#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-১০
ভোরের সূর্য পৃথিবীতে পদার্পণ করেই যেন চাক্ষুষ সাক্ষী হলো নিষ্পাপ, নিঃস্বার্থ, স্বচ্ছ ভালোবাসার। একদিকে উদীয়মান চিরন্তন সূর্যদেবতা, অন্যদিকে অস্তমিত গুটির সমস্ত দুঃখ, কষ্টের দুঃসময়।
গুটির নিদ্রা ভঙ্গ হলো বেশ বেলা করে। ঘড়ির সবচেয়ে ক্ষুদে সদস্য তখন দশের ঘরের অতিথি। চোখ খুলে বিছানা খালি পেয়ে উঠেই সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল। স্নান সেরে বের হলো পেটিকোট আর ব্লাউজের উপর টাওয়াল পেঁচিয়ে। ওয়াশরুমের চপচপে ভেজা মেঝেতে শাড়ী পড়া যায় নাকি? একদমই না। এদিকে শাড়ী বাছাই করতে গিয়ে শুরু হলো সময় বিলাস। ওয়ারড্রবে এতো শাড়ী! গুটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবগুলো শাড়ী উল্টেপাল্টে দেখলো। ধারণা করলো, তিন চারটে নতুন কেনা হলেও বাকি সব সরণের মায়ের। খয়েরী জমিনে কালো পার, তাতে পাতার নক্সা। আচলটায় রঙধনুর সাত রং। পুরোনো দিনের শাড়ী তা বোঝাই যাচ্ছে। এটাই বেছে নিল গুটি। পড়া শেষে মাঝখানে সিঁথি করে মোটা করে সিঁদুর পড়লো। নতুন বউ হিসেবে একটু সাজতে ইচ্ছে হলেও লজ্জা ভর করলো। সরণ কি ভাববে? ড্রেসিং টেবিল একদম মেয়েলি জিনিসপত্র দিয়ে ভরপুর। নিশ্চয়ই মানিকের কাজ এগুলো। এতোসব ব্যাবহার করতে না জানলেও, কাজল পড়তে খুব পছন্দ করে সে। কাজলটাই তুলে নিলো। ভাবল, খুব অল্প করে লাগাবে। কিন্তু দিতে দিতে দুই চোখের কাজলে সামঞ্জস্যতা বজায় রাখতে গিয়ে মোটা করেই দেওয়া হয়ে গেল। গুটি ভাবল, মুখ ধুয়ে ফেলবে। দরকার নেই এতো সাজার। কিন্তু এরমধ্যেই দরজায় ধাক্কা পড়লো। গুটি মুখ ধোঁয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে দরজা খুলতে গেল। মনে মনে কল্পনা করতে লাগল, সরণের মুখোমুখি হবে কীভাবে? কি বললে কি জবাব দেবে? রাতের মুহুর্তগুলো লজ্জায় থামিয়ে দিতে চাইলো পা। কিন্তু দরজার ওপার কড়া নাড়া থামেনি। দরজা খুলে মানিককে খাবারের থালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। মানিক বলল,
“ভেতরে আসবো গুটিদি?”
গুটি মাথা নেড়ে সায় জানালে মানিক ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“পায়ের ব্যাথা কতদূর? ভালোর দিকে?”
“খুব একটা ব্যাথা নেই। অনেকটা কমেছে।”
“আচ্ছা খাবারটা খেয়ে নাও, ওষুধ দেবো। বেলা হয়েছে অনেক আরও আগে খেতে হতো।”
“আমি নিজে নিয়ে নেব ওষুধ, তোমায় কষ্ট করে দিতে হবে না।”
“সরণ আমায় কেলাবে। গতকাল ওষুধ মিস দিয়েছো শুনে যা ঝাড়ি ঝেড়েছে। আজ রিস্ক নেব না।”
গুটির দৃষ্টি খুঁজছে সরণকে। কিন্তু সরাসরি জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হচ্ছে। তাই আগে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি খেয়েছে?”
“আমি তো কোন সকালে খেয়েছি। আমি আবার রান্না করতে করতেই অর্ধেক খেয়ে ফেলা ক্যাটাগরির মানুষ। অপেক্ষা আমার সয় না।”
“আর উনি?”
“উনি?”
“তোমার ভাই?”
“আমার ভাই?”
মানিকের দুষ্টুমি বুঝতে পেরে চোখ পাকালো গুটি। মানিক দাঁত বের করে হেসে সমর্পণের ভঙ্গিতে বলল,
“তোমার উনিও আমার মতোই। রান্না হতে হতে চুলা থেকেই ভক্ষন শুরু করে দেওয়া পাবলিক। সকাল সকাল খেয়েদেয়ে বেরিয়েছে একটা কাজে।”
বাসায় নেই শুনে একটু মন খারাপ হলো। সকালে উঠেনি বলে কি রাগ করেছে? আগে আগে ঘুম থেকে ওঠা উচিত ছিল। খাবারটাও তারই রান্না করা উচিত ছিল।
“আচ্ছা, রান্নাটা কে করেছে?”
“সবসময় তো আমরা দু’জন মিলেই রান্না করি, আজ সরণ একা রান্না করেছে বউকে খাওয়াবে বলে। আমি অবশ্য পাশেই ছিলাম।”
গুটি মনে মনে লজ্জায় নেতিয়ে গেল। কোথায় সে রান্না করবে তা না তার জন্য সরণ সকাল সকাল উঠে রান্না করেছে। ছি! প্রতিজ্ঞা করলো, এখন থেকে রোজ সকাল সকাল উঠে সেই রান্না করবে। সরণকে কখনো রান্নাঘরে ঢুকতে দেবে না। কেন যে এতো বেলা করে ঘুম ভাংলো!
খাওয়া শেষ হলে মানিক নিজ হাতে ওষুধ বের করে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়া দেখে তারপর গেল। তবে যাওয়ার আগে একটা ফোন ধরিয়ে দিয়ে গেল হাতে। মিনিট খানেক বাদেই কল এলো সরণের। গুটি দুরুদুরু বুকে চাপা আনন্দ আর রক্তিম ঠোঁট চাপা হাসিতে কল রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো হৃদয় কাড়া কন্ঠস্বর।
“বউয়ের ঘুম কেমন হলো?”
“আপনি কখন আসবেন?”
ছটফটানো আওয়াজ গুটির। সরণ শান্ত গলায় বলল,
“কাজ শেষ হলেই চলে আসবো। ব্রেকফাস্ট করেছেন?”
“গতকাল না বললাম, আমায় আপনি করে বলবেন না।”
“আমিও তো বলেছি, আপনি বললে আমিও বলবো।”
“আচ্ছা, আমি চেষ্টা করবো।”
“তাহলে আমিও চেষ্টা করবো।”
কিছুক্ষণ নিরব রইলো দু’জন। পিনপতন নীরবতা ভেঙে সরণ বলল,
“ওষুধ খেয়েছো?”
“হ্যা। ভাই দাঁড়িয়ে থেকে খাইয়ে গেছে।”
“নাপা?”
“নাপা?”
“রাতে না বলেছিলাম।”
গুটি মিইয়ে গেল। লজ্জায় দু’চোখ টিপে বলল,
“খেয়ে নেব।”
“এক্ষুনি খাবে, রাইট নাউ। ওয়ারড্রবের উপরেই রেখে এসেছি, চেক করো।”
“হুম পেয়েছি।”
গুটির ওষুধ খাওয়া হলে পুনরায় কিছুক্ষণ চুপ রইলো দু’জন। এবারও নিরবতা ভঙ্গ করলো সরণ।
“মিস মি?”
“নাতো।”
“ওহ, তাহলে তো লেট করে ফিরলেও নো প্রবলেম আই থিংক।”
“মিস করছি না, তবে জলদি ফিরবেন।”
“মিস না করলে জলদি কেন ফিরবো? হোয়াই?”
গুটি ফট করে বলে উঠলো,
“আমি শাড়ী পড়ে সেজেছি।”
কথাটা বলেই দাঁতে জিভ কাটলো। এটা কেমন কথা বলল! শাড়ী পড়েছে বলে জলদি কেন আসবে? ঝোঁকের বসে ফোনও কেটে দিল গুটি। ফোন কেটে পড়লো আরও লজ্জায়। ফোন কেন কাটলো? কি ভাবছে সরণ? ভাবছে সে লজ্জা পেয়ে ফোন কেটেছে৷ সত্যিই তো লজ্জা পেয়ে ফোন কেটেছে। কিন্তু তা ভাবার সুযোগ কেন দিলো? ধুর!
