#শতরঞ্জির_শত_রঙ
#পর্ব-৩
#সাদিয়া খান সুবাসিনী
আমাদের অবস্থা এমন ছিল না।সর্বনাশা নদী ভাঙ্গনে এক রাতে ফসলের সব জমি চলে যায় নদীর পেটে। নদী তার আকার বাড়ায়, ঘর হারাই আমরা।আমার শিক্ষিত আত্মসম্মানী বাবা নিজের উদ্যোগে করেছিলেন ছোট্ট খামার।নদীর পাড়ের জমিতে ফসল ফলতো বেশ। দাদার রেখে যাওয়া ধানের জমিতে যা ধান হতো সেটা দিয়েই দিব্যি চলে যেত আমাদের। কিন্তু বছর তিন আগে সব বদলে গেল।বাজার থেকে ফিরে বাবা আর লুকিয়ে মাকে এটা ওটা দেয় না।মায়ের গায়ে উঠেনা নতুন আঁচল।জমানো টাকা দিয়ে পুনরায় ঘর দাঁড় করানোর চেষ্টা করলো। বন্যা স্থায়ী হলো তিন মাস। হুট করেই বোনের ডায়রিয়া হলে সব ছেড়েছুড়ে আমাদের দৌড়াতে হলো হাসপাতালে । জমানো টাকা খরচ হলো।তখন থেকে দুঃখের দিন শুরু। ধীরে ধীরে আত্মীয়রা দূরে সরে গেল।আমাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে নিতে মা অনেকটা কাহিল হয়ে ধার দেনা করতে লাগলো তার ভাই বোনদের কাছে থেকে।প্রথম দিকে তারা সবাই সাহায্য করলো।বড় মামার কাছ থেকে টাকা এনে একটা গাভীন গরু কিনলো এই আশায় যে গরুতে দুধ দিবে এবং দিনে যদি পাঁচ সাত কেজি দুধ হয় তবে বেশ ভালোই চলবে।কপালে সইলো না।লাখ টাকা দিয়ে কেনা গরু সাত দিনের মাথায় মরে গেল।গরু নেই মামা ভাবলেন টাকা মার যাবে। চাপ দিতে লাগলেন টাকার জন্য।এক সময় সেটা গিয়ে পৌঁছালো হুমকিতে। আমাদের অবশিষ্ট জমি, যেটায় বাবা ধান চাষ করেছিল সেটা বিক্রি করে টাকা শোধ হলো। মা তার ভাই বোনদের কিছু বলে না কারণ বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছু প্রয়োজন হয়।অধিক প্রয়োজন বস্ত্রের। আমাদের গায়ের কাপড় অধিকাংশ তাদের দেওয়া ছিল। লেখাপড়ার খরচ কিংবা একটু অসুস্থ হলে এই নানা বাড়িতেই জানাতে হতো মাকে। আমাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই সে সব সইয়ে যেত।
তো ঈদের পরদিন সবাই বেড়াতে গেলে আমাদের নেওয়া হয়নি।কারণ তাদের সাথে যাচ্ছিলো না আমাদের। বোনটা পিছন পিছন গিয়েছিল।শুনেছি চাচাতো নানা বাড়িতে সবাইকে আলাদা আলাদা প্লেটে সেমাই পায়েশ দিলেও আমার বোনকে দেয়নি। দুলাভাইয়ের প্রতি এখনো মনে সম্মান আছে আমার।সেই তো বার বার এমন লজ্জার পরিস্থিতি থেকে আমাদের দুই ভাই বোনকে আগলে রেখেছেন।সে নিজের প্লেট থেকে বোনকে খাইয়ে দিয়েছিলেন। যেটা মোটেও পছন্দ করেনি আমার বড় খালা।বাড়ি ফিরে খুব করে বকেছিলেন আমার মাকে।লজ্জায় মাথা নত করে ছিল মা।রাতে ফ্লোরে পাটি বিছিয়ে শোয়ার সময় ফিসফিস করে বলেছিলেন,
“অমিক, তোর মামা যে সালামি দিলো টাকাটা ভেঙ্গে ফেলেছিস?”
“না মা আছে।”
“ভাঙ্গিস না বাবা।আর কিছু যদি না পারি এবার বাড়ি গিয়ে বিষ কিনে চারজন খেয়ে মরে যাবো।ওটার জন্য হলেও টাকাটা রেখে দিস।”
মানিব্যাগ থেকে টাকাটা বের করে টেবিলের উপরে রাখে অয়ন।সেই টাকাটা এখনো বুকে আগলে রেখেছে সে।একশ টাকার দুটো নোট। টাকাগুলো হাত দিয়ে তুলে নিয়ে বলে,
“এরপর থেকে এই টাকা দেখলে আমার ভয় করতো। না জানি কখন মা টাকা চেয়ে বসে।যেদিন টাকা নিবে সেদিন আমাদের দুনিয়ায় শেষ দিন।”
নানা নানী ঈদের সাত দিন পর ফিরবেন।কিন্তু আমরা রইলাম না।হাজার খানেক অপমান গিলে বেরিয়ে এলাম ও বাড়ি থেকে।আসার সময় বড় মামী এক প্যাকেট মাংস দিলো।আব্বার জন্য।পুরো রাস্তা আম্মার মুখ চোখের হাসি ছিল দেখার মতো।ঈদেও ও বাড়িতে তেমন মাংস আমরা ভাগে পাইনি।এবার বাড়িতে গিয়ে বেশি করে দেশি আলু দিয়ে রান্না করে দিবেন।পুরো রাস্তা মা কেবল এটাই বলল।বাড়ি ফিরেই তোরজোর শুরু করলো মাংস রান্না করার।টুকটাক মশলা বেটে মাংসের প্যাকেট খুললেন।আব্বা তখন ধানের বীজতলা দিচ্ছেন বাড়িতেই।ফ্রিজের মাংস ছাড়তেও তো সময় লাগে। সেই মাংস প্যাকেট খুলে আম্মার চোখ ছলছল করে উঠলো।কারণ সেখানে কেবল কয়েক টুকরা মাংস ছিল। আর যা ছিল সব ছিল চর্বি এবং হাড্ডি।মাংসের প্যাকেটটা ভারী বা বড় ছিল কেবল হাড্ডির জন্যই।”
#চলবে
(এডিট ছাড়া। সবাই রেসপন্স করবেন।)
#শতরঞ্জির_শত_রঙ
#পর্ব-৪
#সাদিয়া_খান (সুবাসিনী)
নানা নানী হজ্বে থেকে আসার পরেও আমাদের যাওয়া হয়নি।মা ইচ্ছে করে গেলেন না। নানা নানীর আমাদের প্রতি তেমন মায়া ছিলোও না। নানীর অন্য সব মেয়েদের মতো আমার মায়ের প্রতি এতো ভালোবাসা না থাকার কারণ আমি তখন অল্প অল্প বুঝতাম।অথচ এমন একটা সময় আমাদের ছিল যখন বাবা বলতে পাগল ছিলেন আমার নানা নানী।গ্রামের সেদ্ধ মোটা চালের ভাত ছাড়া কেনা চালের ভাত খেতে পারতো না। বাবা লোক দিয়ে প্রতি বছর দুই বার ধান সেদ্ধ করে চাল পরিষ্কার করে পাঠাতেন। শীতের সময় নানান জাতের তাজা তাজা সবজি খেতে দাওয়াত দিতেন। লোক মারফত আমাদের জন্য কয়েকটা খেজুর এবং একটু জমজমের পানি পাঠিয়েছিলেন মাত্র। আম্মা সেই খেজুর আর পানি রেখেছিলেন কিন্তু কাউকে খেতে দেয়নি। হজ্বে থেকে এসে সবাইকে দাওয়াত করে দুম্বার মাংস খাইয়েছে,সবাইকে কত কিছু দিয়েছে,জায়নামাজ, তজবি, পাঞ্জাবীর কাপড়। খেজুর হাত্রপ এসব একমনে শুনে গেল আম্মা।কি জানি আম্মার কি হয়েছিল তখন।আম্মা কেবল নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতেন।যেখানে কোরবানীর সেই গোস্তের নামে হাড়গোড় ফেলা হয়েছিল। বিপত্তি বাজলো সেদিন যেদিন আম্মা বুঝতে পারলো সে আবার মা হতে চলেছে। আরো এক মুখের আহারের কথা হোক কিংবা নিজের অসহায়ত্ব, আম্মাকে ভেঙ্গে ফেলল।নষ্ট করতে চাইলো কিন্তু সেদিন আম্মার পা ধরে বলেছিলাম, “আম্মা আরেকটা মুখ পালার দায়িত্ব আমার, আমরা যা খাবো ও তাই খাবে কিন্তু ওকে মের ফেলিয়েন না।”
ভাগ্য সহায় হলো সেদিন বিকেলেই। ক্লাস সেভেনে সবে উঠেছি।পাশের বাড়ির চাচার দুই ছেলে মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্ব দিলেন।মাসে তিনশ করে টাকা দিবেন। আম্মাকে বললাম রহমত শুরু হয়েছে আম্মা। ধৈর্য্য রাখেন। এক মাস পড়ানোর পর আরো দুই তিন জন পড়ার জন্য আগ্রহ করলে না করিনি।মাত্র তের বছর বয়সে আমি অন্যের বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করি।কিন্তু নানা বাড়ি আর যাওয়া হয়নি। সকালে পাটি বিছিয়ে সকালে বারান্দায় পোলাপান পড়াই।বোন মায়ের সাথে সাথে কাজ করে। মায়ের শরীর ভারী হলে রান্নার দায়িত্ব আমাদের দুই ভাই বোনের উপর পড়লো। আব্বা তখন ধান চাষে ব্যস্ত।নিজেদের যেটুক জমি ছিল ওটুক সাথে নদীর পাড়ে ধান চাষ করলো। মাস শেষ হলে যেদিন বেতন দিলো সেদিন আম্মা বলল,
“অয়ন হাটে যাবি আজ।যা যা আনতে বলবো নিয়ে আসবি।”
আমি ভাবলাম আম্মার কিছু খেতে মন চেয়েছে কিন্তু আম্মা আনতে দিলেন শীত কালীন সবজির বীজ। আব্বা কিছুই জানে না এইসব৷ আমি বীজ এনে দেই, আম্মা উঠোনের উত্তর দিকটা পরিষ্কার করে। বোন পানি টেনে এনে দেয়, আম্মা বীজ বোপন করে। একটু ছাই, পাশের বাড়ি থেকে গোবর এনে দেয়। আব্বা এসব দেখে না। সে যে আমাদের জন্য দু মুঠো খাবার যোগাতে দুনিয়া উলট পালট করে ফেলছিল তখন।দিন যায় আম্মার পেট ভার হয়, বোন সকালে স্কুলে যায়, আমি আম্মার সাথে সাথে থাকি। তরকারি কুটি, কাপড় ধুই, পোলাপান পড়াই তারপর বোন আসলে আম্মার গোসলের পানি তুলে দিয়ে স্কুলে যাই। দেখতে দেখতে আম্মার লাউয়ের ডগা ছড়িয়ে যায়, লাল শাক হালকা বাতাসে তিরতির করে কাঁপে, টমেটোর চারা উঁকি দিচ্ছে। আম্মা বসে বসে নিড়ানি দেয়। বিক্রির উপযুক্ত হলেও আম্মা বিক্রি করে না। কড়াই ভরে শাক ভাজি করে, আমাদের প্লেটে তুলে দেয়, আমরা খাই আর আম্মা তৃপ্তি করে দেখে। আব্বা দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন। আম্মার রোগা শরীর, ভয় পান আব্বা। কিছু জমানো টাকা আম্মার হাতে দিয়ে বলেন,
“দেখো দুইটা ডিম পাড়া হাস মুরগি পাও কি না।ডিম বেঁচতে হবে না।তুমি অন্তত খেতে পারলে হয়।”
“আর আপনারা?”
“আমরা এসবেও চালাতে পারবো।তোমার শরীরে পুষ্টি দরকার।”
আমিও সায় দিলাম আব্বার কথায়। দুই বাড়ি পর থেকে তিনটে ডিম পাড়া হাঁস কিনে আনলো আম্মা।আব্বা নিজ হাতে খোয়ার বানিয়ে দিলেন।দিন ভালো না গেলেও খারাপ যাচ্ছিলো না।আম্মার হাতে বোপন করা সবজি বাজারে নিয়ে যাই আমি, বেশ লাভেই বিক্রি হয়। আম্মা টাকা জমায়, বর্ষার আগেই ঘরের সামনে ঠিক করতে হবে। অথচ আম্মা তখনো জানতেন না, তার জন্য নতুন ঘরের ফরমান আল্লাহ তালা পাঠিয়ে দিয়েছেন।
#চলবে