#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-৯
“পন্থাটা পুরোনো, একটু ফিল্মি, কিন্তু কার্যকরী।”
সরণ নড়লো চরলো না, প্রতিক্রিয়াও শুন্য। দু’জনের মাঝের কয়েক ইঞ্চি দুরত্ব ঘুচিয়ে শুধু একটা মাত্র কাজ করলো, মাথা উঁচিয়ে শব্দ করে চুমু খেলো গুটির ঠোঁটে। গুটি এক মুহুর্ত থমকে থেকে উঠতে গেলে টান দিয়ে ফেলে দিল বুকের উপর। অতঃপর হলো সেই, যা চেয়েছিল সরণ। বুকের সঙ্গে জাপ্টে ধরে আরাম করে মিইয়ে গেল নরম বিছানায়। একটু বেশি মিইয়ে গেল গুটি। ভেতরের অবস্থা তার ভীষণ নড়বড়ে। পেটের ভেতর মোচড়াচ্ছে। পুরো শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে অনবরত। আর সরণ? সে অনুভূতি কুড়াতে বন্ধ চোখে শ্বাস গুনছে যেন। নাকি ফন্দি আঁটছে আর কি করে বশ করা যায় বাঘিনীকে? কিজানি! হয়তো তাই হবে।
“মিসেস সরণ তালুকদার।”
গুটি নিরব। কোন প্রত্যুত্তর নেই। গুটিকে বুকের বাঁপাশে গুটিয়ে রাখতে কতটা সক্ষম হয়েছে সরণ, তার প্রমাণ মিলল গুটির নিরবতা ও নিরবে বুকে মাথা গুঁজে বিলীন হওয়ায়। চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে। দীপ্তিময় আদোলে মায়া আর প্রশান্তির সংমিশ্রণে দারুন আভা ফুটে উঠেছে। সরণ পাশ ফিরল। গুটিকে বুকে নিয়েই পাশ ফিরল। ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমায় ভালো তো বাসেন, বিশ্বাস কেন করেন না? বীরেন তালুকদারের রক্ত বয়ে বেড়াই বলে? বিশ্বাস করুন, ক্ষমতা থাকলে শরীর থেকে রক্ত আলাদা করে ফেলতাম। মুক্তি নিতাম এই পরিচয় থেকে।”
গুটি জবাব দিল না। হয়তো জবাব খুঁজছে। সরণ পুনরায় বলল,
“সেদিন রাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলেন আমার কাছে আসবেন বলে। কতটা বিশ্বাস করলে কেউ এভাবে কারও ভরসায় ঘর ছাড়তে পারে! তখন আমাদের যোগাযোগ ছিল না। আপনার ফোন নিয়ে নিয়েছিল আপনার বাবা। যোগাযোগ বিহীন সম্পর্কে আকাশ সমান বিশ্বাস রেখে জাস্ট একটা ঠিকানা মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন আমার কাছে আসবেন বলে। সেই বিশ্বাস, ভরসা সব এক লহমায় হারিয়ে গেল বীরেন তালুকদারের ছেলের পরিচয়ে। হয়ে গেলাম মিথ্যাবাদী। সত্যিই কি আমি মিথ্যাবাদী? কোন একটা কথা যেচে না বলা আর মিথ্যে বলা এক?”
“আপনি তো সব জানতেন। আমাকে দূর থেকে সাহায্য করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন, সাথ দিয়েছেন। ভেঙে পড়েছি বলার আগেই আগলে নিয়েছেন। কত কথা বলিনি, বুঝে নিয়েছেন। খুবই অল্প সময়ের পরিচয়ে আমায় এক জনমের ভালোবাসা উপহার দিয়েছেন। ওই লোকটা কীভাবে আমার জীবন ওষ্ঠাগত করে তুলেছিল সব শুনতেন, আমি রোজ বলতাম আপনাকে। বীরেন তালুকদারের একটা ছেলে আছে যে ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, যার নাম ভাঙিয়ে বীরেন তালুকদার গ্রামের পরিবেশ ধীরে ধীরে কব্জা করছে, তাও বলেছিলাম। তখনও তো বলেননি আপনিই সেই ছেলে।”
“আপনি যদিও আমার ব্যাপারে কখনো কিছু জিজ্ঞেস করেননি, জিজ্ঞেস করলেও বলার প্রশ্ন ছিল না। কারণ, ওই নরকের কীটটাকে আমার বাবা বলে আমি কোনদিনই মানতাম না। আমার বড় হতে যার পরিচয় লাগেনি, বড় হওয়ার পর তার পরিচয় আমি সেধে আপনাকে দিতাম না গুটি। আমার মাকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখে একই ঘরে পরনারী নিয়ে রাত কাটিয়েছে ওই লোক। আমার মায়ের চোখের সামনে অন্য নারী…”
সরণ আচমকাই থেমে গেল। সমাপ্ত হলো না কথা। গুটিকে সরিয়ে দিল বুক থেকে। গুটিসুটি মেরে বিড়াল ছানার মতো নিজে এবার গুটির বুকে জায়গা করে নিলো। গুটির সর্বাঙ্গে কাঁপন ধরিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল। গুটির ভেতরে কোন ঝড় চলছে আর কত নম্বর বিপদসংকেতের আভাস তা যেন টের পাচ্ছে না স্বয়ং গুটিও। মন, মস্তিষ্ক, শরীর সব মোমের ন্যায় গলছে ক্রমশঃ। গঙ্গার ন্যায় বইতে শুরু করবে যেন এক্ষুনি।
“আমাকে ভালোবাসেন না গুটি?”
সরণের প্রশ্নে দিগ্বিদিক হারিয়ে বসলো গুটি। উপর নিচ মাথা নেড়ে ফুঁপিয়ে উঠলো। চোখ উপচে অধৈর্য্যের বান ভাঙতে শুরু করলো অচিরেই। আর কতো? আর কতো দুরত্ব রবে? সব ঠিক থাকলে আজ দু’জনের সম্পর্ক হতে পারতো স্বচ্ছ। স্বল্প রাগ অল্প অভিমান আর দ্বিধা ও সন্দেহ মিলিয়ে ব্যাঞ্জন এক অনুভূতির বসে পড়ে গেছে। দ্বিধা কাটিয়ে দুরত্ব কমছেই না। আজ আর দুরত্ব নয়। সরণকে বুকের মাঝখানটায় আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মৃদু কন্ঠে স্বগতোক্তির সুরে ‘ভালোবাসি’ বলে। সরণ খানিক চমকালো কিনা বোঝা গেল না। এক মুহুর্ত তর না সয়ে মাথা তুলে গাঢ় চুম্বন এঁকে দিল ভ্রুদ্বয়ের ঠিক মাঝ বরাবর। গুটির চোখে শুরু হলো অশ্রুদের আন্দোলন। সরণ কি যেন চেয়ে দেখলো। হয়তো বোঝার চেষ্টা করলো গুটির মুখে স্বস্তি আছে না অস্বস্তি। গুটির বন্ধ দু’চোখে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। নিজেকে সামলে গুটি আচমকাই সরণের ঠোঁটে হাত চেপে থামিয়ে দিল। ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে বলল,
“আমার অজানা এমনকিছু যদি থেকে থাকে যা আমি মেনে নিতে পারবো না, তবে থেমে যান। আর এগোবেন না। আর যদি এমন কিছু না থাকে যা আমি জানার পর আমাদের সম্পর্কে কোন আঁচ আসবে বা আপনার প্রতি বিতৃষ্ণা কিংবা অসম্মান আসবে, তবে ঠিক ততটা ভালোবাসুন যতটা ভালোবাসা পৃথিবীর সব সুখকে ফিকে করে দিতে পারে। ততটা কাছে আসুন যতটা কাছে আসার পর আর দূরে যাওয়া যায় না। শুরুটা বিশ্বাস আর ভরসা দিয়ে হোক। আপনাকে ভরসা করে দায়িত্ব দিলাম, বেছে নিন কি করবেন।”
সরণের এক মুহুর্ত লাগল না সিদ্ধান্ত নিতে। তৎক্ষনাৎ অধরবন্দী করলো গুটিকে। কয়েক মুহুর্তের বন্দী জীবন কাটলো সরণের ওষ্ঠ কারাগারে। যখন ছাড়া পেল, তখনও বন্দিত্বের শৃঙ্খলের রেষ ধমনী জুড়ে বিচরণ করছে অবাধ্য শিশুর ন্যায়। গুটি নিজেকে ধাতস্থ করার সময় পেল না, দ্বিতীয় বার গাঢ় চুম্বনে লিপ্ত হলো সরণ।
গুটি অপ্রস্তুত ছিল। প্রথম স্পর্শের অনুভূতি সামলে নিতে না নিতেই দ্বিতীয় দফা আক্রমণে দু’হাতে খামচে ধরলো সরণের চুল। দু’জনের ভারী নিশ্বাসের উঠানামা পাল্লা দিয়ে আড়াল করে নিল সরণের চুলে জেঁকে বসা মৃদু যন্ত্রণা। সরণের উন্মাদনা বাড়তে লাগল। সরণ আচমকাই ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে গুটির কপালে কপাল ঠেকিয়ে ভারী শ্বাস টেনে বলল,
“আমায় থামিয়ে দিন গুটি। থামান আমাকে। নয়তো শেষ হয়ে যাবেন।”
গুটি লাজুক ভঙ্গিমায় সরণের বুকে মুখ লুকালো। শক্ত হাতে আবদ্ধ করলো বাহুবন্ধনে। ভারী শ্বাসের উঠানামায় ত্রস্ত দু’জন। সরণ ইঙ্গিত পেয়ে গেছে। আর দেরি কীসের? গুটির উন্মুক্ত কাঁধে ঠোঁট ছোঁয়ালো। একবার, দু’বার, বারবার। বাড়তে লাগলো চুমুর সংখ্যা। পুরো শরীর জুড়ে বিচরণ করতে লাগল একে অপরের অস্তিত্ব। শক্ত হতে লাগল গুটির হাতের বাঁধন। নরম হতে লাগল শরীর, মন ও মস্তিষ্ক। এক হলো দুটো সত্তা।
.
ভোরের আগ মুহুর্তে দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলো গুটি। সরণের পুরুষালী বাহুবন্ধন ভেদ করে উঠতে পারলো না। সরণ তড়িঘড়ি উঠে বসে বুকে জড়িয়ে শান্ত করলো গুটিকে। জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। জবাব না পেয়ে এক গ্লাস জল দিয়ে বলল পুরোটা খেতে। ঘেমে জবজবে অবস্থা পুরো শরীরের। পড়নের কামিস ভিজে মেয়েলি অবয়ব ফুটে উঠেছে। সরণের নজর সেসব পিছু ফেলে গুটির চোখে মত্ত হলো। এ চোখে ভয় যেন মানায় না। মানায় শুধু তেজ। শুইয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“দুঃস্বপ্ন দেখেছেন?”
গুটি মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে গুটিসুটি মেরে সরণের বুকে জায়গা করে নিল। বিড়াল ছানার মতো জাপ্টে শোয়া গুটির চুলে সরণ বিলি কাটতে লাগল আঙ্গুল নেড়ে। গুটির মনোযোগে বিঘ্ন ঘটিয়ে বলল,
“আর একটু প্রেশার দিলে নিশ্চিত বুক চিঁড়ে ভেতরে ঢুকে যাবেন।”
নিশ্চুপ গুটি। সরণ আবার বলল,
“আমার কাছে একটা ওষুধ আছে, যা একবার খেলে সব দুশ্চিন্তা উবে যাবে। এক ডোজই ইনাফ, লাগবে?”
গুটি হটাৎ ফুপিয়ে উঠলো। হাতের বন্ধন হলো আরও শক্ত। কাঁদতে কাঁদতে অস্থির গলায় বলতে লাগল,
“আমার কপালে সুখ সয় না। আপনি সইবেন তো? এমনকিছু নেই তো যা আমাকে টেনেহিঁচড়ে রোজ দুঃস্বপ্ন দেখাতে বাধ্য করবে। যদি থেকে থাকে, তবে আমার অজানাই থাক। আমি চাই না শুনতে। আমি শুধু আপনাকে চাই। আপনাকে নিয়ে সুখী হতে চাই। ছোট্ট একটা সংসার হোক শুধু আমার নামে। আমি পারবো না আর ধোকা সইতে। আর পারবো না।”
“শান্ত হন প্লিজ। এমন কিচ্ছু হবে না। আপনাকে কেউ ধোঁকা দেবে না গুটি। আপনাকে নিয়ে সুখের সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করবো আমি। শান্ত হোন।”
গুটি শান্ত হলো না। সরণ বেছে নিল ভিন্ন পন্থা। ডুব দিল গুটির ওষ্ঠ পদ্মে। গুটির খুব বেশি সময় লাগলো না সরণের ডাকে সারা দিতে। ভোরের সূর্য পৃথিবীতে পদার্পণ করেই যেন চাক্ষুষ সাক্ষী হলো নিষ্পাপ, নিঃস্বার্থ, স্বচ্ছ ভালোবাসার। একদিকে উদীয়মান চিরন্তন সূর্যদেবতা, অন্যদিকে অস্তমিত গুটির সমস্ত দুঃখ, কষ্টের দুঃসময়।
(চলবে)