#শিউলি_পাওয়া <সপ্তম পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১১>
অষ্টমীর সকাল | মানেই মণ্ডপে অঞ্জলি দেয়ার লাইন , মাইকে এনাউন্সমেন্ট ক রাউন্ড অঞ্জলি হয়েছে , আর ক রাউণ্ড অঞ্জলি এখনো বাকি আছে , সব দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর মধ্যে অদ্ভুত একটা তাড়া , কে আগে ফুল পাবে , কে আগে ফুল ছুঁড়ে মায়ের পায়ের কাছে নিজের মনের আর্জিগুলো পৌঁছে দিতে পারবে ! চারিদিকে যেন একটা হুড়োহুড়ি , ধাক্কাধাক্কি | দীপ এইসবই দেখছিলো মণ্ডপের একটা কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে | খুব মন দিয়ে | আসলে এই সব দৃশ্যগুলো ওর কাছে ভীষণ নতুন | বোম্বেতে থাকার সময় কোনো অষ্টমীর সকালেই আর গরজ করে উপোষ করে অঞ্জলি দিতে যায়নি | আর কোনোদিনই বিশেষ একটা উইশ লিস্ট ছিল না ওর মনে | আসলে দীপের কাছে ছোটবেলা থেকেই জীবন মানে হলো এডজাস্টমেন্ট | আর এমন একটা হিসেব, যেখানে চাওয়া পাওয়ার লিস্টগুলো মেলে না বিশেষ | তাই ঠাকুরের পায়ে ফুল ছুঁড়তে যাওয়ার কম্পিটিশনে ও কখনো নামও লেখায়নি নিজের ! তবে আজ এসেছে অনিন্দর মা বাবার জন্য | স্পেশালি অঞ্জলি দেয়ার জন্য ওরা একটা তসরের পাঞ্জাবি গিফ্ট করেছে দীপকে | তাই আজকে ওদের মন রাখতেই এই লাইনে দাঁড়ানো | এইসবই ভাবছিলো মনে মনে, তখনই হঠাৎ একজনের গলার আওয়াজ শুনলো ,
” কি হলো ? কি এতো ভাবছো মন দিয়ে ? তবে একটা কমপ্লিমেন্ট আজ দিতেই হচ্ছে | পাঞ্জাবিতে বেশ মানিয়েছে কিন্তু |” …
কথার মুখে এই কথাটা শুনে দীপের মুখে হাসি .. ” থ্যাংক ইউ .. আই এম অনার্ড … কিন্তু আজকে তোমাকেও একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি | শাড়ি পড়লে বেশ আলাদাই লাগে তোমাকে | লুকিং বিউটিফুল .. “….
যাক , নোটিশ করেছে তাহলে | ভেবেই কথার মনটা খুশি খুশি হয়ে গেলো | এর মধ্যে অঞ্জলি দেয়ার ডাক পড়ে গেছে ওদের | এটাই শেষ ব্যাচ | এবার মিস করলে আবার পরের বছর ডাক আসবে | ভেবেই তাড়াহুড়ো করে কথা আর দীপ ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালো | আজকে ওরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অঞ্জলির মন্ত্রোচ্চারণ করলো | সেই চতুর্থীর দিন যখন প্রথম দেখা হয়েছিল তখন তো ওরা ভাবতেই পারেনি যে ওদের মধ্যে ঝগড়া ছাড়াও কখনো নর্মাল কথা হতে পারে ! তবে আজ সব হিসাব পাল্টে গেছে | আসলে এটাই তো জীবনের নিয়ম | মানুষ যেটা ভাবে না কখনো , বেশির ভাগ সময় ঠিক সেই সেই জিনিসগুলোই তার জীবনে ঘটে যায় | এই যেমন এখন দীপ কথাকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে ফেললো, একেবারে হিসেবের বাইরের ,
” তুমি আজকে সন্ধ্যেবেলা কি করছো ? কোনো প্ল্যান আছে ?”
” আর কিসের প্ল্যান ! দিদি তো অনিন্দদাকে পেয়ে আমাকে ভুলেই গেছে | তাই নো প্ল্যান |”
” আমারও সেম কেস | ভূমিকে পেয়ে আমার বন্ধু আর আমাকে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না | এনিওয়ে , কি আর করা যাবে ! তো আমরা দুজনে আজকে একসঙ্গে ঠাকুর দেখতে পারি না ? ”
এই প্রস্তাবটা শুনে কথা চোখ বড় বড় করে বললো,
” আমার সাথে ঠাকুর দেখবে ! তুমি ! .. আচ্ছা একজন একদিন আমাকে বলেছিলো যে আমি না কি এতো বকবক করি যে লোকজনের মাথা খারাপ হয়ে যায় | তারপরেও ?”
এই প্রশ্নে দীপ আলতো হেসে বলেছিল,
” এখন অভ্যাস হয়ে গেছে | চার দিন তো হলো |”
” ওহ , আচ্ছা আচ্ছা | বুঝলাম |” ……. কথাটা শেষ করেই কথার মুখে এক চিলতে হাসি | এখন আর দীপের কথায় রাগ হয় না ওর | বরং অদ্ভুত একটা ভালো লাগা ঘিরে ধরে মনটাকে | তাহলে কি কথারও অভ্যাস হয়ে গেছে ! সত্যিই তো , চারটে দিন কেটে গেলো | দেখতে দেখতেই |
সেদিন অষ্টমীর সন্ধ্যেবেলা কথা একটু বেশিক্ষণ সময় নিয়ে দাঁড়িয়েছিল আয়নার সামনে | আশমানি রঙের ওড়নার সাথে ম্যাচিং কানের দুলটাকে ঠিক লাগছে তো ! চোখের কাজলটা বেশি হয়ে যায়নি মনে হয় ! আসলে কাজল ছাড়া ও তো নিজের চোখটাকে ভাবতেই পারে না কখনো | আর চুলটা আজকে খোলাই রাখবে | সবাই বলে ওকে না কি খোলা চুলে বেশি সুন্দরী লাগে | কিন্তু আজ কেন এইসব এতো বেশি করে মনে হচ্ছে ! আজকে কি কথা নিজেকে অন্য একজনের চোখ দিয়ে দেখতে চায় ! তাই এতো ভাবনা চিন্তা এসে ভিড় করছে ! কে জানে , আসলে কিছু প্রশ্নের উত্তর এতো সহজে আর এতো তাড়াতাড়ি পাওয়া যায় না | আবার কিছু অনুভূতির কোনো ব্যাখ্যাও অনেক সময় আমাদের মন হাজার খুঁজেও পায় না | কি করছে , কেন করছে সেইসব কারণ গুলো মাঝে মাঝে নিজেরই অজানা হয়ে থাকে | এই যেমন কথা , একদিন আগেও কি ভাবতে পেরেছিলো যে ওই ঝগড়ুটে ছেলেটার মুখ আজকে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে কাজল লাগাতে লাগাতে হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠবে ! একটা ভালো লাগা ছড়িয়ে থাকবে ওর চারিদিকে ওই প্রবাসী বাঙালির জন্য ! ওর কথা ভাবলেই হঠাৎ মুখে একটা হাসি চলে আসবে, একদম বিনা নোটিশে ! না , সত্যি এতো কিছু ভাবেনি কখনো | এইসবই হচ্ছে একদম হিসাবের বাইরে | উপরি পাওনা |
এইসব ভাবনার ভিড়েই সেইদিন ঠিক সাতটার সময় পাড়ার মণ্ডপের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল কথা | দীপ আসলেই একসঙ্গে বেরোবে | অষ্টমীর সন্ধ্যেবেলার পুজো শুরু হয়েছে এখন | মণ্ডপে বেশ ভালোই ভিড় | অনেক অচেনা লোক ওর আশেপাশে | কিন্তু কথার চোখ এদিক ওদিক তাকিয়ে সেই একটা চেনা মুখকেই খুঁজছে ! আর তখনই ভিড় ভেঙে সেই ছেলেটা হঠাৎ ওর সামনে |
আজকে কি এই আশমানি রঙের ওড়নায় কথাকে রোজের থেকে একটু বেশিই সুন্দরী লাগছে ! কথাটা মনের মধ্যে এসেই মিলিয়ে গেলো দীপের | কি হচ্ছে আজকাল কে জানে ! মাঝে মাঝেই এই রকম ওলোট পালট চিন্তা মাথায় আসছে এই মেয়েটাকে দেখে | দু দিন আগেও ঠিক এই রকমটা ছিল না | তখন তো কথার আর এক নাম মাথা ব্যাথা ছিল দীপের কাছে | যার সাথে দশ মিনিট শান্তি স্থাপন করে চলা অসম্ভব | যার সাথে কথা কম আর ঝগড়া বেশি হতে পারে , ব্যাস | কিন্তু এখন তো আর এই রকমটা মনে হয় না | এই যেমন আজকে সকালবেলা অঞ্জলি দেয়ার সময় মনে হলো সন্ধ্যেটা এই মেয়েটার সাথে কাটালে কেমন হয় ! তারপর এখন , ঠাকুর দেখতে দেখতে , একসঙ্গে এই ভিড় রাস্তায় পা মেলাতে মেলাতে , আইসক্রিম , ফুচকা আর ভেলপুরীর মাঝে একটা আলাদা ভালো লাগা ঘিরে ধরে আছে ওর মনটাকে | মনেই হচ্ছে না যে সঙ্গে আছে সে মাত্র চার দিনের চেনা , বরং মনে হচ্ছে যেন অনেকদিন হয়ে গেছে ওদের দেখা হয়ে , অনেক সময় কাটিয়েছে ওরা একসঙ্গে , অনেক রাস্তা হেঁটেছে একে অপরের সাথে পা মিলিয়ে ! আচ্ছা , মানুষের মন কি এতটাই পরিবর্তনশীল ! যে কোনো কারণ ছাড়াই , কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই , হঠাৎ করে এক মুহূর্তেই একজন অচেনা কেউ খুব চেনা হয়ে যায় , খুব নিজের হয়ে যায় | যার সাথে জীবনেও দরকার ছাড়া কথা হবে না বলে একটা সময় মনে হয়েছিল , তাকেই আজকে নিজের পুরো জীবনের পাতাগুলো পড়ে শোনাতে ইচ্ছে করে | যেই কথাগুলো কখনো কাউকে শেয়ার করা হয়নি , সেইসব জমা কথাই হঠাৎ করে বলে ফেলতে ইচ্ছে করে ! এইসবই ভাবছিলো মাঠের ধারে বসে বসে | এটা চুঁচুড়ার সেকেন্ড গ্রাউন্ড | আগে পড়ে আরো দুটো মাঠ আছে | আর তার মাঝখানে দিয়ে চলে গেছে রাস্তা | সেই রাস্তার পাশে সার দিয়ে লাগানো অনেক গাছ | পুজোর জন্য এই পুরো মাঠের ধারটাকেই আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে | ছোট ছোট টুনিগুলো যেন তারার মতন জ্বলছে চারিদিকে | আর একটু দূরেই আবার মহসিন কলেজ | সেখানে বেশ বড়ো করে একটা দূর্গা পুজো হয় | সেই পুজো মণ্ডপের মাইকেই বাজানো হচ্ছে রবীন্দ্রসংগীত , ” খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি , আমার মনের ভিতরে ||” , গানটা দীপের খুব প্রিয় ছোট থেকেই | দিদা মাঝে মাঝে গুনগুন করতো, দাদুর আবদারে আবার কখনো কখনো তানপুরা নিয়ে গানটা শোনাতেও বসে পড়তো | আর এই গানের কথাগুলো দীপের মনের কষ্টটাকে যেন বাড়িয়ে দিতো আরও বেশি করে ! ও নিজেও তো ছোট থেকে একটা ‘খেলাঘর’ই খুঁজেছে নিজের জন্য | এমন একটা ঘর , যেখানে দিনের শেষে ফিরে যেতে পারবে | যেই ঘরের দরজা খুলে অপেক্ষা করবে কিছু নিজের লোক | মা , বাবা কে নিয়ে একটা ছোট্ট ফ্যামিলি | যেখানে কেউ আলাদা না , কেউ দূরের না , সবাই একসাথে , একদম নিজের | এই গানের সুরটা শুনে হঠাৎ এই না পাওয়া গুলো এসে ভিড় করেছিল দীপের মনে , তখনই হঠাৎ কথার আওয়াজে ঘোরটা কাটলো ,” কি হলো দীপ ? চুপ করে যে ?” আর ওর অবচেতন মনটা ভেঙে আবার চেতন মনে ফিরে এলো দীপ | তারপর একটু হেসে বললো ,
” কেন ? দশ মিনিট হয়ে গেছে না কি !”
” আবার শুরু হলো ! না , হয়নি দশ মিনিট | তো ? তাহলে কি চুপ করে যেতে হবে |”
” তো কি বলবো ?”
” আচ্ছা, তোমার ব্যাপারে কিছু বলো | কে কে আছে তোমার বাড়িতে ?”
” কেউ না | আমার বাড়িতে আমি একাই থাকি |”
” মানে ? ” … কথা এই রকম একটা উত্তরের জন্য একেবারেই তৈরী ছিল না | আসলে চারদিনে কখনো আলাদা করে দীপের ব্যাপারে কিছু জানাই হয়নি | তাই একটু অবাকই হলো ! হঠাৎ করে এই প্রশ্নটা করে ঠিক করলো তো ! দীপের থমথমে মুখটা দেখে এটাই মনে হচ্ছিলো ওর | তবে কয়েক সেকেন্ডের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে দীপ নিজেই বলে উঠলো ,
” আমি তখন পাঁচ বছরের ছিলাম | এই রকমই একটা দূর্গা পুজোর আগে বাবা মার্ ডিভোর্সটা হয়ে যায় | তারপর থেকেই হোস্টেল এ !”
কথা এই রকম একটা উত্তর পাবে , এটা ভাবতেও পারেনি ! তাই কোনো রকমে নিজেকে সামলে বলেছিলো, ” ওহ , আই এম রিয়ালি সরি | আমি এই ব্যাপারে সত্যি কিছু জানতাম না |”
দীপ এটা শুনে একটু জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলেছিলো , ” তুমি কেন সরি বলছো ! যাদের বলার তারা তো কখনো বলেনি | কখনো মনেও হয়নি ওদের | মা আর বাবা দুজনেই আবার বিয়ে করে নিয়েছে | বেশ ভালোই আছে এখন ওরা | নতুন লাইফ , নতুন ফ্যামিলির সাথে | ওহ হ্যাঁ, কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে , প্রত্যেক মাসে আমার একাউন্টে ভালোই টাকা ট্রান্সফার করে ওরা | ব্যাস, আর কি ! দ্বায়িত্ব শেষ |”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেছিল সেইদিন দীপ | অনেকদিনের জমা কথা, জমাট কষ্ট | একটা দম বন্ধ করা যন্ত্রণা, যেটা চব্বিশটা ঘন্টা ওর মধ্যে থাকে | যার ভাগ কখনো কাউকে দেয়া যায় না ! এইসব ভাবতে ভাবতেই আনমনে কথার চোখের দিকে তাকিয়েছিলো দীপ | আর খেয়াল করেছিল এখন কথার চোখটাও ভিজে | নিজের কষ্টের একটা ভাগ যেন ও কথার চোখে দেখতে পাচ্ছিলো সেইদিন | কখনো ভাবেনি , এই চারদিনের আলাপে কাউকে নিজের যন্ত্রণার ভাগও দেয়া যায় ! তাই নিস্পলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়েছিলো | আর তখনই অনুভব করেছিল একটা স্পর্শ | ওর হাতের ওপর কথার হাতের স্পর্শ | না , সেইদিন আর কোনো কথা বলেনি কথা | কোনো স্বান্তনা দেয়ারও চেষ্টা করেনি দীপকে | শুধু খুব শক্ত করে ওর হাতটা ধরেছিলো | যেন বোঝাতে চেয়েছিলো একটা স্পর্শে , যে ‘তুমি একা নও , সঙ্গে আছি , সঙ্গে থাকবো |’
<চলবে>