শেষ পরিণতি পর্ব-০৫

0
1270

#শেষ_পরিণতি পর্ব ৫
____________________
হাতে ড্রেসিং করা শেষে রাজন আমাকে রিকশায় উঠিয়ে দিলো। এরমাঝে অনেকবার তাকে নীলিমার কথাগুলো বলতে চেয়েছি কিন্তু রাজন শোনেনি। অবশ্য রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে তার নাম্বার আমাকে দিয়ে দিয়েছে, বলেছে বাসায় গিয়ে রেস্ট নেওয়ার পরে কল দিতে।
আমিও আর আপত্তি করিনি।
রিকশা ছুটে চলেছে বাসার দিকে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখি মা ১০ বার কল করেছে।
এভাবে কি করে বাসায় যাবো বুঝতে পারছি না।
ভয়ে একদম চুপসে গেলাম আমি।
বাসার সামনে রিকশা গিয়ে থামলো।
ব্যথায় আমি নামার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম।
জানালা থেকে আমাকে দেখে মা দৌড়ে আসলেন।
-কি হয়েছে তোর? হাতে ব্যান্ডেজ কেন? এটা কার শার্ট? বলবি আমাকে কি হয়েছে?
– মা বাসায় গিয়ে বলছি। তুমি এখন আমাকে রিকশা থেকে নামাও। পায়ে ব্যথা প্রচুর।
– পায়ে ব্যথা মানে? তুই কি এক্সিডেন্ট করেছিস?
হাজারবার বলি বাসা থেকে কারণ ছাড়া বের হবি না। রাস্তাঘাট দেখেশুনে পার হবি। আমার কথা তো শুনবি না। মা’র কথা না শুনলে কি হয় বুঝেছিস?
এবার মা’য়ের উপর আমার ভিষণ রাগ হলো।
এসব তো বাসায় নিয়েও বলা যায়। তা না, বাইরের মানুষের সামনে বকাবকি শুরু করেছে।
আমি একটু রাগ হয়েই বললাম,
-আমাকে কি রিকশা থেকে একটু নামাবা?
নাকি এই রিকশায় করে আবার চলে যাবো?
মা এবার কিছু না বলে আমাকে ধরে নামালেন।
প্রচন্ড ব্যথায় আমি পায়ে ভর দিতে পারছিলাম না।
মা অনেক কষ্টে আমাকে রুম পর্যন্ত আনলেন।
খাটের উপর বসিয়ে মা’র প্রথম কথা ছিলো,
-এবার বল শার্টটা কার?
আমাকে না বলে কোথায় গিয়েছিলি?
-আমি এক্সিডেন্ট করেছি কই একটু যত্ন করবে আমার তা নয় শুরু থেকেই শার্টের মতো সামান্য ব্যাপাট নিয়ে পড়েছো।

একটু বিরক্তি নিয়েই কথাটা বললাম,
মা এবার বড় বড় চোখ করে বললেন,
-সামান্য ব্যাপার মানে?
এই সামান্য ব্যাপার থেকে একসময় লোকসমাজে আমাদের মাথা নত হয়ে যায়। ওইযে গেছে না তোর বোন, নীলিমা। শুরু থেকে যদি চোখে চোখে রাখা হতো তাহলে এমন হতো না।
– মা! আমি যার বাইকের সাথে এক্সিডেন্ট করেছি, শার্ট টা তার। আমার জামা ছিড়ে যাওয়ায় সে আমাকে দিয়েছে। এছাড়া আর কিছু নয়। এটা নিয়ে আর কথা বাড়িও না।
আমার কথা শুনে মা এবার কাঁদতে শুরু করলেন,
– আমিতো বেশি কথা বলি। কিন্তু বলি যে তোদের ভালোর জন্য সেটা কে বুঝবে? সকালে যদি আমার কথা শুনতি তাহলে এই এক্সিডেন্ট টা হতো না।
কান্নামাখা কন্ঠে মা কথাগুলো বলছে আর আমার জামা চেঞ্জ করে দিচ্ছে।
জামাকাপড় পাল্টে আমাকে খাটে শুইয়ে দিয়ে গেলেন।
.
কিছুক্ষণ পরে আমাকে দেখার জন্য চাচা,চাচি উপস্থিত হলেন।
চাচি এসে কপালে হাত দিতেই আৎকে উঠলেন।
আমার তখন জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।
চাচি একটা বাটিতে করে পানি এনে, ছোট একটা কাপড় ভিজিয়ে জলপট্টি দিচ্ছেন।
এই মানুষটার কাছে আমি মায়ের মতোই স্নেহ পাই।
নীলিমাকে আর আমাকে কখনো ভিন্নভাবে দেখেনি। বরং মা’র থেকে বেশি চাচির কাছে আমি আবদার করতাম।
রান্নার কাজে মা’র থেকে চাচির অভিজ্ঞতা বেশি।
সব রান্নায় পটু তিনি।
যেকোনো ধরনের পিঠা, বা কোনোকিছু খেতে ইচ্ছে করলেই আমি চাচির কাছে গিয়ে বায়না করতাম।
চাচিও কখনো এসব বিষয়ে বিরক্তবোধ করেননি।
কিন্তু আজ নীলিমার জন্য চাচি কতোটা দুঃখী।
দু-চোখ ফুলে গেছে। চেহারাটাও বিষন্নতায় মোড়ানো। ভেতরে ভেতরে আহত হলাম খুব।
আমার যে করেই হোক, নীলিমার ব্যাপারে সব খবরাখবর নিতেই হবে।
.
.
.
মৃদু শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো আমার।
চোখ মেলে দেখি চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
আশেপাশে হাতড়ে বুঝলাম মেঝেতে পড়ে আছি আমি, ব্যথায় নড়ার শক্তিটুকু হ্রাস পেয়েছে।
কোথায় আছি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। “মা ” বলে কয়েকবার ডাক দিলাম।
কিন্তু কথার প্রতিধ্বনি আবার আমার কাছেই ফিরে আসলো। মনে হচ্ছে,ফাঁকা কোনো বদ্ধরুমে আছি আমি। হঠাৎ কারও পায়ের শব্দে আমি চুপ হয়ে গেলাম।
শব্দটা রুমের বাইরে থেকে আসছে।
শব্দ করে ডাক দিতে গিয়েও আমি থমকে গেলাম, বিপদের আঁচ পাচ্ছি কিছুটা।
সবকিছু না বুঝে শব্দ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমি চুপ করে বুঝতে চেষ্টা করলাম সবটা।
হঠাৎ ভয়ংকর চিৎকারে আমার আত্মা কেঁপে উঠলো।
নিজের অজান্তে আমিও জোরে জোরে চিৎকার করতে শুরু করি।
আমি সর্ব শক্তি দিয়ে গলা ফাটিয়ে “মা ” বলে চিৎকার করলাম।
হঠাৎ দেখি আমার রুমের লাইট জ্বলে উঠলো।
মা, বাবা দু’জনে দৌড়ে আমার পাশে এসে বসলেন।
চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, আমি নিজের রুমেই আছি।
তাহলে এতক্ষণ যা দেখছিলাম সেগুলো সবটাই স্বপ্ন ছিলো!
মা পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে, ঢক ঢক করে সবটা খেয়ে ফেললাম।
স্বপ্নটা অনেকটা সাদেকের বাসায় ঘটে যাওয়া ঘটনার মতো ছিলো।
ঘটনাটা এমনভাবে ব্রেইনে গেঁথে গেছে, এখন স্বপ্নেও খুব বাজেভাবে ইফেক্ট পড়ছে।

-কি হয়েছে তুবা? কোনো বাজে স্বপ্ন দেখেছিস?
মা’র কথায় আমি হ্যাসুচক মাথা নাড়াই।
মাথাটা ফেটে যাচ্ছে ব্যথায়। জ্বরটাও বেড়েছে খুব।
বসে থাকতে না পেরে আবারও বিছানায় শুয়ে পড়ি।
শুয়ে শুয়ে শুনছি মা বাবাকে বলছেন,
– মেয়েটা হয়ত খুব ভয় পেয়েছে। জ্বরও উঠেছে কতো, এটা কিন্তু ভালো লক্ষ্মণ না।
তুমি একটু মেয়ের কাছে বসো, আমি ভাবিকে নিয়ে একটু বাইরে থেকে আসি।
আমি জানি মা এখন কোথায় যাবে, আমাদের গলি পার হয়ে পরের গলিতে একজন পীর বাবা আছেন। মা ও চাচি তার অনেক ভক্ত।
কিছু হলেই দৌড়ে তার কাছে যায়, আর এতোগুলা টাকা দিয়ে তাবিজ নিয়ে আসবে।
তার অনেক ভক্ত থাকলেও আমি তাকে একটুও বিশ্বাস করি না।
তার প্রধান কারণ হলো, তার কাছে কোনো সমস্যা নিয়ে গেলেই প্রথমে বলবে কালো ছায়া ভর করেছে।
আমি নিশ্চিত, আমার বেলায়ও মা’কে এই কথা বলে, বড় একটা তাবিজ ধরিয়ে দেবে।
.
.
.
ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম রাত ১১ টা বাজে।
বাবা তখনও আমার পাশে বসে আছেন।
আমি বাবাকে চলে যেতে বললে বাবা না করেন।
কিন্তু আমার রাজনের সাথে কথা বলাটা অনেক জরুরী।
নীলিমার বিষয়েও সাথে সাদেকের বাসা সম্পর্কে।
সেখানে কে কে থাকে, ওই মেয়েটা কে ছিলো, সবকিছু জানতে হবে।
কিন্তু বাবা থাকলে সেটা সম্ভব না।
বেশি রাত হয়ে গেলে একটা মানুষকে কল করে ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে না।
তাই নানাভাবে বুঝিয়ে বাবাকে তিনার রুমে পাঠিয়ে দিলাম।
ফোন থেকে রাজনের নাম্বার বের করে কল দিলাম।
প্রথমবার রিসিভ না করায় পরবর্তীতে আবার কল দিলাম।
দ্বিতীয়বার দুই তিন বার রিং হতেই ফোনের ওপাশ থেকে রাজনের কন্ঠ ভেসে এলো,
-হ্যালো, হ্যা তুবা বলো, তোমার শরীর এখন কেমন আছে?
আমি অবাক হয়ে বললাম,
-আপনার কাছে আমার নাম্বার আগের থেকে ছিলো?
-না তো। তোমার নাম্বার আমি কোথায় পাবো! তোমার সাথে এই প্রথমবার আমার কলে কথা বলা, তাও তুমি কল করেছো।
-তাহলে ফোনটা যে আমি করেছি সেটা বুঝলেন কি করে?
রাজন একটু হেঁসে বললো,
– এটা আমার পারসোনাল নাম্বার।
মা, বাবা ছাড়া কেউ জানেনা। তারা ব্যতীত শুধু তোমাকেই আজ নাম্বারটা দিয়েছি।
তাছাড়া আমি জানতাম তুমি ঠিক কল করবে আমাকে। এখন বলো, তোমার জরুরী কথাগুলো কি?
রাজনের সাথে কথা বলার সময়, রাজনের পাশ থেকে কিছু শব্দ শুনতে পেলাম।
মন না চাইতেও আমি রাজনকে প্রশ্ন করলাম,
-আপনি কি সাদেকের বাসায়?
-হ্যা, কিন্তু তুমি কি করে বুঝলে?
আমি রাজনের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বললাম,
-আচ্ছা সাদেকের বাসায় কে কে থাকে?
-সাদেক আর ওর খালা। মা বাবাকে হারানোর পর থেকে খালার কাছেই বড় হয়েছে সাদেক। সাদেকের বড় ভাই বিদেশে থাকে।
সংসার সে-ই সামলায়।
তাহলে সেদিন যে আমাকে দরজা খুলে দিয়েছিলো, তিনি সাদেকের খালা ছিলেন!
আমি বুঝতে পারছি, রাজন আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছে।,সাদেকের
বাসায় বর্তমান একজন নয়, দুজন মহিলা থাকেন।
রাজন কেন মিথ্যা বলছে বুঝতে পারছি না। দুপুরের ঘটনাটা রাজনকে বলতে গিয়েও আমি থেমে গেলাম।
মনে হচ্ছে এখনই রাজনকে এসব বলা ঠিক হবে না।
আমি রাজনকে নীলিমার বিষয়ে সবকিছু বুঝিয়ে বললাম।
রাজনও সবার মতো চিন্তায় পড়ে গেলো।
এবং আমাকে এই বিষয়ে পূর্ণ সাপোর্ট দিবে বলে আশ্বাস দেয়।
.
.
.
এরপর দুই দিন কেটে যায়।
পুলিশও নীলিমার কোনো খোঁজখবর দিতে পারেনি। চাচা চাচি অনেক দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।
আমি এই দু’দিন এক্সিডেন্টের কারণে বাসায় বসে থাকলেও, আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী রাজন সবসময় ফাহিম এবং তার বন্ধুবান্ধবের উপর নজর রেখেছে। কিন্তু ফলস্বরূপ কিছুই হয়নি।
নীলিমার কোনো খোঁজখবর পায়নি রাজন।
তবুও আমার মন বলছে, ফাহিম নীলিমার সম্পর্কে অনেককিছু জানে।
আজ আমি অনেকটা সুস্থবোধ করছি।
পায়ের ব্যথা পুরোপুরি কমে না গেলেও, চলাচলের জন্য মোটামুটি ঠিক আছে।
এমনিতেও বড্ড দেরি হয়ে গেছে, আজ চারদিন নীলিমার কোনো খোঁজখবর নেই।
না জানি কেমন আছে ও!
না আমাকে যত দ্রুত সম্ভব একটা কিছু করতেই হবে।
এভাবে বাসায় বসে থাকলে কোনো কাজই হবে না।

এখন ঘড়িতে এগারোটা বাজে।
মা দুপুরের রান্নার কাজে ব্যস্ত, বাবাকে আশেপাশে কোথাও দেখছি না।
আমি কোনোরকম রেডি হয়ে, রাজনকে একটা মেসেজ দিয়ে ফোনটা অফ করে ফেললাম।
তারপর লুকিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।
রাজনকে বলেছি, ঠিক ১২:৩০ এ কলেজের পাশে টং দোকানে দাঁড়াতে।
বাকিটা সময় আমার কাজে লাগাতে হবে।
সাদেকের বাসার ঘটনাটা আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে খুব। নীলিমাকে খোঁজায় মন দিতে হলে, আগে এই বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, রাজনের সাথে দেখা করার আগে সাদেকের বাসায় যাবো।
সাদেকের বাসায় আর্তনাদ দেয়া ওই মহিলাটি কে, এবং রাজন কেন মিথ্যা বললো এটা আমার জানতেই হবে। আমার মনে কোথাও একটা বলছিলো নীলিমা কে ওরা আটকে রাখে নি তো!
মনে সাহস জুগিয়ে আমি আগেরবারের মতো সাদেকের বাসার সামনে গিয়ে কলিংবেল প্রেস করি। কলিংবেল প্রেস করার বেশ কিছুক্ষণ পর একজন দরজা খুলে দিলো।
আজকেও দরজা খুলেছে সেই মহিলাটি।
আমি সালাম দিয়ে বললাম,
-আন্টি জরুরী একটা কাজের জন্য সেদিন সাদেকের সাথে কথা না বলেই চলে যেতে হয়েছিল। আজ কি সাদেকের সাথে একটু কথা বলা যাবে।
সাদেকের সাথে আমি কি কথা বলবো জানা নেই,
তবুও যে করেই হোক বাসার ভেতরে আমার ঢুকতেই হবে।
আন্টির কিছু বলার অপেক্ষা না করেই আমি ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিলাম তখন আন্টি বলে উঠলেন,
-আজতো সাদেক বাসায় নেই। জরুরী কাজে বাইরে গিয়েছে, তুমি অন্য কখনো আসো। অথবা তোমার নাম্বার দিয়ে যাও আমি সাদেক কে দিয়ে দেবো।
সাদেক বাসায় নেই শুনে, মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল।
-আচ্ছা আন্টি তাহলে আমি আসি।
কথাটা বলে দরজার দিকে পা বাড়ালাম।
বাসা পর্যন্ত এসে রহস্যটার সমাধান না করে যেতে ইচ্ছে করছে না মোটেও। দরজার কাছে গিয়ে আন্টির দিকে ফিরে বললাম,
-আন্টি খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। ১ গ্লাস ঠান্ডা পানি হবে?
– আচ্ছা তুমি ভেতরে এসে বসো আমি পানি আনছি। বলে আন্টি ভেতরে চলে গেলেন।
আমি ড্রয়িং রুম থেকে উঠে পা টিপে টিপে গিয়ে ভেতরের দিকে উঁকি দিলাম।
হঠাৎ করেই শক্ত কিছু একটার আঘাত এসে লাগলো আমার মাথার পেছনে। শুধু বুঝতে পারলাম একটা ফুলদানি দিয়ে আমাকে আঘাত করা হয়েছে৷ আমি ক্রমশ
জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি…

.
.
.
চলবে…

লেখিকা- Tuba Binte Rauf

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে