শূণ্যতায় পূর্ণতা পর্ব -০৫

0
1521

#শূণ্যতায় পূর্ণতা
#নুরুন্নাহার তিথি
#পর্ব-৫

পনেরোদিন কেটে গেছে। বিভানের বিয়ের তারিখ সামনে এগিয়ে আসছে। অদ্রিও নিজের পরিকল্পনা গোছাতে ব্যাস্ত। এবার সে সবদিকে কড়া নজর রাখছে। এতে তার খরচও হয়েছে তবে আর সে কিছু হারাতে চায়না। অদ্রির শাশুড়ি তার ভাইয়ের বাসায় গেছে দাওয়াত দিতে। বেশি মানুষকে বলবে না বিয়ের কথা। বিভানের মামা, খালা, চাচা ও ফুফিদেরকেই বলবে। অদ্রির বাবা-মা বিভানের বিয়ের খবর শুনে অনেক রেগে গেছিলো। তারা তো বিভানকেও অনেক কিছু বলেছে। পরে অদ্রিই তাদের বুঝিয়ে থামিয়েছে। অদ্রি আজ ছুটির দিন ব্যাতিত অফিসে যায়নি। রিমু ও শিমুও এই বাসায়। অদ্রি রান্না করছে তখন কলিংবেল বাজার শব্দ হয়। অদ্রি তখন মাছ উল্টাচ্ছিল আর তরকারি কসাচ্ছিল বলে গলার আওয়াজ জোরে করে বলে,

–ভাবি! একটু দেখোতো কে আসলো? মাছ গুলো পুড়ে যাবে এখন গেলে।

রিমু বিরক্তিতে বিড়বিড় করতে করতে দরজা খোলে দেখে এক মাঝ বয়সি লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার ভুড়িও আছে তবে ফর্মাল ড্রেসআপে এখন লোকটা। মাথায় চুল কম। রিমু ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,

–কে আপনি?

লোকটা পান খাওয়া লাল লাল দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,
–অদ্রি বাসায় আছে? আমি ওর অফিসের ম্যানেজার পদে আছি।

রিমু বিরক্তি নিয়ে বলে,
–হ্যাঁ আছে। আসুন ভিতরে।

লোকটাকে ভিতরে আসতে দিয়ে রিমু রান্নাঘরে যায়।
–অদ্রি তোমার অফিসের ম্যানেজার এসেছে। যাও দেখা করো।

অদ্রি নিজের মুখে ভীতু প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলে আশঙ্কিত কন্ঠে বলে,
–আশ্চর্য! উনি এখানে কেনো আসবেন?

রিমু ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,
–তা উনাকেই জিজ্ঞাসা করো। তুমি আজ অফিসে যাওনি বলে হয়তো তোমাকে মিস করছে!

অদ্রি কোনো প্রতিউত্তর না করে ড্রয়িংরুমে যায়। ড্রয়িংরুমে অদ্রি তার অফিসের ম্যানেজার মিস্টার রুহুল আমিনের বরাবর সোফাতে বসে। রিমু রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখছে কি হচ্ছে। রুহুল আমিন বলে,

–তুমি যে আজ অফিসে গেলে না? কতো অপেক্ষা করেছি জানো!

অদ্রি রান্নাঘরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে রিমু উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। অদ্রি মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলে,

–অফিসের কাজ অফিসে করবেন স্যার। আমি ছুটি নিয়েছি আজ। আপনার আর কোনো দরকার না থাকলে বসুন চা খেয়ে যাবেন।

অদ্রি উঠে যায়। রান্নাঘরে গিয়ে চা বসায়। রিমু রান্নাঘর থেকে ড্রয়িংরুমে বসে লোকটা সামনে তারপর বলে,

–অদ্রি একদিন অফিসে না যাওয়াতে বাড়িতে চলে আসলেন!

রুহুল আমিন আফসোসের স্বরে বলে,
–দেখতে এলাম মেয়েটা ঠিক আছে কিনা? শুনেছি ওর স্বামী আবারো বিয়ে করছে! বেচারির জন্য মায়া হয়। তাই একটু সঙ্গ দিতে এলাম।

রিমু মুখ বাঁকা করে বলে,
–কিন্তু অদ্রিকে দেখে মনে হয়না সে আপনার সঙ্গ পছন্দ করে! তাও আপনি ওকে সঙ্গ দিতে এসেছেন?

রুহুল আমিন আফসোস করে বলে,
–আমি তো করি। মেয়েটার যে কি হবে! ওর স্বামী বিয়ে করলে তো ওকে একদিন এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই হবে। তখনকার কোনো ব্যাবস্থা করছেই না। আমি অনেকবার বলেছিলাম নিজের জন্য ভাবো।

রিমু কিছু বলার আগেই অদ্রি টি ব্যাগ দিয়ে ইন্সটেন্ট চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে। রুহুল আমিন চা খেয়ে চলে যায়। অদ্রি বাড়ির মেইনগেট লাগিয়ে রান্নাঘরে যায়। এরই মধ্যে রিমু বিনা শব্দে জলদি করে বাহিরে যায়। রুহুল আমিন তখনো বাড়ির রাস্তা পার হয়নি। রিমু তার কাছে গিয়ে পেছোন থেকে ডাক দিয়ে বলে,

–আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি অদ্রিকে পছন্দ করেন। তো ওকে এখান থেকে নিয়ে যান। আর বিভানের তো সামনে বিয়ে। আপনি চাইলে আমি সাহায্য করবো আপনাকে।

রুহুল আমিন বাঁকা হেসে পেছোন ঘুরে তারপর বলে,
–আপনার সাহায্য লাগলে অবশ্যই বলবো। আপনার নাম্বারটা দিন। পরে মেসেজ করে বলে দিবো কোথায় দেখা করে কথা বলবো। এখানে সেফ না।

রিমু তো চরম খুশি। সে নাম্বার দিয়ে দেয়। রিমু বাড়ির ভেতরে চলে গেলে রুহুল আমিন কাউকে মেসেজ করে,,

“প্ল্যান সাকসেসফুল। পাখি খাঁচাতে নিজেই এসেছে।”

রিমু নিজের রুমে গিয়ে শিমুকে সবকিছু বললে শিমুরও মনে হচ্ছে এবার অদ্রি বিদায় হবে!

________
আরো তিন দিন কেটে গেছে। রিমু, শিমু ও মিস্টার রুহুল আমিন একটা ক্যাফেটেরিয়াতে বসে আছে। তিন জনের তিন কাপ কফি অর্ডার করে রুহুল আমিন।
রুহুল আমিন বলে,
–তো কিভাবে সাহায্য করবেন?

রিমু সাথে সাথে কপাল কুঁচকে রুহুল আমিনের দিকে তাকায়। তা দেখে রুহুল আমিন হেসে বলে,
–আরে আপনি কি প্ল্যান করলেন সেটা বলেন। আপনার প্ল্যানে তো আমার সাহায্যই হবে তাইনা?

শিমু বলে,
–সাহায্য আপনিও করবেন। বিভানের বিয়ের দিন অদ্রিকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবেন। তাহলেই হলো।

রুহুল আমিন বলে,
–অদ্রিকে কিডন্যাপ করে কি হবে? আপনাদের উদ্দেশ্যে কি এতে সেটাই বুঝলাম না! অদ্রিকে কিডন্যাপ না করে সুন্দর করে বোঝাবেন আপনারা। তাহলেই তো হয়।

রিমু মুখ বাঁকা করে বলে,
–সে বোঝার মেয়ে হলে তো! বোঝার মেয়ে হলে কি নিজের পছন্দে সতিন খুঁজে? আমার বোনের সাথেই তো বিভানের বিয়ে দেওয়া যায়।

রুহুল আমিন বলে,
–ওহ আচ্ছা। তার মানে আপনি চান, বিভানের বিয়ের দিন আপনার বোনের সাথে বিভানের বিয়ে দিবেন আর অদ্রিকে আমি কিডন্যাপ করে নিবো?

রিমু হ্যাঁ বলে। রুহুল আমিন একটা কাগজ এনে সামনে রেখে বলে,
–আমি রাজী। তো ডিল কনফার্ম করেন। পরে আবার পল্টি খাবেন না। যতই হোক আপনি অদ্রির ভাসুরের বউ হোন। এমনও হতে পারে অদ্রি আপনাকে এখানে পাঠালো!

রিমু বিরক্ত হয়ে বলে,
–আরে ভাই! অদ্রি আমাকে কেনো পাঠাতে যাবে? যদি অদ্রির পক্ষেই থাকতাম তাহলে কি আপনাকে সেদিন ডাক দিতাম নাকি! আর এগুলোই বা কেনো করতাম? আমি চাই আমার বোন বিভানের বউ হোক।

রুহুল আমিন বাঁকা হেসে বলে,
–আপনার বোনের এক বিবাহিত পুরুষের প্রতি নজর কেনো? তার জন্য তো দুনিয়াতে অবিবাহিত পুরুষের অভাব হবে না।

শিমু দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–আপনার যেমন এক বিবাহিত নারীর প্রতি নজর! তেমনি আমারটাও।

রুহুল আমিন আবারো হেসে বলে,
–ভুল বললেন। আমার নজর না। অদ্রি অসহায় আর আমিও বিপত্নীক। অদ্রির দুর্ভাগ্যর জন্য আমি ওর পাশে দাঁড়াতে চাইছি মাত্র। এখন যদি মিস শিমু আমাকে বিয়ে করতে চান তো আমি রাজী। অদ্রিকে তখন দরকার হবে না।

শিমু ক্ষিপ্ত স্বরে বলে,
–এই বুড়ো বয়সে আপনি যুবতী বউ খোঁজেন? আপনার সাহস তো ভালোই! নেহাত অদ্রিকে সরানোর জন্য আপনাকে সহ্য করছি।

রুহুল আমিন আগের মতো হেসেই বলে,
–আমি নিতান্ত হাসি-খুশি মানুষ ও সবকিছু ঠিক ভাবে করতে পছন্দ করি। আপনারা এই পেপারে সাইন করে আমাকে আশ্বাস দিন আপনারা আমার সাথে আছেন। এখন তো নিজের নিঃশ্বাসেরও বিশ্বাস নেই। সাইন করার আগে পেপারটা পড়ে নিবেন। এতে লেখা আছে, “আপনারা এই কাজে সর্ব অবস্থায় আমার পাশে থাকবেন। আমার সব কাজে সাপোর্ট করবেন। কখনো ধোঁকা দিবেন না। আমার সাথে চালাকি করবেন না।” এগুলোই আর আমার নাম ঠিকানা সাথে আপনাদের। কন্ট্রাক্ট পেপার আর কি।

রিমু কপালে ভাঁজ ফেলে সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
–এজন্যই সেদিন আপনি মেসেজে আমাদের ডিটেইলস নিয়েছিলেন আর আমাদের কি আপনার ফ্রড মনে হয়? আশ্চর্য লোক আপনি!

রুহুল আমিন হেসে বলে,
–কোনো ফাঁক-ফোকর রাখতে চাইছিনা। আপনারা ডিল সাইন করেন তাহলেই হয়। আমি নিতান্তই গোছানো স্বভাবের আর এই প্রথম এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছি যা একটু রিস্ক থাকলে সব নষ্ট হয়ে যাবে। আমার মৃত স্ত্রী বলতেন, আমি নাকি অতিরিক্ত সন্দেহ প্রবণ ও খুঁতখুঁতে! অবশ্য সে মিথ্যা বলেনি। নিজের সবকিছুতে নিখুঁত চাই ও নিজেকে ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনা। আমার মৃত স্ত্রী তো ২০ বছর আমার সাথে ছিলেন। সে আমাকে ঠিক চিনেছেন। সে মারা গেছে দুই বছর হবে। এখন বড় ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছি ভার্সিটিতে ভর্তি করে আর মেয়েও বিদেশে পড়তে যাবার জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছে। দুই বছর পর মেয়েটাও চলে যাবে। এখন নিজেকে তো শক্ত রাখতে হবে।

রিমু ও শিমু দুজনেই রুহুল আমিনের ব্যাবহার ও কথায় বিরক্ত। তারা দুজনেই পেপার না পড়ে সাইন করে দেয় তারপর ক্যাফেটেরিয়া থেকে চলে যায়।

রুহুল আমিন আবারো কাউকে মেসেজ করে,
“কাজ শেষ। এবার সময়ের অপেক্ষা।”

চলবে ইনশাআল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে