর বাঁধবে। তাজওয়ার টিস্যু দিয়ে নাক মুছতে মুছতে বিছানায় সুয়ে পড়লো। এর মধ্যে রুমে রাইমা বেগম ধোয়া উঠা কফির মগ হাতে রুমে ঢুকলো। রাইমা বেগম’কে দেখেই তাজওয়ার ইচ্ছেকৃত ভাবে চোখ বন্ধ করে নিলো। তা বুঝতে পেরে রাইমা বেগম তাজওয়ারের মাথার সামনে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠলো….
–আমি জানি তুই ঘুমাস’নি। মায়ের চোখ’কে আজ অব্দি কোনো সন্তান ফাঁকি দিতে পারে’নি। তুই ও পারবি না…
রাইমা বেগমের কথা শুনে বিরক্তি’তে তাজওয়ারের কপাঁলে কয়েক’টা ভাঁজ পড়লো। বিরক্তিকর মুখ নিয়ে অন্য পাশে ঘুরে গেলো। তাজওয়ারের ব্যবহার স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিচ্ছে তা সে এই মুহূতে রাইমা বেগমের সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। তা বুঝতে পেরে রাইমা বেগমের চোখ জলে ছলছল করে উঠলো। চোখের জল লুঁকিয়ে রাইমা বেগম হাসি মুখে বলে উঠলো……
–কি দরকার বৃষ্টি’তে ভিজে শ্যুটিং ফুটিং করে নিজের শরীর খারাপ করার। আয় মাথা টিপে দিচ্ছি ভালো লাগবে…
বলে তাজওয়ারের মাথা টিপার জন্য প্রস্তুত হতে’ই তাজওয়ার বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো। গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো…..
–আমার ভালো লাগছে না মা। আমাকে একটু একা থাকতে দাও প্লিজ……..
রাইমা বেগম অসহায়ের মতো তাজওয়ারের দিকে বোবা দৃষ্টি’তে তাঁকিয়ে থেকে উওর দিলো…..
–আচ্ছা চলে যাচ্ছি। কিন্তু কিছু কথা বলার ছিলো। তুই তো সারাদিন বাসায় থাকিস না তাই….
রাইমা বেগমের ভাঙা কন্ঠস্বর শুনে তাজওয়ার বুঝতে পারলো। সে কষ্ট পেয়েছে তাজওয়ারের এহেতুক আচরণে। তাই তাজওয়ার দুই হাতে মাথা চেপে ধরে শান্ত কন্ঠে বললো……
–যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। আমি একটু ঘুমাবো…..
তাজওয়ারে’র শান্ত স্বর শুনে রাইমা বেগমের মুখে হাসি ফুটলো। সে হাসোজ্জল মুখে তাজওয়ারের দিকে কফির মগ’টা এগিয়ে দিলো। কফি’টা দেখে তাজওয়ার কিছুটা স্বস্তি পেলো। এই মুহূতে এই জিনিস’টা খুব করে দরকার ছিলো। কিন্তু মায়ের কাছে চাইতে অস্বস্তিবোধ হচ্ছিলো বলে বলেনি। তাজওয়ার তৃপ্তি নিয়ে কফির মগে চুমুক দিতেই রাইমা বেগম ওর মাথায় হাত রেখে আদুরে কন্ঠে বললো…..
–মায়েদের কাছে সব কিছু মুখ ফুটে চাইতে হয় না। সন্তানের কখন কি দরকার? তা মায়েরা সন্তানের মুখ দেখেই বুঝতে পারে। কিন্তু সন্তান’রা কোনোদিন বুঝতে পারেনা মায়েরা আসলে কি চায়?
শেষ কথা’টুকু অনেক’টা আফসোস নিয়ে বললো রাইমা বেগম। এইটুকু বলে থেমে গিয়ে বলে উঠলো…..
–হিরো সাহেবের যে ত্রিশ পেড়িয়ে গেছে সে খেয়াল কি তার আছে? তাই আমি আজ থেকে তোর জন্য মেয়ে দেখা শুরু করেছি। এইবার আমি আর তোর কোনো কথা শুনব না। আগেই বলে দিলাম বাপু….
মায়ের কথা শুনে তাজওয়ারের মুখ’টা রাগে লাল হয়ে উঠলো। রক্ত চক্ষু নিয়ে রাইমা বেগমের দিকে তাঁকালো। হুট করেই মাথায় কিছু আসতে’ই তাজওয়ারের ধরে উঠা রাগ’টা পানি হয়ে গেলো। চাহনি মুহূতে’ই পরিবর্তন করে নিয়ে শেষবারের মতো কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে উঠলো…….
–ও’কে নো প্রবলেম। আমি রাজি। তবে আমার আমার একটা শর্ত আছে।
তাজওয়ারের সম্মতি পেয়ে রাইমা বেগম খুশিতে গদগদ করে লাফিয়ে উঠে বললো….
–তোর সব শর্ত আমি মানতে রাজি। একবার শুধু বল তোর কি কি শর্ত আছে…..
তাজওয়ার বেশ আয়েশ করে সুয়ে পড়তে পড়তে বললো…..
–দুই দিনের মধ্যে আমার বিয়ে ঠিক করতে হবে। এই দুইদিন পেড়িয়ে গেলে আমি বিয়ে করব না। এখন তুমি আসতে পারো…..
ছেলের কথা শুনে রাইমা বেগমের মুখ’টা চুপসে গেলো। একটা মাত্র ছেলে তার। তাও আবার সুপারস্টার। কত ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলো সে। কিন্তু দুই দিনে এত কিছু করে সম্ভব হবে। তবে ছেলে যখন একবার রাজি হয়েছে কিছুতেই এই সুযোগ’টা হাত ছাড়া করা যাবেনা। তাই সে বাধ্য হয়ে রাজি হয়ে গেলো। কফির মগ’টা হাতে নিয়ে চিন্তিত মুখ নিয়ে বেড়িয়ে গেলো তাজওয়ারের রুম থেকে। রাইমা বেগম চলে যেতে’ই তাজওয়ার রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো….
—দুইদিনের মধ্যে’ই আমি আমার সব প্রশ্নের উওর পেয়ে যাবো। রেডি থেকো মাই বিউটিফুল লেডিস তোমার সব রহস্যময় খেলা খুব শিঘ্রই শেষ হতে চলেছে……..
#চলবে
[ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন]