শেষ পর্বের শুরু পর্ব – ২

0
880

গল্প: শেষ পর্বের শুরু (দ্বিতীয় পর্ব)
__ ✍️ নীলিমা নওরীন মেঘলা

হঠাৎ করে বাসের মধ্যে বেশ বড়সড় রকমের একটা জটলা পাকিয়ে গেল। তীব্র এক ঝাঁকুনি দিয়ে বাস চলা বন্ধ হয়ে গেল। এই সময় আবার কী হলো কে জানে। যাচ্ছেতাই একদম। ট্রেন, বাসে চলাচলের এই এক অসুবিধা। হুটহাট ইঞ্জিনে সমস্যা হয়, নয়তো চুরি, ছিনতাই লেগেই থাকে।

তবে এবারের বাস বন্ধ হওয়ার কারণটা ভিন্ন। লোকজন সব হামিদ সাহেবকে ঘিরে হন্তদন্ত করছে। কেউই মুখের সদ্য ব্যবহার করতে ছাড়ছে না। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। আমি ঠিক কোনোকিছুই বুঝতে পারছি না। লোকটা আবার কী করে বসলেন কে জানে। ওনার কথা শুনে এইভাবে হুটহাট একসাথে না আসলেও চলতো। কেন যে তখন কৌতুহল দেখিয়ে ওনার প্রস্তাবে রাজি হলাম! ভুলটা আমারই। নিজেই এখন নিজের মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।

আসল রহস্য উদঘাটন করতে ভীড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। হামিদ সাহেবের পাশে গিয়ে বললাম, ‘কী ব্যাপার সবাই চিৎকার করছেন কেন? সমস্যা কী?’

আমার প্রশ্ন করার সাথে সাথে নাদুসনুদুস চেহারার একজন বাঁ’পাশ থেকে বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠেই বলে উঠলেন, ‘আপনি কে হোন লোকটার? চেহারা দেখে তো ভালো ফ্যামিলিরই মনে হয়। অথচ মেয়ে দেখলে হাত-পা কন্ট্রোল রাখতে পারে না। এক’পা তো কবরে দিয়ে বসে আছে, তবুও এই বয়সে কিনা বাসের মধ্যে মেয়েদের সাথে অসভ্যতা করে। একবার গণধোলাই দিলে বেটা একদম লাইনে চলে আসবে।’

পুরো ঘটনা ঠিক না বুঝলেও এতটুকু বুঝলাম এটা মেয়ে ঘটিত কেস। হামিদ সাহেব যতই গায়ে পড়া স্বভাবের হোন না কেন, হুটহাট ইচ্ছাকৃতভাবে মেয়েদের গায়ে পড়ার স্বভাব তার নেই। এতটুকু বিশ্বাস আমার আছে মানুষটার প্রতি।

আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘কেসটা কী? কী করেছেন আপনি?’

হামিদ সাহেব এবার করুণ মুখে আমার দিকে তাকালেন। মিনমিনিয়ে বললেন, ‘পায়চারি করতে লেগে একটা মেয়ের গায়ে পড়ে গেছি ঝাঁকুনি খেয়ে। লোকজন ভুল বুঝে গালাগালি করছে। কিন্তু আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি, বিশ্বাস করো।’

কথাগুলো চোখ বন্ধ করেই বিশ্বাস করা যায়। কেননা ওনার পায়চারি নামক রোগের সাথে আমি বহু আগে থেকেই পরিচিত। তাছাড়া চলন্ত গাড়িতে হাঁটার সময় এর ওর গায়ে হেলেদুলে পড়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এসব কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।

লোকজনকে শান্ত করার জন্য বললাম, ‘সবাই থামুন দয়া করে। আপনাদের বুঝতে কোথাও ভুল হচ্ছে। আসলে… ‘

পাশে থেকে নাদুসনুদুস চেহারার লোকটা আমায় পরবর্তী কোনো কথা বলার সুযোগ দিলেন না। সাপের মতো ফোঁস করে আবার বলে উঠলেন, ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকার একদম চেষ্টা করবেন না। আপনি কার হয়ে ডিফেন্স করছেন? এসব লোকজনদের আমার খুব ভালোভাবেই চেনা আছে। হাড়ে হাড়ে বজ্জাতি। আপনি আবার এসেছেন লোকটার হয়ে সাফাই গাইতে? পিঠে দুই ঘা পড়লে সব বজ্জাতি বেরিয়ে যাবে।’

লোকটার কথার সাথে সবাই কোনোকিছু না বুঝেই তাল মেলালো। ঘটনার যে ভিকটিম সে কিছু না বলে নিজের মতো চুপ রইলো। মেয়েটার এই চুপ থাকার দরুন সবাই নিজের মতো কাহিনী সাজিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

পরিস্থিতি যতই স্বাভাবিক করতে চাইছি আরও যেন হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিরক্ত লাগছে আমার। মানুষটার উপর রাগ হচ্ছে। কতবার বললাম, ‘এইভাবে পায়চারি করবেন না। চুপচাপ বসে থাকুন।’
কিন্তু কে শোনে কার কথা।

আমি এবার কোনো ভূমিকা না করে সরাসরি বলে বসলাম, ‘অযথা হৈচৈ করবেন না। আপনাদের বুঝতে কোথাও ভুল হচ্ছে। ওনার মেয়ে আজ সকালে মারা গেছে। আমরা এখন সেখানেই যাচ্ছি। উনি টেনশনে পায়চারি করছিলেন। হয়তো কারো গায়ে ধাক্কা লেগে গেছে। আর আপনারা ভাবছেন কী না কী হয়ে গেছে।’

কথাগুলো শেষ করা মাত্রই দেখলাম উৎসুক জনতা চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। আমি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। পরিবেশ একদম স্বাভাবিক। সবাই যার যার জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো কিছুক্ষণের মধ্যে। যে মেয়েটাকে নিয়ে এত কাহিনী সেই মেয়েটা এবার মুখ খুললো। সিট ছেড়ে উঠে এসে ক্ষমা চাইলো এবং সমবেদনা জানালো।

হামিদ সাহেব আমার দিকে একবার আড় চোখে তাকালেন। ভাবে মনে হলো, মেয়েটার ক্ষমা চাওয়া কিংবা সবার হঠাৎ করে চুপ হয়ে যাওয়াটা ওনার মনে তেমন কোনো প্রভাবই ফেলেনি। হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে সিটের কাছে নিয়ে এলেন। তারপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, ‘ইমলি তো মারা গেছে বছর পাঁচেক আগে। তুমি শুধু শুধু মিথ্যা বললে কেন?’

‘মিথ্যা না বললে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতো না। আপনার এই রোগের কথা বললে কেউ তো বিশ্বাস করতোই না, বরং উল্টে আরও পাগল বলে মারপিট করতো। তাছাড়া আমি তো জীবিত মানুষকে মেরে ফেলিনি। আপনার মেয়ে তো এমনিতেই মারা গেছে। সে আজ হোক বা পাঁচ বছর আগে।’

মানুষটা আমার কথার কোনো প্রতিবাদ করলেন না। বিষন্ন মুখে ধপ করে বসে পড়লেন নিজের সিটে।
কোথাও যেন মনে হলো, কথাগুলো ওইভাবে বলা আমার উচিত হয়নি। এমনিতেই সবার এত অপমান সহ্য করতে হলো, তার উপর আবার ইমলির কথা বলে বসলাম। শুধু শুধু মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম। পুরনো ক্ষততে আবার নতুন করে লবণ ছিটালাম। হামিদ সাহেবের তো মেয়েটা ছাড়া আর কেউ ছিল না। স্ত্রী বিয়োগের পর মেয়েটাকে অবলম্বন করেই বেঁচে ছিলেন।
ইশ! বড্ড আফসোস হচ্ছে। মানুষটা আজ সারাদিন মন খারাপ করে থাকবেন। মানুষের মন খারাপ আমার সহ্য হয় না। বড্ড বিশ্রী লাগে। কিন্তু আমার কাছে তো অন্য কোনো উপায়ও ছিল না সবাইকে থামানোর জন্য। পরে নাহয় ক্ষমা চেয়ে নেওয়া যাবে।

হাবিজাবি বিভিন্ন কথা ভাবতে ভাবতে নিজের সিটে বসে মুখের উপর একটা বই মেলে ধরলাম। বাস আবার আগের মতো চলতে শুরু করেছে। জানালা দিয়ে হুহু করে বাতাস ঢুকছে। চারপাশে কত গাছগাছালি, মাঠের পর মাঠ দেখা যায়। মন ভালো হওয়ার মতো একটা পরিবেশ। কিন্তু আমার মন ভালো হচ্ছে না। বই পড়াতেও মনযোগ আসছে না। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের ফিনিক্স বইটা কোলের উপর রেখে দু’চোখ বন্ধ করে বড়সড় কয়েকটা শ্বাস নিলাম। রিফ্রেশমেন্টে উপায়টা বেশ কাজে দেয়।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে