শেষ পর্বের শুরু পর্ব – ৭

0
731

গল্প: শেষ পর্বের শুরু (সপ্তম পর্ব)
__ ✍️ নীলিমা নওরীন মেঘলা

রাত প্রায় দ্বি-প্রহরে ঘুমটা ভেঙে গেল। এই শীতেও দরদর করে ঘাম ঝরছে। নিজের শরীরের উঁটকো গন্ধে নিজেরই গা গুলিয়ে আসছে। তারমানে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম?
‘কেউ একজন ছুরি নিয়ে ধাওয়া করেছে আমার পেছনে। মুখটা ঠিক স্পষ্ট নয়, তবে কণ্ঠস্বরটা পরিচিত। যখনই মুখটা দেখতে যাবো, তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল।’
হঠাৎ এই রকম একটা স্বপ্ন দেখার কারণ ঠিক বুঝলাম না। হয়তো সারাদিন হাবিজাবি চিন্তা করার ফলেই মস্তিষ্কে চাপ পড়ে যাচ্ছে। যার ফলাফল স্বরূপ এসব উদ্ভট স্বপ্ন দেখা।

বিছানা ছেড়ে উঠে টেবিল থেকে যখনই পানির গ্লাসটা নিতে যাবো, তখনই কিছু একটার শব্দ এসে কানে লাগলো। এবারের শব্দটা অবশ্য খচখচ বা ঘন্টার ঢং ঢং শব্দের থেকে আলাদা। প্রবল বাতাসের বেগে পৃষ্ঠা বা কোনোকিছু উড়লে যেমন শব্দ হয়, ঠিক তেমন।

আমি সারা ঘরজুড়ে পায়চারি করছি আর শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করছি। মনে মনে ইমলির কথাও ভাবছি। যতবারই মাঝরাতে ঘুম ভেঙেছে ইমলির সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। আর আজ তো অমাবস্যার রাত। ইমলি নিশ্চয়ই এসে কোনো না কোনো ক্লু দিয়ে যাবে।

যে জায়গায় ইমলির ছবিটা ভেসে উঠেছিল সেই জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম একমুহূর্ত। কিন্তু ভূতূড়ে কোনোকিছুই চোখে পড়লো না। তবে বাতাস ছাড়াই আধময়লা ক্যালেন্ডারটা আগের নিয়মে দুলতে শুরু করেছে, পৃষ্ঠাগুলো উড়ছে।
এই প্রথম অদ্ভুত একটা জিনিস চোখে বাধলো। ক্যালেন্ডারের একেকটা পৃষ্ঠায় লাল, কালো বিভিন্ন কালি দিয়ে গোল করা। সচারাচর বিশেষ দিনগুলো আমরা এইভাবে ক্যালেন্ডারে মার্ক করে রাখি। এই ক্যালেন্ডারে এইভাবে মার্ক করার কারণ কী? আর কে-ই বা করলো এই কাজ? হামিদ সাহেব?
.
প্রায় দুই ঘন্টা অপেক্ষার পরেও অস্বাভাবিক কিছুই নজরে এলো না। তাহলে ইমলি কি এবারেও আমাকে ধোঁকা দিলো?
নাহ, আর রাগ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। এইভাবে চলতে দেওয়া যায় না। মনে মনে ঠিক করে নিলাম, কালই ব্যাগপত্র গুছিয়ে এখান থেকে বিদায় হবো৷ কিন্তু তাতে কি আদৌ কোনো সমস্যার সমাধান হবে?
ইমলির আত্মা মুক্তি না পেলে তো এই অশান্তি থেকে আমারও নিস্তার নেই।

একপ্রকার বিরক্তি নিয়ে টেবিল লাগোয়া চেয়ারটা টেনে বসলাম।
নবগঙ্গার পাড়ে পাওয়া বোতলটা টেবিলের এক কোণে সেঁটে আছে এখনো। সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলাম। তারপর ডায়েরিটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করলাম।
হঠাৎ একটা পৃষ্ঠায় চোখ আটকে গেল। আমার লিখে রাখা পয়েন্টগুলোর নিচে আরেকটা পয়েন্ট জ্বলজ্বল করছে। লাল কালি দিয়ে একটা নাম লেখা ‘মিতু’।
এটাই কি তাহলে ইমলির সেই ক্লু?
তাই যদি হয় তাহলে এই মিতু মেয়েটা কে? এর সাথে ইমলি মৃত্যুর যোগসূত্রটাই বা কী? তাহলে কি ধরে নেবো এই আসল কালপ্রিট?

অনেক সিনেমাতে দেখেছি মৃত্যুর আগে ভিকটিম দেয়ালে খুনির নাম লিখে রেখে যায়। তারই ধারাবাহিকতায় তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়।
এই ক্ষেত্রেও যদি তাই হয়ে থাকে তবে একটা এঙ্গেলই মাথায় আসছে। তা হলো ত্রিকোণ প্রেমের সম্পর্ক। ইমলিকে পথ থেকে সরিয়ে নিজের রাস্তা পরিষ্কার করা।

পনেরো বছরের একটা মেয়ে কেনই বা প্রেম করতে যাবে? খেয়েদেয়ে কি কোনো কাজ নেই নাকি? অদ্ভুত!
অবশ্য সবাই তো আর আমার মতো না যে বছর পঁচিশে পা দিয়েও কিনা প্রেম বিহীন থাকে।
.

হামিদ সাহেবের ডাকে আমার ঘোর ভাঙলো। উনি আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতে বসতে বললেন, ‘এখনও জেগে আছো? কোনো সমস্যা?’

আমি আমতা-আমতা করে জবাব দিলাম, ‘না, কোনো সমস্যা না। এমনিই ঘুমটা ভেঙে গেল তাই বসে আছি।’

‘ওহ আচ্ছা।’

হামিদ সাহেবকে একবার মিতুর কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলাম না। থাক, পরে নাহয় জেনে নেওয়া যাবে।

ইতোমধ্যে ফজরের আজান দিয়ে দিয়েছে। হামিদ সাহেব উঠে ওজু করার জন্য কল ঘরের দিকে গেলেন। আজকাল নিয়ম করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। বিষয়টা বেশ ভালো লাগে।
.

নামাজ পড়ে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছি। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে হবে৷ তারপর ঠান্ডা মাথায় সবকিছু ভাবতে হবে। মিতুর খোঁজও করতে হবে। মেয়েটার সাথে দেখা হওয়ার আগে ঠিকঠাকভাবে কিছুই বলা যাচ্ছে না। হাশমত ব্যাপারির সাথেও দেখা করতে হবে। যদি কিছু সাহায্য করতে পারেন।
নানারকম হাবিজাবি চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।
.

সকালে একটা অদ্ভুত ঘটনার মধ্য দিয়ে আমার ঘুম ভাঙলো। হামিদ সাহেব কোথা থেকে যেন এক হুজুর না কবিরাজ ধরে নিয়ে এসেছেন। সেই কবিরাজ আবার সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখছেন আর কী সব বলছেন।

আমি হামিদ সাহেবের হাত ধরে টেনে নিয়ে একপাশে দাঁড় করালাম। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘কী হচ্ছে এসব? উনি কে?’

হামিদ সাহেব ঠোঁটে আঙুল চেপে চুপ করার জন্য ইশারা করলেন। মিনমিনে গলায় বললেন, ‘এখন কোনো কথা না। চুপচাপ দেখে যাও। কত খুঁজে খুঁজে ওনার দেখা পেয়েছি তুমি জানো? বিরাট বড় মাপের মানুষ। অনেক ক্ষমতা ওনার। আত্মাদের সাথে কথা বলতে পারেন, আত্মা হাজির করতে পারেন।’

আমি এবার দাঁত খিঁচিয়ে বললাম, ‘তাহলে তো মিটেই গেল। ওনাকে দিয়ে ইমলিকে হাজির করান। তারপর সবকিছু জেনে নেন। আমাকে কোনো দরকার তো দেখি না। আমি তাহলে ব্যাগপত্র গুছানো শুরু করি?’

‘আহা, অস্থির হচ্ছো কেন? তুমি না থাকলে কীভাবে হবে? তোমাকেই তো আগে দরকার।’

আমি আর কিছু বললাম না৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে কান্ডকারখানা দেখতে লাগলাম। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না এসব করতেই উনি মাঝেমাঝে উধাও হয়ে যান। স্ত্রী, মেয়ের শোকে কি তাহলে পাগল হয়ে গেলেন?
আগে শুধু পায়চারি করে ক্ষান্ত থাকতেন। এখন তো জ্বিন, ভূতে বিশ্বাস করে হুজুর, কবিরাজ ধরে আনা শুরু করেছেন। এরপর যে কত কিছু হবে কে জানে।

আপনমনে যখন গজগজ করছি তখন লম্বা আলখাল্লা পরা সেই কবিরাজ এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন। আপাদমস্তক দেখে নিতে নিতে বললেন, ‘কে তুমি?’

আমি সোজাসাপ্টা উত্তর দিলাম, ‘কেন মানুষ। ছেলে মানুষ। যুবকও বলতে পারেন। বয়স সবে পঁচিশ।’

কবিরাজ একপ্রকার বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘বড্ড বাজে বকো তো। তোমার নাম কী সেটা জানতে চেয়েছি?’

‘এইচ এম আবিদ।’

‘আবিদ তা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু এইচ এম মানে কী?’

‘সেটা আপনি কবিরাজি করে বের করুন।’
কিছুটা ব্যাঙ্গ করেই বললাম।

লোকটা আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে বাড়ির অন্যপাশে হাঁটা দিলেন। হাঁটতে হাঁটতে হামিদ সাহেবের সাথে কীসব গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করলেন। নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে কোনো কথা হবে। তবে ভালো কোনো কথা যে না সেটা বুঝতে বাকি নেই। নিশ্চয়ই আমার নামে বেয়াদব, অসভ্যসহ নানা ধরনের সিলমোহর মারছেন দুজন মিলে। তাতে অবশ্য বিশেষ কিছু যায় আসে না।

আমি সদর দরজার দিকে পা বাড়াতেই হামিদ সাহেব পেছন থেকে ডাকলেন। গম্ভীরমুখে বললেন, ‘উনি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে চান। সোজাসুজি উত্তর দেবে। একদম ফাজলামো না।’

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘আমাকে আবার কী প্রশ্ন করবেন?’

‘উনি ইমলির বিষয়ে জানতে চান। তুমি যা যা জানো সব…’

আমি আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বললাম, ‘আপনি ইমলির বাবা হোন। কিছু জানার থাকলে তো আপনার থেকেই জানতে চাওয়া উচিত। এর মধ্যে আবার আমায় টানছেন কেন? তারপরেও যদি কিছু জানার থাকে, তাহলে ওনাকে মাঝরাতে দেখা করতে বলবেন। আমি ইমলির সাথে কথা বলিয়ে দেবো। ভূতেদের আবার দিনের বেলা অনেক কাজ থাকে তো৷ রাত বারোটার আগে দেখা দেয় না।’
কথাগুলো বলে নিজের মতো হাঁটা দিলাম।
কথাগুলো শুনে হামিদ সাহেব তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে রইলেন। বার কয়েক নাম ধরে ডাকও দিলেন। কিন্তু আমার সেদিকে সামান্যতম ভ্রুক্ষেপ নেই।

শুধু শুধু সকাল সকাল মেজাজ গরম হলো। মানুষটা দিনকে দিন যাচ্ছেতাই হয়ে যাচ্ছেন একদম। আমি কিনা আবার ওনাকেই সাহায্য করতে এসেছি ভাবতেই নিজের মাথার চুল নিজেরই টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে এখন।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে