#শেষ_পরিণতি
পর্ব ২
______________
রাজন বাইক থেকে নেমে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে, হাই বলে হ্যান্ডসেক করার জন্য নীলিমার দিকে হাত বাড়ালো।
নীলিমা রাজনের সাথে হাত না মিলিয়েই বলতে শুরু করলো,
-বাহ! বেশ স্মার্ট হয়ে গেছো দেখছি।
দামি বাইকও কিনেছো, বেশ ভালো।
রাজন মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
-হ্যা এখন আমার সব আছে। নিজেকে পুরো পাল্টে ফেলেছি, আর এই সব পরিবর্তন শুধু তোমার জন্য নীলিমা। এখনও কি আমাকে বিয়ে করতে তোমার আপত্তি আছে?
রাজনের কথা শেষ হতে না হতেই নীলিমা হো হো করে হেঁসে উঠলো।
আমি নীলিমার হাসির কারণটা বুঝতে না পেরে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।
ও থামিয়ে বলল,
-আর ইউ সিরিয়াস রাজন!
তুমি জানো আমাকে কতো মানুষ ভালোবাসে?
কত ছেলেরা আমাকে দেখার জন্য হা তাকিয়ে থাকে? না জানলে খোঁজ নিয়ে দেখো। আমাকে ভালোবাসার মতো মানুষের আমার অভাব নেই।
শত শত বিয়ের প্রস্তাব রিজেক্ট করতে করতে আমি ক্লান্ত, কিন্তু তারা সবাই কোয়ালিটি ফুল। গাড়ি বাড়ি কোনোকিছুর অভাব নেই তাদের। সেখানে তুমি এসেছো আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে?
কাককে ময়ূরের পাখনা পড়ালে যেমন সে ময়ূর হয়ে যায় না, তেমনই চোখে সানগ্লাস, পরনে ভালো শার্ট প্যান্ট আর একটা বাইক হলেই সে আমার যোগ্য হয় না।
আমি চাই না, প্রথমবারের মতো কিছু হোক তোমার সাথে। একটা কথা মনে রেখো, আমি তোমার থেকে হাজার গুন বেটার লাইফ পার্টনার ডিজার্ভ করি।
নীলিমার কথা শুনে রাজনের হাসিমুখটা কালো হয়ে গেল। সাথে বিষন্ন হয়ে গেল আমার মনটাও। আমি নীলিমাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
-তুই কি বলছিস এগুলো। রাজন ভাইয়া তোকে ভালোবাসে, এভাবে কাউকে কষ্ট দেওয়া ঠিক না।
-চুপ কর তুবা। আমি তো শুধু তার জায়গাটা বুঝিয়ে দিচ্ছি। এতে কেউ কষ্ট পেলে আমার কি?
কেউ যদি জেনেশুনে গোলাপকে মুঠোয় চেপে ধরতে চায়, তাহলে কাঁটায় তার হাত ক্ষত বিক্ষত হবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়!
নীলিমার কথার কোনো প্রতিউত্তর আমি দিলাম না।
রাজনের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখ পানিতে ছলছল করছে। মনে হচ্ছে এখনই টুপ করে কষ্টগুলো পানি হয়ে ঝড়ে পড়বে।
চোখের পানি লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রাজন। দু’ফোটা পানি গড়িয়েই বললো গাল বেয়ে।
অস্ফুট স্বরে বলল,
-তোমার আরও বেটার চাই নীলিমা?
নিজের অহংকারকে জেতাতে গিয়ে নিজে হেরে যাচ্ছো না তো? রূপ কিন্তু আজীবন থাকে না। অস্থায়ী এই রূপের জন্য এতো কেন অহংকার?
-রূপ আছে বলেই তো তোমার মতো হাজারটা রাজন আমার পিছনে ঘোরে। এরপরেও বলবে রূপ ভালোবাসার কাছে কিছু না?
রাজন আর কিছু করে না, মাথা নিচু করে বলে আমিও দেখতে চাই এই রূপ তোমার জীবন পথে কতোটা সঙ্গ দেয়।
নীলিমা তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে গন্তব্যের দিকে পা বাড়ায়।
আমি রাজনের দিকে ফিরে লজ্জিত কন্ঠে বলি,
-নীলিমার তরফ থেকে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। ও একটু অবুঝ ধরনের, ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। তবে প্রকৃতপক্ষে আপনি অনেক ভালো একজন মানুষ। ভালোবাসাকে সম্মান করতে জানেন, যেটা সবাই পারে না।
রাজন চোখের পানি মুছে মুখে একটু হাসি টেনে বলল,
-ধন্যবাদ।
আপনারা দুইবোন অথচ দুইজন কতো আলাদা।
তার হয়ে আপনার ক্ষমা চাইতে হবে না। ভালো থাকবেন। সুস্থ থাকবেন।
কথাগুলো বলে রাজন বাইকে উঠে চলে গেল।
নীলিমার হেঁটে একটা আইসক্রিমের দোকানে দাঁড়িয়েছে। আজ আমার আইসক্রিম খাওয়ার মন নেই। তাই নীলিমা আইসক্রিম খাচ্ছে আর আমি পাশে দাঁড়িয়ে ভেবে যাচ্ছি অনেককিছু।
আল্লাহ আমাকে এমন অহংকারী রূপ দেননি বলে মনে মনে কেন জানি অনেক শুকরিয়া আসলো।
রাত ১২ টা বাজে।
বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি। অজানা কারণে ঘুম আসছে না একটুও। বার বার চোখের সামনে রাজনের কান্না মাখা মুখটা ভেসে উঠছে।
যতবার রাজনের কথা মনে পড়ছে ততবারই বুকটা কেঁপে উঠছে। কেন এমন হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না। তবে একটা ব্যাপার আমি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি, রাজনের কষ্টে আমারও কষ্ট হয়।
রাজনের মতো একটা ছেলে,কখনোই এতো কষ্ট ডিজার্ভ করে না।
রাজনকে বলা নীলিমার কথাগুলো মনে পড়তেই মনটা আবারও কেঁদে উঠলো।
.
.
.
পরদিন রওনা হলাম দু’জন।
কিছুদূর আগাতে সামনে দেখলাম ফাহিম দাঁড়িয়ে আছে। ফাহিমকে দেখে নীলিমা বলল,
-তুবা তুই এগিয়ে যা আমি আসছি।
আমি কথা না বাড়িয়ে দ্রুত পা চালালাম।
পেছনে পেছনে নীলিমা এবং ফাহিম আসছে।
কলেজের কাছাকাছি এসে আমার হার্টবিট বেড়ে গেল।
চারদিকে নজর বুলাচ্ছি। মনে হচ্ছে কিছু যেন খুঁজে চলেছি।
কিন্তু কি খুঁজছি বুঝে উঠতে পারছি না।
মনে হচ্ছে কাউকে দেখতে না পেলে বোধহয় দমটা বন্ধ হয়ে আসবে।
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম রাস্তায়। নীলিমা আর ফাহিম কাছে এসে বলল,
-কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
কলেজে চল।
-তোরা যা আমি আসছি, একটু কাজ আছে।
-তোর আবার কি কাজ? আচ্ছা যাই হোক আমরা যাচ্ছি তুই তাড়াতাড়ি চলে আসিস।
নীলিমা চলে গেল কলেজের ভেতরে।
প্রায় ১৫ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি।
কিন্তু কেন দাঁড়িয়ে আছি সেটা আমার অজানা।
দৃষ্টি যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কারো জন্য।
আচমকা একটা বাইক এসে থামলো আমার পাশে।
হর্ণের শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি রাজন বসা বাইকে।
এতক্ষণের সব অশান্তি রাজনকে দেখে নিমিষেই প্রশান্তিতে বদলে গেলো। বুঝতে দেরি হলো না, দুচোখ এতক্ষণ রাজনকেই খুঁজছিলো।
কিন্তু কেন? উত্তরটা খুঁজে পেলাম না।
-আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন?
আপনার সাথে আজতো আপনার বোনও নেই দেখছি।
আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে, বললাম
-একটু কাজ ছিলো তাই। নীলিমা কলেজে চলে গেছে। আপনি কথা বলবেন ওর সাথে,ডেকে দেবো?
-না না। নীলিমার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। যে মানুষকে সম্মান দিতে জানে না, তার থেকে দূরে থাকাই ঠিক। কষ্ট হলেও ভুলে যাবো।
কথাগুলো বলার সময় রাজনের কন্ঠটা ভারী হয়ে আসলো।
আমি বললাম,
-পৃথিবীতে সবকিছু চাইলে তো আর পাওয়া যায় না। ধৈর্য্য ধরুন আল্লাহ হয়ত আপনার জন্য ভালো কিছু রেখেছেন।
আচ্ছা আজ তাহলে আমি আসি, অন্যদিন কথা হবে, বলেই আমি কলেজের দিকে হাঁটা শুরু করলাম।
রাজন বাইক নিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো।
.
.
.
সেদিন কলেজে আমার একদমই মন বসলো না।
সবসময় অনেক অন্যমনস্ক ছিলাম।
বেশকিছু প্রশ্ন জমে আছে মনে।
রাজনকে দেখার জন্য মনটা এতো উতলা হয়ে ওঠার কারণটা বুঝে আসছে না।
রাজনের চিন্তা আমার মনে গেঁথে বসে আছে।
কিছুতেই ভুলে আসছে না।
আচ্ছা এটা কি ওর প্রতি আমার মায়া?
নাকি তার ভালোবাসার প্রতি সম্মান দেখে তৈরি হওয়া ভালো লাগা?
ওকে ভালোবেসে ফেলেছি এমন নয়তো?
নিজের কাছে এতোগুলো প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না।
অগত্যা মনকে শান্ত করে অন্যকাজে লেগে গেলাম।
.
.
.
আজ শুক্রবার।
কলেজ বন্ধ,তবুও এতো সকাল সকাল মা’র ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙায় বেশ বিরক্ত লাগছে আমার।
ঘুম ঘুম চোখে বললাম,
-কি হয়েছে মা ডাকছো কেন?
এই একটা দিনই তো সকালে ঘুমানোর সুযোগ হয়।
-বাড়িতে মস্ত বড় ঝামেলা বেঁধে গেছে, আর তুই আছিস ঘুম নিয়ে।
তাড়াতাড়ি ওঠ।
মায়ের কথাশুনে নিমিষেই ঘুম চলে গেল।বাহির থেকে অনেক শোরগোলও কানে এলো।
আমি শোয়া থেকে উঠে বললাম,
-ঝামেলা হয়েছে মানে?
কিসের ঝামেলা! আর বাইরে এতো হৈচৈ কেন?
-আরে নীলিমা ভোরবেলা বাসা থেকে পালিয়ে গেছে। তোর কাকার আলমারি থেকে টাকা ও অনেক গয়নাও নিয়ে গেছে। এখন বাইরে আয়, তোর বাবা ও কাকা তোর সাথে কিছু কথা বলতে চায়।
মা’র কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম।
নীলিমা পালিয়ে গেছে মানে!
আমি ঠিক শুনছি নাকি বুঝতে কোনো ভুল হয়েছে!
.
.
.
চলবে
– তুবা বিনতে রউফ