শেষটা সুন্দর ২ পর্ব-০১

0
1391

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১।

‘তোর একটা হ্যান্ডসাম ভাই আছে না, সারাজ ভাই? উনাকে না আমার ভীষণ মনে ধরেছে। উনার সাথে আমাকে একটু কথা বলিয়ে দিবি, প্লিজ।’

বেশ অকপটে সুশ্রী আবেদন। অথচ এই সুন্দর, সুশীল কথাটাই ভীষণ বিদঘুটে ঠেকল পুতুলের কাছে। শান্তশিষ্ট মনটা নিমিষেই অশান্ত হয়ে উঠল। তরতরিয়ে রাগ উঠে গেল মাথার তালুতে। ধরাস ধরাস করে সেই তালু লাফাচ্ছে। ইচ্ছে করছে প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর ফর্সা গালটাতে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু, এতটা রুক্ষতা তার সাথে মানায় না। নিজেকে যথেষ্ঠ শান্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে উঠে দাঁড়ায় পুতুল। বেচারি লীনা পুতুলের ভাবমূর্তি বোঝতে সক্ষম হয় না। সে তার হাত টেনে ফের প্রশ্ন করে,

‘কিরে, কিছু বলছিস না কেন? আমাকে ভাবি হিসেবে তোর পছন্দ হয়নি?’

পুতুলের স্বচ্ছ চোখ দুটি কেমন যেন লাল লাল হয়ে উঠে। কী সাংঘাতিক কথা বলেছে মেয়েটা! এই মেয়ে কি আদৌ জানে, সেকি ভয়ানক কথাবার্তা সে বলছে? অন্যের জিনিসের প্রতি নজর দেওয়া মোটেও ভালো কাজ না। এমন একটা জঘন্য খারাপ কাজ তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী কী করে করতে পারল? অবশ্য তার’ই বা দোষ কীসের। ওমন একটা তাগড়া যুবক যদি তার উপচে পড়া সৌন্দর্য্য নিয়ে নিয়ে মেয়েদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়, মেয়েদের নজর তো তার উপর পড়বেই। এটাই স্বাভাবিক। এখানে তো লীনার কোনো দোষ নেই। সব দোষ তো ঐ সারাজের। ওকে কে বলেছিল, সারাক্ষণ ওমন হ্যান্ডসাম সেজে মেয়েদের আশেপাশে ঘুরতে?

ফোঁস ফোঁস শ্বাস ফেলে পুতুল। নিজের সুপ্ত রাগকে সংবরনের চেষ্টা চালাচ্ছে। লীনা চোখ পিটপিট করে পুতুলকে দেখে। মেয়েটার হলো কী? কোনো জবাব দিচ্ছে না কেন? সে পুনরায় কিছু বলতে যাবে, তার আগেই পুতুল তাকে থামিয়ে দিয়ে ঠান্ডা স্বরে বলল,

‘দেখ লীনা, কাউকে পছন্দ করা খারাপ কিছু না। তবে পছন্দ করার আগে অবশ্যই আগে দেখে নিবি সেই জিনিসের উপর আগে থেকেই কারোর কর্তৃত্ব আছে কিনা। যদি দেখিস যে, না নেই। তবে নির্দ্বিধায় তাকে নিজের করে নিবি। আর যদি আগে থেকেই সেই জিনিস অন্য কারোর অধিকারে থাকে, তবে তার দিকে নজর না দেওয়াই ভালো।’

কথাগুলো লীনার মোটা মাথায় ঢুকল না। সে বিরক্ত হলো ভীষণ। এই মেয়ে কীসব বলছে? সে মাথা চুলকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কী বললি তুই, আমি তো কিছুই বুঝিনি।’

পুতুল গুমোট হয়ে বসে রইল এক পল। লীনা চোখ মুখ কুঁচকে চেয়ে রইল। কিছু সময় পর পুতুল তার দিকে চেয়ে শান্ত স্বরে বলল,

‘সারাজ ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড আছে।’

লীনার চোখে মুখে আষাঢ় নেমে আসে। যেন মুহুর্তেই বুকটা ভেঙে খান খান হয়ে যায়। ছোট্ট মনটা প্রেম হওয়ার আগেই বিচ্ছেদের কষ্টে মুখ থুবড়ে পড়ে। সে বুকের বা পাশে হাত রাখতেই পুতুল চোখ মুখ কুঁচকে বলে,

‘কী হয়েছে?’

‘এখানে ব্যথা করছে খুব। মনে হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক হবে।’

পুতুল ভীষণ রকম তেতে উঠল যেন। তবে মুখচ্ছবি স্বাভাবিক রাখে। লীনার হাত টেনে ধরে বলে,

‘চল, চা খেয়ে আসি।’

লীনা ভারাক্রান্ত চোখে চাইল। তার অতি প্রিয় বান্ধবী তার কষ্টে কষ্টিত না? এত নির্দয় তার বান্ধবী! সে জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘তোর কি আমার কষ্টে কষ্ট লাগছে না, দোস্ত?’

পুতুল মাথা নাড়িয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল,

‘একদমই না। বরং ভীষণ খুশি লাগছে। এমনটাই হওয়া উচিত ছিল। না জেনে শুনে যাকে তাকে পছন্দ করে বসলে এমনই হবে। এর থেকে শিক্ষা নিয়ে রাখ, যেন ভবিষ্যতে আর এই ভুল না হয়।’

লীনা দুঃখে নাক টানে। কান্নার ছিটেফোটাও চোখে নেই। তবুও এমন একটা ভাব ধরছে যেন, কান্নার ঢল নেমেছে। পুতুল বিরক্ত গলায় বলে,

‘নাক টানাটানি শেষ হলে এবার চল, চা খেয়ে আসি।’

অগত্যাই পুতুলের পেছন পেছন লীনাকে যেতে হলো। এত দুঃখ পেয়ে কোনো লাভ নেই। আর সারাজের গার্লফ্রেন্ড থাকাটাই স্বাভাবিক। ওমন একটা ডেশিং বয় কখনো সিঙ্গেল থাকতেই পারে না। এই কথাটা আগেই লীনার ভাবা উচিত ছিল। যাকগে, হৃদয়ের দুর্বলতা বাড়ার আগেই পুতুল তাকে জানিয়ে দিয়ে ভালো করেছে। মনে মনে খুশি হয়ে এক হাতে পুতুলকে জড়িয়ে ধরে। পুতুল ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলে,

‘কী হয়েছে?’

‘থেংক্স, দোস্ত। তুই না বললে তো আমার প্রেম তরতর করে বেড়ে যেত। ভাগ্যিস, আগেই জেনে গিয়েছি; নয়তো পরে আরো বেশি কষ্ট পেতাম।’

পুতুল এবার দুঃখী দুঃখী মুখে তার দিকে চেয়ে বলে,

‘থাক, কষ্ট পাস না। তোর জন্য সারাজ ভাইয়ের চেয়েও হ্যান্ডসাম রাজপুত্র আসবে। অপেক্ষা কর।’

চোখে মুখে রাজ্যের দুঃখ প্রকাশ করলেও মনে মনে সে মারাত্মক খুশি। অন্তত, তার বান্ধবীর তো আর তার সতীন হওয়ার চান্স নেই। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

_________

চায়ের কাপে চুমুক দিতে যাবেই সেই মুহুর্তে মনে হলো তার ডান কানটা তীব্র যন্তণার সাথে কুঁচকে যাচ্ছে। পুতুল সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠে। চা রেখে হাত কানের কাছে নিতেই, টের পায় শক্ত পোক্ত এক হাতের স্পর্শ। পুতুল জানে এই হাতের মালিক কে। তাই চোখ কুঁচকে তেঁতে উঠে চেঁচিয়ে বলে,

‘কান ছাড়ো। আমার লাগছে।’

ছাড়ল না সে। উল্টো আরো চাপ দিল। পুতুল রীতিমতো চিৎকার দিয়ে উঠে। পাশে লীনা ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে। পাশ থেকে ভরাট গম্ভীর গলায় কেউ বলে উঠে,

‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে টং এর চা খাওয়ার খুব শখ, না? আজকে তোর সব শখ বের করছি। এক্সট্রা ক্লাসের নামে এসব চলছে? আজ যদি আমি মা’কে না বলেছি।’

পুতুল জোর করে কান থেকে তার হাত সরাল। এতক্ষণে যেন প্রাণ ফিরে পেল সে। কানটা জ্বলে যাচ্ছে। দু বার হাতের তালু দিয়ে কান ঘষে কটমট করে সারাজের দিকে চায়। সারাজের চোখ মুখ তার থেকেও দ্বিগুণ কঠিন। পুতুল কান ডলতে ডলতে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,

‘বললে বলো গিয়ে; আমি কাউকে ভয় পাই নাকি।’

খুব সাহস নিয়ে কথাটা বলল সে। তার কথায় সারাজের ঠোঁটের কোণে ক্রূর হাসি ফুটে। ওর এই চমৎকার সুন্দর হাসি পুতুলকে ভীত করে। এই ছেলেটা যে তাকে মা’র কাছে বকা খাওয়ানোর জন্য সব করতে পারে সেটা সে ভালো করেই জানে। যতই এখন সাহস দেখাক না কেন, মায়ের সামনে গেলেই সব সাহস ফুঁস হয়ে যাবে তার।
সারাজের মুখ শক্ত হয়। গলার স্বরে রাগ ঢেলে বলে,

‘খুব সাহস না তোর? আচ্ছা, আমিও দেখি কতক্ষণ এই সাহস ধরে রাখতে পারিস। চল।’

সারাজ এগিয়ে তার বাইকে গিয়ে বসে। ইশারায় পুতুলকে তার পেছনে বসতে বলে। পুতুল চোখে মুখে অসহায় ঢেলে লীনার দিকে তাকায়। লীনা জোরপূর্বক হেসে বলে,

‘যা তুই। বাই।’

নিরুপায় হয়ে বাইকে উঠে বসে পুতুল। একটু দূরত্ব রাখে। এই দূরত্ব অভিমানের। সারাজ লুকিং গ্লাস ঠিক করে পুতুলের অভিমান মাখা মুখটা একবার পরখ করে নেয়। মনে মনে ভীষণ খুশি হলো সে। তার সাথে টক্কর দিতে আসলে এমনই হবে। মনে মনে বিজয়ীর হাসি হেসে বাইকটা স্টার্ট দেয়।

.

বাইক এসে থামে, খান ম্যানশনের সামনে। সারাজ সোজা হয়ে বসে পেছনে ঘাড় কাত করে বলে,

‘কী ব্যাপার, নামছিস না কেন?’

পুতুল নেমে দাঁড়ায়। সারাজ বাইক থেকে চাবিটা খুলে আঙ্গুল দিয়ে সেটা একবার ঘুরিয়ে পকেটে পুরে নেয়। তারপর সোজা হাঁটা ধরে। দু কদম গিয়ে আবার ফিরে তাকায়। দেখে, পুতুল এখনও আগের জায়গাতেই স্থির। বিরক্ত হয় সে। প্রশ্ন করে,

‘কিরে, এমন স্ট্যাচু হয়ে আছিস কেন? হাঁটতে পারছিস না?’

পুতুল মিইয়ে যাওয়া চোখ মুখ নিয়ে একপ্রকার ছুটে আসে সারাজের কাছে। অনুরোধের সুরে বলে,

‘মা’কে কিছু বলো না, প্লিজ। মা খুব বকবে।’

সারাজ বুকের উপর হাত ভাঁজ করে টানটান হয়ে দাঁড়ায়। মেয়েটাকে ভয় পেতে দেখলে তার বেজায় আনন্দ লাগে। আপাতত সেই আনন্দ সে প্রকাশ করল না। চোখ মুখ গম্ভীর করে বলল,

‘সব সাহস শেষ? এমনি এমনি তো তোকে মাফ করা যাবে না। বড্ড সাহস বেড়েছে তোর। মা’কে এই ব্যাপারে জানাতেই হবে।’

ছলছল করে উঠে পুতুলের স্বচ্ছ চোখের দৃষ্টি। তাতে কষ্ট নয়, বরং মজা পাচ্ছে সারাজ। পুতুল পুনরায় কিছু বলতে যাবে, তার আগেই সারাজ গুমোট স্বরে বলে,

‘তোর কথা শুনব, তবে একটা শর্ত আছে।’

পুতুলের চোখের দৃষ্টি স্থির হয়। মস্তিষ্ক সজাগ হয়। সারাজের শর্ত মানে, তাকে পরাস্ত করার কোনো নতুন ফাঁদ। আপাতত এই ফাঁদে পা দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছে না পুতুল। মা’কে ভয় পায়, তার থেকেও বেশি চিন্তা তার বাবাকে নিয়ে। বাবা যদি শুনতে পারে যে, সে এক্সট্রা ক্লাসের কথা বলে বান্ধবীর সাথে ঘুরে বেরিয়েছে, আবার লোকাল চা দোকানে অত গুলো ছেলে মানুষের ভীড়ে দাঁড়িয়ে চা খেয়েছে, তবে ভীষণ অসন্তুষ্ট হবেন তিনি। পুতুল চায় না এমনটা হোক। বাবার মনে তার প্রতি বিরূপ কোনো মনোভাবের সৃষ্টি হোক, সেটা সে একদমই চায় না। তাই অগত্যাই তাকে সারাজের সামনে হার স্বীকার করতে হলো। ভগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল,

‘কী শর্ত, বলো।’

মেয়েটাকে বাগে পেয়ে সারাজের খুশির অন্ত নেয়। এমনই তো চায় সে। চিরকাল তার পুতুল তার কথায় চলুক। সে তো আর তার পুতুলের খারাপ চায় না। অথচ এই নির্বোধ মেয়ে বুঝলে তো সেসব।

চলবে…

(সারাজ পুতুলের দুষ্টু মিষ্টি সম্পর্ক নিয়েই এই সিজন ২। তবে সিজন ১ না পড়লেও এই সিজন আপনারা বুঝতে পারবেন। আমি সেইভাবেই লিখব। আশা করছি, মেহুল রাবীর আর সাদরাজ রিতার মতো ওরাও আপনাদের একরাশ ভালোবাসা পাবে। অবশ্যই মতামত জানাবেন। আর পছন্দ না হলে বেশি পর্ব করব না।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে