#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৫
আকাশ পরিষ্কার। নীলের মাঝে শুভ্র মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। সূর্যটাও আজ সকাল সকাল তেজ ছড়াতে শুরু করেছে। দোতলার জানালা দিয়ে বেশ ভাল রকমের বাতাস আসছে ঘরে। বাতাসের দাপটে শুভ্র রঙের পর্দাটা ঝাপটে ঝাপটে ক্লান্ত হয়ে এক সময় দমে যাচ্ছে। পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাল ঈশা। গায়ে কারো স্পর্শ পেতেই পিছনে ঘুরে দেখল ইলু তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। একটু বিরক্ত হয়েই তাকে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলো। আড়মোড়া ভেঙ্গে আশে পাশে তাকাল। ইরা নেই। বাইরে তার কথা শোনা যাচ্ছে। অনেক আগেই উঠে পড়েছে মনে হয়। চোখটা বন্ধ করে বালিশে মাথাটা ঠেকাতেই বাইরে থেকে একটা মৃদু গলার আওয়াজ কানে আসতেই মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে গেলো ঈশার। চট করে উঠে বসলো। মায়ের গলার আওয়াজ পেয়ে মুহূর্তেই ঘুম ছুটে গেলো তার। আজ ঈশানের জন্মদিন উপলক্ষে ঈশানদের বাড়িতেই সবাই। কিন্তু এতো সকাল সকাল তার মা যে এসে পড়বে সেটা বুঝতে পারেনি। চোখ ডলে ভাল করে তাকাতেই সামনের দেয়ালে চোখ পড়ল। দেয়াল ঘড়ির কাটা ১১ টা ছুঁইছুঁই। আঁতকে উঠে জিভ কেটে ঢোক গিলে ফেলল ঈশা। তার মা যদি কোনভাবে জানতে পারে ঈশা এখন ঘুমাচ্ছে তাহলে আজ সারাদিনটাই মাটি হয়ে যাবে তার। চেচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামতে যেয়ে আরেক বিপদ বাধিয়ে ফেলল। না দেখেই নিচে পা দিতেই নিচে শুয়ে থাকা ইরিনার উপরে তার পা পড়ল। এক চিৎকার করে উঠে বসলো ইরিনা। ইলুও চমকে উঠে বসলো। ঈশা অপরাধীর মতো কাচুমাচু হয়ে আবার পা তুলে বসে পড়েছে। ইরিনা শক্ত চোখে তাকিয়ে বলল
–আমাকে কি পারা দিয়ে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিস নাকি?
ঈশা দুই হাতে নিজের পা চেপে ধরে অসহায়ের মতো বলল
–সরি। আমি না দেখতে পাইনি।
–অত বড় চোখ গুলা কি আলমারিতে তুলে রেখেছিস যে দেখতে পাস নি। নিচে নামার সময় কি আকাশে দেখে ছিলি? বেয়াদব মেয়ে। এখনি আমার দম বন্ধ করে মেরে দিতিস।
ইলু এতক্ষন কিছুই বুঝতে না পেরে হাবার মতো তাকিয়ে ছিল তাদের দিকে। ইরিনার কথায় কি হয়েছে সেটা আন্দাজ করতে পেরেই অট্টহাসিতে ফেতে পড়ল। ইরিনা কঠিন ভাবে তার দিকে তাকিয়ে বলল
–তোমার কি মাথায় সমস্যা আছে? এভাবে হাসার কি হল?
ইলু হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিয়ে বলল
–আমি এটা ভেবেই হাসছি যে তোর মতো হাতিকে ঈশার মতো পিঁপড়া কিভাবে পারা দিয়ে মেরে ফেলে। মাথায় ঢুকছে না কিছুতেই।
বলেই আবার হাসতে লাগল। এবার ঈশাও তার সাথে জুক্ত হল। ইরিনা প্রচণ্ড রেগে গেলো। রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ইলু আর ঈশা দুজনি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আবার মায়ের আওয়াজ কানে আসতেই ঈশা উঠে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখল ঘরে কেউ নেই। বাইরে বের হল। বের হতেই সোজা সোফায় বসে থাকা সোনিয়ার উপরে চোখ পড়ল। হঠাৎ করেই রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। কিন্তু সবার সামনে সেটা প্রকাশ করতে চায়না বলেই নিজেকে সংযত করে এগিয়ে গেলো। ডাইনিং টেবিলের চেয়ার গুলোয় এলোমেলো ভাবে বড়রা বসে খোস গল্পে মশগুল। আর ছোটরা সোফায়। ইরা ইভানের ফোনে গেম খেলছে আর ইভান টিভি দেখছে। ঈশা সেদিকেই ধির পায়ে এগিয়ে গিয়ে সিঙ্গেল সোফায় বসলো। সোনিয়ার দিকে তাকাতেই দেখল সে এমন ভাবে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে যেন চোখ দিয়ে গিলে ফেলবে। ঈশার খুব রাগ হল। রাগের মাথায় অনিচ্ছাতেই আশ্চর্য একটা কাজ করে ফেলল। উঠে গিয়ে ইভানের পাশে বসে পড়ল। ইভান সাভাবিক ভাবেই পাশ ফিরে একবার ঈশার দিকে তাকাল। তারপর আবার টিভির দিকে মনোযোগ দিলো। ঈশা ইভান কে দেখে নিয়ে সামনে তাকিয়ে বলল
–সোনিয়া আপু কেমন আছ?
সোনিয়া ইভানের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলল
–ভাল আছি। তুমি কেমন আছ?
–ভাল আছি।
উত্তর দিয়েই ঈশা ইভানের দিকে আর একটু চেপে গিয়ে তার অপর পাশে বসে থাকা ইরার ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল
–কি করছিস রে ইরু?
ইরার মনোযোগ বিঘ্ন ঘটায় সে একটু বিরক্ত হল। সেদিকে তাকিয়েই বলল
–গেম খেলি গেম।
ঈশা মুচকি হেসে আবার বলল
–কি গেম রে?
ইরা এবার ভ্রু কুচকে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে বলল
–ক্যান্ডি ক্রাশ।
ঈশাও মনোযোগ দিয়ে সেদিকে দেখছে। কিন্তু তার আশে পাশে কি হচ্ছে সেটা সে বুঝতেই পারছে না। সে এমন ভাবে ঝুকে আছে তার মাথাটা ইভানের নাকের কাছাকাছি। তার চুলের ঘ্রান নাকে আসতেই ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলল। মাতাল করা সেই ঘ্রানের নেশায় ইভান নিজেকে কিছুতেই ঠিক রাখতে পারছে না। কিন্তু ঈশা কিছুতেই সরছে না। ইভানের এবার খুব অসস্তি হচ্ছে। হুট করেই বিস্ময়কর একটা কাজ করে বসলো। আলতো করে এক হাতে ঈশার কোমরে চেপে ধরল। ঈশা মুহূর্তেই কেপে উঠল। বুকের ভিতরে ঢিপঢিপ শব্দটা বেড়ে গেলো। ভীষণ রকমের অপ্রস্তুত হয়ে গেলো সে। উঠে তড়িৎ গতিতে সোজা তো হয়ে গেলো। কিন্তু সরতে পারল না। কারন ইভান অনেক জোরে চেপে ধরেছে। নড়াচড়া করা সম্ভব হল না। সামনে সোনিয়াকে বসে থাকতে দেখে ঈশা একটু অপ্রস্তুত হয়েই ধির কণ্ঠে বলল
–আমাকে ছেড়ে দাও প্লিজ।
ইভান কোন কথা বলল না। এমন কি ঘুরেও তাকাল না। এমন ভাব যে ঈশার কথা সে শুনতেই পায়নি। সোনিয়ার দৃষ্টি যদিও বা তখন টিভির দিকে তবুও ঈশা আবার বলল
–প্লিজ ছাড়ো।
এবার ইভান খুব স্বাভাবিকভাবেই তার দিকে তাকাল। শান্ত কণ্ঠে বলল
–কাপছ কেন? ঠাণ্ডা লাগছে? উষ্ণতা দরকার?
ঈশা কটমট চোখে ইভানের দিকে তাকালেও আবার দমে গেলো। দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। ইভানের শরীরের উষ্ণতা এমনিতেই তাকে জালিয়ে দিচ্ছে। আরও উষ্ণতা বেড়ে গেলো তো পুড়েই ছাই হয়ে যাবে। ঈশার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেলো। ইলুকে তাদের দিকে আসতে দেখে ইভান ছেড়ে দিলো। ঈশা যেন সস্তি ফিরে পেল। মুহূর্তেই দুই হাত সরে গিয়ে বসলো। ইলু এসে ইরার পাশে বসে তার গাল টেনে দিয়ে বলল
–কি রে ইরু গেম খেলছিস?
ইরা বিরক্ত নিয়ে মাথা নাড়াল। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে একটু জোরেই বলল
–কি রে ঈশা তুই তো গরমে ঘেমে একাকার অবস্থা। ওখানে বাতাস পাচ্ছিস না তো। কাছে এসে বস।
ঈশা কোন কথা বলল না। ইলু ভাল করে ঈশার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল। তারপর বলল
–আমি তো এতদিনে জানতাম আমাদের বাড়িটাই সব থেকে ঠাণ্ডা। ঈশা তো তাই বলতো। ওদের বাড়িতে গরম বলে মাঝে মাঝে দুপুরে আমাদের বাড়িতে ঘুমাতে আসে। তাহলে আজ এভাবে ঘামছিস কেন?
–তোর শরির খারাপ লাগছে না তো? তুই ঠিক আছিস ঈশা?
ঈশান কথাটা বলতে বলতে সোনিয়ার পাশে বসলো। ঈশা নত দৃষ্টিতেই ওড়নার এক পাশ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ফেলে বলল
–আমি ঠিক আছি। এমনিতেই গরমটা আজ একটু বেশিই মনে হচ্ছে।
ইভান ঠোট চেপে হাসল। ঈশান বলল
–তুই ফ্যান থেকে দূরে বসেছিস তাই মনে হচ্ছে। ইভান ভাইয়ার কাছে বস। তাহলে গরম লাগবে না।
ঈশা একবার ইভানের দিকে তাকাল। ইভান সামনে তাকিয়ে আছে। তার এসবে কোন যায় আসেনা। চেহারা অতিশয় সাভাবিক। ঈশা কিছুতেই সেখানে বসতে চায়না। কিন্তু সবার কথার জোরে বাধ্য হয়ে ইভানের কাছে এসে বসলো। ইলু উঠে যেতে যেতে বলল
–তুই তো কিছু খাস নি ঈশা। খেয়ে নে।
ঈশা নরম কণ্ঠে বলল
–আমি শুধু চা খাব আপু। এখন কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।
ইলু চলে গেলো। ঈশান সোনিয়ার সাথে গল্পে ব্যস্ত হয়ে গেলো। ঈশান আর সোনিয়া দুজন এক সাথে পড়াশোনা করে। তাই তার জন্মদিন উপলক্ষে সোনিয়া এসেছে। ঈশা মাথা তুলে টিভির দিকে তাকাল। ইভান ঈশার দিকে একটু ঝুকে ধির কণ্ঠে বলল
–সকাল থেকে কিছুই খাস নি। শুধু চা খেলে হবে?
ঈশা আড় চোখে একবার ইভানের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। মিনমিন করে বলল
–এখন খেতে ইচ্ছা করছে না।
–ইচ্ছা অনিচ্ছা শুনতে চাইনি। আমার কথা শুনতে বলেছি।
ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–বললাম তো এখন খাব না।
ইভান একটু গম্ভির গলায় বলল
–আমার কথা না শুনলে কিন্তু কিভাবে শোনাতে হয় সেটা আমি জানি। তাই অজথা জেদ না করে চুপচাপ খেয়ে নে।
ঈশা কোন কথা বলল না। বসেই থাকল। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–এক কথা বারবার বলাটা আমার পছন্দ না। তুই কি আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নিচ্ছিস? নিস না। ভুল করবি। আমি বিগড়ে গেলে তোর কপালে শনি নেমে আসবে।
ঈশা কোন কথা না বলে উঠে গেলো। রান্না ঘর থেকে খাবার নিয়ে এসে খেতে লাগল টেবিলে বসে। বড়রা সবাই ঘরে চলে গেছে। সাংসারিক আলচনায় মত্ত। ইলু চা নিয়ে এসে টেবিলে রেখে বলল
–কে কে চা খাবে?
সবাই সম্মতি দিল। ইলু চায়ের কাপ নিয়ে সবার হাতে হাতে দিলো। ইভান কাপ নিয়ে উঠে গিয়ে ঈশার সামনের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল। ইরাও ইভানের পিছে পিছে এসে তার কোলে বসে পড়ল। ঈশা একবার চোখ তুলে ইভানের দিকে তাকাল। শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে খেতে শুরু করল। হঠাৎ করেই ইভানের আদুরে কণ্ঠ কানে এলো
–এতো রাগ করে খাস না পাখি। গলায় আটকাবে।
ঈশা চোখ তুলে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান ইরার দিকে তাকিয়ে তার সাথে গেম খেলছে। তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে দুজনে এখন দুনিয়ার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত। কি মনে করে ঈশা হেসে দিলো। হঠাৎ মাথায় দুষ্ট বুদ্ধির উদয় হল। ইচ্ছা করে খানিকটা কাশতে লাগল। ইভান ভাবল ঈশার গলায় খাবার আটকে গিয়েছে। পানি এগিয়ে দিলো। বিচলিত হয়ে বলল
–বললাম না গলায় আটকাবে। কথা কানে যায়না না?
ঈশা পানি একটু মুখে দিয়ে গ্লাসটা পাশে রেখে দিলো। দুষ্টুমি করে বলল
–আমাকে বলেছিলে? কই শুনলাম না তো।
ইভান সবটা বুঝতে পেরে বাকা হেসে ইরাকে বলল
–ইলু আপুর কাছ থেকে বিস্কিট নিয়ে আয় তো টুনটুনি।
ইরা কোল থেকে নেমে এক দৌড় দিলো। ইভান উঠে ঈশার পাশের চেয়ারটা একটু টেনে কাছে নিয়ে বসলো। প্লেট থেকে খাবার তুলে ঈশার মুখে দিয়ে বলল
–এখন শুনতে পাবি নাকি আরও কাছে আসতে হবে? তুই চাইলেই আমি আসতে পারি। আমার কিন্তু কোন সমস্যা নেই।
এবার সত্যি সত্যি ঈশার গলায় খাবার আটকে গেলো। ইভান পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে ঠোটে হাসি রেখেই বলল
–ততটুকুই টর্চার করা উচিৎ যতটা নিজের সহন ক্ষমতা। বেশী হয়ে গেলে কিন্তু সেটা নিজের উপরে ভারি পড়তে পারে। ভাবা উচিৎ ছিল।
চলবে………