শোভা পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0
1257

#শোভা
#পর্ব_১৮

– দেখতো, খালা! বেল বাজায় কে?

– দেখতাছি, মা!

– কে, খালা?

– চিনিনা, মা! একজনে তোমার লগে দেহা করবার চায়?

শোভা হাতের কাজটা রেখে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজায় দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে সে ভূত দেখার মত চমকে ওঠে। আবার ভিতরে ভিতরে ভয়ও পেয়ে যায়!

– আপনি? এখানে?

– হ্যা, মা! আমি! ভিতরে আসতে বলবানা?

শোভা কতক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে করে বললো, আসুন!

ভিতরে যেয়ে জহিরের মা বাসার এদিক সেদিক একনজর চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।

– কেমন আছো, মা?

শোভা আস্তে করে উত্তর দিল, ভালো। বসুন।

শোভা তার শাশুড়ির ব্যবহারে অবাক হয়ে গেলো। কিন্তু সেটা তার ভাবভঙ্গিতে বাইরে প্রকাশ হতে দিলোনা।

– কি ব্যাপার! এত বছর পর আমার খোজ কোথায় পেলেন আপনি ? আর কি উদ্দেশ্যে এসেছেন এখানে ?

– মা রে, আমি দুই তিনদিন আগেই জানতে পারলাম যে এই ফ্লাট টা তুমি কিনছো। আগে জানলে আগেই আসতাম দেখা করতে। যাক আমার পোলার শেষ স্মৃতি তুমি রক্ষা করছো। আমি তো মনে করছিলাম ওই শয়তানের বাচ্চা আমার জহিরের শেষ চিহ্ন কার না কার কাছে বেইচা দিছে। মা, এক গ্লাস পানি দিবা?

– খালা, এক গ্লাস পানি দাও এদিকে। তা বলুন! আমাকে আপনার কি দরকার?

শোভার কণ্ঠের দৃঢ়তা দেখে তার শাশুড়ি একটু ঘাবড়ে গেলো। সে মনে করেছিলেন শোভা বুঝি আগের মতই আছে। মনে মনে এজন্য সাজানো গোছানো কিছু পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে। কিন্তু শোভার এই পরিবর্তিত রূপ দেখে সে একটু নড়ে চড়ে বসলো। সে এক গ্লাস পানি চেয়েছে তার কাছে কিন্তু শোভা নিজে না দিয়ে তার বুয়াকে দিয়ে আনাচ্ছে তাও আবার শুধু একগ্লাস পানি আর কিছু না! বউয়ের আয় ব্যয় এর হিসেবের মোটামুটি খোঁজখবর করেই সে এখানে এসেছে। এক সপ্তাহ আগে সে যখন প্রথম জানতে পেরেছে যে তার ফ্লাট টা শোভা কিনেছে সে বিশ্বাসই করতে পারেনি। একদিন বাজারে যেয়ে হঠাৎ করে এই বাসার দারোয়ানের সাথে দেখা! তার কাছেই শুনেছে। দারোয়ান শোভাকে চিনতোনা। কিন্তু বিল্ডিং এর অন্যান্য ফ্লাট মালিকদের কাছে শুনেছে শোভার সম্পর্কে সবকিছু। হঠাৎ করে বাজারে দারোয়ান কে দেখে তার ফ্লাটে কে এসেছে সেই খোঁজখবর করতে গিয়ে সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলোনা। এত টাকা কই পেলো শোভা? আলাদিনের চেরাগ পেয়েছে নাকি? পরে দারোয়ানের কাছে জানলো শোভা এখন বেশ টাকা পয়সার মালিক। ব্যবসা বাণিজ্য করছে। মেয়েরা ভালো স্কুলে পড়ে। সব কিছু শুনে সে যেন গোলকধাঁধায় পড়ে গেলো। নিজেকে নিজে গালমন্দও করলো কেন সে এতদিন শোভার টাকাপয়সার এই খোজ পায়নি। রাগ করে আর ওমুখো না হওয়ার কারণেই আজ এতবড় খবর সে এতদিন পরে জানছে। সব খবর পাকাপাকিভাবে নিয়েই সে আজ এসেছে। তার মত তার মেয়েরা এ খবর শুনে বিশ্বাস তো করলোই না উল্টা মাকে দারোয়ানের কথায় বিশ্বাস করার জন্য বকাঝকা করলো।

পানি খাওয়া শেষ করে শোভার শাশুড়ি বললো, মা, আমার নাতনীদের দেখছিনা যে? আর তোমার ব্যবসা বাণিজ্য কেমন চলছে?

– জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ, ভালো! আর আমার মেয়েরা স্কুলে! কিন্তু এত খোঁজখবর আপনি কেন নিচ্ছেন? আর কিছু?

– ও! তাইলে তো ভালোই। মা আসছিলাম মানে…

তার শাশুড়ির কথা শেষ হওয়ার আগেই শোভা বললো, আমাকে উঠতে হবে। আপনি আর কিছু বলবেন? আর এতদিন পরে হঠাৎ আমাদের কথা কেন মনে পড়লো?

– মনে তো প্রায়ই পড়ে মা। তোমার সাথে যে অন্যায় আমি করেছি জানি তার কোনো মাফ নাই। তবুও একটু মাফ পাওয়ার আশায় এই এতবছর ধইরা মনে মনে খুঁজতেছি। আমার জহিরের বাচ্চাগুলারে দেখার জন্য মনডা ছটপট করে কিন্তু কই পাবো তোমাগো।

– আপনি কি একথা বলার জন্য এখানে এসেছেন?

– হয়রে মা। আর কিছু চাইনা। তোমার একটু ক্ষমা না পাইলে যে কবরেও জায়গা হবেনা।

– ঠিক আছে! যান ক্ষমা করে দিয়েছি। এখন আমাকে উঠতে হবে। বলেই আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে উঠে রুমের ভিতরে চলে গেলো।

ভিতরে যাওয়ার পরে সে মনে মনে যেন হাফ ছেড়ে বাচঁলো। এতদিন শান্তিতেই ছিলো। সে জানে যে এত সহজে ছেড়ে যাবার পাত্রী তার শাশুড়ি না। জামিলের কাছে তাদের ব্যবসায়ের খোঁজখবর সব সে জেনেছে। কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে যে তারা চলছে সে খবরও সে জানে। তার শাশুড়ি তাদের খবর জানতে পারায় সে চিন্তায় পড়ে গেলো।

আধঘণ্টা পরে সে রেডি হয়ে ড্রইং রুমে এসে দেখে তার শাশুড়ি এখনো সেখানে ঠায় বসে আছে।

– আপনি এখনো যাননি? আমি তো বলেছি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আর আমি বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে যাবো। তাই যদি এখন!

– বুঝতে পারছি মা! তাইলে আইজ উঠি। নাতীগো সাথে দেখা করতে আরেক দিন আসবো।

-সেটা আপনার ব্যাপার! তবে ওরা আপনার সাথে দেখা করতে চাইবে বলে আমার মনে হয়না।

শোভা জামিলের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য সন্ধ্যায় জামিলের বাসায় গেলো।

– জামিল ভাই, আপনাকে তো ফোনে সবই বলেছি। খুব ভয় হচ্ছে। মেয়ে দুইটা নিয়ে একা একা থাকি। ওরা তো এখন সবই টের পেয়ে গেছে। তবে আপনার সাথে আমার যে যোগাযোগ আছে তা হয়তো জানেনা। তবে জানতে বেশি সময় লাগবেনা ওদের। একবার যেহেতু আমার খোজ পেয়ে গেছে। আমার খুব ভয় হচ্ছে। আবার উল্টাপাল্টা কিছু করবেনা তো? আমার মাথায় মেয়েদের নিয়ে হাজারটা উল্টাপাল্টা চিন্তা আসছে।

– আরে বোকা! কোনো ভয় নেই। আমি তো আছি।আর ওদের কিছু করার মুরোদ নেই এখন আর! আমি ওদের প্রত্যেকটি গতিবিধির খবর রাখি। আমার ছেলেটা ওদের কাছে থাকে। ইচ্ছে না থাকলেও খবরাখবর রাখতে হয়। এতদিন ছেলের খোজখবর জানতাম না দেখে যোগাযোগ ও ছিলোনা তাই সেটা আলাদা কথা ছিলো। এখন তো আমি আমার ছেলের খোজখবর জানি। আর ওর উপর আমার পিতৃত্বের দাবি কাগজে কলমে ছেড়ে দিলেও অন্তর থেকে কি করে দূর করি বল? আজ হোক বা কাল হোক মুহিবকে আমি আমার কাছে আনবোই। আমি সবকিছু বুঝিয়ে বললে ও নিশ্চয়ই বুঝবে এ বিশ্বাস আমার ওর উপর আছে। ওর শরীরে আমার রক্তও তো বইছে। হয়তো ওই অমানুষদের সাথে থাকতে থাকতে ছেলেটা একটু বেয়ারা স্বভাবের হয়ে গেছে। ওই যে বলেনা সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। ওদের ছায়াতল থেকে বেরিয়ে একবার আমার কাছে আসলে ও ঠিক হয়ে যাবে!

ওরা সর্বস্ব হারিয়ে এখন পথের কাঙাল। বাড়িটাও অল্পদিনের মধ্যে নিলামে উঠবে। বাড়ি বাচাঁনোর জন্য হণ্য হয়ে ছুটছে। কিন্তু ছুটে আর এবার কোনো লাভ হবেনা। সব রাস্তা বন্ধ। গ্রামে অল্প বিস্তর কিছু জমি আছে শশুরের নামে তাই বেচার ধান্ধা করছে। কিন্তু ওই টাকায় কিছুই হবেনা। আমি সব খবরই রাখি। ভিক্ষার প্লেট হাতে নেয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই জানোয়ার গুলির।
তুমি অযথা ভয় পেওনা। ওদের শরীরে এখন আর বিষ নেই। নিজেদের অস্তিত্ব টেকানোই তো এখন ওদের কাছে মুশকিল তোমার পেছনে লাগার সময় কই? বলতে বলতে হেসে উঠলো জামিল। ওই বুড়িটা শুনছে তোমার পয়সা কড়ি হইছে অমনি মা সোনা ডাকা শুরু করছে। পুরাই বদজাত একটা।
তবে হ্যা! একদম ঠাই দিবানা। আর ওদের জন্য কোনো মানবতা দেখাবা না। তুমি তো আবার বাংলা মুভির শাবানা টাইপের বউ। মানবতা মানুষের জন্য।ওদের মত অমানুষদের জন্য নয়। আরো একটা কথা! ওদের সাথে কথা বলার সময় কখনোই মনের ভয় মুখে প্রকাশ করবানা। শত্রুর সামনে দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে গেলে তাদের আঘাত করাটা সহজ হয়ে যায়। আর তখন যুদ্ধে পরাজিত হওয়াটা অবশ্যাসম্ভাবী।কোনোদিন যেন ওদের প্রতি তোমার মনের ভয় টা চেহারায় প্রকাশ না পায়।

– ঠিক বলেছেন। এটা অবশ্য আমিও জানি। অনেক ধন্যবাদ, জামিল ভাই। এই সাহসটুকুর জন্যই আপনার কাছে ছুটে আসা। আপনার ঋণের বোঝায় আমি দিনদিন কুঁজো হয়ে যাচ্ছি।

– দূর পাগলি! বড় ভাইয়ের কাছে আবার ছোট বোনের ঋণ কিসের?

গুনেগুনে ঠিক সপ্তাহ খানেক পর হাজির আবার শোভার শাশুড়ি!

এবার এসে কত কান্নাকাটি! তার বাড়িটা নিলাম হয়ে যাচ্ছে। মেয়েরা যে যার পথ দেখছে। তার
যাওয়ার কোনো পথ নেই। আর মেয়েরাও কেউ তাকে নিতে চায়না।
সে জান্নাতকে কাছে ডাকলে সে তার দাদিকে এভয়েড করে রুমে চলে যায়। সে এখন মোটামুটি ভালোমন্দ বুঝে। তার মায়ের সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানে ও বুঝে। তাই ওনার পরিচয় জেনে ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নেয় ওরা দুই বোন।

– মা, আমি জানি আমারে তুমি কোনোদিনই মাফ করোনাই । মাফ যদি করতা তাইলে আগের মত বড় গলায় মা কইয়া একবার হইলেও ডাক দিতা। কত বড় ভুল আমি করছি তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাইতেছি । বলে কাঁদতে কাঁদতে শোভার পায়ের কাছে এসে বসলো।

– কি করেন? কি করেন? বলেই শোভা দূরে সরে দাঁড়াল।

– মা, আমারে মাফ কইরা দাও। আমি মাইয়াগো পাল্লায় পইড়া তোমার সাথে আর আমার দাদাগো সাথে অনেক অন্যায় করছি। কিন্তু সারাজীবন যাগো জন্য আমি বরবাদ করলাম, সেই মাইয়ারা আইজ আমার শেষ বয়সে বিপদের সময় হাত ছাইড়া দিছে। আমার এখন কোনো কুল কিনারা নাইরে মা। বাপের ভাগের জমি টুক ও বেইচা তিন মাইয়ায় ভাগ বাটোয়ারা কইরা নিছে। আমারে নিয়া শুরু হইছে ঠেলাঠেলি। এ কয় তুই নে ও কয় তুই নে!
আমি এখন একটা ঠেলাগাড়ি। আমার জহির বাইচা থাকলে আইজ এই অবস্থা হইতোনা।

শোভার ওনার জন্য মায়া হতে শুরু করলো। আজ তার শাশুড়ির চোখে সত্যিকার অর্থে কষ্টের ছাপ দেখতে পেলো সে।

– খালা, টেবিলে খাবার দাও ওনাকে! চলেন আমাদের সাথে খাবেন। খাওয়ার পরে আপনার কথা শুনবো।

– না মানে!

গড়িমসি করার দরকার নেই। চলুন!

– ঠিক আছে। তুমি যখন বলছো!

– দাদাভাই রা খাবেনা?

– খাবে তবে পরে! আপনি খান।

– বুঝতে পারছি! আমার সাথে বসবেনা তাইতো? বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো জহিরের মা!

শোভাও বুঝতে পারলো যে আসলেই জান্নাত আর জিনাত তার দাদির উপস্থিতি সহজ ভাবে নিতে পারছে না। ওরা এখন অনেক কিছু জানে আর বুঝে।

– খালা, ওনার প্লেটে করল্লার সব্জিটা দিওনা। অন্য সবজি দাও। উনি করল্লা পছন্দ করেন না।

– ফ্যালফ্যাল করে অশ্রুভারাক্রান্ত নয়নে শোভার দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার এখনো মনে আছে এত বছর পরে?

– মনে থাকবে না কেনো? আপনাদের প্রতিটি কথাই মনে আছে। কি করে ভুলি বলেন?

খাওয়া শেষ করে শোভা বললো, এখন বলুন আমি আপনার জন্য করতে পারি? আমি একটু ব্যস্ত।একটু পরে মেয়েরা আসবে কাজ করতে।

– মা রে, আমি জানি আমার উপর তোমার অনেক রাগ। আমি তোমার সাথে এত অন্যায় করছি যে আমি চাইলেও কোনদিন সেটা তুমি মাফ করবা না। আমি সবই বুঝি। তোমার সাথে যে অন্যায় আমি করেছি তার শাস্তি আল্লাহ আমাগো দিছে। সব হারাই আজ আমরা পথের ভিখারি। যে মাইয়াগো জন্য আমি সারাজীবন এত অন্যায় করছি, আমার জহিররে ঠকাইছি, তোমারে অনেক ভাবে অপবাদ দিছি, অত্যাচার করছি, আমার জহিরের পরাণ তার মাইয়া দুইটা আমার দাদাভাইগো সাথে আমি সবচাইতে বেশি অন্যায় করছি, আইজ সেই মাইয়ারা তাগো নিজের স্বার্থ নিয়া ব্যস্ত। আমি এখন তাগো কাছে একটা বোঝা। এ কয় ওর কাছে যাও, ও কয় তার কাছে যাও। সব হারাই মা এখন রাস্তায় আইসা দাড়াইছি।

শোভা সব শুনে বললো, আমি তো আপনার এত কথা শুনতে চাইনা। এত কথা শোনার আমার টাইম নেই। আপনার কথা আমি শুনছি শুধুমাত্র একটা কারণে। আর কারণ টা হলো আপনি জহিরের মা।
আমি জহিরকে দেয়া আপনাদের আঘাতের কথা কি করে ভুলি, বলেন? আমার সাথে কি করেছেন সে না হয় আমি ছেড়েই দিলাম কিন্তু আমার মেয়েদের সাথে কি করেছেন তা আমার জীবদ্দশায় কোনোদিনই ভুলবোনা। আজ এসেছেন মাফ চাইতে, আচ্ছা ! মাফ করে দিলাম। সারাজীবন অন্যায় করে একদিন এসে কয়েক ফোটা চোখেরজল ফেলে মাফ চাইলেই যদি মাফ পাওয়া যেতো তাহলে মানুষের দরবারেই মানুষের পাপ পুণ্যের বিচার হয়ে যেতো। আল্লাহর দরবার আর জান্নাত জাহান্নাম নামে কিছু থাকতো না। আমি এখন মাফ করে দিয়েছি বললেই যদি মাফ পেয়ে যাবেন এই আশা করে আমার কাছে আসেন, তাহলে আমিও বলছি যান মাফ করে দিলাম। আর কিছু?

– মা, কিভাবে বলি! আমারে একটু জীবনের শেষ সময়ে তোমাদের সাথে আমার দাদাভাই গো পাশে থাকতে দাও, মা! ওদের শরীর দিয়া আমি জহিরের ঘ্রাণ পাবো।

শোভা একটু হেসে বললো, তাই নাকি? যাক শুনে ভালো লাগলো আমার মেয়েরা আমার পেটে হয়েছে বলে যাদের দেখলে আপনার বমি আসতো, এখন তাদের ঘ্রাণ আপনার এত্ত ভালো লাগে। যাক! ওদের দুর্গন্ধযুক্ত শরীর এতদিনে পরিষ্কার হলো তবে! কিন্তু, আমি ভেবে অবাক হই যে, আপনি আমার কাছে এই আশা করেন কোন আশায় আর কিসের অধিকারে ?

– মা, তুমিতো একদিন বলছিলা যে আমি একদিন তোমার কাছে দয়া ভিক্ষার জন্য আসবো আর তুমি আমারে দূরদূর কইরা তাড়াই দিবানা আমি যেমনে তোমারে দিছিলাম। কোনোদিন ভাবিনাই তোমার কথাই সত্যি হবে। সবই আমার কর্মফল। অনেক আশা নিয়া আসছি, মা। জানি তোমাগো উপর আমার কোনো অধিকার নাই। তারপরেও আসছি। আমি যে নিরুপায় মা! নিজের প্যাটের সন্তানদের কাছে আমি এখন বোঝা হইয়া গেছি। আসলে দুনিয়ায় অর্থ সম্পদ না থাকলে কোনো দাম নাই।

– আমি কবে কি বলেছিলাম সে কথার আশায় আপনি চলে আসলেন! আমিতো আরো কতকিছু বলেছিলাম, কত আকুতি করেছিলাম আপনি তখন তো সেগুলি শুনেন নি। অবশ্য আপনার কাছে এসব কথা বলা আর না বলা একই কথা। আমার পক্ষে আপনার সাথে একই ছাদের নিচে থাকা সম্ভব না। মাফ করবেন। আমি যতবার আপনার চেহারা দেখি ততবার আপনার আর আপনার মেয়েদের কুকীর্তির কথা ভেসে ওঠে। নিজেকে তখন বড় অসহায় মনে হয়। অস্থির লাগে, দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। অনেক কষ্ট করে একটু সুখের সন্ধান মিলেছে, আমি এখন আর সেখান থেকে ফিরে সেই নরক যন্ত্রণায় ফিরে যেতে চাইনা। আপনি আপনার মেয়েদের বোঝান। তিন তিনটে মেয়ে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই আশ্রয় দিবে।

– মা, আমার যে রাস্তায় ভিক্ষা ছাড়া আর কোনো পথই খোলা নাই। আমারে এই ঘরের কোণায় একটু ঠাই দেও। আমি তোমার কাজের মানুষের সাথে থাকবো। সারাদিন তোমার চোখের সামনে আসবোনা। আর মন চাইলে দিনে একবেলা দুইবেলা যা খাইতে দিবা তাতেই চলবে। মাইয়াগো অনেক বুঝাইছি। কিন্তু, ওদের কাছে আমি এখন একটা অথর্ব আর নিকম্মা মানুষ ছাড়া কিছুইনা। রিনা তার পোলারে লইয়া একরুমের বাসা লইছে। গ্রামের জমি বেচা টাকার ভাগ দিয়া কি যেন ব্যবসা করবে কইলো। আমারে ওর পোলা দুই চোখ দিয়া দেখতে পারেনা। আমি সাথে থাকলে নাকি সে ঘর ছাইড়া চইলা যাবে। বীনা আর তার জামাই তো এই ফ্লাট হাতছাড়া করার পর হইতে আমার নামও শুনতে পারেনা। বাকি থাকলো কণা। সে তার থাইকা বয়সে মেলা ছোড পুচকি একটা পোলারে বিয়া করছে। বাসা নিছে। পোলাডা বেশি সুবিধার না। কণার জমি বেচা পয়সা কয়ডা শেষ হইলে ওরে লাত্থি মাইরা চইলা যাবে। এই কথা বলছি দেইখা কণা আমার সাথে যা তা ব্যবহার করলো। আর একদিন কি দুইদিন ওই বাড়িতে থাকতে পারবো। এরপর আমাগো বাইর কইরা দিলে আমার হয় গাড়ির তলে পইরা মরতে হবে নয়তো বা ভিক্ষা করতে হবে। একটু দয়া করো, মা! ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো শোভার শাশুড়ি।

শোভার মনটা তার কথা শুনে ধীরেধীরে ভারি হয়ে উঠলো। একবার মন চাইলো তার সমস্ত অভিযোগ ভুলে যেয়ে তার শাশুড়িকে ঠাই দেয় তার বাসায়। কিন্তু, পরক্ষণেই জামিলের কথাগুলি মনে পড়লো। এদের মত মানুষের কোনো বিশ্বাস নেই। হয়তো আবার কোনো নতুন চাল চালতে শুরু করবে। তার আর তার মেয়ে দুটির জীবন আবার বিষিয়ে তুলবে। তাই শোভা তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলো।

কিন্তু, কেনো যেনো তার শাশুড়ির এবারের চোখের পানি তার কাছে সত্যি মনে হলো। তারপরে ও সে আর কোনো বিপদে পড়তে চাইলো না।

– ঠিক আছে, মা! বুঝতে পারছি। ভালো থাইকো। তোমার প্রতি কোনো অভিযোগ নাই। আর পারলে এই পাপি মানুষটারে মাফ কইরা দিও। দোয়া করি, দাদাভাইগো নিয়া জীবনের বাকি দিন কয়টা শান্তিতে থাইকো।
বলে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বের হয়ে গেলো শোভার শাশুড়ি।

উনার প্রতিটি কথা শোভার কানে বাজতে লাগলো।
খুব খারাপ লাগছে উনার জন্য।
সে পিছন থেকে তার শাশুড়িকে ডাক দিলো।

– আপনি একটু দাঁড়ান।

শোভার শাশুড়ি এক বুক আশা নিয়ে পেছন ঘুরে তাকালো।

– আপনি জহিরের বউ বাচ্চা মানে আমাদের সাথে যে অন্যায় করেছেন তার জন্য হয়তো উপরে বসে জহিরের আত্মা কষ্ট পেয়েছে। আমি চাইনা জহির আবারও তার মাকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে দেখে কষ্ট পাক। সে বেচেঁ থাকলে হয়তো এরকম দিন কোনোদিনই আসতোনা। কিন্তু, তাই বলে আপনাকে আমার কাছে রাখাও সম্ভব না। আমিও তো মানুষ। আমার পক্ষে কোনোদিনই আপনার সাথে আমার বাচ্চাদের নিয়ে থাকা সম্ভব নয়। তাই এখানে আমার সাথে আপনাকে রাখতে না পারলেও আপনার থাকার জন্য একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারি।

– মা গো! আমি সবই বুঝি। তুমি যে এইটুক আমার জন্য করতে চাইছো এই আমার পরম সৌভাগ্য। তুমি আমাকে যেখানে যেভাবে রাখবা তাতেই চলবে।

– আমার এক পরিচিত জনের একটা বৃদ্ধাশ্রম
আছে। আপনি চাইলে সেখানে থাকতে পারেন। আমি ওখানকার মাসিক খরচ টা সময়মত পাঠিয়ে দিবো। টাকা নিয়ে আপনার টেনশন করতে হবেনা।

শোভাকে অবাক করে দিয়ে শোভার শাশুড়ি দৌড়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে শোভাকে জড়িয়ে ধরলো।
মা, এটুকুই আমার জন্য পরম পাওয়া। আমার মত পাপিরে তুমি এতটুকু যে সম্মান দিছো এতেই আমি অনেক খুশি। আমার মত দূর্ভাগা এই পৃথিবীতে আর কেউ নাই। তোমার মত বউমারে আমি চিনতে পারিনাই। আমার ফেরেশতার মত ছেলের সাথে ছল করছি। বলে কাঁদতে লাগলো।
দুইহাত উপরে তুলে সে চিৎকার করে উপরের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো আল্লাহ, আমার মা জীবনে অনেক কষ্ট করছে। তুমি তারে আর কোনো কষ্ট দিওনা। সে যেন জীবনের বাকি পথ ভালোভাবে পাড় করতে পারে।

শোভা খেয়াল করে দেখলো তার চোখ থেকে কখন যেন মনের অজান্তেই টপটপ করে পানি পড়ছে। তার কাছে এই পানি কে মনে হচ্ছে যেন এক ধরনের পরিতৃপ্তির পাওয়া। সে যেন দেখতে পাচ্ছে উপর থেকে জহির বউ শাশুড়ির এই মিলন দেখে খুব খুশি হয়েছে। জহিরের এতদিনের অতৃপ্ত আত্মা তৃপ্ত হয়েছে।

( সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে