#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-৪
“আপনি এতো রাতে বিলের মধ্যে কি করছিলেন?”
গুটি ধীর গলায় বলল,
“বাড়ি থেকে পালাচ্ছিলাম।”
এই পর্যায়ে মুখটা ছোট হয়ে গেল সরণের। বিস্মিত চাহনি দিয়ে আশাহত কন্ঠ বলল,
“কার সাথে? কাউকে ভালোবাসেন?”
“বাসি তো। নিজেকে ভালোবাসি। তাই নিজের সাথে পালাচ্ছিলাম।”
এপর্যায়ে স্বল্প হাসি ঠাঁই পেল গুটির ঠোঁটে। কিন্তু সে হাসি জুড়ে তাচ্ছিল্য টের পেল সরণ। তবে সরণের ঠোঁটের হাসি দেখা গেল স্বচ্ছ জলের ন্যায় টলটলে।
“ওই জানোয়ারটা বেঁচে আছে না মরেছে? একটু খবর এনে দিতে পারবেন?”
সরণ বলল,
“আকাঙ্ক্ষিত নিউজ কোনটা? বেঁচে থাকলে খুশি না মরে গেলে?”
“বেঁচে থাকুক। শত বৎসর বেঁচে থাকুক। কোনদিন বলতে তো পারবে না একটা মেয়ে এমন হাল করেছে ওর। বিয়ে বিয়ে করে মরেছে এতোদিন, বিয়ের যোগ্য আর রইলো কই? আমি ওর অক্ষম জীবনযাপন দেখতে চাই। কম মেয়ের জীবন নষ্ট করেনি জানোয়ারটা।”
“কুল, হাইপার হবেন না।”
“আমি ঠিক আছি।”
“আচ্ছা, আপনি পালিয়ে যাচ্ছিলেন কোথায়?”
“জানি না।”
“হোয়াট? এতো রাতে একলা এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন কোন গন্তব্য ছাড়াই?”
“আপনি না চিনে না জেনে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সেই কৃতজ্ঞতায় যা জানতে চেয়েছেন, বলেছি। কিন্তু এই প্রশ্নের জবাবটা দিতে পারছি না, দুঃখিত।”
সরণ বড় কিছুর আঁচ পেল। কি যেন ভেবে জানা সত্বেও প্রশ্ন করলো,
“আপনার পরিবারে আছে কে কে?”
গুটি সময় নিয়ে ভীষণ ধীরে আওয়াজে বলল,
“বাবা… আর আমি।”
“কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে?”
“হচ্ছে একটু…”
“রেস্ট নিন তাহলে। আমি বাইরে যাচ্ছি।”
সরণ উঠে চলে যেতে লাগলে পিছু ডাকলো গুটি। মৃদুস্বরে বলল,
“আপনার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি?”
সরণ এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“কি জানতে চান?”
“কে আপনি? আমাদের গ্রামে তো কখনো দেখিনি আপনাকে। ঘটনাস্থলে খুব জলদি এসে পৌঁছেছিলেন, মানে কাছাকাছি কোথাও ছিলেন।”
“আমি একজন মানুষ। আপনার গ্রামে থাকি না, তাই দেখেননি আগে কখনো। ঢাকা থেকে গতকাল গ্রামে এসেছিলাম একজনের খোঁজে। গ্রামে ঢোকার পথে লাক বাই চান্স দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়ে যাই।”
“মানুষ! মানুষটার নাম?”
“শুনে চমকাবেন না তো?”
“মানে?”
“মামুষটার নাম, সরণ।”
গুটির মুখভঙ্গি পরিবর্তন হলো। কপাল জুড়ে চিন্তার ভাজ সন্তর্পণে আড়াল করে বলল,
“সরণ কি? তালুকদার?”
“ইয়েস। সরণ তালুকদার।”
গুটির বিস্ময় বেড়ে আকাশচুম্বী। বুকটা হটাৎ-ই ভারী হয়ে উঠলো। নিছক কাকতালীয় ঘটনা এমনও হয়? গুটি ঘামতে লাগল হটাৎ করে। আমতা আমতা করে বলে উঠলো,
“আপনার বাবা…”
“ষুহ….”
ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে বাঁধ সাধলো সরণ। বলল,
“ভুলটা দ্বিতীয়বার করবেন না। উনি আমার বাবা না।”
গুটির ভয় কমলো না। উল্টো বাড়লো। সরণের শেষ কথা ভয়ংকর রকমের উপহাস মনে হলো তার কাছে। আতংকে বুক কাঁপছে। কিছুক্ষণের পিনপতন নীরবতা অন্ত করে সরণ বলল,
“কাল আমার সঙ্গে ঢাকা যাচ্ছেন আপনি। যাওয়ার আগে বাবার সাথে দেখা করতে চাইলে বলবেন।”
“না, একদম না। বাবাকে বলবেন না কিছু। আমার খোঁজ যেন কেউ কোনমতেই না পায়।”
“তিনি নিশ্চয়ই চিন্তায় আছেন।”
“তা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমি আপনার সাথে যাচ্ছি না। সাহায্য করেছেন, ধন্যবাদ। সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। কিন্তু হুকুম চালানোর চেষ্টা করবেন না। আর আপনি চাইলে আমাকে পুলিশে দিতে পারেন। আমি সব সত্য পুলিশের কাছেই বলবো কিন্তু আমার দুর্বলতা জেনে গেছেন বলে ব্যাবহার করার চেষ্টা ভুলেও করবেন না। তাহলে বাবার মতোই হাল হবে। কিংবা তার থেকেও খারাপ।”
গুটি মনে মনে যতই ভয়ে সিটিয়ে পড়ুক তা প্রকাশ করলো না মোটেও। তবে তেজ দেখিয়ে কোন লাভ হলো বলে মনে হলো না। কেননা সরণ এমনভাবে চেয়ে হাসছে যেন খুব মজার কথা বলেছে সে। সরণ মিটিমিটি হেসে বলল
“হুকুম করলাম কখন? আমি…”
গুটি কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়ে চট করে বলল,
“আপনি যে কাজে গ্রামে এসেছিলেন সেই কাজ করুন। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আমি আমার মতো থাকতে চাই। আর যদি ব্ল্যাকমেইল করার হয় সরাসরি করুণ ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নয়।”
সরণের বলা হলো না, আমি আপনার খোঁজেই এসেছিলাম গুটি। তবে এটুকু বলল,
“ব্ল্যাকমেইল করবো? মানে করতে বলছেন?”
গুটি খানিক চিৎকার করে উঠলো। বলল,
“ফাইজলামি করবেন না এক্কারে। নিরীহ না আমি। দুর্বল ভাববেন না আমারে। বিপদে ফালানোর ধান্দা থাকলে ঝটপট আসল রূপে আহেন, আর বাপের চরিত্র নিয়া আফসোস থাকলে সাহায্য করছেন ভাইবা খুশি মনে রাস্তা ছাড়েন। কিন্তু সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করলে বাপের থিকাও খারাপ অবস্থা বানামু। বাপের যেডা ছেঁচা গেছে, আপনের হেইডা কাটা না যায়।”
সরণ শুকনো গলায় বিষম খেলো। কাশতে কাশতে দম খাটো হয়ে আসছে কিন্তু হাসি আটকাতে পারলো না। হেসে উঠলো উচ্চস্বরে। হাসপাতালের কথা মাথায় রেখে খুব কষ্টে হাসির শব্দ গিলে নিলে দরজার সামনে মানিক ছিল পাহারায়, মানিকের চাপা হাসি কানে এলো গুটির। গুটির ভয়ের মাত্রা ক্রমেই বাড়তে লাগল। দু’জনের হাসি তার কাছে বিপদের আগাম বার্তার ন্যায়। অচেনা শহুরে মানবের সঙ্গে এতোক্ষণ ভদ্রতার সহিত প্রমিত ভাষায় সুন্দর মতো কথা বললেও রাগে বেরিয়ে এসেছে আঞ্চলিক ভাষা। ঢাকা কেন নিতে চায় তাকে? ঢাকা নিয়ে বেচে দেবে? না ব্যাবহার করবে? উদ্দেশ্য কি? নানান ভাবনায় মাথা ভনভনিয়ে উঠলো। এদিকে সরণের হাসির শব্দ কমলেও হাসি কমেনি। শব্দহীন হেসে যাচ্ছে অনবরত। মুখভঙ্গি এমন, যেন কিছুটা লজ্জাও পেয়েছে। সরণ হাসতে হাসতেই বলল,
“আমি বাপু ভীতু মানুষ, এভাবে ভয় দেখালে হার্ট অ্যাটাক করতে পারি কিন্তু।”
গুটির এবার ভয়ের থেকেও রাগ বাড়তে লাগল বেশি। সরণের হাসি যেন বড়ই কাটা হয়ে গায়ে বিঁধছে। সরণ তা বুঝতে পেরে চুপচাপ গুটির পায়ের কাছে বসলো। আরাম করে পা ভাজ করে মুখোমুখি বসে গুটিকে বলল,
“একটা গল্প শোনাই?”
