শিউলি পাওয়া পর্ব-০৫

0
4

#শিউলি__পাওয়া <পঞ্চম পর্ব >
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৯>
আজ সপ্তমী | কথার সকালে ঘুমটা ভাঙলো ঢাকের আওয়াজ শুনে | সত্যি এই চারদিনের সকাল হচ্ছে বছরের বেস্ট চারটে সকাল | চারিদিকে যেন ছড়িয়ে থাকে পুজো পুজো একটা গন্ধ | এই ভেবে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে জানলার ধারে এসে দাঁড়ালো | আর হঠাৎ আনমনে ভূমির দিকে চোখ চলে গেলো | সকাল সাতটার মধ্যেই একেবারে রেডি ! ভিজে চুল , গোলাপি তাঁতের শাড়ি , কপালে ছোট্ট লাল টিপ্ ,….
” দিদি , তোকে কিন্তু আজ ব্যাপক লাগছে দেখতে | “….
” হ্যাঁ, হয়েছে | পুজোর কাজ করতে যেতে হবে প্যান্ডেলে | আর তুই বসে আছিস যে এইভাবে ? স্নান করে রেডি হবি কখন ? আর আমার সাথে প্যান্ডেলে যাবি না কি বন্ধুদের সাথে প্ল্যান আছে কোনো ?”
কথা এর উত্তরটা দিতে যাবে তখনই হঠাৎ ওর ফোনটা বেজে উঠলো | এতো সকালে আবার কে ফোন করলো ! ভেবেই স্ক্রিনে চোখটা রাখলো | দীপের নাম্বারটা মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠছে দেখে নিজেও অবাক , এতো সকালে তো ওকে মনে করার কথা না ! …. এসব ভাবতে ভাবতেই ফোনটা ধরলো | আর এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো , ——- ” কি ? কি বলছো টা কি ? একসিডেন্ট কিভাবে হলো ? খুব সিরিয়াস ! ইশ ,পুজোর সময় অনিন্দদার এই রকম একটা একসিডেন্ট হলো | ভাবতেই পারছি না ! ”
ব্যাস, আর কিছুই শোনার দরকার ছিল না ভূমির | হঠাৎ যেন শরীরটা খুব হালকা লাগছে | মনে হচ্ছে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না | পাশের দরজাটাকে আঁকড়ে ধরে কোনো ভাবে নিজেকে সামলালো | কি বললো কথা ! অনিন্দর একসিডেন্ট ! কি করে হলো ! কালই তো দেখা হয়েছিল | কাল তো সব ঠিকই ছিল | ওরা পাশাপাশি একই রাস্তা ধরে হাঁটলো , একসাথে ঠাকুর দেখলো , শুধু কথাটাই হলো না | সত্যিই তো , কত কথা বাকি আছে ওদের এখনো | সেই সব কথা কি তাহলে কখনো বলা হবে না | অনিন্দ কি আর কখনো ওর কাছে ফিরে আসবে না ! ওই চেনা মুখটা কি আর কখনো দেখতে পারবে না ভূমি ! ভেবেই আর স্থির থাকতে পারলো না ও | দৌড়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো | কিন্তু কোথায় যাবে এখন , কোথায় খুঁজবে অনিন্দকে ? কোন জায়গায় একসিডেন্ট হয়েছে , কিভাবে হয়েছে কিছুই তো জিজ্ঞেস করেনি কথা কে ! তাহলে এখন কি করবে ? হ্যাঁ, অনিন্দর বাড়িতে যাবে ও | অনিন্দর বাড়ি গেলে তো ওর খোঁজ ঠিক পাবে | ইশ , অনিন্দ কতবার ওর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো , কেন মুখ ঘুরিয়ে নিলো ভূমি ! কেন একবারও জিজ্ঞেস করলো না কেমন আছে অনিন্দ | একদিন যেই ভুলটা অনিন্দ করেছিল , আজ কি সেই ভুলটা ভূমি নিজে করলো ! সময় থাকতে থাকতে কাছের মানুষটার ইম্পর্টেন্সটা বুঝলো না ! ওকে দেখেও দেখলো না | চিনেও চিনলো না | তাই কি আজকে অনিন্দও চলে যাচ্ছে | আর ফিরে না আসার জন্য | আজ, এই মুহূর্তে চারিদিকটা যেন অন্ধকার হয়ে আসছে ভূমির | শুধু মনে হচ্ছে আর যদি কখনো ওই চেনা মুখটাকে দেখতে না পায় ! আর যদি কখনো ওই চেনা গলার আওয়াজটা শুনতে না পারে ! যদি সব শেষ হয়ে যায় এই পুজোতেই | তা ও নিজের শরীরের সব শক্তি দিয়ে পা দুটোকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ও | অনিন্দর বাড়ি ওকে আজ পৌঁছতেই হবে | আজ আর কোথাও দাঁড়াবে না | এইসব ভাবনার ভিড়ে যেতে যেতেই হঠাৎ ওর পা টা থমকে গেলো | সামনের জগন্নাথ মন্দিরে ওটা কে দাঁড়িয়ে নমস্কার করছে ! সেই চেনা মুখ , সেই চেনা মানুষটা | অনিন্দ | তার মানে ও একদম ঠিক আছে | কিছুই হয়নি | ভেবেই ভূমি অনিন্দর কাছে দৌড়ে গেলো , আর সারা জীবনের মতন ওকে আঁকড়ে ধরলো | অনিন্দও এই রকম হঠাৎ মেঘ না চাইতেই জলে অবাক ! কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না | যেই মেয়েটা কাল অব্দি ওর সাথে একটা কথাও বলছিলো না , সে আজ নিজে এসে জড়িয়ে ধরলো এইভাবে , মাঝ রাস্তায় ! কিন্তু ওর এইসব ভাবনার ভিড়েই ভূমি বলে উঠলো
” তুমি ঠিক আছো ? তোমার একসিডেন্ট হয়নি ? ”
” একসিডেন্ট ! কার একসিডেন্ট ! ”
” কার একসিডেন্ট মানে ? তোমার একসিডেন্ট ! দীপ যে কল করে বললো | আমি এতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম |”
ভূমির কথা শুনে অনিন্দ যেন আকাশ থেকে পড়লো , ” কি ! দীপ বলেছে আমার একসিডেন্ট হয়েছে ? আমার তো কিছুই মাথায় আসছে না | আমি তো ওর সামনে এই এক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরোলাম , মণ্ডপে যাবো বলে |”
এইসবের উত্তর পেতে অবশ্য আর এক সেকেন্ড বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি ওদের | কারণ দীপ আর কথা এর মধ্যেই জগন্নাথ মন্দিরের সামনে এসে হাজির | আর দুজনের মুখেই এখন জয়ের হাসি | ঠিক এই সিনটাই ওরা দেখতে চেয়েছিলো এতদিন ধরে | আর আজ ফাইনালি এটা সম্ভব হলো | যদিও এখন ভূমি আর অনিন্দর মুখে একটা বিশাল বড়ো কোয়েশ্চেন মার্ক ! কি হচ্ছে , কেন হচ্ছে , ওরা কিছুই বুঝতে পারছে না | তাই বুঝিয়ে বলার দায়িত্বটা দীপ নিজেই নিলো ,
” দ্যাখ , ফার্স্টলি রিয়ালি সরি | আমি আর কথা প্ল্যান করে এই মিথ্যে কথাটা ভূমিকে বলেছি | আসলে কি করবো , এতদিন ধরে এতো প্ল্যানিং করেও তোদের মধ্যে ডিসটেন্সটা কিছুতেই কমাতে পারছিলাম না ! এতো চার্চ ঘুরে , ঠাকুর দেখেও তোদের মধ্যে একটা লাইন কথা হলো না | তাই আমরা দুজনেও খুব ডিপ্রেসেড হয়ে গিয়েছিলাম | সেই জন্য বাধ্য হয়েই হাজারটা সিনেমায় দেখা এই চেনা সিনটাকে তোদের লাইফে এপ্লাই করলাম | আর , কাউকে হারালেই হয়তো তার ইম্পর্টেন্সটা বোঝা যায় ! যেমন ভূমিকে হারিয়ে তুই নিজের লাইফে ওর জায়গাটা বুঝেছিলিস , ঠিক সেইরকমই আজ তোকে হারানোর কথা ভেবেই ভূমি ওর লাইফে তোর ইম্পর্টেন্সটা বুঝলো | আর তোদের গল্পের একটা হ্যাপি এন্ডিং হলো !”
এটা শুনে কথাও নিজের ঘাড়টা নাইন্টি ডিগ্রি এঙ্গেলে হেলিয়ে দীপের কথায় সায় দিয়ে বললো , ” প্লিজ দিদি | আর রাগ করে থাকিস না | মনে মনে তো তুইও অনিন্দদাকে ভালোবাসিস | তাহলে এই লোক দেখানো রাগ করে কি হবে ! আর আজ যদি সত্যি অক্সিডেন্টটা হতো , যদি সত্যি সব শেষ হয়ে যেত , তাহলে তুই কি কখনো আর অনিন্দদাকে ফিরে পেতিস ? এই দু বছরেও তো , আমি জানি , তুই এক সেকেন্ডের জন্যও অনিন্দদাকে ভুলতে পারিসনি | শুধু সবার কাছে দেখাতিস যে তুই ভুলে গিয়েছিস | কিন্তু এই ভাবে প্রিটেন্ড করে তো আর পুরো লাইফটা চালাতে পারবি না | তাই সময় থাকতে থাকতে নিজের ফিলিংসগুলোকে একসেপ্ট করে নে | ”
না, এতো কিছু শোনার পর সেদিন ভূমিও আর মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেনি | আর নিজের কাছে মিথ্যে বলতে পারেনি | অনিন্দ আজও ওর লাইফের পুরোটা জুড়েই আছে | অনিন্দর থাকা না থাকাতে আজও ওর যায় আসে | আজও অনিন্দকে ও সেই প্রথম দিনের মতনই ভালোবাসে | এই মুহূর্তে ,তাই শক্ত করে অনিন্দর হাতটা ধরে ফেললো ভূমি | আর কখনো এই হাতটাকে ছেড়ে দেবে না ও | আর অনিন্দ তো অবাক ! এখনো যেন কিছু বিশ্বাস হচ্ছে না ! একটা দূর্গা পুজোয় ও যাকে সারা জীবনের মতন হারিয়ে ফেলেছিলো , একটা সপ্তমীর সকাল যে সেই হারানো মানুষটাকে আবার ওর কাছে ফিরিয়ে আনবে , সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ! এই শরৎ টা যেন এসেছেই ওদের জীবনের হারানো শিউলি ফুলগুলোকে যত্ন করে , মুঠো ভর্তি করে আবার ওদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য | যেখান থেকে সব শেষ হয়েছিল , সেখান থেকেই একটা নতুন শুরুর জন্য | ওদের গল্পটার একটা হ্যাপি এন্ডিং এর জন্য |

<চলবে>

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে