শেষ পর্বের শুরু পর্ব – ৪

0
724

গল্প: শেষ পর্বের শুরু (চতুর্থ পর্ব)
__ ✍️ নীলিমা নওরীন মেঘলা

এত অল্প সময়ের মধ্যে বেশ ভালোই আয়োজন করেছেন। খিচুড়ি আর গরুর মাংস রান্না করেছেন। আমার সবচেয়ে পছন্দের খাবার।

খেতে খেতে বললাম, ‘রান্নাটা কিন্তু দারুণ হয়েছে।’

হামিদ সাহেব জোর করে হাসার চেষ্টা করলেন।

ওনাকে বলতে ইচ্ছে হলো, ‘কৃত্রিম হাসি আপনার মুখে মানায় না। বড্ড বিশ্রী লাগে। আপনি আর এইভাবে হাসবেন না।’
কিন্তু কী ভেবে যেন চুপ হয়ে গেলাম। কিছুই বলা হলো না।

এখানে আসার পর থেকেই উনি মনমরা হয়ে আছেন। কারণে অকারণে পায়চারিও করছেন না। কারণটা সম্ভবত এই বাড়িটা। এখানেই ওনার স্ত্রী আর মেয়ের সমস্ত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। স্মৃতিরা বড্ড খারাপ হয়। সময়ে অসময়ে পীড়া দেয়। সেই পীড়ার হাত থেকে বাঁচতেই মানুষটা সবকিছু ছেড়ে এই বয়সে রাজশাহী পড়ে আছেন।

আমি পরিবেশটাকে স্বাভাবিক করার জন্য বললাম, ‘আচ্ছা, আপনাদের কি প্রেমের বিয়ে ছিল নাকি দেখাশোনার?’

হামিদ সাহেব স্মিত হেসে বললেন, ‘তখন কি আর প্রেমের বিয়ের চল ছিল নাকি! আমার আম্মার খুব পছন্দ ছিল শায়লাকে। আম্মাই পছন্দ করে ঘরে এনেছিলেন। তবে মেয়েটার এত এত গুণ ছিল, যে কেউ তার প্রেমে পড়তে বাধ্য।’

‘আপনিও প্রেমে পড়েছিলেন বুঝি? ভালোবাসতেন খুব?’

‘ভালোবাসতাম কিনা জানি না, তবে মানুষটা আমার অভ্যাসের মতো ছিল। এত বছরেও সেই অভ্যাস থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারিনি। অভ্যাস খুব ভয়ানক জিনিস। কিছুটা ব্যাধির মতো।’
কথাটার সাথে সাথে ওনার চোখজোড়া চকচক করে উঠলো। সেটা আনন্দে নাকি কষ্টে ঠিক বুঝতে পারলাম না। মনে হলো, একই সাথে মানুষটা হাসছেন এবং কাঁদছেন। কী অদ্ভুত!

আমি শেষ লোকমাটা মুখে তুলে নিতে নিতে বললাম, ‘সেজন্যই বুঝি দ্বিতীয়বার আর বিয়ে করেননি?’

আমার কথা শুনে ওনার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পড়লো। নিরস গলায় উল্টে আমায় প্রশ্ন করলেন, ‘কখনো কাউকে মন থেকে ভালোবেসেছো?’

আমি ‘না’ সূচক মাথা নাড়ালাম।

উনি বললেন, ‘একবার ভালোবাসলেই বুঝতে পারবে ভালোবাসার মানুষ না থাকার জ্বালা কতখানি। তাকে ছাড়া ঘর, সংসার সবকিছু অতি তুচ্ছ মনে হবে। নতুন করে আর কাউকে নিয়ে থাকতে ইচ্ছে হবে না, ভাবতে ইচ্ছে হবে না।’
কথাগুলো বলা শেষ করেই উনি উঠে বাইরে চলে গেলেন। নিজেকে যেন খুব করে আড়াল করতে চাইলেন। আমার ভেতর থেকে একটা কথাই বেরিয়ে পড়লো সন্তপর্ণে ‘ভালোবাসা। আহা ভালোবাসা…’
.

পুরো বিকালটা হামিদ সাহেব আমাকে গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখালেন। নবগঙ্গা নদীর পাড়েও অনেকটা সময় কাটালাম। গল্পের মতো সাজানো গোছানো একটা গ্রাম, তবে নামটা অদ্ভুত। ‘বারাশিয়া’ এমন কোনো নাম আগে শুনিনি।

এক পর্যায়ে কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসলাম, ‘এটাই কি সেই নদী?’

উনি মুখে একটা পান পুরে নিতে নিতে বললেন, ‘হ্যাঁ, এটাই সেই নদী যেখানে ইমলি ডুবে মারা যায়।’
হাত দিয়ে জায়গাটা দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে ঠিক ওইখানে ওর লাশ পাওয়া যায়।’

আমি ভালোভাবে আশপাশটা দেখতে দেখতে বললাম, ‘থানায় কোনো কেস হয়নি? মানে আপনি কোনো কেস করেননি?’

‘করতে চেয়েছিলাম, তবে গ্রামের মোড়লরা নিষেধ করেছিলেন। কেস করলে নাকি এর রশি অনেকদূর টানতে হবে। তাছাড়া পাকাপোক্ত কোনো প্রমাণ তো নেই। সবটাই আমার সন্দেহ মাত্র।’
কথাগুলো বলেই ফোঁস করে এক নিঃশ্বাস ছাড়লেন। সেই নিঃশ্বাসের উষ্ণ স্রোত এসে যেন লাগলো আমার ঘাড় বরাবর। আর আঘাত করলো ঠিক অন্তর আত্মায়।

আমি নতুন করে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। কোথা থেকে শুরু করবো ঠিক বুঝতে পারছি না। ইন্টারেস্ট থাকলেও তেমন কোনো ধারণা নেই এসব বিষয়ে। ইমলি তো বলেছে সাহায্য করবে। সেটাই শেষ ভরসা। সামনে অমাবস্যা। দেখা যাক কোনো ক্লু পাওয়া যায় কিনা।
.

ঘড়িতে ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ডের কাঁটা একজায়গায় মিলিত হতেই ঢং করে শব্দ হলো। মানে বারোটা বেজে গেছে।
বিছানায় শুয়ে ছটফট করছি। কিছুতেই ঘুম আসছে না। নতুন জায়গায় আসলে এই এক সমস্যা। সহজে ঘুম আসতে চায় না, অস্বস্তি হয়। একটা বই নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে পড়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু পড়ায় মনযোগ আসছে না। কারো সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলে ভালো হতো৷ কিন্তু হামিদ সাহেব তো পড়ে পড়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। বেচারার উপর দিয়ে আজ প্রচুর ধকল গেছে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই তাই ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমিও আর ডেকে ওনাকে বিরক্ত করতে চাইলাম না।

শুয়ে শুয়ে ফেসবুকে স্ক্রল করছি, এমন সময় কিছু একটার খচখচ শব্দ এসে কানে লাগলো। আমি শব্দের উৎস খুঁজতে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম। একবার মনে হচ্ছে শব্দটা খুব কাছেপিঠেই হচ্ছে, আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে অনেকদূর থেকে কেউ ঢং ঢং করছে। কিছুটা ঘন্টা বাজার মতো শব্দ৷
আমি বিছানা ছেড়ে উঠে সারা ঘর পায়চারি করতে লাগলাম। হঠাতই শব্দটা যেন বন্ধ হয়ে গেল। সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।

যখনই শোয়ার জন্য বিছানার দিকে পা বাড়ালাম তখনই মেয়েলি কণ্ঠে কেউ একজন পেছন থেকে বলে উঠলো, ‘একগ্লাস পানি দিবেন, পানি?’

আমি পেছন ঘুরে ‘কে কে?’ বলে তাকাতেই দেখলাম ঘরের দেয়ালে ইমলির ছবি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। হাসিমাখা সেই মুখখানা। এই ছবিটা আগেও দেখেছি। ছবিটা তো উধাও হয়ে গিয়েছিল, তাহলে এখানে আসলো কীভাবে?

আমি ধীরপায়ে ছবিটার দিকে এগিয়ে গেলাম। রিনরিনে গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘পানি দিয়ে কী হবে?’

প্রায় সাথে সাথে জবাব এলো, ‘ডুবে মরবো ডুবে।’

লাইনটা খুব পরিচিত মনে হলো। প্ল্যানচেটের রাতেও ঠিক এই কথাটাই বলেছিল। তারপর থেকেই আর কোনো খোঁজ নেই। এত হেয়ালি না করে সরাসরি বলে দিলেই তো মিটে যায় সবকিছু।

আমি বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠেই এবার বললাম, ‘দেখুন, আমার মোটেও হেয়ালি ভালো লাগছে না। সরাসরি বলুন তো কী চান? এই আসছেন, আবার দুম করে চলে যাচ্ছেন। আমাকে কি পাগল ভেবেছেন?’

‘আমি শুধু মুক্তি চাই মুক্তি। আপনি আমায় মুক্ত করুন।’

গলাটা কেমন করুণ শোনালো। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটা যেন মিইয়ে যেতে থাকলো। এটা তো ফ্রেমবন্দী একটা ছবি মাত্র। ছবির আবার এত রং বদল হয় নাকি?

‘কীভাবে মুক্ত করবো সেটা তো বলুন? আপনি তো আমায় কোনো সাহায্যই করছেন না।’

‘আমি আপনাকে সাহায্য করছি না কে বলল? এই যে আমি এসে আপনার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলোকে সচল করে দিচ্ছি, সেটাই বা কম কী? আপনি এখন আমায় নিয়ে ভাববেন, ঘুমাতে পারবেন না, কিছু করতে পারবেন না; রহস্য উদঘাটনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবেন। আর আপনার এই উদ্বেগটাই আমাকে মুক্ত করতে সাহায্য করবে।’

‘সেটা নাহয় বুঝলাম, কিন্তু কোনো ক্লু কি দেওয়া যায় না?’

‘কালকের পরের দিনই অমাবস্যা। সেদিন নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ক্লু পেয়ে যাবেন।’

আমি পুনরায় কিছু বলতে যাবো, এমন সময় দেখি ছবিটা গায়েব। দেয়ালে ঝুলছে একটা আধময়লা ক্যালেন্ডার। সেই ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠাগুলো উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক ওদিক পতপত করে উড়ছে। অথচ এটা শীতকাল। ফ্যান বন্ধ। বাতাসের কোনো ছিটেফোঁটাও নেই।

আমি তাড়াতাড়ি টেবিল থেকে ডায়েরিটা নিয়ে আজকের ঘটনাটা মার্ক করে রাখলাম। সবকিছু কেমন জটলা পাকিয়ে যাচ্ছে, কিছুই ভালো লাগছে না। কাছেপিঠেই কোথাও ফজরের আজান হচ্ছে। এতটা সময় কীভাবে পার হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি। বিছানার দিকে চোখ পড়তেই খেয়াল হলো হামিদ সাহেব বিছানায় নেই। উনি কি নামাজ পড়তে উঠেছেন? কিন্তু ভোরবেলা তো কখনো ঘুম থেকে উঠতে দেখিনি ওনাকে। বরাবরই কিছুটা বেলা করে উঠতেন। তাহলে কি বাড়ি এসে সব নিয়ম পাল্টে গেল?
কী অদ্ভুত! আমি জেগে আছি দেখেও উনি কথা না বলে বাইরে চলে গেলেন কেন?
বাবা-মেয়ের অত্যাচারে এবার রীতিমতো আমার রাগ হচ্ছে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে