শূন্য অনুভূতি পর্ব-০১

0
1951

#শূন্য_অনুভূতি
#রোকসানা_ইয়াসমিন
#পার্ট:”এক”

পুরো বিয়ে বাড়ি স্তব্ধ হয়ে রয়েছে।আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অতিমাত্রায় সুদর্শন এই লোকটার কথায় আমার মাথা পুরো হ্যাং মেরেছে।আচ্ছা,এই লোকটার মাথা খারাপ টাইপ কোনো ওসুখ নেই তো?নয়তো একটা অজানা অচেনা মেয়েকে হঠাৎ কেউ কেন বিয়ের প্রস্তাব দেবে তাও আবার এভাবে।আমি অবাক করা দৃষ্টি উনার দিক থেকে সরিয়ে বাবার দিকে নিয়ে গেলাম।বাবাও অবাক চোখে লোকটার দিকেই তাকিয়ে আছে।শুধু বাবাই নয় বিয়ে বাড়ি সবাই উনার দিকেই তাকিয়ে আছে।লোকটা আমার বাবার অফিসের এমডি সাহিত্য চৌধুরি।বার কয়েক বাবাকে টিফিন দিতে গিয়ে উনার সামনে পরতে হয়েছে আমায়।যতবার ই উনার সামনে পরেছি ততবারই একটা দমবন্ধ কর অনুভুতির শিকার হয়েছি আমি।জানি না কেন?তবে যখনই উনাকে দেখতাম বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধক করে উঠতো।কিন্তু উনি প্রতি বার স্বাভাবিক ছিলেন।উনার ব্যবহারে কখনো এমন কিছু প্রকাশ পায়নি যার কারণে আজ তার হঠাৎ দেওয়া এই প্রস্তাবটা আমার কাছে যৌক্তিক বলে মনে হতে পারে।না উনি আমার সম্পর্কে কিছু জানেন নাই আমি উনার সম্পর্কে বেশি কিছু জানি।আমাদের মাঝে কখনো কোনো কথা পর্যন্ত হয়নি।তাহলে হঠাৎ এমন কি হলো যার কারণে উনি আমায় বিয়ের প্রস্তাব দিলেন।আমার এসব ভাবনার মাঝেই বাবা উনার দিকে কিছু টা এগিয়ে গেলেন,
“স্যার,এসব কি বলছেন আপনি?আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
এবার সাহিত্য চৌধুরি আমার বাবার দিকে তাকালেন।
“বুঝতে না পারার মতো তো কিছু ঘটে নি মি. রায়হান।আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।এক্ষুনি আর এই মূহুর্তে।”
আমার বুকটা ধক করে উঠল।আমি নিশ্চিত এই লোকটার মাথা খারাপ আছে নয়তো এরকম কথা কেউ বলে।আমি অসহায় দৃষ্টিতে আমার বাবার দিকে তাকালাম।বুঝতে পারলাম না বাবার মাথায় কী চলছে!কিন্তু শেষমেষ আমার বড় বোনের সাথে সাথেই উনার সাথে আমার বিয়েটাও সম্পন্ন হলো।
.
.
.
.
.
বাসর ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।আজ যা ঘটল বা ঘটে চলেছে তা সত্যি ই একটা স্বপ্নের মতো।আচ্ছা,আমি স্বপ্ন দেখছি না তো!নিজের ভ্রম কাটানোর জন্য নিজেই নিজের হাতে চিমটি কেটেই ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলাম।ঠিক সেই সময়েই দরজা খোলার শব্দে চট করে পেছনে ফিরে তাকালাম।উনি দরজা লাগিয়ে সোজা কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গেলেন।উনার ভাব দেখে এমন মনে হচ্ছে যেন এই ঘরে আমি নামক কোনো অস্তিত্বই নেই।উনার এমন ভাব আমার মাঝে রাগের মাত্রা দ্বিগুণ পরিমাণে বেড়ে গেল।নিজেকে আটকাতে না পেরে সশব্দে উনার দিকে এগিয়ে গেলাম।
“এসবের মানে কী মি.সাহিত্য চৌধুরি?হঠাৎ এভাবে অচেনা অজানা মেয়ে কে বিয়ে করার কোনো গুরুপ্ত পূর্ণ কারণ আছে কী?”
আমার এমন ঝাঁঝালো কণ্ঠে ও উনার মাঝে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটল না।উনি এক মূহুর্তের জন্য থমকে গিয়ে আবার নিজের মতো করে কাবার্ডের দিকে মনোযোগ দিলেন।উনার এমন কাজে এবার আমার নিজের চুল নিজেই ছেঁড়ার মতো অবস্থা হলো।নিজের রাগ যথাসম্ভব দমিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আবার বলে উঠলাম,
“কী হলো,কিছু বলছেন না কেন?হঠাৎ করে কেন এভাবে বিয়ে করলেন আপনি আমাকে?”
এবার আমার কথায় উনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন।উনার এই তাকানোর মাঝে না জানি কী আছে মূহুর্তে ই বুকের ধুকপুকানি হাজার গুণে বেড়ে গেল।উনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তে তাকিয়ে তার সুমধুর গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“তার কৈফিয়ত আমি তোমাকে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না।”
কথাটা বলেই উনি কাবার্ড থেকে তাওয়াল বের করে কাবার্ড লাগিয়ে সামনের দিকে এগোতে লাগলেন।উনার এমন জবাবে আমার মাথার রক্ত টগবগ করতে লাগল।আমি আর এক মূহুর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে চট করে গিয়ে উনার সামনে দুই হাত ছড়িয়ে পথ আটকে দাড়ালাম।
“কৈফিয়ত চাইছি না আপনার কাছে।আমি শুধু জানতে চাই হঠাৎ এভাবে আমাকে বিয়ের করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ টা কী।আর এটা জানার অধিকার নিশ্চয়ই আমার আছে।”
আমার কথায় এবার উনি রেগে গিয়ে চট করে আমার দিকে দুই পা এগিয়ে এসে ডান হাত আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।হঠাৎ উনার এমন কাজে আমি কিছু ভয়ে পেয়েই পাশ ফিরে কাবার্ডের সাথে মিশে যাই।উনি উনার এক হাত আমার কাঁধের উপর দিয়ে কাবার্ডে রেখে আমার খুব কাছে চলে এলেন।ভয়ে আমি চোখ বড় বড় করে উনার দিকে তাকালাম।উনি কিছুটা হেলে আমার মুখের খুব কাছে এসে কড়া গলায় বলে উঠলেন,
“অধিকার খাটাতে এসো না।এখানে আছো,থাকবে খাবে আর প্রয়োজনীয় যা যা জিনিস দরকার সব তুমি পেয়ে যাবে।এর থেকে বেশি কিছু আশাও করো না।”
কথাটা বলেই উনি অন্য দিকে তাকালেন।কিন্তু পরক্ষণেই আবার আমার দিকে তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠলেন,
“আর হ্যাঁ,চুপচাপ কোনো কথা ছাড়াই বেডে গিয়ে শুয়ে পড়ো।এটা নিয়ে আমি কোনো ড্রামা ফেস করতে চাইছি না।”
দাঁতে দাঁত চেপে কথা টা বলেই আর একমূহুর্ত অপেক্ষা না করে উনি ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলেন।আর আমি হা করে উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।এই লোকটা এমন কেনো।এক্ষুনি তো আমার আত্মারাম ফুস হয়ে যেত।উফ,,,নিজের বুকে হাত রেখে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে লাগলাম।উনার এতো কাছে আসায় যেন কিছুক্ষণের জন্য আমার হার্টবীট টাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর এখন যেন এই হার্টবীট ট্রেনের থেকে বেশি গতিতে চলছে।আমি এবার ভয়াতুর দৃষ্টিতে বেডের দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিললাম।
.
.
.
.
.
প্রায় ভোর রাত।চোখে এক ফোটা ঘুম ও নেই।উনি আমার পাশেই উবু হয়ে শুয়ে আছেন।সারারাত এই ভয়েই ঘুম হয়নি যে উনি একাকিত্বের সুযোগ না নেন।কিন্তু ভাগ্য ভালো ছিল রাতে শোয়ার পর উনি একবারের জন্য আমার দিকে ফিরেও তাকাননি।এ যাত্রায় বেঁচে গেছি।আমি শোয়া থেকে উঠে বেরকনির দিকে এগিয়ে গেলাম।জীবন টা যেন মূহুর্তের মধ্যেই পাল্টে গেল।কাল রাত অবধিও কি আমি এটা ভেবেছিলাম আজ ভোরে আমি সাহিত্য চৌধুরির বউ হিসেবে উনার ঘরের বেলকনি তে দাঁড়িয়ে থাকবো।আমি বেলকনি তে দাঁড়িয়েই বেডে শুয়ে থাকা সাহিত্যের দিকে তাকালাম।উনি এখনো ঘুমিয়ে আছেন।উনাকে এভাবে ঘুমোতে দেখে ঠোঁটের কোণ দিয়ে এক মুঠো হাসি খেলে গেল।এই লোক টা না কি আমার বর।ভাবতেই অবাক লাগছে।
.
.
.
.
.
দূর থেকে আজানের ধ্বনি কানে আসতেই আমি নিজের কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।স্নান সেড়ে ফজরের নামায আদায় করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।এই বাড়ির কিছুই আমি চিনি না।এক পা দু পা করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই লক্ষ্য করলাম সাদা পঞ্জাবি আর টুপি পরিহিত এক মধ্য বয়স্ক লোক বাড়ির ভেতর ঢুকছে।উনাকে চিনতে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধে হলো না।উনি সাহিত্য চৌধুরির বাবা নিয়াজ চৌধুরি।ইনার সাথে আমার আগেও অনেকবার কথা হয়েছে।ইনফেক্ট উনি আমাকে নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করেন।কাল ও যখন বউ সাজে এবাড়িতে এসেছিলাম তখন ছেলের কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করার কষ্টের চেয়ে উনার চোখে আনন্দ টাই বেশি ফুটে উঠেছিল।উনার সেই আনন্দের কারণ টা আমি বুঝতে পারিনি।
উনার স্ত্রী আজ অনেক বছর আগেই মারা যান।যতদূর উনার আর উনার ছেলির মাঝের সম্পর্ক টা বেশি ভালো নয়।সাহিত্য চৌধুরি তো উনার বাবার সাথে বেশি কথাও বলেন না।তবে আমার এই লোকটা কে বেশ লাগে।বেশ হাসিখুশি টাইপের লোক।সে যাই হোক এখন হয়তো মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরছেন।আমি উনার দিকে এগিয়ে গিয়ে উনাকে সালাম দিলাম।উনি হাসি মুখে আমার সালামের জবাব দিয়ে ভালো মন্দ দুটো কথা বলতে বলতে বসার ঘরে সোফায় গিয়ে বসলেন।আমি উনার আর আমার জন্য দুই কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে দুজনে বসে জমিয়ে আড্ডা দিতে লাগলাম।এরই মাঝে এই বাড়ির কাজের লোক মিঠুন এসে সকালের ব্রেকফাস্ট বানানো তে মনোযোগ দিল।আমি গিয়ে তার টুকটাক কাজে হাত লাগালাম।এতে সে আপত্তি করলেও আমি মানলাম না।আমি নিজেকে এখানে সবার সাথে মানিয়ে নেওয়ার যথাসম্ভব চেষ্টা চালালাম।
.
.
.
.
.
বেশ কিছুক্ষণ পর নিজের রুমে এসে দেখি উনি ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে স্যুট বুট পড়ে অফিসে যাওয়ার জন্য একদম তৈরী।এই মূহুর্তে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের চুল ঠিক করছেন।আমি সেদিকে বেশি মনোযোগ না দিয়ে বেডের নিচ থেকে আমার স্যুটকেস বের করে আমার জামা কাপড় সব কাবার্ডে উনার কাপড়ে পাশে গুছিয়ে রাখতে লাগলাম।এমন সময় হঠাৎ করেই কেউ একজন আমার এক হাত শক্ত করে ধরে পাশ ফেরালেন।হঠাৎ হওয়ায় আমি কিছুটা চমকে গিয়ে ই উনার দিকে তাকালাম।উনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে তীব্র কণ্ঠে বলে,
“আমার কাবার্ডে হাত দেওয়ার পারমিশান কে দিল তোমায়?”
উনার এমন কথায় আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি তে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
“আমার জিনিসে কেউ ভাগ বসাক তা আমার মোটেও পছন্দের নয়।বেডে শুতে দিয়েছি মানে এই নয় যে সব জিনিসেরই ভাগ দেব।আজকের মধ্যেই তুমি তোমার কাবার্ড পেয়ে যাবে।”
শান্ত গলায় কথাটা বলেই উনি উল্টো ঘুরে চলে যেতে চাইলে আমি দুই হাত কোমরে রেখে উনার সামনে গিয়ে দাড়ালাম।চোখ ছোট ছোট করে উনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
“কেউ মানে কাকে বোঝাচ্ছেন আপনি হুম।শুনুন,আমি আপনার স্ত্রী।পাঁচ কালেমা পড়ে বিয়ে করেছেন আমায়।আপনার প্রত্যেকটা জিনিসের ওপরেই অর্ধেক অধিকার আমার।সো,আমি আমি এই কাবার্ডেই আমার জামা কাপড় রাখবো দেখি আপনি কী করেন।”
একনাগাড়ে কথা গুলো বলেই আমি উনার পাশ কাটিয়ে কাবার্ডের দিকে এগোতে গেলেই উনি চট করে আমার এক হাত ধরে হেচকা টানে নিয়ে গিয়ে পাশের দেওয়ালে চেপে ধরল।হঠাৎ এমন হওয়ায় ভয়ে ও ব্যাথায় আমি কুঁকড়ে উঠলাম।হাতটা দেয়ালের সাথে খুব শক্ত ভাবেই চেপে ধরেছেন উনি।ব্যথায় হাত অবশ হয়ে এলো।
চলবে💞

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে