#শিশির_বিন্দুর_জীবন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৪
আবির ক্যান্টিনে বসে আফরিনের অপেক্ষা করছিল। তখনই গুটিগুটি পায়ে আবিরের সামনের চেয়ারে বসলো। আবির অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আফরিনের দিকে। গোলগাল চেহারায় হিজাবটা যেন বেশি ফুটে উঠেছে। কাটছাঁট চেহারার মেয়েটাকে আবিরের চোখে অসম্ভব সুন্দর লাগে। হোক না শ্যামবর্ণে তাতে কি আসে যায়।
আবিরকে এমন হাবলুর মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে আফরিন বিরক্তি নিয়ে বলল
-“কিছু কি বলবে নাকি শুধু হাবলুর মতো তাকিয়ে থাকার জন্য আসতে বলেছ।”
আবির আফরিনের কথায় থতমত খেয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো। এতে আফরিনের বিরক্তি যেন চরম পর্যায়ে উঠে গেলো। আফরিন চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে টেবিলে হাত দিয়ে আঘাত করে বলল
-“হয়েছে তোমার। আমতা আমতা করা আমি একদম পছন্দ করিনা।”
আবির ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করে বলল
-“আমি তোমাকে ভালোবাসি”
কথাটা কর্ণপাত হতেই আফরিন আতকে উঠলো। আফরিন কিছু না বলেই চলে গেলে সেখান থেকে। আবির মুখ ছোট করে তাকিয়ে রইলো আফরিনের যাওয়ার দিকে।
আফরিন ধীর পায়ে ক্লাসে এসে নিজের সিটে ধপ করে বসে পরলো। আরুশা উৎসাহ নিয়ে বলল
-“কিরে কি বলল?”
আফরিন থমকানো সুরে বলল
-“ও নাকি আমাকে ভালোবাসে”
আরুশা স্বাভাবিকভাবে বসে চিপস চেবাতে চেবাতে বলল
-“আমি জানতাম এমনটাই বলবে ওই গাধা। চোখ মুখ দেখে আমি আগেই বুঝতে পারছি।”
আফরিন অবাক করা কন্ঠে আরুশার দিকে তাকিয়ে বলল
-“কি বলছিস এগুলো!”
আরুশা ভাব নিয়ে বলল
-“আমি বুঝতে পারি। তুই তো বলদ।”
———————-
ক্লাস শেষ করে রুম থেকে বের হতেই রামিজাকে দেখতে পায় আফরিন। মেয়েটা আগের থেকে অনেকটাই চুপচাপ হয়ে গেছে। আফরিন রামিজাকে কাছে ডাকে। মুচকি হাসি দিয়ে বলে
-“এখনো বাসায় যাওনি কেন?”
রামিজা মুচকি হেসে আফরিনের হাত ধরে বলল
-“আম্মু তোমার সঙ্গে যেতে বলছে। তা আপু কেমন আছো?”
আফরিন সামনে এগোতে এগোতে বলল
-“আছি আল্লাহ যেমন রেখেছে। তুমি কেমন আছো?”
কথা বলতে বলতেই আফরিনের নজর পরলো দূরে দাড়িয়ে থাকা রাদের দিকে। রাদ দেখতে খানিকটা অস্বাভাবিক লাগছে। চোখ নাকমুখ লাল হয়ে আছে। রামিজা আফরিনকে বলল
-“ছোট ভাইয়া মনে হয় কিছু নিয়ে রেগে আছে। চলো গিয়ে গাড়িতে বসি।”
আফরিন দৃষ্টি নামিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল রামিজার হাত ধরে। দুইজনকে দেখে রাদ কিছু না বলেই উঠে পরলো গাড়িতে। ওরাও কিছু না বলে চুপচাপ গাড়িতে উঠে পরলো।
গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে তখনই রাদ চেচিয়ে বলল
-“আমাকে বিরক্ত করতে না করছিলাম তোকে। তোর মতো ফাউল আর ছেচড়া মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। লজ্জা করেনা তোর। পরবর্তীতে ফোন দিলে খবর আছে তোর।”
বলেই গাড়ি ব্রেক করলো রাদ। আফরিন আর রামিজা ভয়ে কুকরে গেছে। রাদের এমন রেগে কারো সঙ্গে কথা বলতে দেখে দুইজন দুইজনের দিকে তাকাতাকি করলো। রাদ হুট করেই গাড়ি থেকে নেমে পরলো।
রাদ নামতেই আফরিন ঢোক গিলে বলল
-“তোমার ভাই তো দেখি ফায়ার হয়ে আছে।”
রামিজাও মিনমিনে কন্ঠে বলল
-“ছোট ভাইয়া রাগ করে খুব কম। একবার রেগে গেলে অবস্থা খারাপ।আল্লাহ ভালো জানে কার উপর ক্ষেপছে।”
কিছুক্ষণ পর রাদ গাড়িতে এসে পরপর কয়েকটা নিশ্বাস ছেড়ে নরম সুরে বলল
-“সরি,আসলে একটু সমস্যা হয়েছিল তো তাই রেগে গিয়েছিলাম। তা কেমন কাটলো দিন।”
রামিজা মিনমিনে সুরে বলল
-“ভালোই কেটেছে, ছোট ভাইয়া।”
গাড়ির লুকিং গ্লাসে রাদ চোখ রেখে আফরিনকে উদ্দেশ্য করে বলল
-“তোমার কি অবস্থা?”
আফরিন জানালার দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল
-“হুম ভালো”
রাদ গাড়ি চালাতে চালাতে বলল
-“তোমাকে তো আমি বড় ভাবছিলাম। কলেজ ড্রেস পড়ে তো তোমাকে একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে।”
আফরিন কোনো উত্তর দিলো না। বাহিরের দিকেই তাকিয়ে রইলো।
আফরিনের এমন প্রতিক্রিয়ায় রাদের ভ্রুযুগল কুচকে গেল। সে বুঝতে পারলো আফরিন তার সাথে কথা বলতে চাইছেনা। রাদ ওর সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে রামিজাকে বলল
-“ইশরাকে আম্মু নিয়ে যেতে বলছে। তুই গিয়ে নিয়ে আসিস। আমার কিছু কাজ আছে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসিস। তোকে বাসায় রেখে আমি কাজে যাবো।”
আফরিন এবার রাদের দিকে তাকিয়ে বলল
-“কিছু না খেয়ে এমন খালি মুখে চলে গেলে আম্মু মন খারাপ করবে। কিছু খেয়ে গেলে কিছু হবেনা।”
রাদ কিছু বলতে নিবে তখনই আফরিন আবারো বলল
-“কিছু শুনতে চাইনা”
রাদ আফরিনদের বাসা থেকে তাড়াতাড়ি হুড়া করে শুধু পানি খেয়েই দৌড় দিছে ইশরাকে নিয়ে। রামিজা আর ইশরাকে বাসার সামনে নামিয়ে রাদ ওখান থেকেই গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে গেছে।
————————
তীব্র গরমে অস্বাভাবিক জনজীবন অতিবাহিত করছে মানুষ। এই পরিস্থিতিতে প্রশান্তির একরাশ হিমেল স্পর্শ নিয়ে শহর জুড়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। রাদ রাস্তার মাঝে গাড়ি থামিয়ে গাড়ির পাশে দাড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করতে লাগলো। সাদা শার্ট বৃষ্টির পানিতে ভিজে শরীরের সঙ্গে লেগে আছে। এক মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য প্রকাশ পাচ্ছে রাদের। চোখের চিকন ফ্রেমের চশমাটা খুলে মুখটা আকাশের দিকে তুলে চোখ বুজে নেয়।
হুট করেই কেউ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে রাদ। আকস্মিক এমন ঘটনায় অবাক হয়ে রাদ সামনে তাকাতেই দেখে কিছু লোক দৌড়ে আসছে। আর তাকে জড়িয়ে ধরে আছে একটা মেয়ে। মেয়েটা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল
-“আমাকে বাঁচান দয়া করে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। বাঁচান আমাকে।”
রাদ নিজের থেকে মেয়েটিকে ছাড়িয়ে মেয়েটাকে শান্ত করে। ছেলে দুটো উদ্দেশ্যে বলল
-“কিরে কি চাই তোদের!”
বলেই শার্টের হাতা গোটায়। বলিষ্ঠ দেহের রাদকে দেখে বখাটে ছেলে দুটো ভয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকাতাকি করে।
রাদ বাঁকা হাসি দেয় ওদের কাজে। ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠে
-“তুই সরে যা এখান থেকে। আমাদের কাজ আমাদের করতে দে।”
রাদ সামনে থেকে সরে গিয়ে বলল
-“আমি না করছি নাকি। যা খুশি কর।”
রাদের এমন কথায় মেয়েটা ভয় পেয়ে গেল। লোক দুটো দাঁত বের করে হাসি দিয়ে মেয়েটার দিকে এগিয়ে আসতে ধরে। তখনই রাদ একটা পা বেজে দেওয়ায় একটা ছেলে ধপাস করে পড়ে যায়। এটা দেখে অন্য ছেলেটা রেগে রাদের দিকে তেড়ে আসতে নিলো বৃষ্টির পানিতে পা পিছলে ধপাস করে আগের লোকটার উপর পড়ে যায়। এমন ঘটনা দেখে রাদ আবারো বাঁকা হাসি দিয়ে ওদের দিকে এগোতে নিলেই ওরা দুইজন উঠে ভো দৌড় দেয়। ওদের কাজে রাদ হেসে দেয়। রাদ এবার মেয়েটার দিকে ঘুরে গাড়িতে বসতে বলে। রাদ মেয়েটা বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসে।
————————
মায়ের ডাকে হুড়মুড়িয়ে উঠে আফরিন। কলেজ থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নামাজ পড়ে শুয়েছিল। কখন যে ঘুমিয়ে গেছে টের পায়নি। মাগরিবের আযান দিচ্ছে বলে ওযু করে নামাজ পড়ে নেই। এক মগ কফির জন্য রুম থেকে বের হতে নিবে তখনই ওর মা কফির দুটো মগ নিয়ে হাজির হয়ে। ওনি মুচকি হেসে বলেন
-“চল বারান্দায় গিয়ে বসে খাই। ওখানে সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া বইছে। ওখানে গেলে ফুরফুরে লাগবে।
আফরিন ও সম্মতি দিয়ে বারান্দা চলে যায়। ধোয়া উঠা কফিতে এক চুমুক দিতেই আফরিনের মা বলে উঠেন
-“মা আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না। আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি।”
নিজের মায়ের মুখে এমন কথা শুনে কপাল কুচকে যায় আফরিনের সে তার মায়ের দিকে ঘুরে জিঙ্গাসা করে
-“কি হয়েছে মা! আমি তো কিছু বুঝতে পারছিনা। আর কি ভুল আর কিসের ক্ষমা।”
আফরিনের মা মুখটা নিচু করে বললেন
-“তোর মতামত ছাড়া রাহাতের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করা আমার ঠিক হয় নি। আর ওইদিন রাদের কথা বলাও আমার ঠিক হয় নি। তোর সামনে পরীক্ষা কোথায় তোকে আমি মানসিক ভাবে সাপোর্ট দিবো তা না করে। তুই কি পারিস না তোর অপরাধী মাকে এবারের মতো ক্ষমা করতে।”
বলেই আফরিনের মা কান্না করে দিলেন। আফরিন নিজের হাতের কফির মগটা পাশে রেখে মায়ের দিয়ে ঘুরে বসে মায়ে দুটো হাত হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল
-“তুমি আমার মা। আমি তোমাকে ক্ষমা করার কে বলো তো। আর দোষ তো তোমার না আমাদের সমাজে। আমাদের সমাজে বউ মরে গেলে শালীকে জোর করে হলেও দুলাভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। একবার সেই মেয়েটার কথা চিন্তাও করা হয় না। আর ভাইয়া তো আপুকে ভালোবেসেছিল। সে কিভাবে মেনে নিবে তার ভালোবাসার মানুষের জায়গায় অন্যজনকে। যাইহোক তুমি আর এগুলো ধরে রেখে কষ্ট পেয়েও না। যা হওয়ার হয়েছে। এখন শুধু আর বিয়ের কথা বলো না। আর ইশরাকে না আমরা সবাই মিলে মানুষ করে নিবো।”
আফরিনের মা নিজের মেয়েকে নিজের বুকে টেনে নিলেন।
#চলবে