গুটির পাহাড়সম চিন্তা ভাবনার মধ্যেই পুনরায় ফোন বাজল। সরণ কল করেছে আবার। গুটি রিসিভ করে তড়িঘড়ি আগে আগে বলল,
“ভুলে কেটে গেছে। আমি কাটিনি।”
সরণের নির্লজ্জ চাপা হাসি যেন দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছে গুটি।
“শাড়ী পড়ে সেজে আমাকে জলদি আসতে বললে। আমি কি এটাকে শাড়ী খুলে সাজ নষ্ট করার নিমন্ত্রণ ধরে নেব?”
গুটি ফোন কানে নিয়েই বসা থেকে ধপ করে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজলো। সরণ ফের বলল,
“কল কি আবার ভুলে কেটে যেতে চলেছে?”
গুটি প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলল,
“এবার কাটলে দ্বিতীয় বার কল ঢুকবে না। বাসার দরজা খুলবে কিনা তাও গ্যারান্টি দিতে পারছি না।”
“আহা, নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিনি বলে বউয়ের গোসা হলো? ওকে মাই সুইট লেডি, বাসায় ফিরেই সবার আগে তোমার নিমন্ত্রণ রক্ষা করবো। হ্যাপি?”
গুটি কপাল চাপড়ে রাগী স্বরে বলল,
“আপনি একটা…”
“ইয়োর সুইট হাসবেন্ড?”
গুটি জবাব না দিয়ে প্রশ্ন ঘুরালো। বলল,
“কোথায় গিয়েছেন সকাল সকাল? আমায় ডাকলেন না কেন?”
“রাতে বউটা আমার ঘুমাতে আর পারলো কই? তাই সকালে আর ডাকিনি।”
“আপনি জীবনেও ভালো হবেন না। সব কথাতেই এক সুর!”
এরমধ্যেই সরণের ওপাশ থেকে কয়েকজনের গলার আওয়াজ শোনা গেল। সরণ তাড়াহুড়ো করে বলল,
“রাখছি গুটি। সাবধানে থেকো। নিজের খেয়াল রেখো। আ’ল কামিং সুন। লাভিউ।”
গুটি এক মুহুর্ত ভাবলো প্রতুত্ত্যরে লাভিউ টু বলবে কিনা, কিন্তু ততক্ষণে কল কেটে গেছে। না কাটলেও অবশ্য গুটির দ্বারা লাভিউ টু বলা হতো না।
গুটির সারাদিন কাটলো বেশ ব্যাস্ততায়। এ ঘর সে ঘর গোছগাছ আর রান্নাবান্না করে অর্ধেক দিন পার হলো। পাশাপাশি মানিকের সাথে আড্ডাও চলেছে জমিয়ে। তবে সরণকে ছাড়া গুটির সময় বড্ড পানসে কাটলো। মায়ের শাড়ী আর চোখের কাজল যেন বৃথা গেল একজনের প্রশংসা কুড়াতে না পেরে। দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা, অতঃপর রাত। সরণের দেখা নেই। ফোনও দুপুরের পর থেকে বন্ধ। গুটি দু-তিনবার জিজ্ঞেস করেছে মানিক কিছু জানে কিনা। মানিকের থেকে জবাব না পেয়ে থেমে ছিল সারা বিকেল। কিন্তু রাত যত বাড়তে লাগল গুটি তত অস্থির হতে লাগল। ওদিকে মানিক নিজেও জানে না সরণ কোথায় আছে কি অবস্থায় আছে। সরন যেখানে গিয়েছিল সেখান থেকে এগারোটায় বেরিয়ে গেছে বলে জানতে পেরেছে। তারপর তো ফিরে আসার কথা৷ মানিক তো তাই জানে। এদিকে গুটিকে বাসায় একা রেখে বের হতে মানা করেছে সরণ। কোনভাবেই একা ছাড়তে মানা করে গেছে। বাইরে খুঁজতে যাওয়া অতিব প্রয়োজন। কিছু জায়গায় ফোন না করে স্ব শরীরে খোঁজ নেওয়াও আবশ্যক। কয়েকজনকে দিয়ে ওদিকে খোঁজ চালালেও ফলাফল যখন শুন্য, মানিক তখন অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল গুটিকে একা রেখেই যাবে সরণের খোঁজে। গুটির কাছে কাউকে রেখে যাবে এমন বিশ্বস্ত কেউ নেই। আর সরণের বিয়ের কথা কেউ জানেও না। তবে গেটের সামনে কয়েকজন ছেলেপেলে ঠিক করলো। গুটির কথা না বলে বলল বাসায় কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে যার খোঁজে কেউ না কেউ আসতে পারে। কড়া পাহারা দিতে বলল। অতঃপর বের হলো সাংবাদিক শুভংকর দাসের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সেখানেই আগে যেতে হবে।
এদিকে গুটির মনে বাসা বেঁধেছে দুশ্চিন্তা। বারংবার উটকো চিন্তারা অবিশ্বাস হয়ে ছুঁতে চাচ্ছে মন মস্তিষ্ক। গুটি অবিচল। কোনভাবেই সরণকে অবিশ্বাস করতে রাজি নয়। অবিশ্বাসকে দূরে ঠেলে দিতেই মস্তিষ্ক বলে উঠে, তাহলে নিশ্চয়ই কোন দূর্ঘটনা ঘটেছে? ঠিক আছে তো সে? এমন হাজারও দুশ্চিন্তায় ভেতরটা প্রায় লণ্ডভণ্ড। বাড়ির ভেতর টিকতে না পেরে মানিকের নিষেধাজ্ঞা অবজ্ঞা করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। এখানে দাঁড়িয়ে পথ চেয়ে থাকলে কি জলদি আসবে সরণ? ফিরবে এক্ষুনি?
গেটের চারপাশে হটাৎ আট দশজন ছেলেকে ঘুরঘুর করতে দেখে সন্দেহ হলো গুটির। অন্ধকারে ওকে কেউ দেখতে না পেলেও ছেলেগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। রুমে ফিরে মানিককে কল করে বিষয়টা জানালো। মানিক অভয় দিলে ফের বারান্দায় যেতেই চমকে গেল। গেটের সামনে সেই আট দশজন ছেলেকে ঘিরে আছে প্রায় ত্রিশজন লোক। চোখের পলকে রক্তারক্তি কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। আৎকে উঠে মানিককে কল করে না পেয়ে নিচের ঘটনা ভিডিও শুরু করলো। কিন্তু একে একে আট দশজনকে যখন গেটের ভেতরে ঢুকতে দেখল তখন টনক নড়লো গুটির। আগের ছেলেগুলো যদি মানিকের ঠিক করা থাকে আর তাঁদের মেরে বিল্ডিংয়ে ঢোকা মানে তো বিপদ তারই। আবারও কল করলো মানিককে। এবারও ব্যাস্ত দেখালো, তবে রিসিভ হলো। গুটি গড়গড়িয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করতে করতেই দরজায় আওয়াজ হতে লাগল দুমদাম বিকট আওয়াজে। গুটি এক মুহুর্তের জন্য দিশেহারা হয়ে উঠলো। মৃদু চিৎকারে কেঁদে উঠলো তৎক্ষনাৎ। ওদিক থেকে মানিকের নাম ধরে ডাকছে লোকগুলো। তার মানে, গুটির খোঁজে নয় এসেছে মানিকের খোঁজে। এটা বুঝতে পেরে মানিক আগে শান্ত করলো গুটিকে। ভরসা দিয়ে বলল যতক্ষণ সম্ভব লুকিয়ে থাকতে। শীগ্রই চলে আসবে সে। মানিক নিজেও জানে সে যেতে পারবে না এতো জলদি। বাসা থেকে অনেক দূরে আছে। তাই যা করতে হবে দূর থেকেই করতে হবে। বুদ্ধি করে জিহাদকে কল করলো। একটা ঠিকানা দিয়ে বলল দেখা করতে চায়। ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের ঠিকানার যথাযথ প্রমাণও দিল। ব্যাপারটা তার জন্য প্রাণ সংশয়ের হতে পারে। তবুও কাজটা করলে কেননা সে জানে, জিহাদ থেকে খবরটা ওই লোকগুলো অব্দি পোঁছে যাবে যে মানিক বাসায় নেই। বিপদমুক্ত হবে গুটি। ঠিকই মুহুর্তের মধ্যে লোকগুলো অব্দি খবর পৌঁছে গেল যে মানিক বাসায় নেই। ফিরে আসতে বলা হলো তাঁদের। কিন্তু ততক্ষণে তারা দরজা ভেঙে ফেলেছে।
(চলবে)