শতরঞ্জির শত রঙ পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

1
1265

#শতরঞ্জির_শত_রঙ
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব-৫(শেষ)

“সংসারে যত উন্নতির দিকে যাচ্ছিলো আম্মার শরীর ততোই খারাপ হতে লাগলো। আমাদের দিন ফিরতে শুরু করেছিল।ধানে রঙ লাগলে আম্মার খুশির চেহারাও আব্বাকে স্বস্তি দেয়। আমাদের কোনো ঈদ ছিল না গত কয়েকটা বছর। সবজি বিক্রির টাকা আম্মা কাউকে হাত দিতে দেয় না। অনেক যত্নে টাকা জমিয়ে রাখে।নতুন ঘর দিবে কিন্তু এক রাতে আব্বা আম্মাকে বললেন,

” তোমার সময় এসে গেছে।টাকাগুলো আমাকে ধার দিতে হবে।আমি ধান কেটে শোধ করে দিবো।”

“কেন?”

” যদি অপারেশন করা লাগে? আমার হাতে টাক নাই তো।”

“লাগবে না।তবুও ওই টাকায় নতুন ঘর তুলবো।”

“তোমার কিছু হইলে ঘর দিয়ে কি হবে?আজ মরলে কাল এই পোলাপানের জন্য হলেও বিয়ে করতে হবে আমার।তখন?এরচেয়ে ভালো তুমি সুস্থ থাকো তাই না?”

আম্মা মুখ ভেংচায়।আব্বা হাসেন।আমি ঘুমের ভান করে শুয়ে থেকে সব শুনি।আমাদের ধান সবার আগে সোনালি হয়। আম্মা বাড়িতে বসে বসে ধানের জায়গা পরিষ্কার করে। কয়েক দিন অমানুষিক কষ্টের পর ঘরে ধান তুলি আমরা সবাই।আমাদের ধান কাটা শেষ হলে যখন খড় শুকানোর পালা সেদিন আবার সর্বনাশা বৃষ্টি নামলো। ধান তোলার আগে আম্মার কথাতেও ঘরে নতুন টিন দেয়নি। দুই বাপ বেটা মিলে ঠিক করেছিলাম।আম্মা বার বার উঁকি দিয়ে ধান দেখে।
গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ধান তুলতেই পারলো না ঘরে। বানের পানিতে ভেসে গেল অনেকের সহায় সম্বল।বৃষ্টির পানির কারণে ঘর থেকে যখন বের হওয়া মুশকিল হলো তখন আম্মা ঘরেই চুলা তুললেন।এত কিছুর মাঝেও আমার নানা বাড়ি থেকে একটা খবর এলো না। তারা একটা বার খবর নিলেন না আমরা কি অবস্থায় আছি। গ্রামের মানুষের আহাজারি শুনে প্রমোদ গুনে আব্বা।আম্মার শরীর যদি বেশি খারাপ হয় তাহলে কি হবে?

আব্বা একদিন ভোর বেলা বের হলেন।আম্মা তখনো ঘুমে।বোন আর আমি হাটু পানি ভেঙ্গে খাবার পানি আনি,ঘর পরিষ্কার করি, ঘরের বারান্দার রুমে তখন হাঁস,মুরগি রাখা হয়েছিল।সেসব পরিষ্কার করে যখন বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি তখন দেখি আব্বা এসেছেন দুই জন লোক নিয়ে। তাদের সাথে দুইটা নৌকা।আম্মা ভ্রু- কুঁচকে তাকিয়ে আব্বাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলল,

“পাঁচ মণ ধানের বিনিময়ে নৌকাটা কিনবো।”

“এখন নৌকার কি দরকার?”

“পানি আরো বাড়বে।তোমার শরীর ভালো না।রাত বিরেতে কোনো বিপদ আপদ হলে?”

“তাই বলে আমার ঘরের ফসল?”

আব্বা আম্মার কথা শুনলেন না। নৌকা রেখে তারা ধান নিয়ে চলে গেলেন।তখনো গোলা ভরা ধান কিন্তু আম্মার পরাণ কেবল পড়ে রইল ওই ধানের কাছে।দুই দিন পর বুঝা গেল নৌকার প্রয়োজন। এদিক ওদিকে যাওয়ার জন্য সবাই নৌকা চাইতে লাগলো। পাশের বাড়ির একজন বলল তাকে নৌকাটা ভাড়ায় দিতে। যা ইনকাম হবে সমান সমান দিবে। আব্বা রাজি হলেন। সে বছর প্রায় দুই মাস বর্ষা স্থায়ী হলো। আম্মার শরীরও খারাপ করলো এক গভীর রাতে।ঘরে তালা ঝুলিয়ে সে নৌকা নিয়ে আব্বা ছুটলেন হাসপাতালের দিকে। ভোরবেলা যখন আলো ফুটলো আম্মা তখন আরো এক কন্যার জন্ম দিলেন। আম্মা শখ করে তার নাম রাখলো আলো।আলোর জন্মের পর আমাদের জীবনেও আলো ফুটলো। বর্ষার কারণে অল্প দামে এক জোড়া গরু কিনতে পারলেন। মাস পেরুতেই গরুর বাছুর হলো। আমন ধানের ক্ষেতেও যেন আলোর পরশ লেগেছিল।বাড়ি থেকে পানি নেমে যেতেই বেশ ভালো দামে ধান ছাড়লেন আব্বা।আমাদের বাড়িতে নতুন পাকা দুই খানা ঘর উঠলো। গ্রামের শেষ দিকে বয়স্ক এক দম্পতি থাকতেন।সন্তানেরা তাদের ত্যাগ করেছে।নদীতে ঘর ভেঙ্গেছে।অসহায় দুজনকে বাড়িতে আনলেন আব্বা।আম্মা তাদের থাকা নিয়ে আপত্তি করেননি।
আম্মা বেহিসেবী হলেন না।আরো শক্ত হলেন। বাড়ির সাথে ছোট্ট খামার দিলেন। বয়স্ক মহিলা আম্মার হাতে হাতে কাজ করতেন। আর সেই দাদুটা বেশির ভাগ সময় অসুখ থাকতো।আব্বা তাদের সব দায়িত্ব নিয়েছিলেন।চিকিৎসা করিয়ে দাদু সুস্থ হওয়ার পর সে নিলেন আম্মার ছোট্ট খামারের দায়িত্ব। দাদুর হাতে যেন বিধাতার আশীর্বাদ ছিল। আম্মার সবজি চাষ এবং হাঁস মুরগির খামার ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো।

এই বছর আম্মা আব্বার কাছে আবদার করলেন একটা ছাগল কিনে এনে দিতে। আম্মা এবার কোরবানি দিতে চান।আম্মার আবদার আব্বা ফেললেন না। ধানের বীজতলায় বেশি যে চারা ছিল সেগুলো বিক্রির টাকা দিয়ে আম্মাকে দুটো বাচ্চা সহ ছাগল কিনে এনে দিলেন। আম্মা কপট রাগ করে বলল,

“দুধের বাচ্চা রেখে কোরবানি আমি করতে পারবো না। আপনি এমন তামাশা কেন করলেন?”

আব্বা মুচকি হাসে, সেই হাসির রহস্য আম্মা টের পায় না।ঠিক ঈদের আগের দিন সন্ধ্যেবেলা লাল রঙের এক ষাড় নিয়ে ফেরেন আব্বা এবং দাদু। আম্মার হাতে ষাড়ের দড়ি তুলে দিয়ে বলেছিলেন,

“এবার কিন্তু দেশি আলু দিয়ে রাঁধবে। কেমন?”

গত বছরের ঈদ আর সেবারের ঈদের তফাৎ করতে গিয়ে আমি নিজেই কেঁদে ফেলেছিলাম।এরপর আমাদের দিন ফিরেছিল।বছরান্তেই আবার সব ঠিক হয়ে গেল।খুব খারাপ সময় পার করে আম্মা সুখের মুখ দেখলেন। নানা বাড়ি থেকে আবার খবর এলো যাওয়ার। আম্মা হাসলেন, জানালেন সে যাবে।

আলমারি খুলে সবচেয়ে দামী পোশাকটা গায়ে জড়িয়ে গিয়েছিলেন আম্মা।শুনেছি বেশ খাতির করেছিল সবাই কিন্তু আম্মা নাকি কিছুই খায়নি। টেবিলে সাজিয়ে রাখা নানান পদের খাবারের দিকে কেবল চেয়েছিলেন। খালারা ভেবেছিলেন আম্মার নামের জমিটা চেয়ে নিবেন।কিন্তু আম্মা কাউকে দিয়ে আসেন নি।নিয়ে এসেছেন তার প্রাপ্য।

কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। এস এসপি অয়ন মির্জা ওয়েটারকে ডেকে আরেক কাপ কফি দিতে বললেন। আমার সামনে যে বসে আছে, সফলতা যার কদমবুসি করে সেই মানুষটার জীবনের গল্প এতটা করুণ কেন? কফির মগটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে সে পুনরায় বলল,

“আলো আমার ছোটো বোন। আমাদের সু’দিনের হাতছানি। সেই মেয়েটা যখন আপনার ভাইকে চাইলো তখন আমি না দিয়ে পারি না মিস…?”

“মাধুরী,আমার নাম মাধুরী।”

“আমি জানি আপনার ভাইকে আপনি অনেক ভালোবাসেন।আমিও আমার বোনকে খুব স্নেহ করি।তাই আজ আপনাকে ডাকা।”

“ওদের বিয়ে নিয়ে আমার আপত্তি নেই কিন্তু একটা প্রশ্ন ছিল।”

” আমাদের আত্মীয়দের কথা জানতে চাচ্ছেন?খালা চেয়েছিল তার ছোটো ছেলের সাথে শিথিলের বিয়ে দিতে। যে খালা ওড়না চুরির অপবাদ দিয়েছিল আমার বোনকে।আমার বি সি এস ক্যাডার বোনকে কিভাবে দেই?তাই দেওয়া হয়নি।তাছাড়া আমার আম্মা সব মনে রেখেছেন।”

দ্বিতীয় প্রশ্ন করার পূর্বে তার ফোন বেজে উঠে। দ্রুত বিল পে করে সে বেরিয়ে যেতে যেতে বার কয়েক দুঃখিত বলল।ইমারজেন্সি কেস।আমি স্মিত হেসে তাকে বিদায় জানাই।আমার একমাত্র ভাই তারিফ।ওর প্রেম নিয়ে আপত্তি ছিল না কিন্তু মেয়ের ভাইয়ের পেশাটা আমার ভীষণ অপছন্দের। বার বার করে সে অনুরোধ করেছিল বলে আজ দেখাটা করা।ভাগ্যিস দেখা করেছিলাম।না হলে এমন এক কষ্টিপাথর গল্পটা জানা হতো না……….

#সমাপ্ত

( এডিট ছাড়া। সবাই মতামত জানাবেন এবং রেসপন্স করবেন)

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে