#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-১৩
“হ্যা ঠিক বলছেন। আগে বলুন বাবার সাথে কি করেছেন?”
“করিনি, করবো।”
“মানে?”
“মেরে ফেলবো।”
আৎকে উঠলো গুটি। সপাটে চড় মারলো সরণের গালে। সরণ নত মস্তকে বন্ধ করে নিল চোখ। গুটি হতভম্ব! চড় মেরে নিজের হাত নিজেই মুচড়ে ধরলো। হাতটাকে নরকের কীটের চেয়েও ঘৃণ্য মনে হলো যেন। সরণের বুকে আছড়ে পড়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো গুটি। সরণ এক হাতে আলতো করে আগলে নিয়ে থমথমে গলায় বলল,
“আমি কিছু মনে করিনি।”
অথচ সরণের মুখভঙ্গি ভিন্ন কিছু বলছে। উঠে চলে যেতে লাগলে গুটি পা আঁকড়ে ধরলো। সরণ তড়িঘড়ি গুটির হাত তার পা থেকে ছাড়িয়ে শুইয়ে দিয়ে বলল,
“আমার ওষুধ নিতে হবে। আসছি একটু পর।”
আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না সরণ। বাহানা দিয়ে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। গুটি হাওমাও করে কেঁদে উঠলো দু’হাতে মুখ চেপে। বিড়বিড়িয়ে বলতে লাগল,
“কি করলাম আমি! কি করলাম! হায় ভগবান! ওনার মন ভাঙলাম আমি। অপমান করলাম। উনি কষ্ট পেয়েছেন। ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। কি করে মারলাম?”
এরমধ্যেই মানিক ঢুকলো কেবিনে। রাগে বড় বড় শ্বাস টানছে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে দ্রুত গতিতে গুটির মুখোমুখি হয়ে মৃদু চিৎকারে বলল,
“তোমার বাবাকে যে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে তাই তো আমি জানতাম না। জেল থেকে বেরিয়েই তো মেরে দেওয়ার কথা। এমনটাই বলেছিল সরণ। লোকটা যা করেছে আর যা যা করতে যাচ্ছিল তাতে এমন লম্পট, লোভী আর অমানুষ বাবা পরিচয় পাওয়ার যোগ্যই না। আর না বেঁচে থেকে পৃথিবীর বোঝা বাড়ানোর যোগ্য। পৃথিবীর বুকে বোঝা হয়ে বেঁচে থাকতেও মিনিমাম যোগ্যতা লাগে। যা ওই অমানুষটার নেই।”
গুটি ফোপাঁতে ফোপাঁতে চোখ মুছলো। কিছু বলতে চাইলে মানিক থামিয়ে দিয়ে বলল,
“চুপ! একটা কথাও না। সরণকে চড় মারলে তুমি! ও কতটা কষ্ট পেয়েছে ধারণা করতে পারছো?”
গুটির গাল পুনরায় ভিজে উঠলো। অশ্রু বইতে লাগল একই ধারায়।
“যেদিন রাতে গ্রাম থেকে তোমায় নিয়ে আমরা ফিরলাম, সেদিন হসপিটাল থেকে শুরু করে তোমার গ্রামের কোনায় কোনায় লোক লাগিয়ে এসেছিল সরণ। তোমার বাবার পিছনে চব্বিশ ঘণ্টা লোক লেগে ছিল। কি কি সামনে এসেছে জানো?”
গুটির চোখেমুখে আতংক ছড়িয়ে গেল। মানিক ভারী শ্বাস টেনে বলল,
“যেদিন পালালে তারপরের দিন বিয়ের কথা ছিল বীরেন তালুকদারের সাথে। বিয়ের পর কোথায় থাকতে জানো?”
গুটির জবাবের অপেক্ষায় নেই মানিক। বলে উঠলো,
“কি ভাবছো? বীরেন তালুকদারের বাড়ি? উহুম, থাকতে কোন পতিতালয় অথবা বিদেশের যাত্রাপথে। তোমাকে তোমার বাবা শুধু বীরেন তালুকদারের কাছে বিক্রি করেনি। মেয়ে পাচারকারী এক চক্রের কাছেও বিক্রি করেছিল। বীরেন তালুকদার বলেছিল তার সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়ে গেলে তারপর মার্কেটের দলিল আর নগদ টাকা হাতে দেবে। তাই তোমার বাবার প্ল্যান ছিল আগে ওই বুড়োর সঙ্গে তেমার বিয়ে হয়ে যাবে তারপর দলিল আর টাকা হাতে পেয়ে গেলে বীরেন তালুকদারের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনভাবে নারী পাচারকারীদের হাতে তুলে দেবে তোমাকে। আর তোমার হারিয়ে যাওয়ার দোষ বীরেন তালুকদারের ঘাড়ে চাপিয়ে তারপর টাকা নিয়ে গা ঢাকা দেবে। কিন্তু তুমি তো বিয়ের আগের রাতেই পালালে। তোমার বাবা হয়ো উঠলো উন্মাদ। এতো এতো টাকা খোয়ানোর শোকে জঘন্য প্ল্যান করলো। পরেরদিন বীরেন তালুকদার মারা গেল আর তোমার বাবা ক্ষোভ মিটাতে পুলিশের কাছে কমপ্লেইন করলো তোমার বিরুদ্ধে। সে নাকি নিজে চোখে দেখেছে তুমি তাকে মেরে পালিয়েছো। সেই খবর সরণ পেতেই সবার আগে লোক লাগিয়ে নিজের নাম পুলিশ অব্দি পৌঁছে দিল। যে মানুষটাকে কোনদিন বাবা বলে পরিচয় দেয়নি সেই মানুষটাকে নিজের বাবার পরিচয় দিয়ে তারপর খুনের দায় নিজের ঘাড়ে নিলো। তোমার বাবা নেশাগ্রস্ত তাই তার কথার চেয়ে বাবা ছেলের বছরের পর বছর যোগাযোগ বিহীন সম্পর্ক আর মাকে নিয়ে বাবা ছেলের শত্রুতা বেশি প্রাধান্য পেল পুলিশদের কাছে। তোমার খোঁজ বাদ দিয়ে তাই সরণকে গ্রেফতার করে পুলিশ। নয়তো তুমি থাকতে জেলে। আর নয়তো কোন…..”
“আমার বাবা…”
এতটুকু বলেই কাঁদতে কাঁদতে ভেঙে পড়লো গুটি। মানুষটা অসৎ, নেশাখোর। তাই বলে এতোটা অমানুষ? মানিক শান্তনা দেওয়ার মতো ধৈর্য পেল না। সে ভীষণ রেগে আছে। সরণকে চড় মেরেছে তা কোনভাবেই মানতে পারছে না। ছোটবেলায় সরণের মা রাস্তা থেকে তুলে এনেছিল তাকে। মানুষ করেছে নিজের ছেলের মতো। কখনো ভেদাভেদ করেনি নিজের ছেলের সাথে। সরণও সর্বদা নিজের ভাই বলেই মেনে এসেছে। মা’কে তো আগলে রাখতে পারেনি, বন্ধু নামক ভাইটিকে তাই ফুলের মতো আগলে রাখতে চায়।
গুটি কাঁদতে কাঁদতে হটাৎ জ্ঞান হারালে মানিকের টনক নড়লো। ডাক্তার ডাকলো সঙ্গে সঙ্গে। সরণকে হসপিটালে কোথাও খুঁজে না পেয়ে ফোন করলো। কিন্তু রিসিভ হলো না। কিছুক্ষণ বাদে সরণের কল এলে মানিক শুধু বলল,
“গুটি কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়েছে।”
সাথে সাথে কল কেটে গেল। দশ মিনিটের মধ্যে সরণ হসপিটালে ফিরল। এসে গুটির কেবিনে ঢোকার আগে হটাৎ কি ভেবে যেন থমকে দাঁড়ালো। মানিককে জিজ্ঞেস করলো,
“ওর বাবার সম্পর্কে সব বলে দিয়েছিস?”
মানিক মাথা নেড়ে সায় জানালে চোখ বন্ধ করে শ্বাস ছাড়লো সরণ। ধীর পায়ে গুটির কেবিনে ঢুকে বসে রইলো মাথার কাছে।
ঘণ্টাখানিক বাদে গুটির জ্ঞান ফিরলেও মরার মতো লেপ্টে রইলো বিছানায়। কারও সঙ্গে কোন কথা বলল না। না প্রশ্ন করলো আর না হাউমাউ করে কাঁদল। শুধু সরণের হাত আঁকড়ে দু’ফোটা চোখের জল ফেলেছিল নিঃশব্দে। দুফোঁটা জল যেন দু’হাজার বার সরি বলে দিল মুহুর্তের মধ্যে।
দু’দিন পর গুটিকে নিয়ে বাসায় ফিরলো সরণ। তবে আগের ফ্ল্যাটে নয়। সামনের এপার্টমেন্টটা মানিকের। সেখানে উঠলো আপাতত। ওই ফ্ল্যাট মেরামত করতে হবে। তাই আর এই অবস্থায় গুটিকে নিয়ে উঠলো না ওখানে। মানিক সরণের ফ্ল্যাটে চলে গেল থাকতে। এমনিতেও এই ফ্ল্যাটেই সবসময় থাকতো দু’জন মিলে। তার ফ্ল্যাট তো খালিই পড়ে থাকতো সর্বদা।
ভর দুপুরের বৃষ্টি আর রোদ একত্রে ছুঁয়ে দিচ্ছে গুটির ক্লান্ত শরীর। রোদবৃষ্টি হালকা বাতাসের সঙ্গে ঝাপটা মেরে আছড়ে পড়ছে পুরো বারান্দা জুড়ে। গুটি অনিমেষ তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। সেখানে রোদ আর বৃষ্টি দু’টোই আছে। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবে না গুটি জানে। হয় রোদ চলে যাবে না-হয় বৃষ্টি থেমে যাবে। আর নয়তো হারিয়ে যাবে দু’জন একত্রে। রোদ-বৃষ্টির মিলন তো ক্ষণিকের। যেমন তার আর সুখের সন্ধি খুবই অল্প সময়ের। একসঙ্গে টেকেই না। হাসফাস করে চলে যায় সুখ অন্যত্র। নিজেকে শূন্য মনে হয় গুটির। বাবার মুখটা যতবার চোখের সামনে ভেসে উঠে, ততবার ছিন্নভিন্ন হয় ভেতরটা। আর যখন মনে হয় ওই মানুষটার জন্য সরণকে চড় মেরেছে, অপরাধবোধে মরে যেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে হাত কেটে শরীর থেকে আলাদা করে দিতে। বাবা নামক মানুষটাকে ছোটবেলা থেকে নেশা করতে দেখে বড় হয়েছে সে। কতবার যে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে তার হিসেব নেই। প্রতিবার গুটির ঠাকুমা ছাড়িয়ে আনতো। ছেলে তো, ফেলে দিতে পারতো না। তারপর যখন সে মারা গেল, তারপরের বার নেশাদ্রব্য বিক্রি করতে গিয়ে মাতাল অবস্থায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে বেশ কয়েক মাস জেল খেটে এলো। ততদিনে গুটি নিজেকে সামলাতে শিখে গেছে। টিউশনি আর হাতের কাজ থেকে বেশ ভালো আয় করা শুরু করেছে। গুটির বাবা তারপর থেকে লোকসমক্ষে নেশা ছেড়ে দিল। ঘরে বসে নেশা করা শুরু করলো। প্রথমদিকে গুটির রাগ হতো, অভিমান হতো, টাকা দিতে চাইতো না। কিন্তু নেশা করতে না পেরে যখন পাগলের মতো নিজেকে আঘাত করতো, কামড়ের দাগে শরীর ভরিয়ে ফেলত, তখন সইতে পারতো না বাবার কষ্ট। নিজেই নেশা করার জন্য টাকা দিয়ে দিত। বড্ড দুর্বল ছিল যে তখন। তারপর যত দিন যেতে লাগল কঠিন হতে থাকল গুটি। যদিও সমস্ত কাঠিন্যতা ছিল উপরে উপরে। ভেতরটা তো সর্বদা ছিল মোমের মতো। একটা সময় বাবাকে নেশা করার জন্য টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিল গুটি। এমনকি কথা বলাও প্রায় বন্ধ করে দিল। তারপরও তার নেশা করা বন্ধ হয়নি। কীভাবে চালাতো নেশার খরচ তা জানতো না গুটি। এখন বুঝতে পারছে। তখন থেকেই কোন না কোন অনৈতিক কর্মকান্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। গুটি যদি জানতো, নেশার খরচ বন্ধ করে দিলে তার বাবা এমন কাজে যুক্ত হয়ে পড়বে, তবে সে নিজেই সারাজীবনের জন্য দায়িত্ব নিয়ে বাবার নেশার খরচ দিয়ে যেত। মাকে বড্ড মনে পড়ছে। জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেল। সাথে নিয়ে কেন গেল না? কেন একা চলে গেল? আচ্ছা, বাবাকে সত্যি খু ন করবে সরণ? মেরে ফেলবে?
সরণ খাবারের প্লেট হাতে রুমে এসে গুটিকে পেল না। বারান্দায় এসে গুটিকে মেঝেতে বসে ভেজা অবস্থায় পেয়ে রেগে গেল। ধমকে বলে উঠলো,
“আর ইউ ম্যাড? ব্যাণ্ডেজ় তো ভিজে গেছে।”
গুটি কেঁপে উঠলো। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ব্যাণ্ডেজ়ের কথা মনে পড়ায় তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াতে চাইলে হটাৎ মাথা ঘুরে উঠলো। এমনিতেই শরীর দুর্বল, তারওপর অনেক্ক্ষণ বসে ছিল মাথা ঝুঁকিয়ে। তাই আচমকা উঠতে গিয়ে চোখে অন্ধকার দিয়ে মাথা ঘুরে উঠেছে। সরণ পাঁজা কোলে তুলে নিল গুটিকে। রুমে নিতে নিতে বলল,
“আমি এখনও মরিনি। এতো শোক পালন কার জন্য?”
গুটির চোখেমুখে হটাৎ তেজ খেলে গেলো। লাফিয়ে নামার চেষ্টা করলো কোল থেকে। ততক্ষণে চোখ জোড়াও অশান্ত হয়ে ভিজে উঠেছে। সরণ শান্ত কন্ঠে বলল,
“কান্না করবে করো। মেয়েরা শাড়ী গয়না চেয়ে বায়না করবে, না দিলে কান্নাকাটি করবে। সুইট সিচুয়েশন কিউট সিন। কিন্তু তা না করে এসব কি? কথা পছন্দ না হলে ইউ ক্যান কিস মি। মুখ বন্ধ করার বিউটিফুল ওয়ে। বাট কাঁদতে কেন হবে?”
মনে মনে লজ্জায় গুটিয়ে গেলেও সরণকে বুঝতে না দিয়ে কঠিন করলো চোখমুখ। চোখ পাকিয়ে বলল,
“এসব অলক্ষুণে কথা আর কখনো বলবেন না।”
“বললে মুখ বন্ধ করে দিও, সিম্পল।”
গুটির প্রতিক্রিয়া হলো দেখার মতোন। কিন্তু সরণ পাত্তা দিলো না। সরাসরি ওয়াশরুমে নিয়ে নামালো। ডানদিকের সুইচ টিপে বলল,
“নিজে নিজে চেঞ্জ তো করতে পারবে না এই হাতে, আমাকেই করিয়ে দিতে হবে। তাহলে বারান্দায় বসে ভেজার কারণ কি দাঁড়ালো?”
কথাটা বলেই দু’বার ভ্রু নাচালো। গুটিকে রাগিয়ে দিতে সরণের দুষ্টু মুখভঙ্গি ও দুষ্টু আলাপ, কোনটাই কাজে দিল না। উল্টে গুটি যেন আরও শান্ত হলো। সরণের গলা জড়িয়ে ঘাড়ে মুখ চেপে বলল,
“পাল্টে দিন শাড়ী।”
গুটি এই তেজস্বিনী রূপ নিচ্ছে তো এই কোমলমতী রূপে সঁপে দিচ্ছে নিজেকে সরণের বাহুডোরে। সরণ মুচকি হেসে পুনরায় গুটিকে কোলে তুলে নিল। ভেতরে ঢুকে দরজা লাগাতে গেলে গুটি বাঁধা দিয়ে মিনমিন করে বলল,
“লাইটটা…”
সরণ পাত্তা দিল না। দরজার সিটকিনি তুলে দিয়ে বলল,
“হানিমুনে যাচ্ছি না যে লাইট অফ করতে হবে। যে কাজে যাচ্ছি, অন্ধকারে করতে গেলে কোথায় না কোথায় হাত লেগে যায়! তারপর বটি নিয়ে দৌড়ানি না দাও! যা বউ আমার, বিশ্বাস নেই।”
(চলবে)