শূন্যলতা পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0
379

#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
(অন্তিম পর্ব)

গুটি গোমড়া মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সরণের দিকে। রাগবে না হাসবে তা নিয়ে চোখেমুখে বিভ্রান্তি। সরণ সেসবে নজর দিল না। নিজের কাজে মন দিলো। কাপড় বদলানো হলে রুমে এনে ভেজা ব্যাণ্ডেজ় বদলে নতুন ব্যাণ্ডেজ় করে দিয়ে খাবার আনলো সামনে। গুটি একটি খাবারের থালা দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার খাবার কোথায়?”
সরণ ভাত মেখে গুটির মুখের সামনে ধরে বলল,
“প্লেট দেখে কি মনে হয়? সবগুলো তোমার একার জন্য?”
গুটি চেয়ে দেখল যতগুলো খাবার আছে অনায়াসে দু’জনের হয়ে যাবে। খাবারের পরিমাণ খেয়াল করেনি। সরণ গুটির সাথে সাথে নিজেও খেতে লাগল। একবার গুটির মুখে দিচ্ছে, একবার নিজে খাচ্ছে। গুটির অদ্ভুৎ শান্তি অনুভব হচ্ছে। পৃথিবীর সব সুখ যেন সরণের হাতে ধরে থাকা ভাতের থালায়। এইযে আঙ্গুল গুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মানুষটা ভাত মাখছে, এ যেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুন্দরতম এক দৃশ্য। ভালোবাসলে মানুষ এতো বোকা বোকা চিন্তা কেন করে? প্রশ্নটা করে নিজমনে হাসলো গুটি। যার আঙ্গুল ছোঁয়া ভাত তাকে শ্রেষ্ঠ অনুভূতি দিচ্ছে তাকে কি করে চড় মেরে বসলো! আচ্ছা, সারাদিন ভিক্ষে করে রাতে দুমুঠো ভাত নিয়ে বসেও কি কেউ এমন তৃপ্তি পায়? গুটির চোখ আবারও ভিজে উঠলো। চড় মারার দৃশ্যটা বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে। সরণ শেষবারের খাবারটুকু থালা পরিষ্কার করে হাতে তুলে নিয়ে গুটির মুখের সামনে নিয়ে বলল,
“ব্যাপারটা মন্দ না। মেরেও জিতলে, কেঁদেও জিতে যাচ্ছো। ওয়েট, আমি গ্লিসারিন নিয়ে আসছি। চোখে দিয়ে আমিও তোমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাঁদবো।”
গুটি ভাত মুখে নিয়ে হেসে উঠলো। চোখে অনুতাপের জল ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। তাতে সঙ্গ দিল কাশি। ভাত মুখে নিয়ে হাসতে গিয়ে গলায় আঁটকে গেছে। সরণ তড়িঘড়ি জল খাওয়ালো। গুটির কাশি খানিক কমলে সরণ খুব কাছে এসে বসলো। দু’হাতে বাড়িয়ে বলল,
“জলদি বুকে আসো।”
গুটি যেন মূর্ছা গেল, এমনভাবে নেতিয়ে পড়লো সরণের বুকে। বাহুবন্ধন হলো অতিব দৃঢ়। সরণ সময় নিয়ে চুমু খেল কপাল বরাবর। বাহুবন্ধনের চেয়েও দৃঢ়তর কন্ঠে বলল,
“অতীতকে বিসর্জন দাও গুটি। আজ থেকে, এই মুহুর্ত থেকে হোক মনে রাখার দিন। আমাদের স্মৃতিতে না থাকুক বাবলু সাহা আর না থাকুক বীরেন তালুকদার। তুমি আর আমি মিলে, আমরা। আমরা আমাদের ভালোবাসা দিয়ে নতুন স্মৃতি গড়ে নেবো।”
গুটি মাথা নেড়ে সায় জানালে সরণ পুনরায় বলল,
“বাবলু সাহাকে কি করবো?”
বাবার নাম শুনে বুকে একটা মোচড় দিলো গুটির। কোনরকমে বলল,
“আপনি যা ভালো বোঝেন।”
সরণ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
“আমি যা ভালো বুঝি?
গুটি মাথা নাড়লো।
“নিজের বাপকে নিয়ে যা বুঝি, তোমার বাপকে নিয়ে নিশ্চয়ই তার থেকেও মারাত্মক কিছুই বুঝবো। যে তোমাকে নারী পাচারকারীদের হাতে তুলে দিতে উন্মাদ হয়েছিল, বীরেন তালুকদারের সঙ্গে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছিল, কোনটাই করতে না পেরে টাকা খোয়ানোর রাগে পুলিশের কাছে মিথ্যে বলে ফাঁসিয়ে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল, তাকে আমি দয়া দেখিয়ে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারবো না। আর ছেড়ে দিলে নিশ্চিত আবার তোমাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করবে প্রতিশোধ নিতে।”

সরণ খাবারের প্লেট হাতে উঠে চলে যেতে লাগলে গুটি বলল,
“মানুষ তো একটা কুকুরকেও দু’বেলা ভাত দেয়, ওই মানুষটাকেও না-হয় দিলেন। হোক উচ্ছিষ্ট, তবুও খেয়ে পরে বেঁচে থাকুক পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে।”
সরণ পিছু ফিরে গুটির চোখে চোখ রেখে তাকালে গুটি টলটলে চোখ আর মুখভর্তি হাসি নিয়ে বলে উঠলো,
“আমার কথা ছাড়া ওই মানুষটাকে আপনি শেষ করবেন না, আমি জানি। করার হলে আগেই করতেন। আর আমিও তাকে যতোই ঘৃণা করি, মেরে ফেলার কথা বলতে পারবো না, কখনোই না। পুলিশেও যে আপনি দেবেন না, তা আমি জানি। তাহলে আমার বিপদ হতে পারে, তাই তো? বাকি তাহলে থাকে কী?”
সরণ চলে গেল। হয়তো জবাব তার কাছে নেই। অথবা আছে কিন্তু দেবে না। তবে পরিকল্পনা অবশ্যই আছে। মুখে আর বলবে না, যা করার করে দেখাবে।

মাসখানেক কেটে গেল ভালোবাসার আবহে। গুটি আর সরণের সংসার জীবনের আবহাওয়া কখনো রঙিন আসমানের গাঢ় রঙধনু তো কখন ঝুম বৃষ্টির উষ্ণতায় কাবু এক জোড়া চড়ুই। কিন্তু বাবলু সাহার কি হলো? জানে না গুটি। জিজ্ঞেস করার সাহস পায় না। যদি শুনে সরণ মেরে ফেলেছে নিজ হাতে, সহ্য করতে পারবে না। বাবা মরে গেছে কথাটার চেয়ে সরণ বাবাকে মেরে ফেলেছে কথাটা বেশি পুড়াবে তাকে। এই এক মাসে ইশ্বরের কাছে বহুবার বাবার মৃত্যু কামনা করেছে। চেয়েছে এমনিই নাই হয়ে যাক মানুষটা। সরণ যেন নিজ হাতে মানুষটাকে খু ন করে পাপের বোঝা কাঁধে না নেয়। এ-ই কদিনে গুটি খুব ভালো করেই বুঝে গেছে সরণের রাগ খুব চাপা। সহজে কমে না, আবার বহিঃপ্রকাশও করে কম।

সরণ গুটিকে কতটা ভালোবাসে তা গুটি প্রতি টা মুহুর্তে অনুভব করতে পারে। তার জীবনে আছে বলতে তো মাত্র দু’জন মানুষ। গুটি আর মানিক। পৃথিবীতে যার জীবনে হাতেগোনা এক দু’জন আপনজন থাকে, সে জানে আপনজনের মূল্য। জানে কদর করতে, জানে আগলে রাখতে, জানে ভালোবাসতে। আর যার আপনজনের অভাব নেই, সে করে অবহেলা।

গুটির দিন আজকাল মহা আড়ম্বরে কাটে। সকালের জলখাবারের দায়িত্ব সরণ আর মানিকের। আর দুপুরের রান্নার ভাড় গুটির। এটুকু দায়িত্ব নিতেও যুদ্ধ করতে হয়েছে বাকি দু’জনের সাথে। যেহেতু মানিক আর সরণ দু’জনেই দারুণ রান্না করতে জানে তাই হাত গুটিয়ে বসে থাকতে তারা রাজি নয়। শেষমেশ গুটি ভাগ করে নিয়েছে রান্নার কাজ। সকালে গুটি বসে বসে শুধু দুই বন্ধু রূপী ভাইয়ের কাণ্ড দেখে আবার মাঝেমাঝে অংশও নেয়। তবে দল ভাগ হলে সবসময় সে মানিকের পক্ষে। সরণ তখন মুখ বাঁকিয়ে মানিককে বলে,
“আমার মেয়ে আসলে তোকে ডাকবে কংস মামা আর তোর বোনকে ডাকাবো সৎ মা বলে। তখন আমার দলও ভারী৷ হবে।”
গুটি প্রথম প্রথম লজ্জা পেত। এখন আর পায় না। সরণের মুখে আমার মেয়ে, আমার মেয়ে শুনতে শুনতে লজ্জা টজ্জা উবে গেছে। আজও পেল না। উল্টো তর্ক করে বলে,
“আমার ছেলে হবে। আর ছেলে হলে সে থাকবে আমার দলে।”
সরণ জোর দিয়ে বলল,
”আমার মেয়েই হবে। আমি তাকে নাম ধরে ডাকবো না, মা বলে ডাকবো। আমার মা!”
গুটি আর মানিক দু’জনেই মুচকি হাসলো। সরণের চোখমুখে উপচে পড়া আনন্দ, উচ্ছাস। মানিক ব্লেন্ডারে জুস বানাচ্ছিলো, এরমধ্যে একটা কল আসায় হাত ধুয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেই ফাঁকে সরণ করলো সুযোগের সদ্ব্যবহার। গুটিকে হেঁচকা টানে বুকে নিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। গুটির ছটফটানি দেখে কে! কিন্তু সরণ তাতে পাত্তা দিলে তো। গুটি কবজিতে কামড় দিলেও ছাড়লো না। উল্টো গুটির দাঁতে টোকা দিয়ে বলল,
“ইস! আগের জন্মে পিঁপড়া ছিলে না মৌমাছি? সুযোগ পেলেই কামড়!”
“ছাড়বে না দেবো আরেকটা?”
“ছাড়বো কেন? একটা মাত্র বউ আমার, পারলে চব্বিশ ঘণ্টা জড়িয়ে ধরে বসে থাকতাম।”
“উফফ! ভাই চলে আসবে। একবার দেখে ফেললে আর মুখ দেখাতে পারবো না।”
“আমি তোমার মুখে লাভ বাইট তো দিচ্ছি না, মুখ দেখাতে প্রবলেম কোথায়?”
“আমার মাথায়! ছাড়ুন…”
“তোমার ভাই যা সতর্ক, এক মাইল দূর থেকে যক্ষা রোগীর মতো কাশতে কাশতে রুমে ঢোকে। তাকে নিয়ে আবার এতো ভয় কীসের? ও আসার দু’মিনিট আগেই টের পেয়ে যাবে ও আসছে। এবার চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো। রান্নায় মনোযোগ দিতে দাও। ভালো না হলে তোমার দোষ। সব তোমায় দিয়ে খাওয়াবো।”
“আর ভালো হলে?”
“ভালো হলে আমার দোষ। তখন বেশিটুকু আমি খাবো।”
এরমধ্যেই শুরু হলো মানিকের বিখ্যাত কাশি। সরণ ছেড়ে দিল গুটিকে। আঁচল আর চুল ঠিক করে দিয়ে মানিককে বলল,
“ডাক্তার দেখা ভাই আমার, যক্ষায় পেয়েছে তোকে।”
গুটি ছ্যাৎ করে উঠলো। রাগী কন্ঠে বলল,
“খালি রোগবালাই ডেকে আনবে। এসব আকথা-কুকথা বলতে মানা করিনি?”
“রোগের এতো ঠ্যাকা? ডাকলেই চলে আসবে!”
“ডাকবেন কেন?”
“ডাকলেই আসবে কেন? এতো ছ্যাঁচড়ামি তো ভালো স্বভাব নয়। আর তুমি এই আপনি আর তুমি সম্বোধনের খিচুড়ি পাকানো বন্ধ করবে কবে?”
এমনিতে গুটি আর সরণের এমন দুষ্টুমিষ্টি ঝগড়ায় সবচেয়ে বেশি মজা নেয় মানিক। কিন্তু আজ কেমন চুপসে আছে দেখে গুটি জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে ভাই? কোন সমস্যা?”
মানিক আমতা আমতা করে সরণের দিকে তাকালো। কিন্তু সরণ একমনে রান্না করছে। ডেকে বলল,
“সরণ, একটু এদিকে আসবি।”
সরণ কোন প্রশ্ন ছাড়াই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। গুটিকে বলে গেল, “রান্নাটা কমপ্লিট করো।”
গুটি ভীষণ চিন্তিত। কিন্তু তাকে যেহেতু ডাকেনি তাই পিছু গেল না আর।

এদিকে সরণ ড্রয়িংরুমে এসেই মানিককে কিছু বলতে না দিয়ে বলে উঠলো,
“শশ্মানে নেওয়ার ব্যবস্থা কর, আমি গুটিকে নিয়ে আসছি।”
মানিক অবাক ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“এটা সত্যিই আত্মহত্যা ছিলো তো?”
“হানড্রেড পার্সেন্ট।”
“তাহলে…”
“যা, গুটি খেয়ে নিক কিছু তারপর আসছি আমরা।”

সরণ গুটির কাছে গিয়েই কোলে তুলে নিলো। টেবিলে বসিয়ে দিয়ে খাবার বেড়ে বসে পড়লো চেয়ার টেনে। গুটিকে কিছু জিজ্ঞেস করার অবকাশ না দিয়ে চটজলদি ভাত মেখে খাওয়াতে শুরু করলো। সরণ সাধারণত নিজেও খায় গুটিকেও খাইয়িয়ে দেয়, আজ নিজে না খেয়ে শুধু তাকে খাওয়াচ্ছে দেখে অবাক হলো। তবে গুটিকেও খুব বেশি সময় নিয়ে খাওয়ালো না। অল্প পরিমাণে খাইয়িয়ে হাত ধুয়ে উঠে পড়লো। গুটিকে বলল,
“বাইরে যাবো একটা কাজে, আমার সঙ্গে চলো।”
গুটি জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায়?”
“যেতে যেতে বলছি।”
“জামাটা পাল্টাবো না।”
“নো নিড।”
গুটির হাত ধরে জলদি বেরিয়ে পড়লো সরণ। গাড়ি এক টানে গিয়ে থামলো একটা আধ পুরোনো বাড়ির সামনে। অল্প কয়েকজন ছেলেপেলে দেখা গেল। পরিবেশ কেমন থমথমে। গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে ঢোকার আগে সরণ গুটির হাত মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে ধরলো। আরেক হাতে কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
“বি স্ট্রং।”
ততক্ষণে গুটির মনে জান দিয়ে দিয়েছে কি হতে চলেছে। ভেতরে ঢোকার আগেই ধূপ চন্দনের গন্ধ অনেক কিছু বলে দিয়েছে। গুটির পা আঁটকে আসছে। সরণ আগলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো গেট পেরিয়ে। ঢুকতেই চোখে পড়লো কাকে যেন শুইয়ে রাখা হয়েছে। পা হতে মাথা অব্দি চাদর টানা। গুটি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একজন মুখ থেকে চাদর সরিয়ে দিল। গুটি থম মেরে বসে রইলো। চোখ উপচে জল পড়তে লাগলো আপন ধারায়। কিন্তু মুখে কোন শব্দ নেই। গুটির মস্তিষ্ক জুড়ে বাবাকে নিয়ে বহু স্মৃতি ঘুরতে লাগল। কিন্তু কোন স্মৃতিই সুমধুর নয়। বরং, বড্ড বেশিই তিক্ত। তবুও এতো কষ্ট কেন হচ্ছে? বুকটা এতো জ্বলছে কেন? পাশ থেকে একটা ছেলে এসে সিসিটিভির ফুটেজ দেখালো সরণকে। যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাবলু সাহা নেশাদ্রব্য চাইছো উন্মাদের ন্যায়। পাগলের মতো এদিক সেদিক করছে। নিজের শরীর নিজেই খামচে কামড়ে রক্তাক্ত করছে। এক পর্যায়ে দেয়ালের সঙ্গে মাথায় একটা বারি মারতেই নিচে পড়ে গেল। পড়তেই দ্বিতীয় আঘাত আর তারপর মৃত্যু। গুটি চেয়ে দেখল। সরণকে বলল,
“আমি বাসায় যাবো।”
বলতে বলতেই জ্ঞান হারালো গুটি। যতোই হোক বাবা তো! মানুষ টা আর নেই। ইচ্ছে করছিলো চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু কো যেন বাঁধা দিয়ে বলছিলো,
“এই মানুষটার জন্য চিৎকার করে কাঁদবি গুটি? অশ্রু বৃথা যাবে না? এ তো মানুষ রূপী জানোয়ার। বাবা নামের কলঙ্ক। কাঁদিস না গুটি, লোকে হাসবে।”
কিন্তু মন কি মানে? বুক তো জ্বলছে। জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। মনপোড়া গন্ধের ঝাঝ হয়তো আর নিতে পারলো না। জ্ঞান হারালো। কি হতো যদি মানুষটা ভালো হতো? হয়তো দুনিয়া উল্টে যেতো না। কিন্তু গুটি একটু মন খুলে কাঁদতে পারতো। বাবা বলে শেষবারের মতো ডাকতে পারতো। সরণের বুকে আছড়ে পড়ে বলতো পারতো,
“আমার বাবাটা আর নেই।”

গুটির জ্ঞান ফেরানোর কোন চেষ্টা করলো না সরণ। বরং ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখলো। যখন গুটির ঘুম ভাঙলো ততক্ষণে শেষকৃত্যের কাজ সমাপ্ত। গুটি জেগে উঠে আর কাদলো না। চুপচাপ শুয়ে রইলো সরণকে আঁকড়ে ধরে। বেশ অনেক্ক্ষণ পর শুধু জিজ্ঞেস করলো,
“মুখাগ্নি কে করেছে?”
সরণ বলল,
“মানিক।”
ব্যাস আর কোন কথা হলো না। দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে একে অপরের নিঃশ্বাস গুনতে লাগল। সরণ মনে মনে বলল,
“সরি গুটি। নিজে হাতে মারিনি ঠিকই, কিন্তু মরতে বাধ্য করেছি। বেশি কিছু করিনি, শুধু একটু বাধ্য জামাতা হয়েছিলাম। যত নেশা করতে চেয়েছে করতে দিয়েছি। দিনরাত নেশা করতে করতে যখন আসক্তির চরম পর্যায়ে, তখন বন্ধ করে দিয়েছি সব। ব্যাস, আর কিছু করিনি। কিচ্ছু না।”

বছর খানিক পরের কথা। কোন এক শীতের মধ্যরাতে ছাদে বসে আছে দু’জন কপোত-কপোতী। অন্ধকারে ছায়ার মতো লাগছে মানুষ অবয়ব দু’টো। আমাবস্যা গেল গতকাল। আলোর আ-ও নেই। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এমন পরিবেশে রাতের বেলা ছাদে আসা মানে ভূতের সঙ্গে নিশ্চিত সাক্ষাৎ। এমনটাই বলে সরণকে ধরে বেঁধে নিয়ে এসে বসে আছে গুটি। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ কোন ভূত বাবাজীর আগমন না ঘটায় গুটি উঠে পড়লো। বিরক্ত সুরে বলল,
“ধুর, সঙ্গে এক ভূত নিয়ে এসেছি আর কে আসবে? এটা দিয়েই সারাজীবন কাজ চালাতে হবে।”
“হুম, এই ভূত এখন রোমান্টিক মুডে আছে। বেডরুমে যাবে না ছাদেই এডভেঞ্চার ফিল করাবো?”
গুটি দৌড়ে পালালো। সরণ পিছু ছুটলো। নিঃশব্দে দু’জনে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে লাগলো পুরো ছাদ জুড়ে। পুরো শহর জুড়ে নিস্তব্ধতা। শুধু সরণের আঙ্গিনায় দু’জোড়া পায়ের আওয়াজে মুখরিত পুরো ছাদ। এরমধ্যেই সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠছিলো মানিক। ছাদে কারও দৌড়াদৌড়ির ধুপধাপ আওয়াজ শুনে সেখানেই জ্ঞান হারালো। পাশের বিল্ডিংয়ে তার গার্লফ্রেন্ড থাকে। ফোন করে বলেছিল ছাদে আসতে, একটা জিনিস দেখাবে। কিন্তু মানিক বড্ড ভূতে ভয় পায়। আসতে চাইছিলো না, তবুও গার্লফ্রেন্ডের চাপে আসতে হয়েছে। আর আসতেই এই পরিণতি। ওদিকে সরণ আর গুটি দুম করে কিছু একটা পড়ার শব্দ পেয়ে সিঁড়িতে এসে দেখে মানিক অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ওদিকে ফোনে বেজে যাচ্ছে অনবরত। সরণ কিছু একটা টের পেয়ে কপাল চাপড়ালো। যা বোঝার বুঝে গেছে। কল রিসিভ করে বলল,
“নিতু, তোমার মানিক ভূতের ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে।”
ওপাশ থেকে কি বলল তা শুনতে পেল না গুটি। সরণকে তাড়া দিয়ে বলল,
“ভাইকে রুমে নিয়ে চলো জলদি, জ্ঞান ফেরাতে হবে। ইশ, কোথায় কোথায় ব্যাথা পেল কে জানে!”

সরণের রোমান্টিক মুডে জল ঢেলে মানিক চড়ে বসলো কাঁধে। সরণ বিড়বিড়িয়ে গালি দিয়ে বলল,
“শালা মানুষ আর ভূতের দৌড়ের পার্থক্য বুঝিস না। কোথায় বউকে কোলে নেবো বলে দৌড়াচ্ছিলাম, অথচ কোলে উঠে এলি তুই।”

কয়েকদিন পর থেকে হটাৎ করেই গুটির শরীর খারাপ হতে লাগল। যেমন বমি তেমন অরুচি। ডাক্তার দেখিয়ে জানা গেল নতুন অতিথি আসছে ঘরে। গুটির চেয়েও বেশি উচ্ছসিত আর আনন্দে পাগল প্রায় সরণ। কি করবে কি বলবে সব যেন ভুলে বসেছে। এক লহমায় গুটির সকল দায়িত্ব কেড়ে নেওয়া হলো। রান্নাবান্না থেকে সকল কাজ সরণ আর মানিক ভাগাভাগি করে নিলো। গুটির কাজ শুধু হুকুম করা। দু’জন মিলে গুটিকে এমনিতেই মাথায় করে রাখতো, এবার তো যেন আকাশে তুলে রাখে এমন অবস্থা। একটা সময় ছিল গুটির নিজেকে শূন্যলতা মতে হতো। যেখানে ছুঁয়ে দিতো সেখানেই যেন ধ্বংস নামতো। এখন আর মনে হয় না। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী মনে হয় গুটির। খুশিতে কান্না আসে। আগেও তো কত কাঁদত। কিন্তু চোখের জল গড়াতো কত-শত আফসোসে। গুটি এখন রোজ সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে, এই সুখের অশ্রু কোনদিন শেষ না হোক। আজীবন বহাল থাকুক।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে