গল্প: শেষ পর্বের শুরু (পঞ্চম পর্ব)
__ ✍️ নীলিমা নওরীন মেঘলা
নবগঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি প্রায় মিনিট বিশেক হলো। জায়গাটা পুরোপুরি নিস্তব্ধ। এখন পর্যন্ত হামিদ সাহেবের কোনো খোঁজ নেই। মানুষটা হঠাৎ কোথায় গায়েব হয়ে গেলেন কে জানে।
পাশেই হাশমত ব্যাপারি হলুদ দাঁতগুলো বসে বসে খিলাল করছেন। আর একটু পর পর পানি মুখে নিয়ে কুলকুচি করছেন। ওনার ধারণা, নদীর পানি দিয়ে তিনবেলা কুলকুচি করার ফলেই দাঁতগুলো এখনো এত মজবুত আছে।
বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে হয়তো। ছোট্ট একটা মুদিখানার দোকান চালান। অথচ নামের শেষে ব্যাপারি পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
ওনার সাথে আজকেই আলাপ। আমি যখন হন্নে হয়ে হামিদ সাহেবকে খুঁজে বেরাচ্ছি, তখনই বাজারের পথে দেখা।
উনি আমায় আশ্বস্ত করে বললেন, ‘হামিদ সাহেব ঠিক কিছুক্ষইণের মইধ্যে বাড়ি ফিইরা যাইবেন। একদম টেনশন নিয়েন না।’
আমি যখন প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার সাথে কি দেখা হয়েছিল?’ তখন উনি দাঁত বের করে হাসলেন কিছুক্ষণ।
জবাব দিলেন, ‘না, দেখা হয় নাই। তবে আমি সব আগে থেকে কইয়া দিতে পারি। আমার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। কইতে পারেন জ্যোতিষীদের যেমন ক্ষমতা থাকে ঠিক তেমন।’
উনি আমার সম্পর্কেও বলতে চেয়েছিলেন, আমি পাত্তা দেইনি। বিষয়টা এড়িয়ে গেছি।
.
অনেকক্ষণ ধরেই দুজন মানুষ চুপচাপ অবস্থান করছি এক জায়গায়। কেউ কোনো কথা বলছি না। আমিই প্রথম মুখ খুললাম।
নিরবতা কাটানোর জন্য আস্তে করে ডাক দিলাম, ‘হাশমত ব্যাপারি…’
উনি চটজলদি উত্তর নিয়ে বললেন, ‘জ্বি সাব, কন কী কইবেন?’
যতই বলি আমি বয়সে আপনার অনেক ছোট, এই রকম সাহেব সাহেব করবেন না, আমার অস্বস্তি হয়; কিন্তু কে শোনে কার কথা। আমার মধ্যে নাকি একটা সাহেবি ব্যাপার আছে। আর যার মধ্যে যেটা থাকে সেটা স্বীকার দিতে হয়। না হলে পাপ হয়।
আমি গল্প জমানোর জন্য জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা ব্যাপারি, আপনি এই জ্যোতিষশাস্ত্র ছাড়া আর কী কী পারেন?’
উনি একমুহূর্ত না ভেবে হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, ‘কল্লা কাটতে। হাঁস, মুরগী থাইকা গরু, ছাগল সবকিছুর কল্লা কাটতে তো সবাই আমারেই খবর দেয়।’
কথাগুলোর সাথে সাথে যেন গর্বে বুক ফুলে উঠলো ওনার। ভাবে মনে হলো, এত বড় কাজ উনি ছাড়া আর কেউ পারে না এই গ্রামে।
আমি পুনরায় আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘কখনো মানুষের কল্লা কেটেছেন?’
আমার প্রশ্ন শুনে উনি না চমকে আগের মতোই দাঁত খিলাল করতে করতে বললেন, ‘মানুষের কল্লা কাটা অতি কঠিন কাজ সাব। বুকের পাটা চওড়া থাকোন লাগে। আমার বুকের পাটা তো ফিনফিইনা, এই দেখেন।’
কথাগুলো বলে জামার বোতাম খুলে যেন বুক দেখানোর চেষ্টা করলেন।
আমি পানির দিকে ঢিল ছুঁড়তে ছুঁড়তে বললাম, ‘মানুষের কল্লা কাটতে পারে, এমন কেউ জানাশোনা আছে আপনার?’
‘পরিচিত নাই। তবে আপনি কইলে খোঁজ লাগাইতে পারি।’
আমি প্রসঙ্গ পাল্টলাম। বললাম, ‘খোঁজ লাগাতে হবে না। নিজের সম্পর্কে বলুন। আপনি কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন?’
‘বেশিদূর করতে পারি নাই। ফোর পাস দিছিলাম৷ অভাবের সংসার, অত পড়াশোনা করাইবো কেডা?’
কথার সাথে সাথে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পড়লো।
আমি ওনার মন খারাপকে পাত্তা না দিয়ে বললাম, ‘যেহেতু ফোর পর্যন্ত পড়েছেন, সেহেতু নিশ্চয়ই শব্দার্থ জানেন। আচ্ছা বলুন তো, ইমলি মানে কী?’
আমার প্রশ্ন শুনে উনি হাসলেন। হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, ‘ইমলি মানে হইলো গিয়া তেঁতুল। লবণ দিয়া চটকাইয়া খাইতে হয়। কেউ কেউ আচার বানাইয়াও খায়। হেব্বি টেস্ট। সেইসব আমি জানি। কিন্তু আপনি আসলে ইমলি মানে জানতে প্রশ্নটা করেন নাই। আপনি হামিদ সাহেবের মাইয়ার সম্পর্কে জানতে চান। তাই তো?’
হঠাৎ করে ওনার মুখে এমন একটা কথা শুনে আমি পুরো ভ্যাবাচেকা খেলাম।
আমার ভাবমূর্তি দেখে উনিই আবার বললেন, ‘কইলাম না সাব, আমি আগে থেইকা সব বুঝতে পারি। এইবার বিশ্বাস হইলো তো আমার কথা?’
আমি শুধু ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালাম। আর কিছু বলতে পারলাম না।
আমার চুপ থাকার সুযোগ নিয়ে শেষ প্রশ্নটা উনিই আমায় করলেন, ‘আচ্ছা সাব, কন তো দেখি এই নদীর চিয়ারা এত সুন্দর কেমনে?’
আমি চোখ ইশারায় জানতে চাইলাম, ‘কীভাবে?’
‘মানুষ খাইয়া। হাহাহা…’
কথাগুলো বলতে বলতে হাশমত ব্যাপারি পাড় ছেড়ে উঠে চলে গেলেন।
আমি আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। চারপাশটা হেঁটে হেঁটে দেখলাম। বেলা বাড়ার সাথে সাথে মানুষ জনের আনাগোনা বাড়ছে। হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সময় কত তা দেখে নিলাম। নয়টা বেজে চল্লিশ মিনিট।
ইমলির কথা ভাবতে ভাবতে হাঁটছি। কাল অমাবস্যা৷ মাঝখানে গোটা একটা দিন। কী করা যায় সেসবই চিন্তা করছি। কোনোভাবে কি হাশমত ব্যাপারির সাহায্য নেওয়া যায়?
.
বাড়ি ফিরতেই দেখলাম হামিদ সাহেব উঠান জুড়ে পায়চারি করছেন। মনে মনে স্বস্তি অনুভব করলাম। ব্যাপারি তাহলে ভুল কিছু বলেননি। মানুষটা সত্যি সত্যি বাড়ি ফিরে এসেছেন। অবশ্য বাড়ি ছেড়ে কোথায়ই বা যাবেন?
আমি হামিদ সাহেবকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় গিয়েছিলেন আপনি? আমি আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। বলে যেতে তো পারতেন।’
উনি পায়চারি থামালেন না। আগের মতোই হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিলেন, ‘কাজ ছিল একটা।’
‘কাজ? কী কাজ?’
একপ্রকার আমতা-আমতা করে জবাব দিলেন, ‘আসলে শায়লা আর ইমলির কথা মনে পড়ছিল খুব। তাই নামাজ পড়ে কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলাম।’
আমি ‘আচ্ছা’ বলে মাথা নাড়ালাম। আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। চুপচাপ ঘরে গিয়ে বালিশ হেলান দিয়ে বসে রইলাম। হামিদ সাহেব নাস্তা করে নেওয়ার কথা বললেন। বললাম, ‘আপনি খেয়ে নিন। আমি পরে খাবো। ক্ষুধা নেই এখন।’
উনিও আর কিছু বললেন না। চলে গেলেন।
রাতে ঘুম না হওয়ার ফলে মাথাটা ভীষণ ঝিমঝিম করছে। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়া যায়। তাহলে হয়তো ভালো লাগবে।
চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। কখন যে ঘুমিয়ে গেছি নিজেও জানি না।
.
ঘুম ভাঙতে ভাঙতে বেলা প্রায় অর্ধেক চলে গেছে। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম চারটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। হামিদ সাহেবের সাথে চোখাচোখি হতেই স্মিত হাসি দিলেন।
বললেন, ‘ঘুমাচ্ছিলে জন্য আর ডাক দেইনি৷ তুমি খাওনি জন্য আমিও না খেয়ে বসে আছি। আসো শিগগির খেয়ে নেবে।’
মানুষটা আমার জন্য এতবেলা পর্যন্ত না খেয়ে আছে শুনেই খারাপ লাগছে। অন্যদিকে ভালো লাগছে এটা ভেবে যে, কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করে।
.
খাওয়া দাওয়া পর্ব সেরে বেরিয়ে পড়লাম গ্রাম দেখতে। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, হাশমত ব্যাপারি মানুষটা কেমন?’
হঠাৎ করে ব্যাপারির নাম নেওয়াতে হামিদ সাহেব বেশ অবাক হলেন। উল্টে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার সাথে দেখা হয়েছিল নাকি?’
‘সকালে আপনাকে যখন খুঁজছিলাম, তখন দেখা হয়েছিল।’
‘তাহলে নিশ্চয়ই তোমাকে জ্যোতিষ শাস্ত্রের গল্প শুনিয়েছে?’
‘হ্যাঁ শুনিয়েছেন। কিন্তু আসলে কি ওনার তেমন কোনো ক্ষমতা আছে?’
‘সেটা তো আমিও জানি না। তবে লোক খারাপ না। নিজেকে বেশি চালাক ভাবে, এই এক দোষ।’
‘হু।’
আমি আর কোনো কথা বললাম না। কিছু সময়ের ব্যবধানে হামিদ সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোনো ক্লু কি পাওয়া গেল?’
‘এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ক্লু পাইনি। দেখা যাক কী হয়।’
‘আচ্ছা।’
‘আপনি বরং ইমলির সম্পর্কে বলুন। এই ইমলি নাম রাখার কারণ কী?’
ইমলির কথা জানতে চাওয়াতে হামিদ সাহেব একই সাথে কষ্ট পেলেন ও উৎফুল্ল হলেন। বেশ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, ‘আসলে শায়লা, মানে ইমলির মা ভীষণ তেঁতুল খেতে পছন্দ করতো। ইমলি পেটে থাকতে প্রায় কেজি কেজি তেঁতুল খেতো। তাই আমি মজা করে বলতাম, আমাদের ছেলেমেয়ে হলে নাম রাখবো তেঁতুল। কিন্তু তেঁতুল তো আর নাম হয় না। সেজন্য তেঁতুলের সমার্থক শব্দ হিসেবে ইমলি রাখলাম। অদ্ভুতভাবে মেয়েটাও তার মায়ের মতো তেঁতুলপ্রেমী ছিল। সারাক্ষণ তেঁতুল খেতো, আর মুখ দিয়ে টাহ্ শব্দ করতো।’
কথাগুলোর সাথে সাথে হামিদ সাহেব যেন অতীতে হারিয়ে গেলেন।
আমার আরও কিছু প্রশ্ন করার ছিল, কিন্তু কীভাবে জিজ্ঞেস করবো ঠিক বুঝতে পারছি না।
একপ্রকার ইতস্ততভাবে বললাম, ‘কিছু মনে না করলে কয়েকটা প্রশ্ন করতাম।’
আমার কথায় যেন উনি বাস্তবে ফিরে এলেন। চোখেমুখে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী প্রশ্ন?’
‘আসলে কীভাবে বলবো বুঝতে পারছি না। কোনো প্রেম ঘটিত ব্যাপার জড়িত কি এসবের সাথে?’
আমার প্রশ্ন শুনে ওনার মুখ যেন পাংশু বর্ণ ধারণ করলো। একপ্রকার অস্বস্তি নিয়ে জবাব দিলেন, ‘তুমি তো জানো, ইমলির মা অনেক ছোটবেলায় মারা গেছে। ওর আর কোনো ভাই-বোনও নেই। মেয়েরা সাধারণত এসব বিষয় বাবার সাথে শেয়ার করে না। তবুও আমার ধারণা, তেমন কোনো কিছু ছিল না।’
আমি ফের প্রশ্ন করলাম, ‘তাহলে এমন কেউ কি আছে যে আপনার ক্ষতি করতে চায়? আই মিন, কোনো শত্রু?’
‘আমার জানামতে তেমন কোনো শত্রু নেই।’
‘আচ্ছা।’
.
বেলা প্রায় ডুবতে চলেছে। রাস্তার নিয়ন বাতিগুলো এক এক করে জ্বলতে শুরু করেছে। কাছেপিঠেই কোথাও মসজিদে আজান হচ্ছে।
হামিদ সাহেব মুখ থেকে পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, ‘মসজিদ কাছেই। চলো নামাজটা পড়ে নেওয়া যাক।’
আমি সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালাম।
চলবে…