#শিউলি_পাওয়া <ষষ্ট পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১০>
পুজোর সময় ঘড়ির কাঁটা যেন একটু বেশিই তাড়াতাড়ি এগোয় ! অন্তত প্রত্যেকটা বাঙালির তো তাই মনে হয় | এই যেমন সেইদিন , চোখের পলকেই সপ্তমীর সকাল পেরিয়ে সন্ধ্যে নেমে এলো | কিন্তু অনিন্দর আর টিকি খুঁজে পাচ্ছে না দীপ , অনেকক্ষণ ধরেই | ভেবেছিলো সন্ধ্যেবেলা কোথাও একটা বেরোবে , কিন্তু বন্ধু যেহেতু তার গার্ল ফ্রেন্ডকে নিয়ে বেপাত্তা , তাই বেরোনোর প্ল্যান ক্যানসেল করে পুজো মণ্ডপে গিয়েই হাজির হতে হলো দীপকে | কি আর করবে , সপ্তমীর সন্ধ্যে তো আর বাড়ি বসে কাটানো যায় না ! আর সত্যি কথা বলতে কি ,এই মণ্ডপে এসে বেশ ভালোই লাগছে | এতো লোকের ভিড় , ঠাকুর মশাই এর মন্ত্রোচ্চারণ , সন্ধ্যের আরতি , চারিদিকের ধুনোর ধোঁয়া , আর ধূপের গন্ধ , তার মধ্যে ঢাকের আওয়াজ যেন পুরো মণ্ডপটাকেই একেবারে জমজমাট করে রেখেছে | আর অদ্ভুত ব্যাপার হলো বাচ্চা থেকে বয়স্ক , এই মণ্ডপে এখন যারা যারাই বসে আছে, তাদের প্রত্যেকের মুখে একটা আনন্দ ছড়িয়ে | যাকে বলে পুজোর আনন্দ | এই আনন্দ ভরা মুখগুলো মনে হয় শুধু মাত্র বছরেই এই চারটে দিনই দেখা যায় ! এটা হচ্ছে অনেকটা দূর্গা পুজো স্পেশাল অফারের মতন | ষষ্ঠী , সপ্তমী , অষ্টমী , নবমীর সাথে সাথে সবার হাসি হাসি মুখ ফ্রি ফ্রি ফ্রি ! কথাটা ভেবেই দীপের মুখেও আনমনে একটা হাসি চলে এলো | আর তখনই হঠাৎ ঢাকের আওয়াজ , ঠাকুর মশাই এর মন্ত্রোচ্চারণ , কাশর ঘন্টার ঢং ঢং শব্দ ভেদ করে সেই চেনা গলার আওয়াজটা ওর কানে এলো ,
” কি ব্যাপার ? এইভাবে একা একা দাঁড়িয়ে হাসছো যে ? হ্যাঁ , অবশ্য পাগলেরা অনেক কিছুই করে | তোমার কাছে তো এটাই নরমাল | ”
এই কথা মেয়েটা কথা না শুনিয়ে যেন দু সেকেন্ডও থাকতে পারে না ! দিলো হাসিখুশি মুডটার বারোটা বাজিয়ে | এটা ভেবেই দীপ ঘাড় ঘুরিয়ে বললো ,
” আচ্ছা , কথা , তোমার প্রবলেম কি ? এই সপ্তমীর সন্ধ্যেবেলা তো লোকে ঠাকুর দেখে টাইমপাস করে | তাহলে তুমি কেন আমার পা এ পা লাগিয়ে ঝগড়া করে সময় নষ্ট করছো ? ”
এটা শুনে কথার মুখটা একটু যেন অন্ধকার হয়ে গেলো , ” তো কার সাথে ঠাকুর দেখবো শুনি ! দিদি আর অনিন্দদা তো প্রেম করতেই ব্যস্ত | আর ঠাকুর দেখা তো দূরে থাক , কিছুক্ষন বাদেই পাড়ায় অন্তাক্ষরী শুরু হবে | প্রত্যেকবার আমি আর দিদি টিমে নাম দিই , আর ফার্স্ট হয়ে পাঁচশো টাকা প্রাইজ মনি জিতে আসি | কিন্তু এইবার তো সেটাও হবে না | কারণ আমার পার্টনার সকাল থেকেই বেপাত্তা তার হিরোর সাথে | তাই কি আর করবো , ঝগড়া করেই টাইম পাশ করছি | ”
কথার এইসব কথা শুনে দীপ হাজার চেষ্টা করেও নিজের হাসি কন্ট্রোল করতে পারলো না ! সত্যি মেয়েটা যেন মঙ্গল গ্রহ থেকেই আমদানি হয়েছে | এই রকম কথাবার্তা জীবনে কারোর মুখে শোনেনি ! কেউ ঝগড়া করেও টাইম পাশ করে ! এটাও সম্ভব ! … যাই হোক, কোনো মতে নিজের হাসিটাকে কন্ট্রোল করে দীপ কথাকে একটা প্রস্তাব দিয়েই ফেললো এবার , ” বুঝলাম | তো যদি অন্তাক্ষরী তে নাম দেয়ার হয় , তাহলে আমি তোমার পার্টনার হতে পারি | তুমি গিয়ে আমার আর তোমার নামটা দিয়ে আসো |”
যদিও কথা এতো সহজে এই প্রস্তাবটা নিতে পারলো না দীপের | দু সেকেন্ড ভেবে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতন মুখ করে বললো , ” কিন্তু তোমার আর আমার পার্টনারশিপ তো আজ সকালেই শেষ হয়ে গেছে | দিদি আর অনিন্দদার হ্যাপি এন্ডিং এর পর |”
এটা শুনে দীপ ভদ্রতার হাসি হেসে বললো , ” ভালো , তাহলে দিতে হবে না নাম | আমার কি ! দাঁড়িয়ে থাকো একা একা | এই জন্য বলে কারোর ভালো করতে নেই !”
এই রে , এই ছেলে তো সত্যি ক্ষেপে গেছে | আর যতই ছেলেটা পাগল আর ঝগড়ুটে হোক , পাঁচশো টাকা প্রাইজ মনির জন্য এর সাথে আর একবার পার্টনারশীপ তো করাই যায় ! , তাই কথা কিছু কথা সাজিয়ে এবার দীপকে ম্যানেজ করার জন্য বললো , ” আচ্ছা , না না | সরি | রেগে যেও না | আমি নাম দিয়ে আসছি আমাদের | তবে একটা কথা , ভালো ভাবে গাইতে হবে কিন্তু | আমার রেকর্ড ব্রেক হলে চলবে না | এইবারও ফার্স্ট হতেই হবে , যেন তেনো প্রকারেন , বুঝলে |”
সেইদিন এরপর গানের তালে , সুরের ছন্দে কখন যে দুটো ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছিলো , ওরা দুজনে বুঝতেও পারেনি ! তবে হ্যাঁ, দীপ কথা কে একটুও ডিসএপয়েন্ট করেনি কিন্তু | এইবারও ওর রেকর্ড ব্রেক হয়নি | গানের অন্তাক্ষরীতে ফার্স্ট হয়ে পাঁচশো টাকার প্রাইজ মনিটা এখন কথারই পকেটে | আর এটা যার জন্য সম্ভব হলো , তাকে তো একটা থ্যাংক ইউ বলতেই হয় এবার | আফটার অল ভদ্রতা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে ! তাই কথা বেশ হাসি মুখেই বললো ,
” থ্যাংক ইউ সো মাচ .. তুমি সত্যিই খুব ভালো গেয়েছো | কাকু সেইদিন ঠিক কথাই বলেছিলো , তুমি আসলেই একজন ভালো সিঙ্গার |” ..
দীপ আর যাই হোক, কথার কাছ থেকে ‘থ্যাংক ইউ’ শব্দটা শুনবে এটা কখনোই এক্সপেক্ট করেনি | তাই একটু বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে বলেছিলো , ” বাবা , এই ওয়ার্ড দুটোও জানো তাহলে ! থ্যাংক ইউ !” ..
এটা শুনে কথার মুখ গম্ভীর , ” সব সময় ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতেই হবে ? কখনো সোজা ভাবে কথা বলা যায় না ?”
এই রে , আবার রেগে গেছে মেয়েটা | তবে আজ কি জানি কেন , এই মেয়েটার সাথে একদম ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না দীপের | তাই ম্যানেজ করার জন্য বললো , ” আচ্ছা, রিয়ালি সরি | ঐভাবে বলাটা ঠিক হয়নি | আর একটা থ্যাংক ইউ তো তোমারও পাওনা আছে | আজকে তোমার জন্যই এই পাড়ার অন্তাক্ষরীতে নাম দিলাম , আর এতো সুন্দর টাইমটা কাটলো | সত্যি, পাড়ার পুজোর ব্যাপারটাই আলাদা | এখানে এসে আমার এতো ভালো লাগছে | ইনফ্যাক্ট এই পুজোটাই আমার লাইফের বেস্ট পুজো | এর আগে তো কখনোই এইভাবে পুজোটাকে ফিলই করিনি | সারা জীবনই তো একা একাই !” .. না , কথাটা আর শেষ করলো না দীপ | মাঝখানেই থেমে গেলো | কিছু কথা হয়তো এই রকমই হয় , কাউকে বলা যায় না | এইভাবে হঠাৎ করে মাঝখানে থামিয়ে দিতে হয় | তবে কথা ব্যাপারটা খেয়াল করেছিল , তাই জিজ্ঞেস করেই ফেললো , ” একা একা মানে ? তুমি চুপ হয়ে গেলে কেন ?” ….
না, চুপ হয়ে যাওয়ার কারণটা দীপের একান্তই নিজের | তার ভাগ কাউকেই দেয়া যাবে না | তাই কথা ঘুরিয়ে বললো , ” কিছু না | এমনি | যাও , এখন বাড়ি যাও | অনেক রাত হলো | কাল তো আবার অষ্টমীর অঞ্জলি আছে সকাল সকাল | দেখা হবে তখন |”
এবার কথাও হেসে উত্তর দিলো , “হ্যাঁ , দেখা হবে , আসি |”
সেইদিন প্রথম একটা ভালো লাগার রেশ নিয়ে কথা বাড়ি ফিরলো | একটা অদ্ভুত ভালো লাগা , যার কারণ ও ঠিক জানে না | তাহলে কি ওই ঝগড়ুটে পাগল ছেলেটা একটু হলেও নিজের জায়গা ওর মনে করে নিয়েছে ! না কি ওর মনে এই জায়গাটা সেই ময়ূরপঙ্খী ঘাটের প্রথম দেখা থেকেই ছিল ! আজ সেটা হঠাৎ বুঝতে পারলো | কে জানে ! সাধে কি বলে মানুষের মন খুব জটিল | তাই তো কিছু প্রশ্নের উত্তর মনের আনাচে কানাচে হাজার খুঁজলেও এতো সহজে পাওয়া যায় না | ভেবেই একটা হাসি চলে এলো কথার | আজকে আলমারি ঘেঁটে পুজোর বেস্ট শাড়িটা বার করেছে ও | কালকে অঞ্জলি দেয়ার সময় এই লাল রঙের তাঁতের শাড়িটাই পরবে | আচ্ছা , দীপ কি সেটা নোটিশ করবে ! কি জানে ! .. এইসব ভাবতে ভাবতেই বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো কথা | আস্তে আস্তে সপ্তমীর রাত শেষের পথে | কালকে একটা নতুন সূর্য উঠবে | অষ্টমীর ভোর উঁকি দেবে বাঙালির দরজায় | আর কাল আসলেই তো আজকে রাতের অপেক্ষাটাও শেষ হবে | দীপের সাথে আর একবার দেখা হওয়ার অপেক্ষা !
<চলবে>