শেষটা সুন্দর ২ পর্ব-০২

0
775

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২।

‘আমি যখনই এখানে আসব, আমাকে তুই চা বানিয়ে খাওয়াবি। যতবার বলব ততবার বানাবি। আর অবাধ্য হলে তো জানিসই কী করব।’

সারাজের কথা শুনে পুতুল ক্ষুব্ধ হলো। মগের মুল্লুক নাকি! তাকেই তো তার মা চা বানিয়ে দেয়, আর সে নাকি এখন আরেকজনের জন্য চা বানানোর দায়িত্ব নিবে; জীবনেও না। সুযোগ পেলেই এই ছেলে তাকে দিয়ে কামলা খাটায়। এখন আবার নতুন ফন্দি এঁটেছে। সে গম্ভীর গলায় জবাব দিল,

‘আমি চা বানাতে পারি না।’

‘ইউটিউব দেখে শিখে নিস।’

দায়সাড়া ভাবে বলেই সারাজ সামনে পা বাড়াতেই পেছন থেকে পুতুল বলে,

‘শিখলেও তোমাকে চা বানিয়ে খাওয়াবো না।’

সারাজ ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে বলে,

‘ঠিক আছে, চল তবে মায়ের সাথে কথা বলি।’

পুতুল পড়েছে এই এক বিপদে। এই ছেলে তার জীবন ত্যানাত্যানা বানিয়ে ছেড়েছে। বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। সুযোগ একদিন তারও আসবে। আপাতত, শত্রু পক্ষের দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই। পুতুল দু হাত দুদিকে ছুড়ে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ঠিক আছে, আমি তোমার শর্তে রাজি।’

সারাজের ঠোঁট বাঁকে। যেই হাসি দেখে পুতুলের মাথার ভেতরে ধপধপ করছে। পারছে না, এর নাক বরাবর একটা ঘুষি মেরে দিতে। অবশ্য তার যে হাত আর হাতের শক্তি, এই ছেলের কাছে তার একটা ঘুষি একটা পিপড়ার কামড়ের সমতুল্য।

সারাজ হাত বাড়িয়ে পুতুলের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলে,

‘দ্যাট’স লাইক অ্যা গুড গার্ল।’

বলেই বাড়ির ভেতরে পা বাড়ায়। পুতুল তাকে ভেঙিয়ে বলে,

‘দ্যাট’স লাইক অ্যা গুড গার্ল। উনার কথা শুনলেই গুড গার্ল হয়ে যাই। যত্তসব।’

মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে বাড়িতে প্রবেশ করে সে। বসার রুমে পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করে বসে আছে সারাজ। একপলক তাকে দেখে পুতুল দৌড় লাগায় তার রুমে। এখানে থাকলেই তাকে আবার নতুন কোনো কাজের অর্ডার দিত।
পুতুলের ছুটে যাওয়া সারাজ বোকার মতো চেয়ে দেখে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সারাদিন ছোটাছুটি করা ছাড়া এই মেয়ের আর কোনো কাজ নেই।

.

বসার ঘরে সারাজকে দেখে মেহুল খুশি হয়। শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বলে,

‘কিরে, কখন এলি?’

সারাজ মৃদু হেসে সোজা হয়ে বসে। বলে,

‘এই তো এখনই, পুতুলকে ভার্সিটি থেকে নিয়ে এলাম।’

‘ওহহ, ঠিক আছে। ফ্রেশ হয়ে আয়, আমি দুজনের জন্য খাবার বাড়ছি।’

_______

খাবার খাওয়ার ফাঁকে সারাজকে আড়চোখে না দেখলে পুতুলের কখনোই পেট ভরে না। এই যে এই সুদর্শন যুবক কিঞ্চিত সময়ের জন্য তার সামনে আসে, এই কিঞ্চিত সময়ের প্রতিটা মুহুর্ত পুতুলের কাছে ভীষণ রোমাঞ্চকর। সময়টাকে আটকাতে পারলে হয়তো তাই করতো। এভাবে ক্ষুদ্র সময়ের সাক্ষাতে যে পুতুলের মন ভরে না, চোখের তৃষ্ণা মেটে না। এই কথাটা এই যুবককে সে কী করে বোঝাবে?

সারাজ মুখে লোকমা তুলতে গিয়ে পুতুলের সাথে চোখাচোখি হয়। পুতুল সঙ্গে সঙ্গেই চোখ নামিয়ে ফেলে। লজ্জা পায় ভীষণ। সারাজ সোজা হয়ে বসে। আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে একবার চেয়ে ক্ষীণ সুরে বলে,

‘আমাকে দেখলে পেট ভরবে না। পেট ভরাতে গেলে খেতে হয়। তাই আমাকে না দেখে খাওয়ায় মনোযোগ দে।’

লজ্জায় অস্বস্তিতে গলায় খাবার আটকায় পুতুলের। সারাজ তার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। ঢকঢক করে পানি শেষ করে পুতুল দম ফেলে। লজ্জা ঢাকতে নিজের চোখে মুখে মেকি রাগ ফুটিয়ে তুলে। নাক ফুলিয়ে বলে,

‘নিজেকে কি কোনো দেশের রাজপুত্র মনে করো? আর মনে করলেই বা কী? তোমার মতো এমন হাজারটা রাজপুত্র আমার পেছনে হাত ধুয়ে পড়ে আছে। ওদের রেখে আমার তোমাকে দেখার সময় আছে নাকি? আমি তো কেবল দেখছিলাম, তুমি ঠিকঠাক মতো খাচ্ছো কিনা।’

মনে মনে খুব করে চাইল, সারাজ ভাই যেন তার বলা এই ডাহা মিথ্যে কথাটা বিশ্বাস করে নেয়। কিন্তু, আদৌ বিশ্বাস করল কি না কে জানে। সে তার মাঝে আর কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়ার দেখল না।

সারাজ আস্তে ধীরে খাওয়া শেষ করে। পুতুল তখনও মিনমিনিয়ে খাচ্ছে। পণ করেছে, সারাজের দিকে আর তাকাবে না। সারাজ বেসিনে হাত ধুয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। ফিচেল স্বরে বলে,

‘আমি যদি রাজপুত্র হতাম, তোকে আমার রাজ্যের খাস দাসী বানাতাম। যার প্রধান কাজ হতো, আমার রাণীর সেবা যত্ন করা। আফটার অল, আমার প্রিয় পুতুল তুই। তোকে ছাড়া আমার রাণীর কী করে চলতো, বল? তবে চিন্তার কিছু নেই, তোর জন্যও আমার একজন রাজপুত্র ঠিক করা আছে। বাবার গাড়ির ড্রাইভার, মিলনকে আমার বেশ লাগে। তোর সাথে ভীষণ সুন্দর মানাবে। একবার চান্স নিয়ে দেখতে পারিস। আর না পারলে আমাকে বলিস, আমি ব্যবস্থা করে দিব।’

বলেই ঠোঁট বাকিয়ে হেসে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল সারাজ। ঐদিকে পুতুলের রাগে আর খাওয়া চলছে না। এত বড়ো অপমান! গা জ্বলে যাচ্ছে তার। এত নিষ্ঠুর, নির্দয় একজন মানুষ কী করে হতে পারে? সে কি এতটাই খারাপ? দাসী হওয়ার যোগ্য? সারাজ এভাবে বলতে পারল তাকে? রাগে দুঃখে আর খেতেই পারল না। খাবারের শেষ অংশটা প্লেটে রেখেই উঠে পড়ল। মেহুল ততক্ষণে গোসল সেরে রুম থেকে বেরিয়েছে। পুতুল বেসিনে হাত ধুয়ে এসে মায়ের আঁচলে হাত আর মুখ মুছে। এটা তার নিত্যদিনের অভ্যাস। মেহুল জিজ্ঞেস করে,

‘খাওয়া শেষ?’

‘হু।’

মেয়ের চোখ মুখ দেখে ফের প্রশ্ন ছুড়ল,

‘কী হয়েছে? রান্না মজা হয়নি?’

‘হয়েছে।’

‘তাহলে মন খারাপ কেন?’

পুতুল বিষন্ন গলায় বলে,

‘মা, তোমার ঐ আদরের ছেলে সারাজকে আমার একদম পছন্দ না। উনি সবসময়ই আমার সাথে ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলেন। আমার উনাকে একদম সহ্য হয় না। উনি দু’দিন পর পর এই বাড়িতে কেন আসেন, বলতো? উনার বাড়ি নেই? আমি আজ মামনির কাছেও বিচার দিব।’

মেহুল চোখ বুজে শ্বাস ফেলল। ছেলে মেয়ে দুইটা হয়েছেও এমন, একটা আরেকটাকে যেন সহ্যই করতে পারে না। অথচ ছোটবেলায় একজন অন্যজনের জান ছিল। বড়ো হওয়ার সাথে সাথে সম্পর্কটা এমন ঘোলাটে হচ্ছে কেন? এমন হলে তো তার আর রিতার ইচ্ছেটা অপূর্ণ’ই থেকে যাবে।

মেহুল নরম গলায় বলল,

‘তুমি যেমন এই বাড়ির মেয়ে, তেমনি সারাজও এই বাড়ির ছেলে। এই বাড়িতে তোমার অধিকার যতটা সারাজের অধিকার ও ঠিক ততটা। আর বড়ো ভাইয়েরা বোনদের এমন একটু শাসন করেই থাকে। এটা নিয়ে এত মন খারাপ করতে হয় না।’

মায়ের কথায় পুতুলের রাগ আরো চড়ে বসল। সে ক্ষিপ্ত কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল,

‘ও আমার ভাই না।’

বলেই হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। মেয়ের আচরণে মেহুল মাঝে মাঝে চিন্তায় পড়ে। মেয়েটা আসলে চায় কী? একবার মনে হয়, সারাজকে সে সহ্যই করতে পারে না। আবার মনে হয়, সারাজ ব্যতিত সে বোধ হয় দিশেহারা। বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা দুদিকে নাড়িয়ে মেহুল মনে মনে ভাবল, আজকালকার ছেলে মেয়েদের হাবভাব বোঝা বড়ো দায়। ওরা যে কী চায় আর না চায়, সেটা হয়তো ওরা নিজেরাও বুঝে না।

_______

সূর্যটা বোধ হয় বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাইরের রোদ কমে এখন নির্মল ঠান্ডা আবহাওয়া। দূরের রাস্তার নারকেল গাছগুলোর পাতা এদিক ওদিক দুলছে। ঐদিকে বাতাস খুব। বিকেলে একবার ঐদিকে হেঁটে আসলে মন ভালো হয়ে যায়। আর তার সাথে সেখানে বসা ফুচকা স্টলের ফুচকাগুলো যেন রোজ নিয়ম করে একবার পুতুলকে ডাকে। আর পুতুলের নরম তুলতুলে মন সেই ডাকের সাড়া না দিয়ে থাকতেই পারে না। আজও ডাকছে। পুতুলের মন তাই অস্থির। একবার যে সেখানে যেতেই হবে।

পরিপাটি হয়ে নিচে নামে পুতুল। বসার ঘরে বাবা আর সারাজ বসা। গল্প করছেন দুজনে। পুতুল ধীর পায়ে এগিয়ে বাবার পাশে সোফার হাতলে বসল। আড়চোখে একবার সারাজকে দেখে, তবে খুব সতর্কের সাথে।

রাবীর তখন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করে,

‘শুনলাম, আমার রাজকন্যার নাকি আজ খুব মন খারাপ? তা, বাবা কি তার রাজকন্যার মন খারাপের কারণ জানতে পারে?’

পুতুল ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে। কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করে,

‘বাবা, তোমার রাজকন্যাকে যদি কেউ তার রাজ্যের দাসী বানাতে চায়, তবে তুমি কী করবে?’

রাবীর মেয়েকে খুশি করতে শক্ত গলায় বলে,

‘তবে সেই মূর্খের গর্দান নিব আমি। আমার রাজকন্যাকে দাসী বানানোর স্বপ্ন কে দেখে, কার এত বড়ো বুকের পাটা?’

পুতুল নাক ফুলিয়ে বলে,

‘তোমার ঐ আদরের ছেলের।’

সারাজ এবার একটু নড়ে বসে। এতক্ষণ বেশ আয়েশ করে বসে সে পুতুলের পটরপটর শুনছিল। রাবীর ভ্রু বাঁকা করে তাকায়। সারাজ ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। বিদ্রুপের সুরে বলে,

‘বাবা, শুধু দাসী বলিনি তো; খাস দাসী বলেছি। মানে দাসীদের রাণী। এর থেকে ভালো অফার আর কিছু হতে পারে না কিন্তু। আমার মহলে থাকলে, থাকা খাওয়া সব ফ্রি; সাথে চা আর ফুচকার ব্যবস্থাও করে দিব। আমার খাস দাসী বলে কথা, হেলাফেলা করা যাবে না।’

সারাজের কথায় পুরোনো রাগ ধপ করে মাথায় চড়ে বসল পুতুলের। তেতে উঠে বলল,

‘বাবা, তুমি কিছু বলছো না কেন?’

রাবীর কোনোরকমে ঠোঁট চেপে হাসি আটকায়। মেয়েকে স্বান্তনা দিয়ে বলে,

‘আরে, ওর রাজত্ব থাকলেই না তুমি দাসী হবে। আর বাবা আছি না, দাসী না; সেই রাজ্যের রাণী বানাব তোমাকে।’

সারাজ সেই কথায় স্মিত হাসে। পুতুলের রাগ পড়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। মনে উদ্বেগ দেখা দেয়। ভেতর থেকে কেউ ফিসফিসিয়ে বলে,

‘এই, বাবা কি তোকে সারাজের রাজ্যের রাণী বানানোর কথা বলছেন?’ পুতুল সেই প্রশ্নে বোধ হয় লজ্জা পায়। সেই সত্ত্বাকে মনে মনে জবাবে বলে, ‘আশ্চর্য, আমি কী করে জানব?’

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে