শূণ্যতায় পূর্ণতা পর্ব -০৭

0
1572

#শূণ্যতায় পূর্ণতা
#নুরুন্নাহার তিথি
#পর্ব-৭(রহস্য উন্মোচোন ২)

বিভানকে সকাল ৯টার দিকে চুপিসারে রিসোর্ট থেকে বের করে এনে এয়ারপোর্টে পাঠিয়ে দেয় জাবিরের সাথে। সকালেই বিভান ওর মায়ের পায়ের কাছে বসে বলেছিল, সে বিয়ে করবে না। বিভানের মা তখন বলেছিল,
“তার কিছুই করার নেই!”
বিভান তখন এটুকু বলেই নিজের রাস্তা ক্লিয়ার করেছিল যে,
“তোমার কথাই রইল তবে এই মুহুর্ত থেকে তুমি আমার মুখ দেখতে চাইবে না বিয়ের আগ পর্যন্ত যদি না আমি দেখাই। তোমার যদি বিয়ের এক মুহুর্ত আগেও সিদ্ধান্ত বদল হয় তাহলেই আমার মুখ দেখতে আসবে। আমি আজ জার্মান চলে যাবো। তোমার নতুন বউয়ের বাসর দেখার ইচ্ছেও নেই।”

বিভানের মা আটকাতে চেয়েছিল সাথে বলেছিল,
“বিয়ে করবি মায়ের সাথে দেখা না করে? তুই সত্যি পারবি এটা? আমার বিশ্বাস হয় না একদম। তোর ভালোর জন্যই তো আমরা যা করছি। বোঝার চেষ্টা কর বাবা। ”

বিভান আর কিছু না বলে চলে এসেছিল। অদ্রি রুমের বাহির থেকে সবই শুনেছে। তার খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। তার শাশুড়িকে একজন স্ত্রী ও নারী হিসেবে ব্যাপারটা বুঝতে হবে কিন্তু তিনি একজন মা ও শাশুড়ি হিসেবে দেখছেন। মা হিসেবেও খুব কমই দেখছেন। মা হিসেবে শুধু একপাক্ষিক ছেলের ভবিষ্যৎ সুখের স্বপ্ন দেখছেন তাও অন্যকারো প্ররোচনায়।

দুপুর ৩ টায় বিয়ে পড়ানো হবে। এর মধ্যে রিয়ান খুব সুন্দর করে বর সেঁজে মুখের উপর সেহরা বেঁধে হাজির। রুহুল আমিন তার লোকদের বলেছে শিমুকে তু’লে নিয়ে আসতে! একটু আগে রিমুর কথা মতো অদ্রিকে তু’লে নিয়ে যাবার কথা কিন্তু আসলে তো নিবে শিমুকে! পরে বাহানা দিবে লেহেঙ্গা অদল-বদলের কারনে ভুল বোঝাবোঝি হয়েছে। রিমু রুহুল আমিনকে বলেছিল বধুবেশে নিহাকেও যেনো কোথাও সেন্সলেস করে ফেলে রাখা হয়। নিহা আবার শাড়ির উপর খিমার পড়বে।

__________
হাতে আর আধঘন্টা আছে বিয়ের। রিমু ইভানকে ফোন করে যেনো তাকে বাহিরে নিয়ে যায়। ইভান মানা করছিল কিন্তু রিমুর জোরাজুরিতে একটা হুইল চেয়ার এনে হাজির হয়। অদ্রি সুযোগ বুঝে রিমুর রুমের সামনে দাঁড়ায়।

অদ্রি ব্লু লেহেঙ্গা যেটা কাল রিমু অদ্রিকে ডেকে এনে দিয়েছিল সেটা পড়েছে সাথে ব্লু হিজাব ও মুখও ঢাকা খিমারের মতো করে। হিজাবের নিচ দিয়ে কপালে পাথরের ডিজাইনার টিকলি দেওয়া। গলায় লম্বা এক পাথরের লং নেকলেস। লেহেঙ্গাটার ব্লাউজ পার্ট কোমড় পর্যন্ত আর স্লিভও ফুল। খুব সুন্দর করে সেঁজেছে অদ্রি।

রিমু তার রুম থেকে বের হয়ে দরজায় দাঁড়ানো মুখ ঢাকা শুধু আইসেডো দিয়ে সাঁজানো চোখ দেখা যায় মেয়েটাকে চিনতে পারেনি। হঠাং কিছুটা সামনে গিয়ে তার লেহেঙ্গাটার কথা মনে পরে। সে ইভানকে হাত দিয়ে থামায় তারপর নিজেই হুইল চেয়ারের চাঁকা ঘুরিয়ে পেছোনে ঘুরে তাকায় অবাক নয়নে। অদ্রি রিমুর সামনে এসে মুখ থেকে খিমার সরিয়ে মুচকি হেসে বলে,

–দেখোতো ভাবি! কেমন লাগছে আমায়? তোমাকে এত্তোগুলা ভালোবাসা এই সুন্দর লেহেঙ্গাটার জন্য। জানো বিভান আমাকে দেখে তো কিছুক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়েই থাকবে। বেচারার অন্যদিকে মন তো ঘুরবেই না! তাইনা ইভান ভাইয়া?

ইভান মলিন হেঁসে অদ্রির মাথায় হাত রেখে বলে,
–তখন এরকম জোর না করলেই পারতে। বিদেশে বিভিন্ন উন্নত চিকিৎসা নিয়ে আল্লাহ্ চাইলে খুব শিগ্রই তোমাদের কোল আলো হতো। আমি জানি বোন তোমার খুব কস্ট হচ্ছে বলেই তুমি তোমার মুখ থেকে হাসি সরাচ্ছো না। যদি কাঁদতে মন চায় তো নিরিবিলি চিৎকার করে কাঁদো। মন হালকা হবে। কস্ট পুষে না রেখে সেটাকে অশ্রুর মাধ্যেমে বাহির করো। চলো রিমু।

ইভান হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে রিমুকে নিয়ে চলে যায়। আর রিমু যেনো নিজের বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে! অদ্রির দিকে হা করে তাকিয়ে ছিল। সে ভাবছে, অদ্রিকে তো রুহুল আমিনের লোকেরা সেন্সলেস করে নিয়ে গেছিলো তো অদ্রি এখানে কিভাবে এলো? আর দুপুর ১২টা থেকে শিমুর ফোন বন্ধ পাচ্ছে। শিমুর খোঁজ পাচ্ছে না। এজন্য তার টেনশন বেশি হচ্ছে। একজন স্টাফকে পাঠিয়েছিল শিমুকে ডেকে আনতে কিন্তু শিমু নাকি সাঁজ-গোজ করছে তাই আসেনি। এখন তো রিমুর টেনশন হচ্ছে খুব। সে ইভানকে বলে,

–আমাকে একটু শিমুর রুমে নিয়ে যাবে প্লিজ। শিমুর ফোন বন্ধ আর ওর তো পা মচকে গেছে। চলো দেখে আসি। প্লিজ চলো।

ইভান তখন রিমুকে নিয়ে কয়েকটা সিঁড়ি পারি দিয়ে ফেলেছে। এখন আবার হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে উপরে নেওয়া কষ্টসাধ্য। ইভান বলে,

–তোমাকে নিচে রেখে এসে আমি উপরে গিয়ে দেখবো শিমুর রুমে। এখন তোমার উপরে যাওয়ার দরকার নেই। হুইল চেয়ার মাঝ সিঁড়িতে ব্যালেন্স হারালে তোমার পা আর থা”কবে না!

তারপর রিমুকে নিচে রেখে শিমুর রুমে গিয়ে শিমুকে পায়না কিন্তু রুমে কিসের যেনো স্মেল পাচ্ছিলো। সেটাকে এমনেই হেলাফেলা করে সে রুম থেকে বাহির হয়ে দেখে অদ্রি করিডরে মালার ডালা নিয়ে নামছে। ইভানকে দেখে অদ্রি থেমে বলে,

–ভাইয়া কিছু খুঁজছিলেন?

ইভান বলে,
–আর বলো না! তোমার ভাবী ও ভাবীর বোন আমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরায়। কোনো কথা যদি শুনতো! এখন মাঝ সিঁড়িতে তার বোনের কথা মনে হয়েছে। তাকেই তো কতো ঝামেলার মাঝে নিতে আসলাম। এখন আবার তার বোন! যাইহোক। তুমি কি শিমুকে কোথাও দেখেছো? মেয়েটার পা তো মুচড়ে গেছে এরমধ্যে কোথায় যে গেলো? দেখেছো ওকে?

অদ্রি মিথ্যা বলবে না তবে কথার ধাচ ঘুরিয়ে বলবে। অদ্রি হেসে বলে,
–নিজের চোখে তো দেখিনি!

ইভান কথা না বুঝে বলে,
–মানে? তুমি জানো সে কোথায়?

অদ্রি বলে,
–কোথায় আছে তা তো বলতে পারিনা।

ইভান চলে যেতে নিলে অদ্রি তার উদ্দেশ্যে বলে,
–আপনি ভাবীকে এতো কেনো ভয় পান? ভাবী কি আপনাকে থ্রে’ট দেয় নাকি?

ইভান হালকা হেসে বলে,
–তোমার ভাবীর তো কিছু হলেই বাবার বাড়ি চলে যাবে ছেলে সহ! এমন কথা। একবার তো পনেরো দিন পর আমি গিয়ে বহু কষ্ট করে নিয়ে আসলাম। পনেরো দিনে যে কতোবার তারে মানাতে গেছিলাম তা আমিই জানি। তবে যাই বলো, আমার ভাইয়ের ভাগ্য খুব ভালো যে তোমার মতো শান্ত ও নম্র বউ পেয়েছে। তোমাদের মধ্যে ঝামেলা হলেও তোমাকে দুই দিনের বেশি কোথাও গিয়ে থাকতে দেখিনি। আর তোমার রাগও কম। আফসোস! আমার মা ও বউ এই শান্তিকে অশান্তি করে দিলো।

ইভান আফসোস করতে করতে চলে যায়। অদ্রি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে একই ভাবে। তারপর মেসেজ টোন বাজাতে মোবাইলে তাকায়। সেখানে লেখা,

“রিমু আমাকে মেসেজ করেছে। আমি তোমাকে কিডন্যাপ করিনি কেনো? আর শিমুকে কিভাবে বিভানের বউয়ের জায়গায় বসাবো? শিমু কই? এসব জানতে।”

অদ্রি মেসেজ পড়ে মুচকি হেসে বলে,
“শিমুকে দিয়ে সাইন করিয়ে নেন। আপনি সামনে যাবেন না একদম। লোক দিয়ে সাইন করিয়ে নিন। আপনাদের রেজেস্ট্রি হবার পর রিমুর হোয়াটসএপে সুন্দর করে ছবি পাঠিয়ে দিবেন। এর আগে কোনো রিপ্লে ক্লিয়ার করে করার দরকার নেই। আর ছবি পাঠাবেন রিয়ান ও নিহার বিয়ে সম্পূর্ণ হবার পর। এর মধ্যে সে একটু ছটফট করুক। আমিও এন্জয় করি! খুব তো শখ শিমুর কারো দ্বিতীয় স্ত্রী হবার! তো হোক। বিভানের তো প্রথম স্ত্রী জীবিত আছে তাতে শিমু সুখী হতে পারতো না। তাই না! কিন্তু আপনি তো বিপত্নীক। সে খুউবই সুখী হবে! ইনশাআল্লাহ। ”

অদ্রি এবার নিচে নেমে যায়। বিয়ের স্টেজের সামনে যায়। সেখানে ফুলের পর্দা দেওয়া দুই পাশে বর-বউ। ফুলের পর্দার কথা রিমু বলেছিল। রিমুর তো আহ্লাদ কম না!
বিভানের মা বিভানকে কয়েকবার ডেকেছিল যখন দেখলো তার ছেলে সত্যি সত্যি তার সাথে আর দেখাই করছে না। কিন্তু বিভানের সাজে রিয়ান প্রতিবার ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে। বারবার জাবিরের হাত ধরছে। অদ্রি নিচে গিয়ে দেখে রিমু ও ইভান রিয়ানদের কাছে যাচ্ছে। অদ্রি তৎক্ষণাৎ ওদের ডাক দিয়ে বলে,

–ভাইয়া ও ভাবি, শিমুর রুমের বাহিরে সাইডে যে বড় ফুলদানি আছে সেখান থেকে রিংটোনের শব্দ পেলাম। এই নিন ফোন। শিমু যে কোথায় গেলো ফোনটা সেখানে রেখে!

রিমু কিছুক্ষন আগে শিমুকে কল করেছিল তখন ফোন অন করা পেয়েছে কিন্তু কেউ তুলেনি। অদ্রি রিমুর হাতে ফোন দিয়ে চলে যায়। রিমুর মন তো আরো ঘাবড়ে গেছে। তখন রিমুর ফোনে মেসেজ আসে রুহুল আমিনের কাছ থেকে।

“কি বলেন? আমি তো ইতিমধ্যে বিয়ে করে ফেলছি। যাকে তু’লে আনিয়েছি তার মুখ থেকে আমার উকিল নিজে গিয়ে সব নাম-ঠিকানা নিয়েছে তারপর তার থেকে সাইন নিচ্ছি। এখন আমার কাছে আসলে আমিও সাইন করবো। উকিল বললো মেয়ে নাকি নাম ঠিকানা বলতে চায়নি। আমার লো’কেরা জো’র করে বলিয়েছে। তারপর ইন্সটেন্ট কাগজ রেডি করে এখন আমার লোক গেছে সাইন করাতে। তারপরে আমিও করবো।”

রিমু এবার ঘামতে থাকে। এদিকে কাজি বসে আছে বর-কনের সামনে। রিমুকে ঘামতে দেখে অদ্রি কাছে এসে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বলে,

–কি হয়েছে ভাবি? খারাপ লাগছে? ইভান ভাইয়া আপনি একটু জলদি করে শরবতের ব্যাবস্থা করুন তো। মনে হয় প্রেশার ফল করছে।

ইভান আশেপাশে কোনো স্টাফ না দেখে জলদি করে নিজেই যায়। অদ্রি এবার বিভানের বোন ও বোনজামাইকে ডেকে বলে,

–আপু একটু ভাবীকে বাতাস করেন প্লিজ। আর জিজু একটু এসি অফ করে ফ্যান গুলো ছাড়তে বলেন গিয়ে। আশেপাশে কোনো স্টাফ তো নেই। আমাকে বিভানের কাছে যেতেই হবে। নাহলে তো বুঝতেই পারছেন!

বিভানের বোন ও দুলাভাই অদ্রির বলার পর ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। এরপর অদ্রি কাজির সামনে গিয়ে দ্রুত আস্তে আস্তে বর ও কনের নাম-ঠিকানা বলতে বলে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে