#শূণ্যতায় পূর্ণতা
#নুরুন্নাহার তিথি
#পর্ব-৪(রহস্য উন্মোচোন)
–তোকে আগেই বলেছিলাম আপু, এই মেয়েটাকে সরিয়ে দে। এভাবে একটু একটু করে কাজ না করে যা করার একেবারে কর। কিন্তু তখন শুনলি না তো! প্রতিবার প্রেগনেন্ট হতো আর তুই কিছু না কিছু করে ওর বাচ্চা নষ্ট করাতি। এর থেকে ভালো হতো একবারে ওর খাবারে কিছু মিশিয়ে দিতে যাতে কাজ একবারে শেষ হয়ে যেতো। এখন তো আমাদের সব প্ল্যানিং ঘেটে দিলো।
রিমুর শিমুর কথা শুনে চিন্তিত হয়ে থাকে। আজ তারা মেয়ে দেখতে এসেছে। অদ্রি যেই মেয়েটাকে খুঁজেছে সেই মেয়েটাকে। তবে মেয়েটাকে সবাই দেখতে পারবে না। শুধু দুইজন দেখতে পারবে। অদ্রি ওর শাশুড়ি ও বড় ননদকে নিয়ে গেছে ভিতরে। রিমু যেতে চাইছিল কিন্তু অদ্রি বলেছে,
–ভাবি, আপনি এখানেই থাকেন। মা আর আপু গেলেই হবে। এমন তো না এটা বিভানের প্রথম বিয়ে আর আপনাকে নিজের পছন্দ মতো দেবরের বউ আনতেই হবে! এটা দ্বিতীয়বার আর প্রথমবার যেহেতু নিজের মন মতো পাননি তো দ্বিতীয়বার কি দরকার!
রিমু অবাক হয়ে তখন দাঁড়িয়ে ছিল। অতঃপর অদ্রির শাশুড়ি ও ননদ ভিতরে গিয়ে মেয়ে দেখে বাহিরে এসে আলহামদুলিল্লাহ বলে। বিভান অদ্রির হাসিমাখা মুখের দিকে ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। কি যে হতে চলেছে তা তার ধারনাও নাই।
রাতের বেলা,,
অদ্রি বিভানের কাছে এসে আহ্লাদী স্বরে বলে,
–চলো আজকে হাইওয়েতে সোডিয়াম লাইটের আলোয় হাঁটবো!
বিভান অবাক হয়ে বলে,
–এখন? এতো রাতে! সময় দেখো। রাত ১০টা বাজে! এতো রাতে বের হলে সবাই কি ভাববে? সন্ধ্যা হলে কথা ছিল।
অদ্রি গাল ফুলিয়ে বলে,
–সবাই যা খুশি ভাবুক। তাতে আমার কি? ওদের ভাবনা-চিন্তা চাইলেও বন্ধ করতে পারবো না। আর আমরা হাজবেন্ড-ওয়াইফ। নিজেদের কোয়ালিটি টাইম যেভাবে ইচ্ছা স্পেন্ড করবো। আমি তো যাবোইইই!
শেষের কথাটা প্রচন্ড জেদ নিয়ে বলে অদ্রি। বিভান হেসে ফেলে। অদ্রি গাল টেনে বলে,
–বড্ড জেদী তুমি। বাচ্চাদের মতো জেদ করো। আচ্ছা চলো। রেডি হও।
অদ্রি দাঁত বের করে হেসে বিভানের গালে হুট করে নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের আলতো স্পর্শ দিয়ে কাভার্ড থেকে শাড়ি বের করতে যায়।
__________
–বুঝলাম না! ওই মেয়ের মা এতো নির্বিকার কিভাবে? তারা যেনো অদ্রির নামে কথাগুলো বিশ্বাসই করলো না!
শিমুর কথাতে রিমু বলে,
–অদ্রি ওদের আগেই ব্রেইন ওয়াশ করে রেখেছে বিধায় আমাদের কথা শুনছে না। এমনও হতে পারে আমার ও তোর নামে উস্কে রেখেছে! শত হোক মেয়ে তো অদ্রি ঠিক করেছে। মেয়ের মাকে আরো বোঝাতে হবে।
শিমু চিন্তিত হয়ে বলে,
–বিয়ের তারিখ তো এক মাস পর ঠিক হয়েছে। এর মধ্যে যদি বোঝাতে না পারো? সব প্যাঁচালে এই অদ্রি মেয়েটা!
রিমু বাঁকা হেসে বলে,
–বোঝাতে না পারলে বিয়ের দিন কনে বদল হবে! তাও তোর সাথে বিভানের বিয়ে হবেই।
শিমু খুশিতে ওর বোনকে জড়িয়ে ধরে।
______
হাইওয়েতে রেলিংয়ের কাছে হাঁটছে অদ্রি ও বিভান। অদ্রি গুন গুন করে জিৎ গাঙ্গুলির গান গাইছে,
“দূরে দূরে মেঘ যাচ্ছে পুরে
মন মেলল স্মৃতি দুডানা। (২)
জানিনা..
কেন তা জানিনা!
জানিনা কেনো তা জানিনা (৩)
জানিনা..”
(বাকিটা নিজ দায়িত্বে শুনে নিয়েন।)
বিভান অদ্রির হাত ধরে রেখেছে সর্বদা। ছটফটে স্বভাবের মেয়ে মাঝে মাঝে ফাঁকা হাইওয়েতে মাঝ রাস্তায় দৌড় দেয়। এক প্রকার আনন্দ এটা অদ্রির কাছে। ফাঁকা হাইওয়ে! শুনশান নিরবতা আর মাঝে মাঝে একটা দুটো গাড়ি তীব্র বেগে ছুটে চলে। এরকম একটা মোমেন্টে পাশের ভালোবাসার ও ভরসার মানুষটা থাকলে মূহুর্তটা স্মৃতির পাতায় লেখার মতো। অদ্রিকে বিভান যে হাত দিয়ে ধরে রেখেছে অদ্রি এবার হাত ছাড়িয়ে সেই হাতের বাহু জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে হাঁটছে আর মুখে এখনো গানের সুর তুলছে। হুট করে গানের সুর বন্ধ করে দিয়ে অদ্রি এমতাবস্থায় জিজ্ঞেস করে,
–ধরো, একমাস পর যেদিন তোমার আবারো বিয়ে ঠিক হয়েছে সেদিন তোমাকে জার্মানিতে যেতে হলো!
বিভান কথাটাকে সিরিয়াসলি নেয়নি। অদ্রির এক প্রকার উদাসীন কথা মনে করে সেও ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–তাহলে তো ভালোই হয়। বিয়েটা করতে হয়না। তুমিও চলো আমার সাথে।
অদ্রি মুচকি হেসে বলে,
–হুম। যাবো তো। আগে তুমি যাবে। তার কয়েকদিন পর এই শহরে আমার নিঁখোজ হওয়ার বিজ্ঞাপন ছাঁপবে তারপর তোমার শহরে নতুন সূর্যদয়ের মতো এই অদ্রি উদিত হবে।
বিভান অদ্রিকে এবার নিজের কাঁধের উপর থেকে সরিয়ে দুহাত অদ্রির দুই গালে রেখে আদুরে স্বরে বলে,
–বেশি মন খারাপ? কি দরকার মায়ের কথায় এসব করার? এখন তো কতো উন্নত চিকিৎসা আছে। সেগুলো বিদেশে গিয়ে করলেই হয়। সেরোগেসিও তো আছে। এসব আমারো ভালো লাগছে না। তুমি একবার বলো শুধু। আমি এক সপ্তাহের মধ্যে তোমায় নিয়ে চলে যাবো। জানো আমার কাছে প্রফেসর রাসিফ আলীর মেইল এসেছে। আমাকে জার্মানিতে এক ইউনিভার্সিটিতে প্রথম ছয় মাস শিক্ষকতা ও রিসার্চের জন্য অফার করেছে। আমি চাইলে সেই সময় আরো বাড়াতে পারবো। চলো আমরা চলে যাই।
অদ্রি ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি নিয়ে বিভানের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে কথা গুলো শুনছে। তারপর অস্ফুট স্বরে বলে,
–মা যে খুব কস্ট পাবেন! সে তো ভাববে তার ছেলেকে আমি বশ করে নিয়েছি!
বিভান অদ্রির কপালের সাথে নিজের কপাল মিশিয়ে চোখ বন্ধ করে,
–একসময় তিনিও সবটা বুঝতে পারবেন। এক মা হবার আগে তিনি একজন মেয়ে ও স্ত্রী। আমরাও আস্তে আস্তে তাকে মানিয়ে নিবো।
অদ্রি বিভানের কথা গুলো শুনে কিন্তু কোনো প্রতিউত্তর করে না। তারও যে বিভানের কথা গুলো মানতে ইচ্ছা করে কিন্তু নিজের অনাগত সন্তানদের হত্যাকারীকে ছেড়ে দিলে তো তার অনাগত সন্তানরা শান্তি পাবে না! কি দোষ করেছিল ওরা? নিষ্পাপ ছিলো তো। অদ্রির এখনো মনে পড়ে যেদিন অদ্রি এসব জানতে পারে। সেদিন অদ্রির কেমন লেগেছে আর নিজেকে কিভাবে সামলিয়েছে তা অদ্রি নিজেও বুঝতে পারে না। তার তো তৎক্ষণাৎ ওদেরকে পিষে ফেলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ওই সময় এতো ধৈর্য কোথা থেকে আসলো তা অদ্রির বোঝারো বাহিরে।
“ফ্লাশব্যাক——–
তৃতীয়বার এবোর্শনের পর অদ্রি আস্তে আস্তে সুস্থ হবার পাঁচ মাস পর একদিন শরীর একটু খারাপ থাকায় অফিসে যায়নি। মাথা ঘুরছিল অদ্রির আর শরীরও খারাপ লাগছিল। বিভান তাই অদ্রিকে অফিসে যেতে মানা করেছে। সেদিন দুপুরের একটু পরে অদ্রি ঘরে বসে বসে বিরক্ত হওয়ায় আসরের আগে একটু ছাদে যায় আস্তে আস্তে। চাকরিজীবী মানুষ সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে থাকলে তাও একা একা! একটু বিরক্তবোধ তো করবেই। বিভান তার মাকেও বলে গেছিলো যাতে অদ্রিকে সারাদিন রেস্ট করতে বলে। আর রান্না-বান্নার জন্য তো বুয়া ভোর সকালে এসে কাটাকুটি করেই আর অদ্রিতো ব্রেকফাস্ট বানায় আর দুপুরের খাবার সপ্তাহের ছয়দিন রিমুই বানায়। শুক্রবার দিন অদ্রির দখলে থাকে রান্নাঘর।
ছাদের সিঁড়িতে বিনা শব্দে আস্তে আস্তে উঠছে। ছাদের দরজা চাপানো ছিল। অদ্রি আস্তে করে হালকা ফাঁকা করে ছাদে যায়। তার আসলে কোনো শব্দই ভালো লাগছে না বলে খালি পায়েই ছাদে এসেছে। ছাদের দক্ষিন পাশে যেতে চাইলে কারো ফিসফিস শব্দ শুনতে পায়। অদ্রি দেয়ালের সাথে আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে এটুকু শুনে,,
“যদি আবার প্রেগনেন্ট হয় তো রিস্ক থাকবে। এবারেরটাও ম/রলে মনে হয় ওর জরায়ু কেটে ফেলতে হবে। তারপর বিভান একসময় বিরক্ত হয়ে ওকে ছুঁড়ে ফেলবে।”
অদ্রি অবাক হয়ে যায়। যেই ভাবিকে সে বোনের নজরে দেখে সে কিনা এগুলা ভাবে! তারপর কয়েক সেকেন্ড পর আবার শুনে,,
“হ্যাঁ রে বাবা! তারপর তোর সাথেই বিয়ে দিবো আমার দেবরের। কতোদিনের শখ এটা আমার!”
অদ্রির যেনো এবার দমবন্ধ লাগছিল। মুখে মধু অন্তরে বিষ! কথাটা যেনো রিমুর ক্ষেত্রে ফলে। অদ্রি আর শুনতে চায়না। রিমু কার সাথে ফোনে কথা বলছে তা অদ্রির ধারনা হয়ে গেছে। রিমুর বোন শিমুকে যে বিভানের বউ করতে চেয়েছিল রিমু তা বিভান তাকে জানিয়েছিল তবে রিমু তখন পর্যন্ত অদ্রির সাথে খারাপ ব্যাবহার করেনি। অদ্রির মনে প্রশ্ন উঠে,
“তবে কি আমার মিসক্যারেজ গুলো কোনো ষড়যন্ত্র ছিল?”
ফ্লাশব্যাক এন্ড”——–
রাত ১২টার পর অদ্রি ও বিভান বাড়ি ফিরে আসে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,