#শেষ বিকেলের আলো
#পর্ব_০২
#নিশাত_আনজুম
গত কয়েকদিন ধরে সেতুর গলা ব্যথা শুরু হয়েছে। ভেবেছিল এমনিতেই সেরে যাবে। কিন্তু ব্যথা কমার চাইতে বেড়েছে আরো। আজ আবার সকাল থেকে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। অসুস্থ শরীরে ঘরের কাজ শেষ করতে হয়েছে। আদিবা সাত মাসের প্রেগন্যান্ট। বাচ্চা পেটে আসার পর থেকেই সে অসুস্থতার দোহায় দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে। আদিবা বড় ঘরের আর শিক্ষিত হওয়ায় শাশুড়ী তাকে সমীহ করে চলে। প্রথম দিকে তিনি আদিবাকে ঘাটালেও সুবিধা করতে পারেননি। আদিবা সেতুর মতো নয়। সে নিজের যেটা ঠিক মনে হয় সেটাই করে। শাশুড়ির আদেশ মেনে মিনমিন করে চলা মেয়ে নয়। তাছাড়া হামিমও বউয়ের খুব ভক্ত। বউয়ের হ্যা’তে ‘হ্যা’ না’তে ‘না’ বলে। হামিমের ভয়েও রুবিনা আদিবাকে কিছু বলে না। সেতুকেই তিনি চাপের মধ্যে রাখেন। সেতু এসব মেনে নিয়েছে। সংসারটা তো তারই। স্বামী,সংসারকেই আপন করে নিয়েছে সে। তাছাড়া সংসারে বড় বউদেরই দায়িত্ব বেশি। সেতু দুপুরের দিকে হামিদকে ফোন করলো। দ্বিতীয় বারে রিসিভ হলো।
” কী করছেন? খেয়েছেন? ”
” না খাইনি এখনো। কেন ফোন করেছো?”
সেতুর মন খারাপ হলো। তার কাছ থেকেও তো বিপরীতে জিজ্ঞেস করতে পারতো সে কী করছে,খেয়েছে কি না।
” কয়েকদিন ধরে গলা ব্যথা করছে। ভেবেছিলাম কমবে। সকাল থেকে আরো বেড়েছে আর জ্বরও এসেছে। আপনি কি আজ তাড়াতাড়ি আসতে পারবেন? ডাক্তারের কাছে যেতাম।”
” বাবাকে সাথে নিয়ে যাও। বিকালে আমার কাজ আছে,” হামিদের সোজাসাপ্টা জবাব।
” বিকালে বাবা একটা আক্ব্দের অনুষ্ঠানে যাবে শুনলাম।”
ওপাশ থেকে হামিদের বিরক্তসূচক শব্দ করলো। বললো, ” বিকালে রেডি থেকো। আমি ফোন করার সাথে সাথে বের হবে।”
সেতুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো, ” আচ্ছা। আপনি ফোন করলেই আমি বের হবো।”
বিকালে হামিদ আসলো সেতুকে নিয়ে। বড় রাস্তায় উঠে সেতু বললো, ” রিকশায় চড়ে যাই! রিকশায় চড়তে ইচ্ছে করছে। অনেক দিন উঠিনি।”
হামিদ বিরক্তির স্বরে বললো, রিকশায়ও চড়তে ইচ্ছে হয় কারো! আমার সময় কম। সিএনজিতে বসো।”
সেতুর মন খারাপ হলো। বিয়ের পর পর তারা কোথাও গেলে রিকশায় চড়ে যেতো সেতুর আবদারে। সেতু তখন বলেছিল হামিদের সাথে সেতুর রিকশায় চড়তে ভীষণ ভালো লাগে। হামিদও সেতুর পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আগলে রাখতো, কথা বলতে বলতে যেতো।
ডাক্তারের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে হামিদের ফোনে তিন-চার বার কল চলে এসেছে। ডাক্তার দেখানো শেষে হামিদ বললো, ” আমার মার্কেটে যেতে হবে কলিগের সাথে ওর ফোন কিনতে। তোমাকে গাড়ি ঠিক করে দিচ্ছি তুমি চলে যাও।”
” আমার একটা শাড়ি লাগতো রিমার বিয়েতে পরার জন্য। যেগুলো আছে সেগুলো পুরনো হয়ে গেছে। আর বারবার ঐ দুুই-তিনটা শাড়ি পরে যেতে লজ্জা লাগে।”
” পরে একদিন আদিবার সাথে এসে নিয়ে যেতে পারবে না? আদিবা তো প্রায়ই বের হয়।”
” বিয়ের তো আর দেরি নেই। পরে আর রায়ানের জন্য বের হতে পারবো না।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেতুকে নিয়ে মার্কেটে গেল। ঢুকতেই সায়মাকে দেখতে পেল। সেতু এবার বুঝলো কোন কলিগ। সায়মা কাছে এসে বললো, ” এসেছি আধ ঘন্টা হয়েছে। তোমার দেরি হবে আগে বললে কী হতো!”
সেতু পেছনে থাকায় তাকে দেখেনি সায়মা। হামিদ সায়মাকে জানলো সেতুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ায় দেরি হয়েছে। সায়মা অহ্ বলে সেতুর পাশে গেল। সায়মা হাসিমুখে বললো, ” তোমাকে আমি চিনতে পারিনি। আগের চাইতে মোটা হয়েছো। তোমাকে শেষবার দেখেছিলাম দীনার ভাইয়ের মেয়ের আকীকাতে না?”
সেতু আড়ষ্টভাবে জবাব দিলো, ” হ্যা।”
সায়মাকে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। চেহারা, ফিগার, ড্রেসআপে, কথাবার্তায় খুব স্মার্ট একটা মেয়ে সায়মা। হামিদের পাশে দাঁড়ানোতে খুব চোখে লাগছে ওকে। সেতু নিজের দিকে একবার তাকিয়ে আবারও সায়মার দিকে তাকালো। তারা একটা কাপড়ের দোকানে গেল। সেতু শাড়ি দেখতে দেখতে সায়মা কয়েকটা গোল জামা আর টপস এনে একপাশে রাখলো। সেখান থেকে একটা একটা নিয়ে সেতুর গায়ের সাথে লাগিয়ে দেখতে লাগলো।
” জামাগুলো খুব সুন্দর। মনে করেছি তোমাকে মানাবে। এখন দেখছি মানাচ্ছে না একটাও। পরলে বিশ্রী দেখাবে। তুমি বরং শাড়িই দেখো।”
দোকানদার সায়মাকে বললো, ” আপু আপনাকে মানাবে ড্রেসগুলো। আপনি ফরসা তো ডিপ কালারটা ফুটে উঠবে।”
সায়মা খুশি হয়ে সেখান থেকে ডিপ কালারের দুইটা জামা কিনলো।
সায়মা যেন হামিদের সামনে বুঝিয়ে দিয়েছে যে এসব সুন্দর জামা সেতুর জন্য নয়। এসব সায়মাকেই মানায়। সেতু হামিদকে শাড়ি পছন্দ করে দিতে বললে সে জানায় মেয়েদের শাড়িটাড়ি সম্পর্কে বুঝে না সে।
মোবাইলের দোকানে গিয়ে সায়মা একটা মোবাইল পছন্দ করলো। দাম বাজেটের চেয়ে একটু বেশি হওয়ায় সেটা রেখে অারেকটা দেখছে। ছেলেটা হামিদকে বললো, ” স্যার, ম্যাডামের যে ফোনটা পছন্দ হয়েছে সেটা নতুন মডেলের। বর্তমান বাজারে এটা খুব চলছে। দাম একটু বেশি হলেও মান ভালো। আপনার যদি এই মুহূর্তে টাকা না থাকে সমস্যা নেই। আমরা বক্স করে রেখে দিলে আপনি কাল বা পরশু আসলে দিয়ে দিব। ম্যাডাম পছন্দ করেছে কিনে না দিলে মন খারাপ হবে।” দোকানী শেষের কথাটা হেসেই বললো।
” আরে না না। আপনি ভুল বুঝছেন। ওনি আমার… ” হামিদকে বলতে না দিয়ে সায়মা হাতের মোবাইলটা দেখিয়ে বললো, ” আমার এটাই ভালো লাগছে। তাছাড়া অতো বাজেট নেই। আপাতত এটা হলেই চলবে।”
হামিদ আড়চোখে সেতুর দিকে তাকালো। এক হাতে কাঁধের ব্যাগ, অন্য হাতে শাড়ির প্যাকেটটা নিয়ে হামিদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
মার্কেট থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সায়মা সেতুর সামনেই হামিদকে জানালো হামিদ সায়মাকে পৌঁছে দিয়ে আসলে ভালো হবে। তাদের বাসায় যাওয়ার রাস্তাটা সন্ধ্যার পর নির্জন থাকে, অনেক সময় গাড়িও পাওয়া যায় না তাই সে ভয় পাচ্ছে। সেতু এবার চুপ না থেকে বললো, ” আপনাকে রিজার্ভ গাড়ি ঠিক করে দিলে তো হচ্ছে। বাসার সামনে নামিয়ে দিবে।”
হামিদ সেতুকে বললো, ” তোমাকে বড় বাজারে নামিয়ে দিয়ে পরিচিত রিকশা ঠিক করে দিলে যেতে পারবে না? সায়মার বাসা যেহেতু দূরে, গিয়ে দিয়ে আসি। আর বড় মামীকেও দেখে আসবো।”
” তাহলেও আমি যাবো। দীনা আপু সেদিন ফোন করে অনেকবার বলেছে যেতে।”
” রায়ানকে একা রেখে অতো সময় তুমি বাইরে থাকবে? মা ফোন করে বলেছে শুনোনি রায়ান ঘুম থেকে উঠে গেছে! ”
সায়মাকে বড় বাজার থেকে রিকশা ঠিক করে দিয়ে সায়মার সাথে গেল হামিদ।
সেতু দীনাকে পরপর দুইবার ফোন করার পর তৃতীয়বারে দেখতে পেল দীনা। সেতুর কল দেখে হাসলো দীনা। মনে মনে বললো বোকা মেয়ে। রিসিভ করার সাথে সাথে সেতু বললো, ” তোমাকে সন্ধ্যা থেকে কতবার কল করেছি! তুমি কোথায় ছিলে?”
” ফোন চার্জে ছিল তাই দেখতে পাইনি রে। ”
” অহ্ আচ্ছা, ” বলে সেতু ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে সরাসরি হামিদের কথা জিজ্ঞেস করলো।
” আপু, উনি তোমাদের বাসায় কখন গেছে আর এখন কোথায়? ”
” ও তো সন্ধ্যায় এসেছে। মায়ের সাথে তখন থেকে গল্প করতে বসেছে,এখনও গল্পই করছে।”
দীনা সোফায় বসা হামিদ আর সায়মার দিকে তাকালো। দীনা সহ সায়মার বাসাতেই বসে কথা বলছিল এতক্ষণ। আসার পর দীনার মায়ের সাথে কথা বলে সায়মা হামিদকে তাদের ফ্ল্যাটে নিয়ে গেছে। সায়মার মা খাবারের আয়োজনও করে ফেলেছে হামিদের জন্য। দীনা’ই সায়মার সাথে হামিদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সায়মাকে হামিদের অফিসে চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে বলেছিল।
” আর কেউ নেই? “সেতু জিজ্ঞেস করলো।
” আর কে থাকবে! আমি আছি।”
” আপু, সায়মার সাথে হামিদের সম্পর্ক আছে। আমি জানতে পেরেছি আপু,” ফিসফিস করে বলতে বলতে কেঁদে দিলো সেতু।
দীনা অবাক হলো। সেতুকে কীভাবে জানলো এসব।
” কে বলেছে তোমাকে?”
” তারা সবসময় এখানে সেখানে ঘুরতে যায়, আমার অগোচরে ফোনে কথা বলে। এমন আরও অনেক কিছু আমার নজরে এসেছে আপু। এভাবে থাকতে পারবো না আমি। উনাকে আমি এতো ভালোবাসি, তাও উনি অন্য মেয়ের সাথে… আমি বাঁচতে পারবো না আপু এভাবে। উনি আমাকে ঠকাচ্ছে। আজকেই কথা বলবো হামিদের সাথে। উনি আর রায়ান-ইতো আমার দুনিয়া। ”
সেতুর কাঁদো গলায় বলা কথাগুলো শুনে রাগ হলো দীনার।
” এই হচ্ছে তোমাদের স্বভাব। শুনো তুমি হামিদকে এই সম্পর্কে কোনো কিছুই জিজ্ঞেস করবে না। এভাবে সন্দেহ করা ঠিক না। তুমি যে ওকে সন্দেহ করছো সেটাও ওকে বুঝতে দিবে না। ”
” সন্দেহ করছি না। ওদের সত্যি সত্যিই সম্পর্ক আছে। আমার বড় আপা ছবি পাঠিয়েছে রেস্টুরেন্টে ওদের একসাথে দেখে। আজ উনি আসলেই আমি কথা বলবো। তোমাকে ফোন করবো তখন, শুনে নিও।”
” আস্ত পাগল মেয়ে তো! তোমার বড় আপা এক নাম্বারের কুটনি মহিলা। আমি প্রথমেই বুঝেছি। রাখো এখন, কালকে ফোন করবো তোমাকে।”
একমাত্র দীনাকেই আপন মনে করে মনের সব কথা বলতো সেতু। দীনাও সেতুকে খুব পছন্দ করে বলে জানতো। আজ মনে হচ্ছে সে ভুল জানতো। দীনার মাধ্যমেই তো হামিদের সাথে সায়মার পরিচয় হয়েছে। সায়মার চাকরির জন্য সুপারিশ করতেও বলেছে। সব দোষ দীনার মনে হচ্ছে।
দীনা কল কেটে সামনের রুমে গিয়ে সায়মার পাশে বসলো। হামিদ জিজ্ঞেস করলো, ” কী রে! কে ফোন করেছে?”
দীনা হেসে বললো, ” আমার এক বন্ধু। ভাইয়া চলে এসেছে বোধহয়। আওয়াজ শুনলাম। যাওয়ার আগে দেখা করে যেও।”
” এসেছে? তাহলে যাই দেখা করে আসি।” হামিদ দাঁড়ালো।
” আরে এখন যেও না। খেয়ে তারপর যাও। তোমাদের কথা শুরু হলে আবার শেষ হবে না।” সায়মার সাথে দীনাও হ্যা মিলালো।
চলবে…..