গুটি হ্যা না কিচ্ছু বলল না। সরণ বলতে লাগল,
“হটাৎ একদিন, আননোন নম্বর থেকে একটা কল আসে। রিসিভ করে কানে তুলতেই তেজি কন্ঠ শুনতে পাই; বীরেন তালুকদারের ছেলে সরণ তালুকদার বলছেন? ব্যাস, গেল মাথা গরম হয়ে। যার পরিচয় আমি নিজে দিই না তার ছেলের পরিচয়ে কল! দিলাম মুখের উপর কল কেটে। ওপাশের তেজস্বিনী এতোই রেগে গেলেন যে আবারও কল দিলেন। আমি রিসিভ করলাম না। তবে কল আসা বন্ধ হলো না। কল আবারও আসলো। তিনবারের বেলা আবার রিসিভ করলাম। ওপাশের পরিবেশ তখন খুবই উত্তপ্ত। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিলেন একটা ধমক দিয়ে। বললেন, রঙ নম্বর হলে বলুন তারপর কল কাটুন। আর বীরেন তালুকদারের ছেলে হলে বলুন হ্যাঁ আমি বীরেন তালুকদারের ছেলে। দ্বিতীয় দফা মাথা গরম হলো। তরতর করে বাড়তে লাগল রাগ। আমি কিনা বলব আমি বীরেন তালুকদারের ছেলে? তার রাগের আগুনে ঘি ঢেলে প্রত্যুত্তর ছাড়াই আবার কাটলাম কল। একদম মুখের উপর চটাস করে। আমার ফোনে ফের কল এলো তৎক্ষনাৎ। এক বার দু’বার রিং হয়ে কেটে যাওয়ার পর তিনবারের বেলা রিসিভ করলাম। টের পেলাম কি ভয়ানক রেগে আছেন তিনি। রাগে ফোঁস ফোঁস করছেন। বুঝে গিয়েছিলাম মুখের উপর কল কাটা তার ভীষণ গায়ে লাগে। তাই কথা বলার সুযোগ দিলাম আবারও কল কাটবো বলে। যাকে বলে নিরব প্রতিশোধ। মনে মনে ঠিক করলাম এবার কল কেটেই ব্লকলিস্টে জায়গা দেবো। কত বড় সাহস! বীরেন তালুকদার এর ছেলে বলে পরিচয় দেয়। এসব ভেবে আমি কল কাটার অপেক্ষায় যখন, তখন ওপাশ থেকে এমন কথা কানে এলো যে আমি শক খেয়ে গেলাম। রাগ দেখানোর আগেই তিনি কল দিলেন কেটে। নিরব প্রতিশোধ। এবার আমি কল করলাম, একবার, দু’বার তারপর তিনবারের বেলা রিসিভ করতেই দ্বিতীয় শক, দ্বিতীয় ছক্কা। কি তেজ! যেন এক টুকরো লাভা। টগবগিয়ে ফুটছে আমায় পুড়িয়ে দেবে বলে।”
এটুকু বলে থামলো সরণ। গুটি বিস্ফোরিত নজরে চেয়ে আছে। সমস্ত হিসেব তার লন্ডভন্ড। মিলছে না বিন্দুমাত্র।
(চলবে)