#শেষ বিকালের আলো
#পর্ব-০৬
#নিশাত_আনজুম
বাবা-মায়ের যে আজ বিবাহবার্ষিকী সেটা ছেলেদের কারোরই জানা নেই। সেদিন কথায় কথায় শ্বশুরের কাছ থেকে সেতু তা জানতে পেরে মনে মনে ঠিক করে রাখে কিছু একটা করবে এই দিনে। সে দুপুরের জন্য স্পেশাল খাবারের আয়োজনে বৌয়া ভাত আর ২১ পদের ভর্তা আর ডিম ভাজি করলো। সেতুর সাথে আদিবাও যতটুকু পারে হেল্প করেছে। সেও সেতুর থেকে রান্না শিখতে চায়। দুপুরে তিন ভাইকে জরুরি ভিত্তিতে অফিস থেকে ডেকে আনা হলো। খাবার টেবিলে আয়োজন দেখে দুই বউ ছাড়া অন্যরা বেশ অবাক হলো। যাদের জন্য এই আয়োজন তারাও ধরতে পারলেন না। রুবিনা তো বলে ফেললেন, ” তোমার অডার বাদ পড়ে গেছেনি? এইজন্য এইগুলা আমাদের খাওয়াইয়া শেষ করাইতেছো!”
সেতু আর আদিবা জবাব না দিয়ে হাসলো কেবল। তবে রুবিনা, ইকরাম খুব খুশি হলেন। পছন্দের খাবার বলে কথা। খাওয়া শেষ হলে আদিবা সেতুর বানানো কেক নিয়ে আসলো। কেকের ওপর লেখা দেখেই তিন ভাইয় বিস্ময়ে একে অপরের দিকে তাকালো। ইকরাম হেসে উঠলেন, ” আজ আমাদের নাতির জন্মদিন আগে বলবা না! কিছু তো কিনি নাই ওর জন্য। ”
আদিবা হেসে উঠলো আওয়াজ করে।
” বাবা, আজকে আপনাদের বিবাহ বার্ষিকী। ”
” আজ ১৪তারিখ! আমার তো মনেই নাই। কী গো, তোমার মনে আছে?” রুবিনার দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করলেন ইকরাম।
সেতু বললো, ” বাবা, কেক কাটা শেষ হলে আপনারা তৈরি হয়ে নিন। আপনাদের দুজনকে একটা জায়গায় পাঠাবো। একটু সময় কাটিয়ে আসবেন।”
রুবিনা সেতুকে বললেন, ” লাই পাইয়া মাথায় উইঠা যেইটা ইচ্ছা করতেছে সেইটাই করতেছো দেখি। আমাগো বুড়া পাইয়া যা মন চায় তা করবা! ”
ইকরাম কেক থেকে গোলাপ ফুলটা নিয়ে রুবিনার মুখে ঠেলে দিয়ে বললেন, ” আহা! রাগ করো কেন? কেক খাও। তোমারে গোলাপ ফুলটা দিছি খাইতে।”
রুবিনা আগুন চোখে তাকালো স্বামীর দিকে। দুজনকে রেখে সবাই সরে গেল সেখান থেকে।
রুমে গিয়ে হামিদ সেতুকে বললো, ” তুমি আমাকে আগে বলোনি কেন বাবা-মায়ের বিবাহবার্ষিকী আজ? সব আয়োজন নিজে করলে।”
” ওমা আমি কেন বলবো? তাঁদের বিবাহবার্ষিকী কখন সেটা আপনাদের জানা উচিত। আপনারা বলবেন আমাদের। ”
” না মানে তাঁরা তো কখনো বলেনি তাই….”
