#শিউলি_পাওয়া <প্রথম পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
(১)
শরৎ মানেই শিউলি ফুলের দিন চলে আসা | চারিদিকে আগমনীর সুর আর পুজো পুজো গন্ধ ।
এরকমই একটা শরৎ এ পুজোর আনন্দে যখন সবাই মাতছে, তখনই দীপের জীবন থেকে কিছু শিউলি ফুল হঠাৎ চলে গেল | সালটা ছিল ১৯৯৩। ওর বয়স তখন মাত্র পাঁচ। ওর মা বাবার ডিভোর্স টা হয়েই গেল ! অনেক দিন ধরেই যদিও কেস চলছিল। একটা সম্পর্কের বোঝা , দীপের বোঝা থেকে মুক্তি পেতে চাইছিলো অলকেশ আর শ্যামলী | দুজনেই সব বাঁধন ভুলে নতুন করে বাঁচতে চাইছিলো | এমন একটা বাঁচা যেখানে পুরোনোর আর কোনো জায়গা নেই , তাই সেই বছরই দীপকে পাঠিয়ে দেয়া হলো দার্জিলিং এর এস.টি.জোসেফ বোর্ডিং স্কুলে | দূর্গা পুজোটা কাটলো সেইবার কার্শিয়াং এ কাকার বাড়িতে, একা একা | এরপর স্কুলের ছুটিতে কখনো কখনো আসতো কলকাতায়, ওর দাদুর বাড়িতে, তবে পুজো তে আর কখনই আসা হয়নি।
যাই হোক , স্কুল লাইফ শেষ করে দীপ চলে গেল বোম্বেতে ডাক্তারি পড়তে, তারপর শীত গ্রীষ্ম বসন্ত পেড়িয়ে জীবনের ত্রিশটা বছর কেটে গেছে | এখন ও বোম্বের হিরানান্দানি হসপিটাল এর একজন নাম করা গাইনোকোলজিস্ট । জীবনের এই এতগুলো বছর ওকে একা থাকতে শিখিয়ে দিয়েছে। আগে যখন ছোট ছিল তখন একটা আশা ছিল যে অন্যদের মতন ওর বাবা মা ও আসবে একদিন ঠিকই দেখা করতে। কিন্তু সেইসব কিছুই হয়নি কখনো ! একবারের জন্যও মা বাবা আসেনি | তার বদলে এসেছে কিছু সাজানো কথা , অজুহাত |…..” খুব কাজের চাপ, আসতে পারবে না রে এবার |….”দেখা করার সময় নেই একদম |” , এইসব কথাগুলো ছোট থেকে শুনে শুনে এখন তো ওর অভ্যাসই হয়ে গেছে। তাই নিজেই আস্তে আস্তে ফোন করা কমিয়ে দিয়েছে। বাড়তে দিয়েছে দূরত্ব |
আসলে দীপ জানে , ওরা যোগাযোগ রাখতেই চায়নি কখনো | দুজনেই নতুন বিয়ে করেছে। আর এই নতুন সংসারে তারা বেশ খুশি | তাই কেউই পুরনো স্মৃতির বোঝা টানতে চায় না | দীপ আসলে ওদের জীবনে আর কিছুই না ! শুধুই একটা দ্বায়িত্ব । ও এটা বুঝে গেছে যে এই এতো বড়ো পৃথিবীতে ওর নিজের বলতে কেউ নেই | একটা শরৎ ওর জীবন থেকে নিজের সব মানুষগুলোকে কেড়ে নিয়ে ওকে ফেরৎ দিয়েছে শুধুই একাকিত্ব | যেই একাকিত্বকে সঙ্গী করেই হয়তো কাটিয়ে দিতে হবে সারাটা জীবন |
কিন্তু এই বারের শরৎটা একটু আলাদা দীপের জন্য। ওর হিরানান্দ হসপিটাল এ এসে একটা খুব ভালো বন্ধু হয়েছে। ডা: অনিন্দ চক্রবর্তী। বাঙালি বলে প্রথমেই আলাপটা জমে গিয়াছিল। ওরা তো এখন একই ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকে | আগে দীপের বাংলা বলতে একটু অসুবিধা ছিল, কিন্তু এখন অনিন্দর সাথে থাকতে থাকতে বাংলাটা বেশ রপ্ত করে নিয়েছে |
এইবার পুজোতে অনিন্দ যাবে ওর বাড়ি হুগলী | আর অনিন্দ কিছুতেই দীপকে ছাড়া যাবে না | তাই অনিন্দর জোরাজুরিতে না না করে শেষে হ্যাঁ বলতেই হলো ওকে | আর অনিন্দর মুখে এত বার ওর মা বাবার কথা শুনেছে যে একবার দেখা করার ইচ্ছা দীপেরও ছিল ! আর দূর্গা পুজোটাও এই সুযোগে এনজয় করা যাবে। ও তো এই পুজো টা কে কখনো এর আগে ভালো করে ফীল ই করেনি ! তাই একটা আলাদা অপেক্ষা ছিল ওর চতুর্থীর দিনটার জন্য। ওই দিন ই তো ওদের ফ্লাইট।
<২>
অনেক দূর থেকে আসা একটা রাস্তা এসে মিশেছে সবুজ মাঠ আর নীল দিগন্তের ওপারে | আর সেই রাস্তার পাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাদা কাশফুলের বন | সেই কাশফুলগুলোর মাঝখান থেকে উঁকি দিচ্ছে নীল রঙের আকাশ | পেঁজা তুলোর মতন মেঘগুলো সেই আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে ওদিক | আর সেই কাশফুল , নীল আকাশের মাঝখানে একটা দুর্গার মুখ | কেউ যেন তুলির টানে এঁকে দিচ্ছে সেই দূর্গা প্রতিমার চোখ | সেই প্রতিমার আসে পাশে ছড়িয়ে আছে কিছু শিউলি ফুল | এই শিউলি ফুলের ভিড়েই হঠাৎ কানে এলো ওর নাম , —–” দীপ , এই দীপ , উঠবি না ঘুম থেকে ! চারটে বেজে গেছে তো | দু ঘন্টা বাদে ফ্লাইট আমাদের !” ……….. চেনা গলার আওয়াজটা কানে আসতেই জেগে গেলো দীপ , সামনে অনিন্দ দাঁড়িয়ে | ওহ , আজই তো চতুর্থী | কিছুক্ষণ বাদে ওদের ফ্লাইট | ভেবেই ঘুমের ঘোরটা কেটে গেলো ওর | তবে স্বপ্নের রেশটা এখনো আছে মনে মনে ! যাই হোক, আর দেরি করা যাবে না | তাড়াতাড়ি রেডি হতে হবে | নইলে সত্যি সত্যিই ফ্লাইটটা মিস করে ফেলবে |
সেইদিন ঠিক টাইমেই এয়ারপোর্টে পৌঁছেছিল ওরা | তবে ফ্লাইটে বসেও অনিন্দ যেন একটু অন্যমনস্ক | কি একটা ভাবছে অনেকক্ষণ ধরে ! দীপ ব্যাপারটা বুঝেছে যদিও | কার কথা ভাবছে অনিন্দ !
——” ভূমির ব্যাপারে চিন্তা করছিস তো ? বুঝেছি | চিন্তা করিস না এতো | তোকে দেখলে ও আর রেগে থাকতে পারবে না |”
দীপের কথাটা শুনে অনিন্দর একটা দীর্ঘ্য নিঃশ্বাস আপনাআপনিই চলে এলো , ” জানি না কি হবে ! দু বছর আগে দূর্গা পুজোর সময়ই তো ব্রেক আপটা করেছিলাম আমি | তখন বুঝতে পারিনি যে ভূমি আমার লাইফে এতোটা ইম্পর্টেন্ট | ও সত্যি ভালোবাসতো আমাকে | কিন্তু তখন এই সব নিয়ে বিশেষ ভাবিনি | আসলে কেরিয়ার ছাড়া কিছু যেন ভাবতেই পারতাম না আমি তখন | ওই দূর্গা পুজোতে কথা ছিল হুগলী যাবো , দেখা করবো ওর সাথে | ও খুব ওয়েট করেছিল জানিস আমার জন্য সেইবার | কিন্তু আমি যাইনি | হিরানন্দ হসপিটালের অফারটা পেয়েই সব ভুলে সোজা ব্যাঙ্গালোর থেকে বোম্বে চলে এসেছিলাম | ভেবেছিলাম আর লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপ রাখা সম্ভব না | তাই একটা ফোন করেই সব শেষ করে দিয়েছিলাম আমি | এইসবের পর প্রথম প্রথম সব ঠিকই ছিল , কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে ওকে মিস করতে শুরু করলাম | যখন দেখলাম সারাদিন পরে আমার কথা শোনার জন্য ওই ফোনটা আর আসছে না , তখন ফিল করলাম যে লাইফে কেরিয়ারটাই সব না | তারপর ভূমিকে অনেকবার ফোন করেছি | কিন্তু ও একবারও ধরেনি | জানিস তো , একটা সময় ছিল যখন ও ফোন করতো , আর আমি ধরার সময় পেতাম না | বা অনেক সময় কত বিরক্তির সঙ্গে কথা বলেছি ওর সাথে | কিন্তু আজ আর ও ফোন ধরে না | এখন আমি বুঝি যে ওই দিনগুলোতে ওর কতটা খারাপ লেগেছিলো | ”
অনিন্দর কথাগুলো শুনে দীপ কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো, ” এই দু বছরে তো তুই হুগলী গিয়েছিলিস কয়েকবার | তো ওর সাথে দেখা হয়নি ?”
” না হয়নি | ও আমাদের ব্রেক আপের পর শান্তিনিকেতন চলে গিয়েছিলো | ওর মাসির বাড়িতে | ওখানেই একটা স্কুলে চাকরি করতো | এই বছর ও চাকরিটা ছেড়ে বাড়ি ফিরেছে | ওর বোনের সাথে তো কন্ট্যাক্ট আছে আমার | ও ই এইসব খবরগুলো দিয়েছে আমাকে | তাই তো এই পুজোটা আমার জন্য খুব দামি | ওকে ফিরে পাওয়ার হয়তো এটাই শেষ চান্স !” ……
অনিন্দর কথাগুলো শুনে দীপ একটু হাসার চেষ্টা করে বললো, ” ডোন্ট ওরি , সব ঠিক হয়ে যাবে | এন্ড অফ দ্যা ডে হ্যাপি এন্ডিংই ওয়েট করছে তোর জন্য | সো ডোন্ট লুজ হোপ … ”
এইসব কথা বলে অনিন্দকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও আসলে দীপ জানে কিছু কিছু সময় মানুষের জীবনে আসে , যখন সে সব হারিয়ে ফেলা আর সব ফিরে পাওয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে | অনিন্দও আজ সেইরকমই একটা সরলরেখার ওপর দাঁড়িয়ে | এখন শুধু একটাই অপেক্ষা , জীবন ওকে হারাবে , না কি হারানো সব কিছু ফিরিয়ে দেবে!
< চলবে >