#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-৭
“সুন্দর একটা সকাল চাই না আপনার? ভীতিহীন বিকেল, চিন্তামুক্ত রাত? আমি সব এনে দেবো। সকালের রোদ আর রোদের প্রখরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমি আপনার সব স্বপ্ন পূরণ করবো। শুধু একবার হ্যাঁ বলুন।”
বেশ খানিক্ষণ চুপ করে রইলো গুটি। সরণের ধৈর্য ভাঙলো। মৃদু স্বরে বলল,
“সে সামথিং….”
“যদি হ্যাঁ বলি আজই বিয়ে করবেন? আজই সব?”
“আপনার কথার ধরন পাল্টে গেল গুটি। শহুরে কথার আদোল! তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ফিচেল হাসি। আমি বেড শেয়ারের কথা বলিনি, লাইফ শেয়ার কথা বলেছি। আমার দিকে এভাবে তাকাবেন না।”
“উত্তর দিন না।”
“এবার কন্ঠ নরম, চোখের দৃষ্টি তে বিনা আগুনের ধোঁয়াশা। কি চাইছেন গুটি?
“আমি রাজি বিয়েতে, কিন্তু নিজেকে সঁপে দেওয়ার আগে নিজের জন্য কিছু চাইবো না?”
“কি চান?”
“আপনি রাজনীতি করেন। আজ বেঁচে আছেন, কাল মরেও যেতে পারেন। তখন আমার কি হবে? আপনার যেখানে যা আছে, মানে টাকা পয়সা, জায়গা-জমি সব আমার নামে করে দিতে পারবেন? বিয়ের আগেই। পরে না।”
সরণ অদ্ভুত গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তাহলে আপনি রাজি বিয়েতে?”
“হুম।”
সরণ কিছু সময় তাকিয়ে থেকে পকেট হাতড়ালো। ফোন পেল না। বিছানার ওইদিকটায় গুটির সামনে পড়ে থাকতে দেখে বাইরে বেরিয়ে গেল। মানিকের ফোন হাতে নিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঢুকলো পুনরায় কক্ষে। গুটির সামনে দাঁড়িয়ে দ্রুত গতিতে কিছু একটা টাইপ করলো। কিয়ৎকাল বাদে মেসেজ টোন বেজে উঠলো গুটির সামনে পরে থাকা ফোনটায়। গুটি চেয়ে দেখলো না। বুঝলো না মেসেজটা সরণই পাঠিয়েছে। যেহেতু ওটা তার নিজের ফোন নয়, তাই মেসেজ টোনে সচকিত হয়ে ফোন পরখ করার প্রশ্নই আসে না।
সরণ ফোনটা পকেটে চালান করতে করতে গুটিকে বলল,
“আচ্ছা, যা চাইছেন সব দেবো। আমার যা কিছু আছে সব লিখে দেবো আপনাকে। এবং তা বিয়ের আগেই।”
গুটি কয়েক সেকেণ্ড চুপচাপ তাকিয়ে রইলো। উপহাস করে বলল,
“এমন স্বার্থপর প্রস্তাবে যে এক কথায় রাজি হয়, সে নিজেও স্বার্থপর। আমি কোন স্বার্থপরকে বিয়ে করবো না। টাকা দিয়ে ভালোবাসা কিনতে চাওয়া মানুষের কাছে আমি বিক্রি হবো না, না আমার ভালোবাসা বিক্রি হবে!”
“যদি না বলতাম রাজি হতেন? হ্যাঁ করতেন বিয়েতে?”
“একদম না। না করলে বুঝে নিতাম একটা লোভী আপনি।”
সরণের ঠোঁটে খেলে গেল মন ভোলানো হাসি। চৌকস ব্যাক্তিত্বের সুদর্শন যুবকটি দু’হাত পকেটে গুঁজে মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে এগোতে লাগল গুটির দিকে। গুটির কপাল কুঁচকে এলো। ওড়না ঠিক করে ঠিকঠাক বসতে বসতে সরণ এসে দাঁড়ালো খুব কাছে। গুটি বসা বিছানায়, সরণ বিছানা ঘেঁষে ঝুঁকে গেল গুটির সামন বরাবর। তড়িৎ বেগে সরতে গিয়ে পায়ে খানিক ব্যাথা পেলেও চিৎকার গিলে গুটি বলে উঠলো,
“কাছে আইল খু ন অইবেন খু ন।”
গুটি ফিরে গেল আঞ্চলিক ভাষায়। তার হুমকি শেষ হতে হতে সরণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। গুটির সামনে যে ফোনটা ছিল সেটা নিতেই ঝুঁকেছিল। ফোনটা হাতে নিয়ে নিজের কপালে দু’টো ঠোকর মারলো সরণ। ঠোঁটে সেই হৃদয়কাড়া হাসি। ফোনের লক খুলে গুটির সামনে ধরলো। গুটি চমকে আরও কিছুটা দূরে সরে যাচ্ছিল, ফোন এগোতে দেখে ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। তবে স্ক্রিনে বেশিক্ষণ চোখ রাখতে পারলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তেড়ে গেল সরণের দিকে। সরণ পালানো তো দূর, ল্যাম্পপোস্টের ন্যায় খুঁটি গেঁড়ে দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে দিল নিজেকে। যেন বুক পেতে এবার গু লি নেওয়ার পালা। আর নয়তো দেওয়ার পালা। গুটি হাঁটু গেঁড়ে বসে কলার চেপে ধরলো সরণের। রাগে চিৎকার করে বলল,
“কি মনে করেন নিজেরে? সবজান্তা….”
গুটির কথা বন্ধ হলো আচমকা। সরণ উল্টো হাতে চেপে ধরেছে গুটির কপাল। গুটি রাগ দেখানোর সময় পেল না, পেল না প্রতিক্রিয়া দেখানোর সুযোগ। তার আগেই সরণ চুমু বসালো গুটির কপালে রাখা নিজের হাতের উল্টোপিঠটায়। গুটি ঢোক গিলতে গিলতে যে সময়টুকু নিল, ততক্ষণে চলে গেল সরণ কক্ষের বাইরে। গুটি রইলো একভাবে। ধীরে ধীরে চুপটি করে বসলো। ঠোঁট তো তাকে ছোঁয়নি, উত্তপ্ত নিঃশ্বাসও ছোঁয়নি তার কপাল। তবুও ঘামতে লাগল গুটি। শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ বইতে লাগল প্রতিবার, যতবার কানে বাজতে লাগলো মৃদু চুমুর আওয়াজ আর এতোটা কাছ থেকে পাওয়া পুরুষালী গায়ের গন্ধ। গুটি ভুলে গেল ঝগড়া এখনও বাকি আছে। কিছুক্ষণ উদভ্রান্তের ন্যায় বসে থেকে ফোনে সরণের দেখানো মেসেজটিতে পুনরায় চোখ বুলালো। গুটি যা বলেছে সেই কথাগুলোই অগ্রিম মেসেজে লিখে অতঃপর জবাব দিয়েছে সরণ। লিখেছে,
“আমি রাজি হলে বলবেন এমন সেলফিশ একটা প্রোপোজালে রাজি হয়েছি মানে আমিও সেলফিশ। তারপর বলবেন ভালোবাসা টাকা দিয়ে কিনতে চেয়েছি আমি। আর যদি রাজি না হই তাহলে বলবেন লোভী। গাছের আর তলার মাগনা খাওয়া লোভী পুরুষ। যে নিতে রাজি বাট দিতে নয়। রাইট? জবাব যাই দিই, ঘাড়ে চেপে মাথা ঠিকই আলাদা করবেন।”
এতটুকু পড়ে থামলো গুটি। তখন এতটুকুই পড়েছিল। অনেকটা নিচে আরও একটু লেখা আছে। সেটুকু তখন পড়েনি। এখন চোখ বুলালো সেখানে।
“আই হ্যাভ মাই বিউটিফুল উডবি ওয়াইফ, আই, মি, এন্ড মাইসেল্ফ। আমার এই আমি আর সে ছাড়া আমার বলতে কেউ নেই। তাকে তো দেবো না, নট ইভেন হার রিফ্লেকশন অর শ্যডো। সো, নিলে আমাকে নিতে পারেন। এছাড়া দেওয়ার মতো আর কিছু নেই তেজস্বিনী। নেবেন আমাকে? উদার মনে দিয়ে দেবো। আমি শুধু হ্যান্ডসাম নই, হাম্বল প্লাস রোমান্টিক। নিলে আফসোস করতে দেবো না। ট্রাস্ট মি, ইউ উইল লাভ মি।”
লেখাটুকু পড়তে পড়তে গুটির মুখে কখন লজ্জা আর হাসি ভর করেছে তা গুটি নিজেও জানে না। হাসি থামলো মানিকের নম্বরটা ‘মাইনকার চিপা’ নামে সেইভ দেখে। বড় করে শ্বাস নিয়ে আবারও হেসে ফেলল। হাসি আর সরলোই না। একদম না। সাথে খানিক ভিজলো চোখের দুয়ার। চোখেমুখে আনন্দের দ্যুতি ছড়াচ্ছে ভীষণ দ্রুত।
সারা দুপুর আর দু’জনের দেখা হলো না, কথা হলো না। মানিক এসে খাবার দিয়ে গেল দুপুরের। গুটি খুব করে চাইলো মানিক নিজে থেকে বলুক সরণ কোথায়। কিন্তু মানিক এলো নিঃশব্দে, গেলও নিঃশব্দে। গুটির এক আকাশ লজ্জা নিয়ে ছটফট করতে লাগল একা একা। ভাবল, তার কি মেসেজের রিপ্লাই করা উচিত? কোন জবাব না পেয়েই হয়তো সামনে আসছে না সরণ। ফোন হাতে নিতে মনে পড়লো কাকে জবাব দেবে? যাকে দেবে তার ফোন তো এখানে। মানিকের ফোন কি আর এখনও আছে তার কাছে? ফেরত দিয়ে দিয়েছে হয়তো। বেশ কিছুক্ষণ অপ্রয়োজনীয় বিরহ নিয়ে বসে থেকে হটাৎ মনে হলো সে কিছুটা অদ্ভুত ব্যাবহার করছে। সে তো কাঠখোট্টা, কঠিন মুখছোটা মেয়ে। লজ্জাবতী লতা তো নয়। নিজেকে মনে মনে দু’টো গালি দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাইরে গেল। মানিককে ড্রয়িংরুমে পেয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,
“উনি কোথায়?”
মানিক এগিয়ে এসে বলল,
“আরে গুটিদি, তুমি পায়ে হেঁটে বাইরে এসেছো কেন? সেলাই কাঁচা, ব্লিডিং হবে তো!”
গুটি চমকে উঠলো ডাকটা শুনে। মনে পড়লো সরণ একদিন বলেছিল তার ছোট ভাইয়ের শখ পূরণ করতে রেডিমেড একটা ভাই জোগাড় করে ফেলেছে সে। বয়সে তার থেকে বড় হলেও, বড় বোনের অভাবে সে বড় দিদি বলেই নাকি মানে। ছোট করে ডাকে গুটিদি বলে। কিন্তু কে সে তা বলেনি। বলেছিল, তাকে সামনে পেলে নিজেই চিনে নিতে পারবেন। নিশ্চিত হতে ভাইয়ু বলে ডাকার কথা বলেছিল শুধু। গুটি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ভাইয়ু বলে উঠলো কিছুটা প্রশ্নের সুরে। যেন প্রশ্ন করলো সে ভাইয়ু কিনা? মানিক উত্তর নিয়ে মাথা নেড়ে হাসলো। গুটির চোখ ভিজে উঠলো আবার। কোনমতে দৃষ্টি আড়াল করে বলল,
“উনি কোথায়?”
“চলে আসবে দি, তুমি খেয়ে নাও। তোমার ওষুধ আছে দুপুরে।”
গুটি চলে গেল ভেতরে। বুক ভরা মন কেমন করা প্রসন্নতার মেলা বসেছে। আবেগি মেলা।
সারাদিন পর সন্ধ্যায় সরণ বাড়ি ফিরলো এক গাদা শপিং ব্যাগ নিয়ে। গুটির চোখ জুড়ালেও নিজেকে মেলে ধরতে পারলো না আগের গুটি রূপে। জড়তায় জড়িয়ে রইলো। আগ বাড়িয়ে কথা বলল সরণ। কয়েকটা শপিং ব্যাগ হাতে দিয়ে বলল,
“বউ সাজতে পারো?”
গুটি অস্বস্তি লুকিয়ে ছোঁ মেরে ব্যাগ ক’টা নিয়ে বলল,
“সাজতে পারি, তবে সাজলে বউয়ের মতো লাগবে না সঙের মতো তা জানি না।”
“একটু পর সিঁথিতে সিঁদুর উঠলে এমনিতেই বউ হয়ে যাবে।”
গুটি নত করে নিলো দৃষ্টি। সরণ বলল,
“আজ থেকে সাজবে তুমি, আর তা নষ্ট করবো আমি। দারুণ না ব্যাপারটা?”
“আপনি যাবেন এখান থেকে?”
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই গুটি নিজেকে আপনমনে প্রশ্ন করলো,
“আমি এমন চিল্লাচ্ছি কেন?”
গুটি অস্বস্তি লুকাতে গিয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়ছে দেখে সরণ টিপ্পনী কাটলো।
“লজ্জা পেলে মেয়েরা চিল্লাচিল্লি করে, জানা ছিল না! মেয়েরা কখন কখন চিল্লায় বলো তো?”
গুটি আগের ফর্মে ফিরে গেল মুহুর্তেই। সরণের দিকে এগোতে এগোতে তেজি গলায় বলে উঠলো,
”জায়গামতো একটা দিলেই বুঝতে পারবেন কখন কখন চিল্লাতে হয়। সকালেরটা মনে নেই?”
দু’জনকে ব্রেক টানালো মানিক এসে। সরণের আনা নতুন পাঞ্জাবি পড়েছে মানিক। তাই দেখাতে এসেছে। গুটির সামনে গিয়ে বলল,
“গুটিদি, ভালো লাগছে?”
গুটি মাথা নেড়ে সায় জানালে সরণ বলল,
“কার পছন্দ দেখতে হবে তো।”
মানিক আর সরণ বেরিয়ে গেলে গুটি তড়িঘড়ি ব্যাগ থেকে শাড়ী বের করলো। আরও পেল কিছু কসমেটিকস। তবে কোন গয়না নেই। যা পেল তাই দিয়ে সাজতে বসলো। সাজগোজ শেষ হতেই সরণ এলো একটা সোনার চেইন আর ছোট্ট এক জোড়া কানের দুল নিয়ে। গুটিকে বলল,
“আমার মায়ের, পড়িয়ে দিই?”
গুটির সজ্জা সম্পূর্ণ হলো না। হাত খালি। সরণকে সেদিকে চেয়ে থাকতে দেখে বলল,
“শাখা-পলা পড়বো তো, তাতেই হবে। আর কিছু লাগবে না।”
সরণের চোখেমুখে তৃপ্তি ছেয়ে গেল। তিনজন রওয়ানা হলো মন্দিরের উদ্দেশ্যে, তবে আলাদা আলাদা। গুটি বের হলো শাড়ীর উপর দিয়ে কালো বোরকা পড়ে। সরণ কেন এমনটা করালো তা জানে না গুটি, জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করেনি। যখন বলবে, তখন নিশ্চয়ই সবই বলবে। তাকে প্রশ্ন করার সুযোগই হয়তো দেবে না।
বেশ দূরের একটা ছোটখাটো মন্দিরে বিয়ে সম্পন্ন হলো সরণ আর গুটির। কিন্তু বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পাঁচ মিনিট পেরোতে না পেরোতেই আলাদা হয়ে গেল দু’জন। আচমকা পুলিশ এসে এরেস্ট করলো সরণকে। গুটি হাতের মুঠোয় দুনিয়া পেয়ে হাত মুঠো করে ধরতেও পারলো না, তার আগেই সব হারিয়ে বসলো। নানান আশংকা আর ভীতিতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রইলো মন্দিরের মেঝেতে। মানিক দিশেহারা। কাকে সামলাবে? সরণ মানিককে গুটির দায়িত্ব দিয়ে চলে গেল পুলিশের সাথে খুনের আসামি রূপে। তবে যাওয়ার আগে বলে গেছে, এখনই জ্ঞান না ফেরাতে। থাকুক কিছুক্ষণ নিশ্চিন্তে। না থাকুক জ্ঞান।
(চলবে)