#শেষ বিকালের আলো
#শেষ_পর্ব
#নিশাত_আনজুম
অ্যাকসিডেন্টে হামিদের খুব বড় ক্ষতি হয়নি। তবে রিকশাওয়ালার খুব লেগেছে। হামিদের শরীরের কিছু কিছু জায়গায় ছিঁড়ে গেছে আর ডান হাত ও বাম পায়ের হাড় ভেঙ্গেছে। সেখানে প্লাস্টার লাগিয়ে কিছুদিন বেড রেস্টে থাকতে বলেছে ডাক্তার। হামিদ আপাতত বেড রেস্টে আছে। হাঁটতে না পারায় সেতু সবকিছু টাইম টু টাইম বিছানায় এনে হাজির করে। সেতুর যত্নে প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছে। হামিদকে খাওয়ানো, গা মুছে দেওয়া, ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়া সবকিছু সেতু একা হাতে সামলাচ্ছে। হামিদের মনে পড়ে গেল রায়ান সিজারে হওয়ার পর সেতু শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিল খুন। তখন হামিদ সেতুর পাশে থাকেনি। সে নিজের মতোই থেকেছে উলটো সেতুর কাজকারবারে বিরক্ত হয়ে দুই চার কথা শুনিয়েছে। সেই সময় থেকে তাদের দূরত্বটা আরো বেড়েছে। হামিদ ভেবেছিল এবার সেতুর কাছাকাছি আসার সুযোগ পাবে। হামিদের কষ্টে সেতুরও কষ্ট হবে, কান্না আসবে, টেনশন হবে। তারপর আস্তে আস্তে দুজনের সম্পর্ক সুন্দর হয়ে উঠবে। কিন্তু সেসবের কিছুই হলো না। সেতু শক্ত মনে নীরবে হামিদের সেবা করছে। সেতুর সাথে এখন আর হামিদের তেমন কথা হয় না, গল্প করা হয় না। আগে হামিদ শুনতে না চাইলেও সেতু মনের মধ্যে কোনো কথা রাখতো না। সব হামিদকে শুনাতো। অদ্ভুত অদ্ভুত কথা আর পাগলামি। আগের সেতু আর এখনের সেতুর মধ্যে বিস্তর পার্থক্য।
সেতু হামিদকে এসে বললো, ” আজকে গোসল করে নিলে ভালো হবে। আপনাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাবো। আসুন।”
” মাকে ডেকে আনলে ভালো হতো না! একটু হেল্প করতো। তুমি পারবে?”
” মা নিজেই অসুস্থ শরীরে হাঁটতে পারে না। আমি পারবো।”
হামিদ সেতুর কাঁধে ভার রেখে ধীরে ধীরে ওয়াশরুমে গেল। হামিদকে বসানোর জন্য আগে থেকেই চেয়ার রেখেছে। হামিদকে সেখানে বসিয়ে সেতু হামিদের হাত পায়ের নখ কেটে দিচ্ছিল। হামিদ হঠাৎ বলে ফেললো, ” তোমাকে অনেক কষ্টে ফেলে দিয়েছি, তাই না?”
এর আগেও কয়েকবার সেতুকে ইনিয়েবিনিয়ে এই কথা বলেছে। সেতু স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো, ” এতো ফর্মালিটির কী আছে? এটা তো আমার দায়িত্ব। ”
হামিদের মনঃক্ষুণ্ন হলো। সেতু এসব দায়িত্ব থেকে করছে! ভালোবেসে করছে না। গোসল সেরে সেতু হামিদের দুপুরের খাবার এনে বিছানায় রেখে খেয়ে নিতে বলে চলে গেল। এতোদিন হাত নাড়তে পারতো না বিধায় সেতুর হাতে খেয়েছে। হামিদ খেল না। খাবারের প্লেটটা দূরে সরিয়ে রেখে শুয়ে পড়লো। সেতু কিছুক্ষণ পর এসে তা দেখে বললো, ” আপনি তো হাত নাড়াচাড়া করতে পারছেন। খাননি কেন এখনো? ঐদিকে আমার কতো কাজ পড়ে আছে। রায়ানকে গোসল করাতে হবে, নিজে করতে হবে।”
” খেতে ইচ্ছে করছিল না তাই খাইনি। নিয়ে যাও।” হামিদ চোখ বন্ধ করে জবাব দিলো।
” সেটা বললে তো হবে না। খেয়েদেয়ে সুস্থসবল হতে হবে। এভাবে আর কতদিন পড়ে থাকবেন? হাঁটার চেষ্টা করতে হবে। ডাক্তার বলেছে কিছুক্ষণ কিছুক্ষণ হাঁটতে।” বলতে বলতে সেতু হামিদকে খাইয়ে দিলো।
রাতে হামিদ রায়ানকে বিছানায় দেয়ালের দিকে রেখে সেতুর জন্য মধ্যে জায়গা রেখে সেও অপর পাশে শুয়ে পড়লো সেতু আসার আগে আগে। শুতে এসে সেতু রায়ানকে মধ্যখানে নিয়ে আসলে হামিদ মিনমিন করে বললো, ” বাবুকে ঐ পাশে রাখো। বাবুর জন্য আমার এদিক-ওদিক ফিরতে কষ্ট হয়।”
এমন কিছুই হয় না। রায়ান সবসময় মায়ের বুকের কাছে ঘুমায়। তাই বিছানায় হামিদের পাশে অনেকখানি জায়গা থেকে যায়। সেতুর পাশে শোয়ার জন্য হামিদ এ কথা বলেছে। হামিদের কথা শুনে সেতু উঠে ফ্লোরে একটা বেড বিছিয়ে সেখানে রায়ানকে নিয়ে শুয়ে পড়লো। হামিদ হতাশ হলো।
.
.
হামিদ এখন অনেকটাই সুস্থ। হাঁটা-চলা করতে পারে মোটামুটি। সারাদিন ঘরেই কাটায়। সেদিনের ঘটনার পরের দিন অফিসের বস তাকে ফোন করে ডেকেছিল। হামিদের অ্যাকসিডেন্টের কথা শুনে ফোনে জানালেন সায়মা নাকি নিজের দোষ স্বীকার করেছে। সেদিন সায়মার কথা বিশ্বাস করে অপমান করার জন্য বস অনুতপ্ত হলেন এবং হামিদকে সুস্থ হলে অফিসে জয়েন করতে বলেছেন। হামিদ তখনই না করে দেয়। যেখানে সত্যিটা তাকে বলার সুযোগ না দিয়ে আরেকজনের মিথ্যে অভিযোগের ভিত্তিতে সবার চোখে তার চরিত্রে দাগ লাগিয়েছে, সবার সামনে ছোট হয়েছে সেটা তো আর ভুলবার নয়। এখন যতই প্রমাণিত হোক সে নির্দোষ তাও সেখানে চাকরি করার রুচি চলে গেছে হামিদের। বাসায় সে এসব কিছু জানায়নি। বলেছে এমনিতেই ভালো লাগছে না বলে চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে।
সকালে হামিদ দেখলো সেতু কোথাও যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। হামিদ জিজ্ঞেস করলো, ” কোথায় যাচ্ছো?”
” রিমার শ্বশুরবাড়িতে। রিমার শাশুড়ি দাওয়াত দিলো না সেদিন!”
” মা তো বলে দিয়েছিল তুমি যেতে পারবে না।”
” মায়ের অনুমতি নিয়েই যাচ্ছি। আপনি তো এখন সুস্থ। হাঁটা-চলা করছেনই। তাও আমি সব গুছিয়ে রেখে যাবো।”
হামিদ কিছু না বলে চুপচাপ সেতুকে দেখছে। সেতু একটা সবুজ শাড়ি পরেছে। এখন হিজাব বাঁধবে। দেখতে দেখতে হামিদ হঠাৎ বললো, ” তুমি শুকিয়ে গেছো আগের চাইতে।”
” সত্যিই শুকিয়েছি! সবুজ ভাইও বললো সেদিন। কিন্তু আমার তো লাগছে না। ” বলে সেতু আয়নার সামনে গিয়ে কোমরে হাত রেখে এদিক থেকে ওদিক ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলো নিজেকে।
” আর কী বলেছে সবুজ?”
” বলেছে আমাকে নাকি চিকন-মোটা দুই ভাবেই সুন্দর লাগে।”
হামিদ মনে মনে বললো, ” আসলেই সুন্দর লাগে। আমার দেখার চোখ সুন্দর ছিল না তাই চোখে পড়েনি এতোদিন। ”
সেতু সেদিন রিমার শ্বশুরবাড়ি থেকে সোজা নিজের বাড়িতে চলে গেছে। হামিদ রাতে মায়ের কাছ থেকে শুনলো সেটা। কিছুদিন নাকি থাকবে সেখানে। হামিদ ফোন করে বললো, ” বাবুকে মিস করছি সেতু। কাল সকালে চলে এসো।”
ঐপাশ থেকে সেতু বললো, ” বাবু তো তার বাবাকে মিস করছে না। বাবার সাথে তো তার তেমন ভাব নেই যে মিস করবে।”
হামিদের মন খারাপ হলো সেতুর সরাসরি জবাবে।
” কখন আসবে?” আবার জিজ্ঞেস করলো।
” সেটা বলতে পারছি না। হয়তো না-ও যেতে পারি আর। আচ্ছা রাখছি। বাবু কাঁদে।” ব্যস্ততা দেখিয়ে কল কেটে দিলো। হামিদ থম মেরে বসে রইলো অনেকক্ষণ। সেতু কী বললো এটা!
হামিদ সিদ্ধান্ত নিলো সেতুর কাছে ক্ষমা চাইবে সে। তার এতো সুন্দর সংসারটা ভাঙতে দিবে না। তাদের দূরত্বটা মেটানো খুবই জরুরি। সেতুকে এভাবে হারাতে পারবে না সে। সেতু ছাড়া অচল সে। এটা বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে গেল। তার মধ্যে কোন শয়তান যে ভর করেছে কে জানে! আল্লাহর কাছে বারবার ক্ষমা চাইলো নিজের করা ভুলের জন্য। সেই সাথে আল্লাহকে ধন্যবাদও জানালো তাকে হেদায়েত দেওয়ার জন্য।
.
.
হামিদ সি.আর.বি তে গিয়ে দেখলো সেতু সেই গাছটার নিচে বসে অপেক্ষা করছে যেখানে তারা বিয়ের আগে দেখা করতো। হামিদ গিয়েই জিজ্ঞেস করলো, ” আমি কী বেশি দেরিতে এসেছি? ”
সেতু হামিদের কথায় তার দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার সামনের দিকে চোখ রাখলো। উত্তর দিলো, ” না। একটু আগেই এসেছি আমি।”
” রায়ানকে আনলে না যে?”
” ও ঘুমাচ্ছে তাই।”
“অহ্। আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো ? ”
“না।”
” আচ্ছা। কী খাবে তুমি? ”
সেতু বিরক্ত গলায় বললো, ” এমন আচরণ করছেন যেন আমরা বিয়ের আগের প্রেমিক-প্রেমিকা দেখা করতে এসেছি। ”
হামিদ এবার মিইয়ে গেল। সেতু জিজ্ঞেস করলো, ” কী এমন কথা বলবেন যে এখানে ডেকেছেন?”
” তুমি তো বাসায় যাচ্ছো না তাই এখানে ডেকেছি।”
” তো আমাদের বাসায় গেলেই পারতেন।”
” সেখানে এই কথাগুলো বলার সুযোগ নেই তাই।”
“আচ্ছা। কী বলবেন শুনি!”
হামিদ তখনই কিছু বললো না। মনে মনে কথা গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো।
” সেতু চাকরিটা আমি এমনি এমনি ছেড়ে দেয়নি।”
” তাহলে?”
হামিদ ধীরে ধীরে সেদিনের ঘটনাটা বললো। তবে সায়মার সাথে তার সম্পর্কটা গোপন রাখলো। সব বলার পরও যখন সেতু নিশ্চুপ রইলো তখন হামিদ জিজ্ঞেস করলো, ” সেতু, তুমি কী বিশ্বাস করো আমি এমন করতে পারি?”
” উহুম। আপনাকে আমি অনেক দিন ধরে চিনি। আপনাকে বিশ্বাস করেই তো মাত্র তিন মাসের পরিচয়ে সারাজীবন থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঘরে বউ বাচ্চা রেখে অন্য মেয়ের দিকে আকৃষ্ট হবে এমন পুরুষ নয় আমার স্বামী। আপনার উপর আমার পুরো বিশ্বাস আছে।”
হামিদের বুক কেঁপে উঠলো। সেতুর এতো বিশ্বাস হামিদের উপর আর সে কী করেছে! ঘৃণা হচ্ছে নিজের উপর। হামিদ ফাঁকা ঢোক গিললো।
“আচ্ছা। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এসব নিয়ে কষ্ট পাওয়ার দরকার নেই। আপনি কী সেটা জানাতে এখানে ডেকেছেন আমাকে?”
হামিদ সেটার উত্তর না দিয়ে হুট করে সেতুর পায়ের কাছে বসে পড়লো।
” আরে আপনি এখানে বসছেন কেন? মানুষজন দেখলে কী বলবে? উঠুন।” সেতু এদিক ওদিক তাকালো।
হামিদ সে কথার পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো করে বললো, ” সেতু, আমি কথাগুলো না বলে শান্তি পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে তুমি হারিয়ে যাচ্ছো আমার জীবন থেকে। সেতু, আমাকে ক্ষমা করে দাও। অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাকে। একটুও বুঝার চেষ্টা করিনি। আমার আচরণে অনেক কষ্ট পেয়েছো তুমি। অনেক অবহেলা করেছি তোমাকে।”
” আমি তো বলিনি যে আপনার আচরণে কষ্ট পেয়েছি। আমারই বুঝা উচিত ছিল সবারই নিজস্ব একটা জগৎ আছে। আমিই হয়তো অতিরিক্ত করে ফেলেছিলাম। এখন বুঝতে পেরেছি। আমাদের যে যার মতো থাকাই ভালো। আপনাকে নিয়ে আমি কোনো অভিযোগ করিনি কখনো, করবোও না।” কথাগুলো বলার সময় সেতুর গলা ধরে এলো।
হামিদ সেতুর দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, ” এসব তুমি অভিমান করে বলছো জানি। আমার উপর যে তোমার পাহাড়সম অভিমান সেটা তোমার চোখ দেখে আমি বুঝতে পারি। আগে সেটা বুঝার চেষ্টা করিনি আমি। কিন্তু বিশ্বাস করো আমাকে এখন থেকে সেভাবেই পাবে যেভাবে তুমি আশা করো। আমি শুধু আমার সেই আগের সেতুকে চাই। তাকে খুব মিস করছি। আমি একটুও ভালো নেই। তুমি আমাকে একটা সুযোগ দাও। আমি খুব বড় একটা ভুল করে ফেলেছি। সেই ভুলটা শুধরেও নিয়েছি। আমি কথা দিচ্ছি আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো স্বামী, ভালো বাবা হয়ে দেখাবো।”
সেতুর অনেকদিনের জমিয়ে রাখা কান্না গড়িয়ে পড়লো। অন্যদিকে ফিরে সেই কান্না মুছে হাসার চেষ্টা করলো।
” আচ্ছা হয়েছে। আপনার উপর আমার কোনো রাগ,অভিমান নেই। এবার উঠুন। মানুষজন দেখছে বারবার এদিকে। ” সেতু হাতটা সরানোর চেষ্টা করলো।
হামিদ উঠলো না। হাতটাও ছাড়লো না। ঐভাবেই বললো, ” এটা তোমার মনের কথা না। আমি তোমার মনের কথা বুঝি। আগে আমাকে ক্ষমা করে দাও আর কথা দাও আগের সেতুকে ফিরিয়ে দেবে।”
” আচ্ছা আপনি যেই দোষ করেছেন, ভুল করেছেন সেগুলো ক্ষমা করে দিয়েছি। এবার উঠুন। ”
হামিদ সেতুর হাতের উলটো পাশে চুমু খেয়ে উঠে বললো, ” তুমি বসো। আমি পানি নিয়ে আসছি। পানির পিপাসা পেয়েছে আমার। ”
হামিদের শেষ কথা শুনে হেসে উঠলো সেতু। হামিদ যাওয়ার পর দীনাকে ফোন করলো সে।
” আপু, হামিদ ওর ভুল স্বীকার করেছে র আমার কাছে ক্ষমাও চেয়েছে।”
” সায়মার বিষয়টা নিয়ে কিছু বলেছো তুমি? ”
” না বলিনি। আমি যে ঐ বিষয়টা জানি সেটাও বুঝতে দেইনি। উনিও ঐ বিষয়টা এড়িয়ে গেছেন।” দীনাই নিষেধ করেছিল হামিদ আর সায়মার সম্পর্কের কথা যে সেতুর জানা সেটা হামিদকে না বলতে। সেতু যদি এ নিয়ে হামিদের সাথে ঝগড়াঝাটি করতো তাহলে হয়তো বিপরীতটা হতো। হামিদ ঐ সময় হয়তো সেতুর কাছে ক্ষমা চাইতো। কিন্তু আড়ালে সায়মার সাথে সম্পর্কটা চালিয়ে যেতো। নয়তো দেখা যেতো হামিদের ভয় ভেঙে গেছে। যে কাজটা সপ সেতুর কাছ থেকে লুকিয়ে করছে সেটা সরাসরি করছে। সেতুর সামনেই সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। তাই সেতুর তখন ঐ কাজটা করার আগে হামিদকে সেতুর জায়গাটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার ছিল। সেতুও যে কোনো অংশে কম নয়, হামিদকে ছাড়াও সেতু দিব্যি সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে সেটা হামিদের জানা দরকার।
দীনা ওপাশ থেকে বললো, ” ও নিজের কৃতকর্মে অনুতপ্ত। ওতো আর জানে না যে তুমি জানো সেটা। ও বুঝতে পেরেছে ঐ বিষয়টা জানলে তুমি কতোটা কষ্ট পাবে তাই বলেনি।”
” হুম। আমি সারাজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো আপু। তুমি আমার পাশে না থাকলে আমার সংসারটা যে আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো!”
” উহুম। তুমি তোমার নিজের মনোবলের জন্য ওকে ফিরে পেয়েছো।”
” তুমি পরামর্শ না দিলে তো এতদিনে আমার সংসারটা থাকতো না।”
” আচ্ছা। এসব এখন বাদ। বোন যখন ডেকেছো পাশে তো থাকতেই হবে। এখন পুরনো কথা ভুলে সুখে শান্তিতে সংসার করো। ভালোবাসায় ভরে উঠুক তোমাদের সংসার।”
” এতো ভালো তুমি। তোমার সংসারটা কেন হলো না! তোমারও সুন্দর একটা সংসার হোক। আমি সবসময় দোয়া করবো। একদম মন থেকে। ”
দীনা ওপাশ থেকে হেসে উঠে বললো, ” আচ্ছা, রাখি। পরে কথা হবে।”
দীনার উপকার সেতু কোনোদিনও ভুলবে না। সেতুর জন্যই তার সংসারটা তার আছে এখনো। নয়তো সেতু সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল হামিদের সাথে থাকবে না বলে। মাকে ফোন করে কেঁদে কেঁদে বলেছেও সে ঐ সংসারে থাকতে চায় না। সেদিন দীনার সাথে ফোনে কথা হওয়ার আগ পর্যন্ত সে দীনাকে দোষী ভেবেছিল। পরে দীনাই তাকে বুঝিয়েছিল সংসার ভাঙা একটা মেয়ের জন্য কতখানি কষ্টের। সেতুর মা-বোন হয়তো সেতুর পাশে ছিলো, তাও কী তার বাকি জীবনটা সুখের হতো! একটা ডিভোর্সি মেয়ের জীবন যে অভিশাপের! তার উপর একটা বাচ্চা আছে। রায়ানের জীবনটা যে শেষ হয়ে যেতো, সেতুর জীবনটাও। যেমন দীনার জীবনটা হয়েছে। হ্যা। দীনা ডিভোর্সি। তারও সংসার ছিল। সংসারে স্বামীর সাথে টুকটাক কথা কাটাকাটি থেকে ঝগড়া শুরু হতো। একসময় জীবনটা নরক হয়ে উঠলো। তার মা-ভাবীও পাশে ছিল। একসময় তাদের কথায় দীনা ঐ সংসার ছাড়ালো। এখনও তার জীবনটা নরকই আছে। এখন আবার তার উপর তকমা লেগেছে ডিভোর্সি। দীনার মা-ভাবী এখন তাদের স্বার্থে পছন্দ মতো দীনাকে বিয়ে দিতে চায়। সুবিধা করতে না পারায় দীনাকেও ছেড়ে কথা বলে না। দীনার আগের সংসার নিয়ে কথা বলে, তাকে দোষী করে। সেতুর জীবনটাও হয়তো তেমনই হতো। তার মা -বোনও সেতুর এই সংসার নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তারা সেতুকে আরও উচ্চ ঘরে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। তাদের কাছে সংসারে সুখ মানেই অঢেল টাকা পয়সা।
ভাগ্যে থাকলে হয়তো সেতুর নতুন সংসার হতো, ভালোই থাকতো। তখন নিজের সুখের জন্য সন্তান যে সুখহারা হতো!
হামিদ পানির বোতল আর হাওয়ায় মিঠাই নিয়ে আসছে। দূর থেকে হামিদকে দেখে সেতু উঠে সেদিকে গেল। হামিদ কিছু না বলে মিষ্টি হেসে সেতুকে হাওয়ায় মিঠাই দিলো। তারপর দুজনেই পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। হঠাৎ হামিদ সেতুর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললো, ” তুমি বলেছিলে না বিয়ের পর আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার এই জায়গাটায় প্রতি সপ্তাহে আসবে! এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে এখানে আসবো আমরা। রায়ানও থাকবে আমাদের সাথে। তিনজন একসাথে শেষ বিকালের আলো দেখবো। তোমার সব ইচ্ছে, তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করার চেষ্টা করবো আমি।”
সেতু হাসলো। মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করলো তার সংসারটা রক্ষার জন্য, স্বামীকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। সেই সাথে দীনাকেও ধন্যবাদ জানালো। মনে মনে বললো, ” তোমার এলোমেলো জীবনটা গুছিয়ে দিক আল্লাহ্। তোমার জীবনে কেউ আসুক।”
সমাপ্ত
______________