লতাকরঞ্চ (৯)

0
890

লতাকরঞ্চ (৯)

কিশোর ভাই এসে বললো,
– লতা, প্রান্তিক.. আন্টি সুস্থ আছেন আল্লাহর রহমতে। দেখে আসো যাও।
প্রান্তিক ভাই আমার কাছে এসে একবার না পারতে বললো,
– চল লতা।
কিশোর ভাই হাতের আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে ঠোঁট, নাকে হাত দিয়ে ঘষলো।

আমার হাত-পা অসার হয়ে গিয়েছে। কেমন যে লাগতেছে বলতেও পারতেছিনা কাউকে। মনে হচ্ছে এখনি যদি উঠে দাঁড়াই তাহলে ধঁপাস করে হয়তো পড়ে যাবো।
প্রান্তিক ভাই আমাকে কথাটা বলে নিজেই চলে গেলো। আমাকে যে একটু ধরে উঠাবে, নিয়ে যাবে…না..

কিশোর ভাই ও লিমা আপু, ফুফা, ফুফুর সাথে চলে গেলো। আমি উত্তেজিত, অসম্ভব বেশি খুশি। কিন্তু দৌঁড়ে যে চলে যাবো সেই শক্তিটুকু ও নেই দেহে।

খুব কষ্টে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম।
উঠে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে উঠলো।
পড়ে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনি দেখলাম কারো হাত আমার কোমরে এসে পড়েছে।
কিশোর ভাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
আমিও বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছি।
সিনেমায় যখন এই সিনটা আসে যে নায়িকা পড়ে যায়, নায়ক এসে পিছন থেকে ধরে.. আমি এটা নিয়ে সবসময় ব্যাঙ্গ করতাম আর হাসতাম এই বলে যে হাউ ক্যান ইট বি পসিবল.. আর এখন সেই ব্যাঙ্গমী আমার জীবনেও ঘটে গেলো।

কিশোর ভাই বললো,
– তোমার অবস্থা খুব খারাপ লতা। খুব দূর্বল তুমি। তোমাকে কিছু খেতে হবে। আগে আন্টিকে দেখে আসো তারপর আমি ব্যবস্থা করতেছি।
আমি কিছুই বললাম না।
কেবিনে ঢুকলাম কিশোর ভাইয়ার হাত ধরে।
মঞ্জু ভাই ট্রিটমেন্ট করেছে আম্মার।
মঞ্জু ভাই বলতেছে,
– অতিরিক্ত মানসিক আঘাত পেয়েছে বলেই এই অবস্থা।
আর বেশিক্ষণ দেরী হলে স্ট্রোক ও হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ।
ঊনাকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষন ঘুমাক।

লিমা আপু মঞ্জু ভাইকে বার বার বলতেছে,
– আম্মার যেন কিছু না হয় দেখবেন। আপনি আব্বার কাছে যান। এখনি যান।

আমি শুধু শুনে যাচ্ছি।
আমার হিতাহিত জ্ঞান নেই।
মাথা ঘুরাচ্ছে।

কিশোর ভাই আমাকে আম্মার পাশেই একটা জায়গায় এনে শুইয়ে দিয়েছে। প্রান্তিক ভাইকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। শোভা আপু আসেনি আমাদের সাথে, বাড়িতেই রয়ে গিয়েছে কালুসহ। নিশ্চয়ই প্রান্তিক ভাই বাড়িতে চলে গিয়েছে শোভা আপুর একাকিত্বের সঙ্গী হওয়ার জন্য।
কিছুক্ষন পর দেখলাম, না। প্রান্তিক ভাই আবার এসে ঢুকেছে।

প্রান্তিক ভাই ফুফুকে বলতেছে,
– আম্মা আপনার শরীরের উপর আর প্রেশার দিবেন না। চলেন আমার সাথে বাড়ি চলেন। এখানকার খাবার ভালোনা, আমি আমাদের সবার জন্য খাবার অর্ডার করে দিয়েছি। রাতে দিয়ে যাবে।

ফুফু বলতেছে,
– আরে, কি বলিস! কোথায় যাবো! এখানে এই অবস্থা আর আমি কিনা বাড়িতে চলে যাবো! আমার ভাই হার্ট এট্যাক করেছে, ভাবী অসুস্থ। ভাইঝিটা এভাবে নুইয়ে গিয়েছে সেখানে…
তুই বরং যা। শোভা মেয়েটা একা আছে। আবার রাতে একবার এসে দেখা করে যাস।

প্রান্তিক ভাই বললো,
– আবার আসবো মানে? আমি কি ডাক্তার নাকি? আমি এসেই বা কি করতে পারবো! আপনি যদি বলেন তাহলে আমি লতাকে নিয়ে যেতে পারি বাড়িতে। ও কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

ফুফা এসে বললো,
– হ্যাঁ ওটাই ভালো রুজিনা।(বড় ফুফুর নাম) প্রান্তিক লতাকে নিয়ে চলে যাক। এখানে আমরা কয়জনের দেখাশোনা করবো? লতা চলে গেলেই বরং ভালো হবে। প্রান্তিকের সাথে ওকে পাঠিয়ে দাও।

এই বলে লিমা আপুকে ডাক দিলো ফুফা।
লিমা আপু গেলো।
লিমা আপুকে বলা হলো আমাকে গাড়ি উগ্ধি(অবধি) পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
আপু এসে আমায় জিজ্ঞেস করলো,
– কিরে লতা? বেশি খারাপ লাগতেছে?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, – না।

আপু বললো,
– ফুফু, ফুফারা বলছে তোকে গাড়িতে পৌঁছে দিতে। প্রান্তিকের সাথে বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য বলতেছে। যাবি?
আমি চোখ বন্ধ করে বললাম,- না।

আপু আবার বললো,
– দেখ এখানে আমরা কয়জনের খেয়াল রাখবো বলতো? আব্বার কোনো ভালো খবর এখনো পাইনি। তাছাড়া আম্মা এত অসুস্থ। এর উপর তুই ও..

আমি লিমা আপুকে জড়িয়ে ধরার জন্য হাত বাড়ালাম।
আপু বুঝতে পেরে মাথা নিচে ঝোঁকালো।
আমি ঝাপ্টে ধরে বললাম,
– আপু,প্লিজ আমাকে পাঠায়ে দিস না। আমি এখানেই থাকবো। এইতো ঠিক হয়ে গিয়েছি দেখ।

পিছন থেকে প্রান্তিক ভাই এসে বললো,
– ঠিক হয়ে গিয়েছিস মানে? এত তাড়াতাড়ি ঠিক হলিটা কিভাবে? না মানে কারো হাতের স্পর্শে কি আপনা-আপনিভাবেই ঠিক হয়ে গেছিস নাকি অন্য কোনো মতলব? এই, নাকি সবই নাটক করছিস?

আমি কিছুই বলতে পারলাম না শুধু তাকিয়ে রইলাম স্থির দৃষ্টি নিয়ে। উনি কেন সবসময়ই আমার সাথে এই ব্যবহার করে?

লিমা আপু রেগে গিয়ে বললো,
– প্রান্তিক। সবকিছুর একটা লিমিট থাকে। এরকম ব্যবহার কেন করতেছো তুমি ওর সাথে?
ও নাটক করতেছে মানে? আরে আমাদের পরিবারের এমন একটা দুর্দশা এখন। সেখানে ও এখন এখানে বসে বসে নাটক সিনেমা করবে? না মানে তুমি এগুলো ভাবোটা কিভাবে, আমাকে বলবা প্লিজ? আর ওর শরীরের অবস্থা ওকে দেখলেই তো বুঝা যায়। নেহাত কিশোর এসে ধরেছিলো বলে মেয়েটা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়নি। আর তুমিতো তোয়াক্কা না করেই আগে আগে চলে আসছো। বলি,বোনটা কার? কার দরদ থাকবে বেশি, তোমার না কিশোরের? আর আমিই তো কিশোরকে পরে পাঠাইছিলাম, কারণ আম্মা আমার হাত ছাড়েনা। নয়তো আমিই যেতাম। আমি বুঝতে পারছিলাম ওর শরীর ঠিক নেই। তোমায় বলছিলাম লতার সাথে সাথে থাকার জন্য। তুমি তো বললা দরকার নেই, তোমার নাকি ভালো লাগেনা।

প্রান্তিক ভাই বললো,
– লিমা… এই হচ্ছে তোমার একটা বিকট সমস্যা। অতিরিক্ত বুঝো। আমি জানি ওর শরীর খারাপ। তাইজন্যই বলতেছিলাম ও আমার সাথে চলুক। ওখানে খালি হাতে বসে আছে শোভা,কালু। আমিও আছি। আমরা ওর দেখাশোনা করতে পারবো। তোমরা এদিকটা সামলাও।
তাছাড়া আমার ও গা ম্যাঁচম্যাঁচ করতেছে, আমার ও বিশ্রাম দরকার।

লিমা আপু বললো,
– বেশি বুঝে বসে থাকো তুমি।
আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– এই লতা তুই কি যাবি ওর সাথে? নাকি আপুর কাছেই থাকবি?
আমি বললাম,
– যাবোনা। এখানেই থাকবো।
কিশোর ভাই এসেছে।
হালকা কিছু খাবার সাথে নিয়ে এসেছে।
আমার গলা দিয়ে এইসব খাবার এখন নামবে না তবুও জোর করে স্যুপ, গ্লুকোজ খাওয়ানোর জন্য তাগিদ দিলো কিশোর ভাইয়া -আপুকে।
বললো,
– লিমা, তুমি ওকে এগুলো জোর করে খাওয়াও। আমি আন্টিকে দেখছি।

এই বলে কিশোর ভাই আমার অসুস্থ আম্মাকে খাবারগুলো খাইয়ে দিচ্ছে। আমি একবার চোখ খুলে দৃশ্যটা উপভোগ করলাম।

দেখে খুব ভালো লাগতেছে।
আপু আমাকে খাইয়ে দিলো।
এইমধ্যে কখন যে প্রান্ত ভাইয়া লাপাত্তা হয়ে গেলো জানিনা।

কিছুক্ষন পর মঞ্জু ভাই এসে বললো,
– আব্বা আল্লাহর রহমতে ভালোই আছেন।

আমরা কিছুদিন আব্বার কাছেই থাকলাম।
আম্মা আল্লাহর রহমতে সুস্থ।
কিশোর ভাইকে এইমধ্যে একবার জিজ্ঞেস করলাম, এভাবে লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার কারণ কি।
উনি বললেন, সময় হোক। জানতে পারবা।
______________
_________

অত:পর বাড়িতে ফিরলাম সবাই মিলে।
বাড়িতে ফিরে দেখলাম ফুফু-ফুফা বেজায় চিন্তিত।
আব্বার এ অবস্থা তারপরেও প্রান্ত ভাই আর শোভা আপুর বিয়ের কথা তুললো।

প্রান্তিক ভাই কি এসবের কিছুই জানেনা?

লিমা আপুর বিয়ে ঘনিয়ে আসছে।
আমি মেহেদী, সাজগোজ, পিঠাপুলির দায়িত্ব নিলাম। এসব হালকা-পাতলা জানি তাইজন্য।
শোভা আপু জানিয়ে দিলো,
সে সাজগোজের ব্যাপারটা দেখবে।
আমি একবার গিয়ে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– শোভা আপুকি যাবেনা?
আম্মা বললেন,
– না। ও তো একেবারেই এ বাড়িতে চলে আসতেছে মনে হয়।

চলবে….

( আমার অন্যান্য ছোট গল্পগুলো পড়ার ইচ্ছা আছে?)

#ফারজানা_রহমান_তৃনা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে