#শিউলি_পাওয়া <শেষ পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১২>
আজ নবমী | পুজোর শেষ দিন | বাঙালির মনে আজ পুজোর আনন্দর সাথে একটা অদ্ভুত দুঃখ মিশে আছে | কালই বিসর্জন , আবার তারপর এক বছরের অপেক্ষা | তাই প্রত্যেকটা বাঙালিই আজকে ঘড়ির কাঁটাকে যেন আটকে রাখতে চায় , সময়টাকে থামিয়ে দিতে চায় , আর নবমীর দিনটাকে ধরে রাখার একটা অদ্ভুত চেষ্টা করে যায় সারাক্ষন | দীপেরও আজকে মনটা একটু খারাপ | এই নবমীর রাতটা কাটলেই তো পুজো শেষ ! আসলে এই কদিন এখানে এতো মজা করেছে , এতো জড়িয়ে গেছে এখানে থাকা মানুষগুলোর সাথে , এই শরৎ-টার সাথে , যে পুজো শেষ হওয়ার কথা মনে এলেই একটা খারাপ লাগা ঘিরে ধরছে ওকে | যাই হোক, সেইসব মন খারাপ নিয়েই ল্যাপটপটা খুলে বসেছিল | সময়কে মুঠো বন্দি না করতে পারুক, ফ্রেম বন্দি তো করেছে | তাই সেইসব পুরোনো ছবিগুলোকেই দেখছিলো ! সেই চতুর্থীর দুপুর , ময়ূরপঙ্খী ঘাটের ফটোগুলো | আর তখনই একটা ফটোটা এসে ওর চোখটা আটকে গেলো | গঙ্গার সৌন্দর্য ক্যাপচার করতে গিয়ে কখন যে কথাকেও ফ্রেমে নিয়ে এসেছিলো, নিজেও বোঝেনি ! এখন ফটোটা দেখে মনে পড়লো | সেই লাল চুড়িদার, সেই প্রথম দিন | উফ , সত্যি , এই একটা ফটোর জন্য কি ঝগড়াই না শুরু করেছিল কথা ! ভেবেই একটা হাসি চলে এলো দীপের মুখে | ব্যাপারটা যে অনিন্দ খেয়াল করছে দূরে দাঁড়িয়ে , সেটা দীপ বোঝেনি | বুঝলো , যখন হঠাৎ অনিন্দ বলে উঠলো ,
” কি রে ? কি ব্যাপার ? হাসছিস যে ! প্রেমে পরে গেলি না কি ?”
আচমকা এই রকম একটা স্ট্রেট কাট প্রশ্নের জন্য দীপ তৈরী ছিল না , তাই দু সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বললো , ” থামবি | আরে , ফটোটা দেখে ময়ূরপঙ্খী ঘাটে প্রথম দিনের ঝগড়ার কথাটা মনে পরে গেলো , তাই হাসছিলাম |”
এবার কিন্তু অনিন্দ একটু সিরিয়াস ভাবেই বললো , ” ওকে , বুঝলাম | তবে একটা জিনিস বলতে পারি | কথার মতন মেয়ে হাজার খুঁজেও পাবি না |”
এটা শুনে দীপ হেসে ফেললো , ” হ্যাঁ , জানি তো | পাবো না | এই রকম পাগল, ঝগড়ুটে টাইপের মেয়েকে পাওয়া সত্যি খুব মুশকিল |”
এরপর অনিন্দ আর কিছু বললো না | চুপ করে গেলো | বেশ গম্ভীর হয়ে গেছে মুখটা ! দীপ ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছে না | কি হলো আবার হুট্ করে ! ও তো মজা করেই কথাটা বলেছিলো | অনিন্দ রেগে গেলো না কি ! এইসবই ভাবছিলো , তখনই অনিন্দ হঠাৎ বলে উঠলো ,
” আমি মজা করছি না দীপ | সিরিয়াসলি বলছি | কথার মতন মেয়ে দেখা যায় না | নইলে এতো কিছু হওয়ার পরও কেউ এতটা হাসিখুশি থাকতে
পারে ?”
” এতো কিছু হওয়ার পর ? মানে ? কি হয়েছে ওর ?” দীপ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো এবার |
এর উত্তরটা দেয়ার সময় অনিন্দর একটা দীর্ঘ্যশ্বাস আপনাআপনিই চলে এলো , ” কথার তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ার | সেইবার দূর্গা পুজোয় কলকাতায় ঠাকুর দেখতে গিয়েছিলো ওরা | কিন্তু , ফেরার পথে ওদের গাড়িটার একটা একসিডেন্ট হয়ে যায় | গাড়িতে ভূমি , ওর মা বাবাও ছিল | কারোর বিশেষ লাগেনি , শুধু কথারই ! কোমর থেকে প্যারালাইসিস হয়ে গিয়েছিলো পুরো | ওই রকম হাসিখুশি চঞ্চল একটা মেয়ে হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরেছিল হুইল চেয়ারে | আমরা তো কেউ ভাবতেই পারছিলাম না যে কথা কি করে পুরো ব্যাপারটাকে একসেপ্ট করবে ! এক্সিডেন্টের পর প্রথম দু মাস তো সিভিয়ার ডিপ্রেশনে ছিল | কারোর সাথে কথা বলতো না | কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে নিলো | আবার শুরুর থেকে চেষ্টা করতে থাকলো , এক পা এক পা করে হাঁটার | প্রায় দু বছর লেগেছিলো ওর সোজা হয়ে দাঁড়াতে | আর চলতে আরো এক বছর | কত ফিজিওথেরাপি, ওষুধ , ইনজেকশনের পর ! আর সব থেকে বড়ো কথা কি জানিস ! কথা ছোট থেকেই দারুন নাচতো | ওর ঘরে গেলে দেখবি , ক্লাসিক্যাল ডান্সের জন্য কত এওয়ার্ড এখনো সাজানো আছে শো কেসটায় | খুব চাইতো গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে বিশ্বভারতী থেকে নাচ নিয়ে পড়বে | কিন্তু ওই এক্সিডেন্টের জন্য সেইসব কিছুই আর হলো না | ডাক্তার বলেই দিয়েছে , ওর পা এ খুব স্ট্রেস দেয়া যাবে না কখনো | তাই আর কোনোদিনও ও নাচতে পারবে না | কিন্তু এতো কিছুর পরও ও কত হাসিখুশি থাকে সব সময় | ওকে দেখে তো কেউ ভাবতেই পারবে না যে লাইফে কি কি ফেস করতে হয়েছে মেয়েটাকে ! ”
এইসব শোনার পর দীপ যেন কিছুক্ষনের জন্য একটু থমকে গেলো | কিছুতেই মেলাতে পারছে না কোনো কিছু ! যার সাথে চার দিন এতো কথা হলো , এতো ঝগড়া , এতো একসঙ্গে ঘোরা , ঠাকুর দেখা , এতো হাসি মজা হলো , তার লাইফটা আসলে এই রকম ! এতটা অন্ধকার , কষ্ট , যন্ত্রনা মিশে আছে ওই হাসি মুখটায় ! ভাবতেই পারছিলো না | তিন বছর একটা মানুষ হাঁটতে পারেনি , একটা হুইল চেয়ারে বসে কাটিয়েছে | কতটা খারাপ লাগা নিয়ে সেইদিন গুলো বাঁচতো কথা ! আর ছোট থেকে যেই স্বপ্ন দেখে এসেছে , নাচ নিয়ে পড়ার স্বপ্ন , সেটা যখন এক সেকেন্ডে ভেঙে গেলো ! তখন ঠিক কি রকম লেগেছিলো ওর | না , দীপ সেটা হয়তো কোনোদিনও জানতে পারবে না | ওই পরিস্থিতে একটা মানুষের কি রকম লাগে , সেটা সে নিজে ফেস না করলে কখনো বুঝতে পারা যায় না | ভেবেই ওর চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো হঠাৎ | নিজের অজান্তেই কথার জন্য ওর চোখে জল জমেছে কখন ! ও বুঝতেই পারেনি | এখন হঠাৎ খুব কথাকে দেখতে ইচ্ছে করছে | মনে হচ্ছে এই চার দিনের চেনাটা যেন কোনো চেনাই ছিল না | আজ নতুন করে চিনলো ওই মেয়েটা | ওর সহ্য শক্তিকে | ওর ওই হাসি মুখটাকে | আসলে এতো কিছু না পাওয়া নিয়েও যে কোনো মানুষ এতো লাইভলি হতে পারে, নিজের কথা দিয়ে অন্যের মুখেও হাসি এনে দিতে পারে , এটা দীপ আজ প্রথম জানলো | তাই আজ কথাকে আবার প্রথম থেকে চিনতে , নতুন করে বুঝতে ইচ্ছে করছে খুব | এইসব ভেবেই কথার বাড়ির সামনে গিয়ে হাজির | কলিং বাজাতেই দরজার ওপার থেকে সেই হাসি মুখটা বেরিয়ে এলো | আচমকা দীপকে ওদের বাড়িতে দেখে তো সে অবাক ! — ” কি ব্যাপার ? তুমি ? হঠাৎ , এই অধমের বাড়িতে ?”
দীপ গম্ভীর মুখে বললো , ” কেন ? আসতে পারি না ! ”
কি হলো ব্যাপারটা ! মুখটা এই রকম অন্ধকার লাগছে কেন ! ভেবেই কথা বলে উঠলো , ” আরে , আমি ওই ভাবে বলেছি না কি ! আর কি হয়েছে ? তুমি এতো সিরিয়াস কেন ? ”
এবার দীপ একটু অধৈর্য্য হয়ে বললো , ” আচ্ছা , সব কথা কি দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে বলবো ? ভেতরে যেতে দেবে না |”
এটা শুনে কথা হেসে ফেললো | সত্যি , দরজাটা ধরে ও কতক্ষন দাঁড়িয়ে আছে | তাই তাড়াতাড়ি সরে এসে বললো , “প্লিজ প্লিজ , আসুন আসুন | আপনি তো আমার সব থেকে বড়ো অতিথি |”
সেইদিন প্রথম কথার ঘরে গেলো দীপ | অনিন্দর কথাটাকে ওর ঘরে গিয়ে ঠিক মিলিয়ে দেখলো | একটা শো কেশে কত কত মেডেলস , সার্টিফিকেট , এওয়ার্ডস যত্ন করে সাজানো আছে | তখনি আনমনে ও বলে উঠলো , ” এইসব সার্টিফিকেট , মেডেলস গুলো তোমার ? ”
কথা কয়েক মুহূর্তে সময় নিয়ে হেসেই উত্তর দিলো , ” হ্যাঁ, একটা সময়ের আমার | একটু আধটু নাচতাম তখন | এখন আর এইসব কিছুই পারি না |”
এবার দীপের চোখটা কথার সামনেই ভিজে গেলো | সঙ্গে একটা রাগও হলো | চারটে দিন নেহাত কম কিছু না | এতো ঝগড়া, এতো কথা হয়েছে ওদের মধ্যে , কিন্তু এতো বড়ো একটা ঘটনার ব্যাপারে কথা একবারও একটা শব্দ উচ্চারণ করেনি ওর কাছে ! কেন এতটা দূরের ভাবে ওকে ! ভেবেই বেশ রেগে বলে উঠলো দীপ , ” তোমার এক্সিডেন্টের ব্যাপারে আমাকে কেন কিছু বলোনি ? কাল ও তো আমাদের মধ্যে কত কথা হলো | আমার পুরো লাইফ হিস্ট্রি জেনে নিলে তুমি | আর নিজের জীবনের এতো বড়ো কথাটা শেয়ার করলে না ? ”
তার মানে দীপ সব কিছু জেনে গেছে | ওর থমথমে মুখটা দেখে কথা বুঝতে পারছে এখন ওর কতটা খারাপ লাগছে | সত্যি কখনো ভাবেনি , চার দিনের চেনা একটা মানুষের চোখ ওর কারণে ভিজতে পারে ! তাই দীপের হাতটা শক্ত করে ধরে ওকে পাশের চেয়ারটায় বসালো | তারপর শান্ত গলায় বললো ,
” বলিনি কারণ আমি মনে করি না ওই একসিডেন্ট , ওই তিনটে বছরের ব্যাপারে আমার বলার মতন কিছু আছে ! সত্যি কথা বলবো , আমার এটা নিয়ে এখন আর কোনো কষ্ট হয় না | হ্যাঁ , এক্সিডেন্টের পর দু মাস আমি ডিপ্রেশনে ছিলাম , কারোর সাথে কথা বলতাম না | একেবারে চুপ থাকতাম | কিন্তু তারপর রিয়ালাইজ করলাম , যা হয়েছে আমার লাইফে সেটাকে তো আমি এইভাবে বদলাতে পারবো না | একচুয়ালি আমাদের হাতে তো কিছুই নেই | খারাপ ভালো যা ই হোক , সবটাই আমাদের একসেপ্ট করতে হয় , আর রোজ নিজের মতন করে ভালো থাকার চেষ্টা করতে হয় | এটাই তো লাইফ | জানি , ওই এক্সিডেন্টের জন্য আমার তিনটে বছর নষ্ট হয়েছে , আমার লাইফ থেকে নাচটা চলে গেছে | তার জন্য খারাপ লাগা আছে | কিন্তু সেটা আমি একসেপ্ট করে নিয়েছি | আর যখন মন খারাপ হয় , তখন এটা ভাবি যে ওই একসিডেন্টে তো আমি মারাও যেতে পারতাম | তখন তো সব শেষ হয়ে যেত ! কিন্তু তার বদলে লাইফ তো আমাকে আর একটা চান্স দিয়েছে, নতুন করে বাঁচার চান্স | তাই সেই চান্সটাকে মন খারাপ করে , কষ্ট পেয়ে , কি কি জীবনে হলো না , কি কি পেলাম না , এইসব ভেবে নষ্ট করে কি হবে ! তার থেকে বরং এই হিসাবটা করি , যে কি কি পেয়েছি | কি কি নিয়ে নতুন ভাবে আবার সব কিছু শুরু করা যায় | বুঝলেন | ইশ , অনেক জ্ঞান দিয়ে ফেললাম | বোর হলে না তো ? ”
শেষের এই লাইনটা কথা যেন ইচ্ছে করেই বললো | আর তারপরই ওর মুখে এক চিলতে হাসি | চারিদিকটা আসলে বড্ডো সিরিয়াস হয়ে গেছে | আর দীপের এই রকম থমথমে মুখটা দেখতে একদম ভালো লাগছে না কথার | কিন্তু সেই মুহূর্তে দীপ হাজার চেষ্টা করেও হাসতে পারলো না | অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছিলো ওর | কিসের কষ্ট , ও নিজেও ঠিক বুঝতে পারছে না ! ওই একটা কথা আছে , প্রথম আলাপে কখনো কাউকে বিচার করতে নেই | কথাটার মানে আজ দীপ বুঝলো | যেইদিন এই মেয়েটার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল , মনে হয়েছিল এর থেকে বেশি ইমম্যাচিওর মেয়ে ও জীবনে দেখেনি ! আর আজ ঠিক উল্টোটা মনে হচ্ছে | মনে হচ্ছে লাইফটাকে যে কেউ এতটা পজিটিভলি , ম্যাচিওরলি দেখতে পারে , সেটা আজ কথার কথাগুলো না শুনলে বুঝতেই পারতো না | তাই অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো ,
” তুমি খুব আলাদা কথা | সবাই তোমার মতন করে ভাবতে পারে না | সব কিছুকে এই ভাবে একসেপ্ট করতে পারে না |”
কথা এবার দৃঢ় গলায় উত্তর দিলো , ” কেন পারে না ! চাইলেই পারা যায় | আর একটা কথা বলবো তোমাকে ; তুমিও একসেপ্ট করে নাও | আমি জানি তোমার সাথে যেটা হয়েছে খুব খারাপ হয়েছে | ছোটবেলা থেকে ওই ভাবে একা একা থাকা ! তোমার মা বাবা থাকা সত্ত্বেও তুমি জানো না ফ্যামিলি কি ! আর শুধু টাকা দিয়েই তো আর মা বাবা হয় যায় না | মা বাবা হতে গেলে ভালোবাসতেও জানতে হয় | আসলে তোমার মা বাবা শুধু নিজেদেরটাই ভেবেছে সব সময় | তোমার কথা ওরা কোনোদিনও ভাবেনি | যদি ভাবতো , তাহলে এই ভাবে দূরে সরিয়ে রাখতো না | আর আমি জানি এই কথাগুলো তোমার রোজ মনে হয় | রোজ খুব রাগ হয়ে ওদের ওপর | আর রোজ এই কথাগুলোকে , এই রাগটাকে , এই খারাপ লাগাটাকে তুমি জমিয়ে রাখো, নিজের মধ্যে | কিন্তু ট্রাস্ট মি , এই ভাবে জমিয়ে রাখতে রাখতে তো একদিন তুমি নিজেই শেষ হয়ে যাবে | আর সেইদিনও ওদের কিছু যায় আসবে না | তাই বলছি , যা মনে আছে সেই সব কিছুই বলে ফেলো , আর জমিয়ে না রেখে ! শেষ করে দাও সব কিছু | আর হ্যাঁ, ওদেরও তো জানা দরকার , যে ওরা ঠিক কতটা খারাপ | কতটা ইররেসপন্সিবল দুটো মানুষ | ”
কথাগুলো শেষ করেই কথা চুপ করে গেলো | দীপও আজ নিঃস্তব্ধ | মনে হচ্ছে ওর সামনে যেন কেউ একটা আয়না ধরে দাঁড়িয়ে আছে এখন | এতদিন যেই যন্ত্রনা , যেই কষ্ট , যেই খারাপ লাগা নিয়ে ওর দিনের চব্বিশটা ঘন্টা কেটে যেত , কিন্তু তা ও একটা হাসি হাসি মুখের মুখোশ পরে সারাদিন সবার সামনে ঘুরে বেড়াতো , সেই মুখোশটা হঠাৎ যেন কথা টেনে খুলে দিয়েছে | কি অদ্ভুত , এতো এতো বন্ধু ওর লাইফে , সবাই ওকে কত বছর ধরে চেনে | কিন্তু কেউ আজ অব্দি ওর ভেতরের মানুষটাকে চিনতেই পারেনি ! আর কথা , মাত্র চারদিনের আলাপে , হয়তো ওকে ওর থেকেও বেশি চিনে ফেলেছে | তবে আর না | আর এই ভাবে বাঁচবে না ও | যারা ওর কথা কখনো ভাবে না , তাদের নিয়ে আজকের পর থেকে আর ও নিজেও ভাববে না | কথা ঠিক বলেছে | একসেপ্ট করতে হবে সব কিছু | জমা কথাগুলো জমিয়ে না রেখে বলে ফেলতে হবে আজ | শেষ করে দিতে হবে এই পুরো চ্যাপ্টারটা | এইসব ভাবনার ভিড়েই নবমীর সন্ধ্যে নেমে এলো | চারদিকে মাইকের আওয়াজ , ঢাকের তাল , জমজমাট সন্ধ্যে | কিন্তু দীপের ঘরটা অন্ধকার | তবে আর বেশিক্ষন এই অন্ধকার থাকবে না ওর জীবনে , কারণ আজ সবটা শেষ করে দেবে দীপ |
<১৩>
সেইদিন ল্যাপটবটা খুলে ও আর এক সেকেন্ডও ভাবলো না | কমপোজ মেইল এ গিয়ে সবটা লিখে ফেললো | সেই পাঁচ বছর থেকে জমে থাকা সব কথা |
” ডিয়ার মা এন্ড বাবা ,
কথাগুলো তোমাদের ফোন করেও বলতে পারতাম | কিন্তু বললাম না | আজকাল আর তোমাদের গলা শুনতেও ইচ্ছে করে না আমার , তাই এই মেইলটা করছি | আসলে কথাগুলো অনেক দিন ধরেই জমে ছিল আমার মধ্যে | আর আজ মনে হয়েছে , এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে তোমাদের সবটা বলে দেয়া দরকার | একচুয়ালি আমি আমার লাইফে তোমাদের মতন স্বার্থপর দুটো মানুষ কখনো দেখিনি | আর আই উইশ , যে কখনো যেন দেখতেও না হয় | একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাকে হোস্টেলে রেখে এলে ! খোঁজ নেয়ারও কখনো একবারও প্রয়োজন মনে করলে না, যে সে ঠিক কেমন আছে ! নিজেদের নতুন লাইফ নিয়ে এতোই ব্যস্ত ! সত্যি , তোমাদের মিউজিয়ামে রাখা উচিত , কারণ বিলিভ মি , এই পৃথিবীতে হাতে গুনে হয়তো এই রকম মা বাবা খুঁজে পাওয়া যাবে | মাঝে মাঝে তো আমার মনে হয় , এর থেকে কোনো অরফ্যানেজে জন্মালে বোধ হয় ভালো হতো | অন্তত নিজেকে শান্তনা তো দিতে পারতাম যে মা বাবা পৃথিবীতে নেই, মারা গেছে !
যাই হোক , একটা কথাই বলার ছিল , মা বাবার সাথে কখনো টাকার সম্পর্ক হয় না | মা বাবা হতে গেলে একটু ভালোবাসতেও জানতে হয় | আর সেটা তো তোমাদের পক্ষে কোনোদিনই পসিবল না ! তাই প্রত্যেক মাসে আমার একাউন্টে টাকাটা প্লিজ আর পাঠিয়ো না | এটা আমার রিকুয়েস্ট | আর খুব ভালো থেকো , যেই রকম এতদিন থেকে এসেছো | এন্ড ফর মি , ইট’স এ গুড বাই ফর এভার , সো আর আমাকে কন্ট্যাক্ট করার চেষ্টা কোরো না
কখনো |”
সেইদিন মেইলটা সেন্ড করে দীপের মুখে আপনাআপনিই একটা হাসি চলে এসেছিলো হঠাৎ | মনে হচ্ছিলো যেন অনেক দিনের জমে থাকা একটা পাথর বুক থেকে নেমে গেছে , আর সব কিছু খুব হালকা লাগছে | চারিদিকটা ভীষণ ভালো লাগছে | কথা মনে হয় এই ভালো লাগার কথাটাই বলেছিলো সকালে | আর ঠিকই তো , নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্বটা তো একদম নিজেরই | আর আজ থেকে দীপ এই কাজটাই রোজ করবে | রোজ নিজের মুখে হাসি ফোটানোর একটা রিজন ও ঠিক খুঁজে বার করবে | আর হ্যাঁ , আজকে থেকে কোনো কথা নিজের মনের মধ্যে আর জমিয়ে রাখবে না ও | জমা কথাগুলোই আস্তে আস্তে বুকের মধ্যে বড়ো একটা পাথরের মতন হয়ে যায় | যেই পাথরটাকে আর ও কোনোদিনও নিজের জীবনে জমতে দেবে না | তাই এবার যাকে যা বলার স্পষ্ট করে , মুখের ওপর বলবে | নিজেকে পুরোপুরিভাবে এক্সপ্রেস করবে |
<১৪>
সেই সন্ধ্যেবেলা দীপ যখন পাড়ার ফাংশনে গিয়ে পৌঁছলো তখন ঘড়িতে সাড়ে সাতটা | হ্যাঁ, আজকেই সেই বিখ্যাত অনুষ্ঠান , যেখানে দীপের এন্ট্রি অনেকদিন আগেই অনিন্দর বাবা করে দিয়েছে | আর এমনি সেমনি ভাবে না , বোম্বে থেকে আসা সিঙ্গার হিসেবে ! কথাটা ভেবেই হেসে ফেললো দীপ | আর তখনই খেয়াল করলো দূরে সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে , নীল রঙের শাড়িতে, ওরই দিকে তাকিয়ে |
তবে আজ এই মুহূর্তে কথার মুখে একটা অদ্ভুত বিষন্নতা ! যেন জোর করে হাসছে | আসলে আজ নবমীর সন্ধ্যেবেলা হঠাৎ মনে হচ্ছে পুজো তো শেষ | কাল দশমী , বিসর্জনের দিন | আর আজ রাতটাই হয়তো ওর আর দীপের গল্পেরও শেষ | এরপর প্রবাসী বাঙালির প্রবাসে ফেরার সময় চলে আসবে | তখন ! তখন তো আর এই মিষ্টি মুখের ছেলেটাকে দেখতে পাবে না কখনো ! আর হয়তো কোনোদিনও দীপ আসবে না ওর এই শহরে | হ্যাঁ, ফোন আছে | কিন্তু চারদিনের আলাপে কে ই বা কাকে মনে রেখে ফোন করে ! আর ফিরে গিয়ে দীপের জীবনেও অনেক ব্যস্ততা এসে ঘিরে ধরবে | হসপিটাল , পেশেন্টস , ওখানকার বন্ধু বান্ধব , তখন হয়তো ভুলেও আর কথার কথা মনে পরবে না | আর এটাই তো স্বাভাবিক | এই ক দিনের আলাপে কেনই বা মনে রাখবে কেউ ! ভেবেই মুখটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিলো কথার | কালো মেঘ এসে ভিড় করছিলো ওর চারিদিকে যেন | কিন্তু তখনই হঠাৎ দীপের নামটা মাইকে এনাউন্স হওয়ায় কথার সম্ভিত ফিরলো | মনে হলো , চারিদিকের কালো মেঘ কেটে যেন এক টুকরো রোদ এসেছে ওর সামনে | আর ও নিস্পলকে তাকিয়ে রইলো সেই রোদের দিকে |
সেইদিন পাড়ার ফাংশনে দীপ নিজের পছন্দের গানটাই গেয়েছিল | ” খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি , আমার মনের ভিতরে |” তবে আজকে এই গানের সুর ওর মন খারাপ করে দেয়নি | বরং নতুন করে একটা স্বপ্ন দেখিয়েছি | নতুন খেলাঘর তৈরী করার স্বপ্ন | জানে না , এই স্বপ্নের পরিণতি কি ! এই কয়েকটা মাত্র দিনে কারোর মনে জায়গা করে নেয়া হয়তো আদেও সম্ভব না ! কিন্তু তা ও দীপ নিজের মনের কথা বলবে | তারপর যা হয় দেখা যাবে | আর নিজের মধ্যে কোনো ফিলিংস জমিয়ে রাখবে না ও , এবার এক্সপ্রেশ করার সময় এসেছে | এই ভেবেই সেইদিন ভিড়ের মধ্যে কথার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো | তারপর মনের সব সাহস এক করে কথার কানের কাছে এসে আস্তে করে ওকে ডাকলো | আচমকা দীপকে দেখে কথা একটু অবাক ! ভিড়ের মধ্যে কখন ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি ! তবে কথার অবাক হওয়ার আরোও বাকি ছিল , কারণ দীপ হঠাৎ নিজের মনের কথার ঝাঁপি খুলে বসলো ওর কাছে | চারিদিকের ভিড়ে , ঢাকের আওয়াজের মাঝে ওর কানের কাছে এসে বললো , ” কথা , একটা কথা বলার ছিল | হয়তো শুনে রাগ করবে | মুখের ওপর না বলে দেবে | কারণ মাত্র এই চার দিনে কাউ কে দেখে আর যাই হোক , ভালোবাসা যায় না | কিন্তু কি ভাবে জানি না ,আমি ভালো বেসে ফেলেছি ,তোমাকে | আর আজই একটা ডিসিশন নিয়েছি আমি | মনে কথা জমিয়ে না রাখার ডিসিশন | তাই কিছু না ভেবে বলে ফেললাম সবটা | ” .. এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে চুপ করে গেলো দীপ | এখন শুধুই অপেক্ষা , কথার উত্তরের | কিন্তু কথার মুখেও এখন আর কোনো কথা নেই ! কি হচ্ছে , ব্যাপারটা বুঝতে ওর একটু সময় লাগছে | ভাবতে পারছে না যার জন্য ভেবে ওর এতো মন খারাপ হচ্ছিলো , যাকে আর কখনো দেখতে পাবে না ভেবে ওর চারদিকটা অন্ধকার হয়ে আসছিলো , সে নিজেই হঠাৎ ওর কাছে এসে ও যা শুনতে চায় সব লাইন এর পর লাইন সাজিয়ে বলে দিচ্ছে | বিশ্বাস হচ্ছে না , যেই স্বপ্নগুলো কিছুক্ষন আগেও অধরা লাগছিলো , সেই সব স্বপ্ন নিয়ে সে এসে হাজির হয়েছে ওর সামনে ! কিন্তু কথাকে ওই ভাবে চুপ থাকতে দেখে দীপের মনটা ভেঙে যাচ্ছিলো | তার মানে উত্তরটা ‘না’ ই | হয়তো খুব অপ্রস্তুত হয়ে গেছে এইসব শুনে , তাই এইভাবে চুপ করে গেছে | না , আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোনো লাভ নেই ওর , ভেবেই দীপ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো ,আর তখনই কথা ওর হাতটা শক্ত করে ধরে নিলো , আর তারপর ঢাকের আওয়াজ , ভিড় , সব এড়িয়ে ওর কানের কাছে এসে বললো , ” এই কদিনে তোমাকে সহ্য করার অভ্যেস হয়ে গেছে আমার | তাই সারা জীবনের পার্টনারশিপে কোনো প্রব্লেম নেই | তবে হ্যাঁ, ঝগড়া কিন্তু আগের মতনই করবো | আসলে ওটা না করলে ঠিক জমবে না ব্যাপারটা | রাজি তো এই শর্তে ?”
দীপের মুখে এবার চওড়া হাসি | ভাবতে পারেনি এই রকম একটা পজিটিভ আনসার পাবে ! ভাবেনি যে এই ঝগড়ুটে পাগল মেয়েটাকে সারা জীবনের মতন নিজের করে পাবে ! আজ তাই দীপও কথার হাতটাকে শক্ত করে ধরলো | সামনে এখন ধুনুচি নাচ চলছে | ঢাকের তালে ধুনোর ধোঁয়ায় পা মেলাচ্ছে পাড়ার ছেলেরা | আর লোকের ভিড়ে , সবার অজান্তে , দুটো মন একসঙ্গে তাল মেলাচ্ছে | দীপ আর কথার আজ থেকে একটা নতুন গল্পের শুরু হলো | নতুন করে খেলাঘর বাঁধার গল্পের | বিসর্জনের আগেই যেই শিউলি ফুলগুলো হারিয়ে গিয়েছিলো ওদের জীবন থেকে , সেই শিউলি গুলোকে একসাথে জড়ো করে , মুঠো বন্দি করে, এই শরৎ ফিরিয়ে দিয়েছে ওদের কাছে | তাই আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখার সময় শুরু হয়েছে |
আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এই রকম হারানো কিছু শিউলি ফুল আছে | প্রত্যেকের জীবনেই ভেঙে যাওয়ার , শেষ হয়ে যাওয়ার গল্প আছে | আর প্রত্যেকেরই হয়তো একটা অপেক্ষা আছে ! হারানো শিউলি ফুল গুলোকে ফেরত পাওয়ার অপেক্ষা | একটা এই রকম শরৎ এর অপেক্ষা |
——— <সমাপ্ত>———–
( এই রকম মন কেমন করা উপন্যাস পড়ার জন্য সংগ্রহ করতে পারেন আমার নতুন বই ‘ মন কেমনের গল্প ‘ এবার হার্ড কপি হিসেবে। বইটি প্রি বুকিং এর জন্য হোয়াটস অ্যাপ করতে পারেন 8420275853 নম্বরে। বইটির মূল্য মাত্র 150 টাকা। এছাড়া https://shopizen.app.link/cU0E47ExtPb এই লিঙ্কে ক্লিক করে বইটি শপিজেন এর ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি বুক করতে পারেন। বইটি পনেরো দিনের মধ্যে আপনার এড্রেস এ পোস্ট হয়ে যাবে। এছাড়াও 25 ডিসেম্বর থেকে বইটি নিউটাউন বইমেলায় শপিজেন এর স্টলেও পাওয়া যাবে। )