সেতু কিছু না বলে বিছানা ঠিক করতে লাগলো। হামিদ কী আশা করছে তাঁরা নিজ থেকে ছেলেদের বলবে যে এই তারিখ আমাদের বিবাহবার্ষিকী! হামিদ আবার জিজ্ঞেস করলো, ” বাবা-মাকে কোথায় পাঠাবে বলছিলে? এসব করার কী দরকার শুধু শুধু? বয়স হয়েছে তাদের।”
” বয়স হলে ঘরে বসে থাকতে হবে এমন কোনো নিয়ম আছে বলে তো মনে হয় না আমার। স্বামী -স্ত্রী তারা। তাঁদেরও ইচ্ছে হয় কোথাও গিয়ে একটু সময় কাটাতে।”
হামিদ আর কিছু বললো না আর। সত্যিই তো প্রত্যেক স্বামী-স্ত্রীর ইচ্ছে করে কোথাও গিয়ে নিজেদের মতো সময় কাটাতে। সবাই তো আর তার মতো বাইরের মেয়ের সাথে সময় কাটায় না যে বউয়ের সাথে সময় কাটানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে না।
ঠান্ডা আবহাওয়ায় হামিদের দুপুরে আরামের ঘুম হলো। বিকালে ঘুম ভাঙলে পাশ ফিরতেই চোখ গেল সেতুর দিকে। সেতু ড্রেসিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে কী যেন করছে। সেতু শাড়ি পরেছে আজ। হামিদ উঠে চোখ ডলে জিজ্ঞেস করলো, ” কোথায় যাচ্ছো তুমি সেজেগুজে? ”
সেতু স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলো, ” কোথাও যাচ্ছি না তো! আর কই সেজেছি?”
” এই যে শাড়ি পরে চুল খোলা রেখে মেকআপ করেছো। তোমার মুখ দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে। ”
“শুধু শাড়ি পরেছি হঠাৎ ইচ্ছে হলো বলে। সাজগোজ করবো কেন ঘরে! সবসময় যেরকম থাকি সেরকমই তো আছি।”
” অহ্ আচ্ছা। না তোমার চুল আর মুখটা কেমন যেন লাগছে। ” হামিদ কথাটা বলে মাথা নামিয়ে নিল। সেতুকে যে আজ সুন্দর লাগছে সেটা বলতে কেন যেন সংকোচ বোধ করলো হামিদ। হয়তো কখনো বলেনি বলে। কিন্তু হঠাৎ করে সেতুকে তার অন্যরকম লাগবে কেন? সেতু ফর্সা হলেও আজ মুখটা উজ্জ্বল লাগছে আর চুলগুলোও স্ট্রেইট। তাহলে এতোদিন কি তার চোখে পড়েনি! কেন? বাইরের মেয়ের দিকে নজর ছিল বলে!
পাশের বাসার এক ভাবীর পার্লার আছে। সেতু সেই ভাবীর কাছে গিয়ে ফেসিয়াল আর চুল স্ট্রেইট করে এসেছে। হামিদকে সে চাইলেই বলতে পারতো। ইচ্ছে করেই বলেনি। সেতু বারান্দায় গিয়ে হাত বাড়িয়ে বাইরের বৃষ্টি ছোঁয়ার চেষ্টা করলো। হামিদ বিছানায় বসেই এক দৃষ্টিতে সেতুর দিকে চেয়ে রইলো। সেতু হাত বাইরে দিয়ে বৃষ্টির পানিতে মুঠো ভর্তি করছে, আবার ফেলছে, আবার মুঠো ভর্তি করছে। একটু পর এক হাত দিয়ে পেছন থেকে চুলগুলো সামনের দিকে নিয়ে গেল। বড় গলার ব্লাউজ হওয়ায় পিঠের অর্ধেক অনাবৃত। নীল জরজেট শাড়িটা আঁকড়ে ধরেছে যেন সেতুর শরীরটাকে। হামিদের হঠাৎ কেমন যেন লাগছে সে নিজেই বুঝতে পারছে না। নিজের বউকে দেখতে এতো সংকোচ কেন? ধীর পায়ে হেঁটে বারান্দায় সেতুর কাছ থেকে দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। সেতু হামিদের উপস্থিতি বুঝেও দৃষ্টিপাত করলো না সেদিকে। হামিদ থেমে থেমে বললো, “সেতু, এক কাপ চা হবে? ”
” দাঁড়ান আনছি,” বলে সেতু চলে যাচ্ছিল। হামিদ পেছন থেকে গলা উঁচিয়ে বলে উঠলো, ” দুই কাপ নিয়ে এসো।”
কিছুক্ষণ পর সেতু দুই কাপ চা এনে হামিদের হাতে দিয়ে চলে গেল। হামিদ দুই হাতে দুই কাপ নিয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। আশ্চর্য সে কী তার জন্য আনতে বলেছে দুই কাপ! দুই কাপ চা খাবে!
ঘরে ভালো লাগছে না তার। বৃষ্টির মধ্যেও সে বেরিয়ে গেল। এলো রাত দশটার পরে। এসে দেখে সেতু বাবুকে ঘুম পাড়াচ্ছে। হামিদ যে এতো সময় বাইরে কোথায় ছিল সেটা নিয়ে নির্বিকার সেতু। হামিদ যখন ভাত বাড়তে বললো তখন সেতু জানালো সে খেয়ে নিয়েছে। হামিদের খাবার টেবিলে রাখা আছে। সে যেন খেয়ে নেয়। খেতে বসে একা খাওয়া হলো না হামিদের। নিজেকে কেমন অসহায় অসহায় লাগছে। সেতু তো জানে হামিদ একা খেতে পারে না। সেতু এমন করছে কেন? কী হলো তার!
রুমে যাওয়ার পর দুজনের মধ্যে কোনো কথা হলো না। হামিদ অন্ধকারে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে হঠাৎ বুঝতে পারলো সেতু উঠছে। হয়তো ওয়াশরুমে গেছে। অনেকক্ষণ পরও যখন সেতু আসলো না হামিদ দেখলো সেতু নেই সেখানে। রুম থেকে বেরিয়ে পাশের রুম আলো দেখে সেদিকে গেল। দরজা ঠেলে সে অবাক হলো। সেতু বড়ো ক্যানভাসে কিছু একটা আঁকছে। ফ্লোরে নীল শাড়ির আঁচল বিছানো, খোলা চুলগুলো মৃদু বাতাসে উড়ছে। পেছন থেকে সিনেমার অভিনেত্রীর থেকে কম লাগছে না। হামিদের মনে হলো নিজের বউকে সে লুকিয়ে দেখছে কেন? সেতুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” কার ছবি আঁকছো তুমি এতো রাতে?”
” আপনি ঘুমাননি? “সেতু পাল্টা প্রশ্ন করলো।
” না। কয়েকদিন ধরে ঘুম হচ্ছে না। কেন কে জানে!” বলার পর মনে পড়লো সে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মরার মতো ঘুমিয়েছে।
সেতু শুধু ‘ অহ্’ বলে ছবি আঁকায় মন দিলো।
” কার ছবি এটা?”
সেতু হাতের মোবাইলটা হামিদের দিকে এগিয়ে দেখালো,”এই যে। মেজো ভাইয়া আর আদিবার ছবি। আদিবা বললো তাদের ছবিটা স্ক্যাচ করে দিতে। রুমে নাকি সাজিয়ে রাখবে।”
” এরকম একটা আমাদের রুমে রাখলে মন্দ হয় না।”
” ওদের ছবি আমাদের রুমে রাখবো?” সেতু যেন বুঝেনি এমন ভাব করলো।
“আরে না, না। ওদের ছবি কেন রাখবো! আমাদের তিনজনের ছবির কথা বলছি। রাখলে সুন্দর দেখাতো আর কী।”
” অহ্। কিন্তু আমি তো ছবি না দেখে আঁকতে পারি না।”
” আমাদের ছবি আছে তো। সেদিন যে তুললো!”
” আরে, ঐগুলা কোনো ছবি নাকি। আদিবা ছবিতে আপনাকে দেখে অনেক হাসাহাসি করেছে। আপনাকে নাকি পাশের বাড়ির ভুড়ি মকবুলের মতো লাগছে। ” কথাটা বলেই সেতু হাসলো কিছুক্ষণ।
আর হামিদের হাত আপনাআপনি নিজের ভুড়িতে চলে গেল। এলাকায় মকবুল দুইজন হয়ে যাওয়ায় গুলিয়ে যায়। তাই পাশের বাড়ির মকবুলের বিশাল ভুড়ির জন্য তাকে ভুড়ি মকবুল নামে ডাকে। হামিদকে সত্যি সত্যি ভুড়ি মকবুলের মতো লাগে! সেতুর হাসি দেখে সে অপমানিত বোধ করলো। প্রচন্ড রেগে সেতুকে কিছু বলতে ইচ্ছে করলেও বললো না। রাগ চেপে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। হামিদকে জব্দ করতে পেরে সেতুর মনটা ভালো হয়ে গেল।
চলবে…