#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৩।
বেশ কয়টা দিন পার হয়ে গিয়েছে। মেহুলের বাবা এখন অনেকটাই সুস্থ। মেহুলও আজকাল বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। সামনে পরীক্ষা তার, তাই এখন খুব চাপ। এই কিছু দিনে রাবীরের সাথেও বেশ একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার। তবে মেহুলের ঝগড়া করার স্বভাব এখনো যায়নি। ছোট খাটো ব্যাপার নিয়েও রাবীরের সাথে তার ঝগড়া করতেই হবে। যদিও রাবীর কোনোবারই তাকে কিছু বলে না। আর তাই প্রতিবার মেহুল’ই তার তর্কে জয়ী হয়।
_______
ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় রিতা বলল, সে একটু মার্কেটে যাবে, কিছু একটা নাকি কেনার আছে তার। মেহুল তাই ড্রাইভার কে বলল, গাড়িটা শপিং মলের দিকে নিয়ে যেতে।
রিতা আর মেহুল শপিং মলে ঢোকার পথেই কেউ একজন মেহুলকে ডেকে উঠে। মেহুল পেছনে ফিরে তাকায়। লোকটাকে তার খুব পরিচিত লাগছে। তবে পুরোপুরি চিনে উঠতে পারছে না। লোকটা তার চোখের সানগ্লাসটা খুলে মেহুলের সামনে এসে দাঁড়াল। মুখে চওড়া হাসি টেনে বলল,
‘কী হলো, চিনতে পারেননি?’
এবারের মেহুলের মনে পড়ল। হেসে বলল,
‘আপনি সাদরাজ?’
‘জি।’
‘কেমন আছেন?’
‘আমি তো আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। আপনার কী খবর? আর আপনার বাবা কেমন আছেন?’
‘আমি আর বাবা দুজনেই ভালো আছি।’
‘আপনাকে তো বলেছিলাম আপনার বাবার জ্ঞান ফিরলে আমাকে একবার জানানোর জন্য। কিন্তু, আপনি তো আর জানালেনই না।’
মেহুল অপ্রস্তুত হেসে বলে,
‘আসলে দুঃখিত, আমার না একদম খেয়াল ছিল না। স্যরি, প্লিজ কিছু মনে করব না।’
‘উম্ম, স্যরি টা এক্সেপ্ট করা যায় যদি আমার একটা কথা রাখুন।’
‘কী কথা?’
‘একসাথে বসে কি দু কাপ কফি খাওয়া যাবে?’
মেহুল রিতার দিকে চায়। রিতার চোখ মুখ কুঁচকে লোকটার দিকে চেয়ে আছে। মেহুল কী বলবে বুঝতে পারছে না। মুখের উপর না বলে দেওয়াটাও খারাপ দেখায়। সে ইতস্তত স্বরে বলল,
‘আসলে আমি আমার ফ্রেন্ড এর সাথে একটু শপিং এ এসেছিলাম। এখন কফি কী করে…’
‘সমস্যা নেই, আপনার ফ্রেন্ডকেও নিয়ে চলুন।’
মেহুল রিতার দিকে চেয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল সে রাজি কিনা। রিতা জবাব না দিয়ে আগের মতোই মুখ করে চেয়ে আছে। সাদরাজ আবারও প্রশ্ন করল,
‘কী হলো, কিছু বলছেন না যে?’
মেহুল উপায়ান্তর না পেয়ে বলল,
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। চলুন।’
সাদরাজ হাসল। এই তো পাখি ধীরে ধীরে তার খাঁচায় পা দিচ্ছে। সে বলল,
‘ঠিক আছে। এখানেই দোতলায় একটা কফি শপ আছে; চলুন, সেটাতেই বসি।’
সাদরাজ হাঁটা ধরল। তার পেছন পেছন মেহুল আর রিতাও হাঁটছে। রিতা মেহুলকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘এই লোকটা কে?’
‘ঐ যে বলেছিলাম না, একটা লোক বাবাকে রক্ত দিয়েছিলেন। উনিই তিনি।’
‘ওহহ।’
_______
কফি খেতে খেতে সাদরাজ বলল,
‘আন্টি ভালো আছেন?’
‘জি।’
‘আচ্ছা।’
সাদরাজ তারপর রিতার দিকে একবার চেয়ে মেহুলকে বলল,
‘আপনার ফ্রেন্ড এর সাথে তো পরিচয় করালেন না।’
মেহুল হেসে বলল,
‘ও রিতা, আমার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড। আর রিতার কাছে আমি আপনার কথা আগেই বলেছিলাম।’
‘তাই! তা আপনার পড়াশোনা কেমন চলছে?’
‘ঐ তো চলছে কোনোরকম। সামনে আবার সেমিস্টার ফাইনাল, এখন তাই খুব চাপ চাচ্ছে।’
‘কোন ইয়ারে এখন আপনি?’
‘থার্ড ইয়ারে আছি। এবার এক্সামের পর ফোর্থ ইয়ারে উঠব।’
‘আচ্ছা। অনার্স শেষ করার পর কী করার ইচ্ছা?’
‘আপাতত, আমার গান নিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার ইচ্ছা আছে। আর তারপর বাকিটা ভাগ্য।’
‘তাই? আপনি কি গান করেন?’
‘ঐ একটু আধটু ভার্সিটির ফাংশনে গাই আরকি।’
‘তাহলে তো আপনার গান একদিন শুনতে হয়।’
‘আমাদের পরীক্ষার পর ভার্সিটিতে একটা প্রোগ্রাম আছে, আমি সেখানে গান গাইব। আপনার আমন্ত্রণ রইল। এসে আমাদের ভার্সিটিও ঘুরে যাবেন আর আমার গানও শুনে যাবেন।’
‘তা তো অবশ্যই।’
সাদরাজ তারপর কফিটা শেষ করল। কিছুটা বিরতি নিয়ে বলল,
‘বিয়ে নিয়ে কী ভাবছেন?’
মেহুল ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘কার? আমার বিয়ে?’
‘জি।’
‘আমার বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে।’
সাদরাজ এমন একটা ভাব করল যেন সে কিছুই জানে না। সে অবাক হয়ে বলল,
‘ওমা! আপনি বিবাহিত?’
‘জি।’
‘আপনার হাজবেন্ড কী করেন?’
‘রাজনীতি।’
‘বাবা তাই! নাম কী উনার?’
‘আরিয়ান খান রাবীর।’
‘ওহহো, আপনি রাবীর খানের ওয়াইফ। আগে বলবেন না। আপনার হাজবেন্ড তো আমাদের এলাকার প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ। আপনি তার ওয়াইফ, সেটা আগে জানলে তো আরো বেশি করে সমাদর করতে পারতাম।’
মেহুল বেশ অস্বস্তিতে পড়ে। হালকা হেসে বলে,
‘না না, এভাবে ভাবার কিছু নেই। আমার হাজবেন্ড রাজনীতিবিদ বলে আমাকে আলাদা করে সমাদর দেখানোর কোনো দরকার নেই। আমি এসবে অভ্যস্ত না।’
‘সেটা অবশ্য আমি আপনাকে দেখেই বুঝেছি। আপনার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে তো এতক্ষণে অহংকারে মাটিতে পা’ই পড়তো না। আপনি অন্যরকম। রাবীর খানের কিন্তু খুব সৌভাগ্য, উনি আপনার মতো একজন মেয়েকে ওয়াইফ হিসেবে পেয়েছেন।’
‘আপনি কিন্তু এবার আমাকে অস্বস্তিতে ফেলছেন।’
সাদরাজ হাসে। বলে,
‘একদিন আপনার হাজবেন্ডের সাথেও বসে কফি খাওয়ার সুযোগ করে দিয়েন।’
‘অবশ্যই। আপনি বললে আমি এখনই কল দেই উনাকে।’
‘না না, উনি ব্যস্ত মানুষ। এমন হুট হাট করে কল দিয়ে উনাকে বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না। তার চেয়ে বরং অন্য
আরেকদিন কফি খাওয়া যাবে।’
‘ঠিক আছে, ভাইয়া। আপনার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগল। আজ আমরা উঠি, নয়তো বাসায় ফিরতে লেইট হয়ে যাবে।’
‘আচ্ছা, আবার দেখা হবে। আল্লাহ হাফেজ।’
মেহুল আর রিতা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে। রিতা বাইরে এসে হেসে বলে,
‘আমার কি মনে হয় জানিস, লোকটা বোধ হয় কষ্ট পেয়েছেন।’
‘কেন?’
‘তুই যখন বললি, তুই বিবাহিত। তখন উনার চেহারাটা দেখার মতো ছিল। ইশ, বেচারা বোধ হয় তোকে নিয়ে অনেক কিছু ভেবে ফেলেছিলেন। আর তুই এক নিমিষেই উনার হৃদয়টাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিলি।’
‘বেশি বুঝিস না? একদিনের পরিচয়ে উনি আমাকে নিয়ে অনেক কিছু ভেবে ফেলেছেন? সবাই তো তোর মতো, তাই না? আর তোর যদি উনার জন্য এতই মায়া হয়, তবে যা তুই’ই উনার গলায় ঝুলে পড়। তোদেরকে কিন্তু বেশ ভালো মানাবে।’
‘তা অবশ্য ঠিকই বলেছিস। ছেলেটা দেখতেও হেব্বি। কথা বলার স্টাইল ও সুন্দর। কী বলিস, একবার চান্স মেরে দেখব?’
মেহুল মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
‘আগে সামনে পরীক্ষায় কীভাবে পাস করবি সেই চিন্তা কর, বাকি সবকিছু পড়ে দেখা যাবে।’
________
মেহুল খাবার খাচ্ছে আর টিভি দেখছে। রামিনা বেগম এসে তার পাশে বসেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে জিজ্ঞেস করেন,
‘কালকে কি তোর কোনো ইম্পোরটেন্ট ক্লাস আছে?’
মেহুল টিভির দিকে চেয়েই জবাবে বলল,
‘হ্যাঁ মা, পরীক্ষার আগে সব ক্লাসই ইম্পোরটেন্ট।’
‘কালকে ক্লাস না করলে হয় না?’
মাত্রই মুখে লোকমা পুরেছিল মেহুল। সে ভরা মুখে মায়ের দিকে চেয়ে বলল,
‘কেন?’
‘রাবীরদের বাড়ি থেকে আমাদের কালকে দুপুরে দাওয়াত দিয়েছে। তাই বলছিলাম, কালকে আর ক্লাস করার দরকার নেই।’
মেহুল মুখের খাবারটা শেষ করে বলল,
‘কিন্তু মা, এখন ক্লাস মিস করলে আমি অনেক সাজেশন পাবো না। তাছাড়া উনারা হঠাৎ করে আমাদের দাওয়াত কেন দিল?’
‘কালকে নাকি রাবীরের বাবার মৃত্যু বার্ষিকী। সেই উছিলায় উনাদের কিছু আত্মীয়স্বজন আসবেন। তাই সাথে আমাদেরও ডেকেছেন আরকি। আর তুই এত চিন্তা করছিস কেন? রিতা তো ক্লাস করবেই, ওর থেকে না হয় সব সাজেশন নিয়ে নিবি। তাহলেই তো হয়।’
‘তাও যেতে হবে আমাকে?’
‘হ্যাঁ, তুই ঐ বাড়ির বউ। তুই না গেলে কী করে হবে?’
মেহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। যাব।’
চলবে …
#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৪।
মেহুল গোসল শেষ করে বেরিয়ে দেখল তার বিছানার উপর একটা শাড়ি রাখা। মেহুল বুঝে যায় এটা তার মা জননীর কাজ। তাই সে তার মা’কে ডাকে।
‘মা, এখানে শাড়ি কেন?’
‘পরার জন্য।’
মেহুল বড়ো বড়ো চোখ করে বলে,
‘কে শাড়ি পরবে?’
‘কে আর পরবে, তুই পরবি।’
‘মা, এই গরমে শাড়ি পরলে আমি একেবারে ম’রেই যাব। শাড়ি পরা অসম্ভব।’
রামিনা বেগম তার কথায় পাত্তা দিলেন না। তিনি শাড়িটা হাতে নিলেন। বললেন,
‘এই জন্যই এই নরমাল শাড়িটা দিয়েছি। নাহলে আরো ভারি শাড়ি দিতাম। আর এটা পরলে খুব বেশি গরমও লাগে না। কাপড়টা নরম আছে।’
‘না মা তাও। আর ঐখানে শাড়ি পরে যাওয়ার কী আছে?’
‘বিয়ের পর এই প্রথমবারের মতো শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছিস, একটু বউ বউ ভাব নিয়ে যেতে হবে না। যা, চুল মুছে তোয়ালে রেখে আয়; আমি শাড়িটা পরিয়ে দিচ্ছি।’
মেহুল চোখ মুখ কুঁচকে বিষন্ন সুরে বলল,
‘উফফ মা, তোমাকে কিছু বলেও লাভ নেই।’
.
‘দেখ, শাড়িটা কী ভালো মানিয়েছে তোকে?’
‘হ্যাঁ, আমার এখনই গরমে অস্থির লাগছে। এতক্ষণ কী করে এভাবে থাকব সেটাই ভাবছি।’
‘আরে কিচ্ছু হবে না। আস্তে আস্তে এই গরম সয়ে যাবে। এখন একটু সাজুগুজু করে নে। আমি তোর বাবাকে কাপড় দিয়ে আসি।’
‘আচ্ছা, যাও।’
________
গাড়ি থেকে নামতেই মেহুল চমকে গেল। তাদের আশেপাশে বেশ কিছু কালো পোশাক পরিহিত লোক এসে দাঁড়িয়েছেন। যাদেরকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ওরা গার্ড। আর তাদের সাথেই সামনে এসে হাজির হয় রাবীর। অন্যদিনের মতোই সাদা পাঞ্জাবী গায়ে একদম ক্যাজুয়াল হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। সে তার শ্বশুর শাশুড়িকে সালাম দিয়ে সাদরে গ্রহণ করে। মেহুলের দিকে চোখ যেতেই খানিকটা স্তব্ধ হয়। শাড়িতে স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। মেহুল চোখ সরায়। রাবীরের দেখার তৃষ্ণা না মিটলেও আপাতত তাকে চোখ সরাতে হচ্ছে। সে সবাইকে নিয়ে ভেতরে যায়। বাড়ির মেইন ফটকের সামনেই রাবীরের মা দাঁড়িয়ে ছিলেন। মেহুলের মা বাবার সাথে তিনি কুশল বিনিময় করেন। মেহুল গিয়ে উনাকে সালাম করে।
খাবার টেবিলে নাস্তার বাহার দেখে মেহুলের জ্ঞান হারানোর উপক্রম। এত খাবার কেউ বানায়? মেহুল অসহায় ভাবে খাবারগুলোর দিকে চেয়ে আছে। রাবীরের মা এসে তার পাশে বসলেন। আদর করে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী খাবে, মা? মিষ্টি খাবে?’
মেহুল কী বলবে। অস্বস্তি নিয়ে মুচকি হাসে কেবল। তার এই হাসির অর্থ ভদ্র মহিলা কী বুঝলেন কে জানে। তিনি মিষ্টি নিয়ে মেহুলের মুখের সামনে ধরলেন। মেহুলের যদিও মিষ্টি পছন্দ না। তাও সে ভদ্রতার খাতিরে মিষ্টিটা মুখে তুলল।
রাবীরের মা গিয়ে এবার উনার বেয়াই বেয়াইন কে আপ্যায়ন করেন। খাবার বেড়ে বেড়ে দেন। কী খাবেন না খাবেন বারবার প্রশ্ন করেন। রাবীর এতক্ষণ সেখানে ছিল না। কোথ থেকে এসে যেন সে মেহুলের পাশে গিয়ে বসে। মেহুল তারদিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেও সে তাকে খুব একটা পাত্তা দেয় না। বরং সে সেখানে কথার প্রসঙ্গে তার রাজনীতির কথা তুলে বসে। সামনে নির্বাচন, কীভাবে কী করবে না করবে সেসব ব্যাপারেই কথা বলে। মেহুলের মোটেও এসব কথা পছন্দ হচ্ছে না। বসে বসে কেবল বিরক্ত হচ্ছে সে।
কিছুক্ষণ বাদে রাবীরের মা বললেন,
‘রাবীর, মেহুলকে নিয়ে উপরে যাও। ওকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাও সবকিছু।’
‘জি মা।’
তারপর সে মেহুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘চলুন।’
রাবীর আগে যায়। মেহুল তার পেছন পেছন সিঁড়ি বেয়ে উঠে। উপরে উঠার পর রাবীর থেমে মেহুলের দিকে চায়। জিজ্ঞেস করে,
‘আগে কোথায় যাবেন?’
মেহুল ঠোঁট উল্টে বলে,
‘আপনার যেখানে খুশি।’
রাবীর ভ্রু কুঁচকে তার দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে বলে,
‘যেখানে খুশি?’
মেহুল চোখ মুখ খিঁচে বলে,
‘জি।’
‘ঠিক আছে, চলুন।’
মেহুল রাবীরের পেছন পেছন হাঁটে। একটা রুমের ভেতর গিয়ে সে থামে। মেহুলও থেমে যায়। রাবীরের দিকে তাকাতেই সে বলে,
‘এটা আপনার আর আমার ব্যক্তিগত কক্ষ, আর এখানেই আমরা আমাদের সুখ দুঃখ সাজাব।’
মেহুল ভেতরে প্রবেশ করে। পুরো রুমে চোখ বুলায়। বিশাল বড়ো রুম। খুব বেশি ফার্নিচারের ঝামেলা নেই। একদম পরিপাটি সবকিছু। তার সাথে সবকিছু ঝকঝকে পরিষ্কার। বিছানার পাশেই একটা বিশাল জানলা। সেদিক দিয়ে বাতাস আসছে খুব। এই দুপুরের গরমেও যেন বেশ শান্তি লাগছে তার। খাটের বিপরীত পাশে একটা বুক সেলফ রাখা। এত বই সেখানে! লোকটা এত বই পড়ে?
মেহুল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বারান্দাটা বোধ হয় তাদের অর্ধেক রুমের সমান হবে। মেহুল তো এই বারান্দা দেখে খুব খুশি। এর মাঝেই সব ভেবে ফেলেছে সে। এই বারান্দা সে তার নিজের মনের মতো সাজাবে। কোথায় গাছ লাগাবে, কোথায় দোলানা টানাবে সব ঠিক করে ফেলেছে সে।
‘আপনার রুম পছন্দ হয়েছে?’
মেহুল চমকে পেছনে তাকায়। দেখে রাবীর তার খুব কাছে। সে মৃদু হেসে ইতস্তত সুরে বলে,
‘জি।’
‘তাহলে চলে আসুন। আপনাকে ছাড়া এই রুমটা বিশাল এক শূন্যতায় ভুগছে।’
মেহুল মাথা নুইয়ে মৃদু সুরে বলে,
‘সময় হলে আসব।’
রাবীর নিশ্বাস ফেলে। বলে,
‘আর এই সময়টা কখন হবে?’
মেহুল তার দিকে চেয়ে বলে,
‘আরো এক বছর পর।’
রাবীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘আরো এক বছর?’
‘জি।’
‘আর ততদিন পর্যন্ত যদি আমি না থাকি?’
কথাটা শুনে মেহুল যেন থমকে যায়। মুখটা ছোট হয়ে যায় তার। ভয় পায়। ভীত সুরে বলে,
‘কেন থাকবেন না? আপনি আমার সাথে আজীবন থাকবেন।’
রাবীর আরেকটু আগায়। মেহুলের ওষ্ঠযুগল কাঁপছে। রাবীরের দৃষ্টি সেদিকেই যায়। মনে ঘোর লাগে তার। সে তার সেই তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি বহাল রেখেই বলে,
‘আমাদের রাজনীতিবিদদের জীবনের কোনো ভরসা নেই। প্রতিবার নির্বাচন এলেই মা আতঙ্কে থাকেন, এই বুঝি তিনি তার ছেলেকে হারালেন। আমারও শত্রুর অভাব নেই। কখন কী হয় বলা তো যায় না। হতেও তো পারে এক বছর পর আমি আর থাকলাম না। তখন?’
মেহুলের বুকে মোচড় দেয়। এই কয়দিনে এই লোকটার উপর যে তার এত মায়া জন্মাবে তা সে মোটেও কল্পনা করেনি। এই মুহুর্তে তার মনে হচ্ছে, এই লোকটার অনুপস্থিতি যেখানে সে কল্পনাও করতে পারবে না, সেখানে সেই ভয়ংকর বাস্তব সে কী করে মেনে নিবে?
মেহুল রাবীরের দিকে চাইতেই তার দৃষ্টি দেখে সে আরো বেশি অস্বস্তিতে পড়ে যায়। ঢোক গিলে। কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু, কথা সব গলাতেই আটকে থাকে। রাবীর আর তার মাঝে হয়তো কয়েক ইঞ্চির দুরত্ব। রাবীর আরেকটু এগুতেই মেহুল চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। অস্বস্তিতে শরীর জমে গিয়েছে তার। বুক এত ধরবর করছে যে, মনে হচ্ছে হৃদপিন্ড বোধ হয় এখনই তার বেরিয়ে আসবে। কিছুক্ষণ বাদেই কপালে সে উষ্ণ কিছুর ছোঁয়া পায়। সে বুঝতে পারে সেটা কী। রাবীর এবার পিছিয়ে আসে। মেহুল এখনও চোখ বুজেই দাঁড়িয়ে আছে। রাবীর তা দেখে মুচকি হাসে। নরম গলায় বলে,
‘আরো চুমু লাগবে?’
ফট করে চোখ মেলে তাকায় মেহুল। রাবীরের মুখের হাসি দেখে লজ্জায় মিশে যায় সে। এই লোকটা আজকাল বড্ড বেশরম হয়ে যাচ্ছে। সে চোখ মুখ কুঁচকে রাগি গলায় বলল,
‘আপনি যে এমন লাগামহীন কথা বার্তা বলেন সেটা তো আগে জানতাম না। সবাইকে কি আপনার মতো বেশরম ভাবেন নাকি?’
রাবীর নিচের ঠোঁটকে কামড়ে ধরে হাসে। মেহুল সেই হাসি দেখে আবার ঢোক গিলে। বারান্দার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলে,
‘এই যে নেতা সাহেব, খবরদার আর এমন কিছু করেছেন তো। আপনার বাড়িতে এসেছি বলে আপনি যা খুশি তাই করতে পারবেন, ভুলেও তা ভাববেন না। এখন আর ঝগড়া করার মুড নেই বলে কিছু বললাম না। নাহলে আজকে আপনার খবরই ছিল।’
মেহুল এই বলে দ্রুত সেই রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আর রাবীর তার কর্মকান্ড দেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসে আর ভাবে, “যেখানে তার দিকে কখনো কেউ চোখ তুলে তাকানোর সাহসও পায়না সেখানে এই মেয়ে তাকে মিনিটে মিনিটে হুমকি দিচ্ছে।”
চলবে…