#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-৬
সরণের দ্রুত হেঁটে আসার শব্দে তড়িঘড়ি ফোন রাখলো গুটি। সোজা হয়ে বসে বড় করে শ্বাস টানলো। যেন চুরি করতে গিয়ে এক্ষুনি ধরা পড়তে পড়তে বেঁচেছে। সরণ এরমধ্যেই ল্যাপটপ হাতে ঘরে ঢুকে পড়েছে। গুটির সামনে ল্যাপটপ রেখে গুটিকে বলল,
“এই ফোল্ডারে শাহরুখ খানের প্রায় ত্রিশ প্লাস মুভি আছে। আপনার যেটা খুশি দেখতে পারবেন।”
গুটির শাহরুখ খানকে ভীষণ পছন্দ। একদিন বলেছিল সরণকে। সেই কথা মনে রেখেছে সরণ। তবে মুগ্ধ হওয়ার সুযোগ পেল না। সদ্য জলে পড়া অভিব্যক্তি নিয়ে বলল,
“আমি জীবনে ল্যাপটপ ছুয়্যাও দেহি নাই। কেমনে কি করা লাগে আমি জানি না।”
সরণ একবার ঘড়িতে সময় দেখে গুটিকে বলল,
“আচ্ছা আমি শিখিয়ে দিচ্ছি। জাস্ট কোন মুভিটা দেখবেন সেটা সিলেক্ট করে প্লে করবেন, সিম্পল।”
তেজস্বিনীর তেজ লেজ গুটিয়ে হাওয়া হলো। চুপসানো আতংকিত আদোলে কোনা চোখে চেয়ে রইলো ল্যাপটপের স্ক্রিনে। গুটির মনে হচ্ছে সে হাত দিলেই ল্যাপটপ নষ্ট হয়ে যাবে। যদি উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে! এতোই সোজা নাকি? মুহুর্তেই শিখে ফেলা যায়? তবে ভীতির বহিঃপ্রকাশ করতে রাজি নয়। স্ক্রিনে নজর বুলিয়ে মুভির নাম পরখ করে শান্ত কন্ঠে বলল,
“মে হুনা দিলেই হবে। আমাকে শেখাতে হবে না। আপনি দিয়ে চলে যান।”
সরণ মুভিটা দিয়েও সারতে পারলো না। দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো মানিক।চিন্তিত চেহারায় ডেকে বলল,
“সরণ জিহাদ এসেছে।”
চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠলো সরণের। গুটিকে বলল,
“যতক্ষন না আমি নিজে আসছি, রুম থেকে বের হবেন না।”
সরণ কথাটা বলে দরজা অব্দি গিয়ে আবার ফিরে এলো। অস্থির ও কঠিন কন্ঠে গুটিকে পুনরায় বলল,
“নো মিনস নো। অবাধ্যতা করবেন না।”
“এতো সমস্যা থাকলে বাইরে থিকা লাগাইয়া যান দরজা।”
সরণ কথা না বলে বেরিয়ে গেল। তবে বাইরে থেকে দরজা লাগালো না। মানিকও সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলে গুটি অনুভব করলো বুকের ভেতর অদ্ভুত দোলাচল। সন্দেহ আর আগ্রহ জুটি বেঁধে অস্থির করে তুললো তাকে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ড্রয়িংরুমের কথোপকথন শোনার ইচ্ছেয় দরজার পাশে দাঁড়ালো। শুনতে পেল না তেমন কিছুই। খুব সাধারণ কথাবার্তা চলছে। গুটি প্রায় পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে বিছানায় চলে এলো। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। এক পায়ের ভরে কতক্ষণ আর দাঁড়ানো যায়? কিন্তু বিছানায় ফিরে আসার কয়েক মিনিটের মধ্যে হইচই শুনে চমকে উঠলো গুটি। প্রায় দশ বারোজনের কন্ঠে শোনা যাচ্ছে হুমকি আর গালিগালাজ। তার মধ্যে সরণের কণ্ঠ নেই। সরণ কোথায়? মারামারি বাঁধলো কি? খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাইরে যেতে গিয়ে থেমে দাঁড়ালো। সরণের শেষ কথা মনে পড়লো। গেল না বাইরে। ফিরে এসে বিছানায় বসেও শান্তি পেল না। অধৈর্য হয়ে দরজার বাইরে গিয়ে উঁকি দিল ড্রয়িংরুমে। অবাকের মাত্রা ছাড়ালো গুটির। ভেবেছিল দশ বারো জন হবে, কিন্তু ড্রয়িংরুমে তো প্রায় ত্রিশ চল্লিশজন ছেলেদের গরম আবহাওয়া চলমান। এক চিলতে ফাঁকা নেই কোথাও। সরণকে দেখতে পেল চুপচাপ পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু চোখেমুখ শক্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে খালি হতে শুরু করলো ড্রয়িংরুম। একে একে সবাই চলে গেলে সরণের সঙ্গে রইলো মানিক এবং আরও একটি ছেলে। যাকে গুটি চেনে না। সরণ মানিককে ধীর আওয়াজে কিছু একটা বলে গুটির রুমের দিকে আসতে লাগলে গুটি তড়িঘড়ি রুমের ভেতরে যেতে গিয়ে পুনরায় সকালের সেই ঘটনা ঘটালো। দুম করে আছাড় পড়া যাকে বলে। শরীরের সমস্ত ভর ক্ষতবিহীন পায়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হুট করে দু’পায়ে ভর দিয়ে ছুটতে গেলে ধপাস করে পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এরমধ্যেই সরণ সামনে এসে দাঁড়ালে গুটি মনে মনে কপাল চাপড়ালো। সরণ গুটির হাত ধরে সাহায্য করলো উঠতে। গুটি কোন হুমকি ধামকি দিল না। হাতও ছাড়ালও না। পরিস্থিতির গম্ভীরতাকে বাড়াতে চায় না সে। গুটিকে দাঁড় করিয়ে বিছানায় গিয়ে আগে আগে বসলো সরণ। গুটি পাশে গিয়ে দুরত্ব বজায় রেখে বসলে দু’হাতে দু’চোখ চেপে ধরা অবস্থায় গুটিকে বলল,
“বাইরে যেতে মানা করেছিলাম।”
“আমাকে কেউ দেখেনি।”
“কিছু জিজ্ঞেস করতে চাও?”
“উহুম।”
“কিচ্ছু না?”
“আপনি ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। কোন একটা উচ্চ পদে আছেন জানি। এইসব বুঝি কম, গুছাইয়া কইতে পারমু না। কিন্তু এটুকু বুঝি, রাজনীতি মানেই এইসব।”
“কোনসব?”
“যেইসব হইলো মাত্র।”
“কিসব হলো মাত্র?”
“আপনি না কলেজ যাইবেন, যান। মাথা খাইয়েন না।”
“যে কাজে যেতাম তাতো হলোই। এখন আর না গেলেও চলবে।”
গুটির খুব প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে। কি হলো, কি হতে যাচ্ছে, কোন বিপদ হবে নাতো? ছেলেগুলো কারা? কতকিছু বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না। ছুতো গাঁথছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আর অভিমান তো গায় গায়। সব ভাবনা ঝেড়ে বলল,
“আপনি আমারে তুমি তুমি করতাছেন।”
সরণ মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিল। গুটির কথার প্রত্যুত্তরে শুধু হাসলো কিঞ্চিৎ। গুটি তা মনোযোগ দিয়ে দেখল। দেখে বলল,
“সেই দশ মিনিট কি আর নিবেন না কোনদিন?”
“দিতে যখন চান, সবটুকুই দিন না।”
“কি?”
“সব। সবটুকু।”
“আমার পা একটু ঠিক হইলে আমি চইলা যামু।”
পাল্টে গেল সরণের মুখভঙ্গি। কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল,
“ঘর তো ছেড়েছিলেন আমার কাছে আসবেন বলেই। তাহলে কেন এমন করছেন?”
গুটি চমকালো। দৃষ্টি লুকালো এদিক থেকে সেদিক। সরণ খানিক এগিয়ে এসে গুটির মুখোমুখি হয়ে বলল,
“ওইদিন রাতে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আমাকে ফোনে না পেয়ে দারোয়ান চাচাকে ফোন করেননি? খোঁজেননি আমাকে? বলেননি আপনি আসছেন আমার কাছে?”
গুটি জবাব না দিয়ে সরে বসলে সরণ আরও কাছে গিয়ে বলতে লাগল,
“আমার হাতে সময় খুব কম গুটি। টক টু মি।”
“সময় কম মানে?”
“আমি আমার একান্ত কাছের মানুষ ছাড়া পার্সোনাল কিছু শেয়ার করি না। পার্সোনাল বিষয় জানতে হলে পার্সোনাল মানুষ হতে হবে। হবেন?”
“আমার কাছে মিথ্যা বলা আর সত্য লুকানো এক। আপনি দিনের পর দিন আমার সাথে কথা কইছেন অথচ কন নাই আপনি বীরেন তালুকদারের….”
“ষুউউউ… সে আমার কেউ নয়। তার নামের সঙ্গে বাবা শব্দটা জুড়বেন না।”
সরণ ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে কথাটা বলতেই গুটি চুপ করে গেল। সরণ পুনরায় বলল,
“আগে কি করেছি কেন করেছি সেসবের কৈফিয়ত আমি শুধুমাত্র আমার বউকে দিতে চাই। বিয়ে করবেন আমাকে?”
গুটির বুক কাঁপছে উত্তেজনায়। এক হাতে কোনমতে মুখ চেপে আড়াল করতে চাইলে সরণ হাত টেনে সরিয়ে দিল। গুটির এবার লজ্জা লাগতে লাগলো ভীষণ। সরণ ধীর কন্ঠে আবারও বলল,
“বিয়ে করবেন আমায়?”
গুটি কিজানি ভেবে বলে উঠলো,
“যদি না করি?”
“তবে আপনাকে সেইফলি অন্য কোথাও শিফট করবো। দেন লাইফ যেমন চলছে চলবে। আর যদি জবাবটা হ্যাঁ হয়, তবে আজকে এই শহরে আমার আর আপনার শেষ রাত।”
গুটির দৃষ্টিতে এবার ভয়। বিপদের আশংকা আর অজানা ভয়ে বলে উঠলো,
“কোন সমস্যা?”
“একটু আগে কি বললাম? আমি আমার কাছের মানুষ ছাড়া পার্সোনাল কথা শেয়ার করি না। পার্সোনাল বিষয় জানতে হলে পার্সোনাল মানুষ হতে হবে।”
“যার ভরসায় ঘর ছাইড়া আইছি আর যার ঘরে আছি, মানুষ দুইজন এক। কিন্তু আমার বিশ্বাস তো ভাগ হইয়া গেছে। আপনি অস্বীকার করলেই আপনার পরিচয় মুইছা যায় না৷ পুরা গ্রামের মানুষ জানে বীরেন তালুকদার একমাত্র পোলা সরণ তালুকদার বিশাল এক নেতা। সেই পাওয়ারে পাওয়ারফুল বীরেন তালুকদার মেম্বার হইছে। আমি বীরেন তালুকদারের ছেলের বউয়ের পরিচয় কোনদিন মানতে পারুম না।”
“যে মানুষটি আর বেঁচে নেই, তার পরিচয় মুল্যহীন।”
চমকে উঠলো গুটি। উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“বাঁইচা নাই মানে? আপনি না বলছিলেন মরে নাই।”
“যখন বলেছিলাম তখন বেঁচে ছিল। এখন আর নেই।”
গুটির মিশ্র অনুভূতির তিক্ততায় বুক ভারী হয়ে এলো। নিজেকে খুনী বলে আপনমনে ডেকে উঠলো দু’বার।
“আমার হাতে সময় খুব কম গুটি। আর এদিক সেদিক করে কথা আগাতে চাচ্ছি না। সোজাসাপটা জবাব দিন। আমাকে বিয়ে করবেন?”
“আমি…আমার…”
“সুন্দর একটা সকাল চাই না আপনার? ভীতিহীন বিকেল, চিন্তামুক্ত রাত? আমি সব এনে দেবো। সকালের রোদ আর রোদের প্রখরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমি আপনার সব স্বপ্ন পূরণ করবো। শুধু একবার হ্যাঁ বলুন।”
(চলবে)