রৌদ্দুরে প্রেমের বৃষ্টি পর্ব-৩৭ এবং শেষ পর্ব

0
4017

#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি
#পার্টঃ৩৭
#রুবাইদা_হৃদি

” ভালোবাসি ” আর ” ভালোবাসা ” দুইটা শব্দ আলাদা৷ এক অর্থ বহন করলেও সবটা যে এক না৷ দিন চলে যাচ্ছে৷ আব্বুকে হারানোর আজ দশতম দিন৷ ব্যাক ইয়ার্ডে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি৷ কাঁধে গরম হাতের ছোঁয়া পেতেই আমি দূরে সরে যাই৷ নিজেক গুটিয়ে রাখছি৷ কেন রাখছি জানি না৷ তবে তার সাথে কথা বলতে আমার একদম ভালো লাগছে না৷ আমার কাধে আবার হাতে ছোঁয়া পেতেই গম্ভীর ভাবে বললাম,

–‘ একা থাকতে দিন৷ ‘

ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার শব্দ কানে এলো৷ আবার দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ মানুষ মারা গেলে কোথায় যায়? এই একটা প্রশ্ন ছেলেবেলার মতো ঘুরেফিরে বেড়ালো৷

–‘ রুমে চল৷ ‘

–‘ যাবো না আমি৷ আপনি যান৷ ‘
আমার ভাবেলাশীন উত্তর শুনে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন উনি৷ মৃদু স্বরে বললেন,

–‘ জিনিয়ার সাথে কথা বলবি? ‘

–‘ কি বলবো? যে তোর আপু ভালোবাসার সাগরে ডুবে আছে এর জন্য আসতে পারে নি? ‘

হঠাৎ করেই কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো৷ তাও আমার ভাবনার নড়চড় হলো না৷ উনি বোধহয় আন্দাজ করতে পেরেছেন কথাটার মানে৷ কথার জবাব দিলেন না৷ আমার মতো নীরবতা পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷ হঠাৎ করেই আমার পেছনে দাঁড়িয়ে কোলে উঠিয়ে নিলেন৷ আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম না৷ সব কিছুর জন্য আমার চলে আসাটা দায়ী মনে হচ্ছে৷ না আমি আসতাম না আব্বুকে হারাতাম৷ সব কিছু নিছক একটা ভাবনা? না বাস্তবতা জানি না৷ তবে আমার মনে হচ্ছে এইটাই৷
___________
বার্লিনের একেকটা দিন হঠাৎ করেই আমার কাছে বিষাদময় হওয়া শুরু করলো৷ কবিতা আপুর ডেলিভারি সময় হয়ে গেছে তাই তারা আবার ফিরে গেছেন৷ যাওয়ার আগে শুধু আমার হাত ধরে কাতর কন্ঠে বলেছিলো,

–‘ সব কিছু নিজের মতো হয় নারে নীতু৷ করে নিতে হয়৷ আল্লাহ চেয়েছিলেন বলেই আমার ভাই তোর জীবনে এসেছে৷ আমার ভাই তোকে আগলে রাখবে৷ মামুর কষ্টের জায়গা কেও পূরণ করতে পারবে না কিন্তু মেয়েদের বিয়ের পর সেই জায়গা টা তার স্বামীর হয়ে যায়৷ তুই ভালো থাকবি৷ আর তোকে ভালো রাখবে আমার ভাই৷ ‘

আমি ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিলাম৷ আপু চলে যাওয়ার পর সব আরো অসহনীয় হয়ে উঠলো৷ জিনিয়াটাও ফোন দিয়েই কান্না করে৷ আব্বুর রাজকন্যা৷ হঠাৎ করেই সব শেষ৷ ফুঁপির কাছে আছে কিন্তু ভালো নেই৷ মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে কান্না করে বলে,

–‘ আপু,আমাকেও মেরে ফেল৷ নয়তো আমি নিজেই মরে যাবো৷ আম্মু নেই,তুই নেই এমনকি আব্বুও নেই৷ আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসে রে৷ ‘

আমি উত্তরে কাঁদি৷ ফুঁপি আদর মাখা হাতে ওকে আগলে রাখে৷ তারা আছে বলেই আমি ভরসা পাই৷
__________
ক্লাসে উদাস হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কিছু খুজে কাজ খুজে পাচ্ছি না৷ থেকে থেকে আব্বুর কথা আর দেশের কথা মনে পড়ে৷ ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস চলছে এর মাঝে একজন এসেই আমার খোজ করলো৷ আমি চমকে উঠলাম৷ পুরো ক্লাস আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ স্যার আবার প্রজেক্টরের দিকে মনোযোগ দিতেই আমি ব্যাগ হাতে আলুথালু পায়ে তার সাথে বেরিয়ে এলাম৷ হঠাৎ কে এলো আমার খোজ করতে? বাইরে বেড়িয়ে কাওকে খুজে না পেয়ে অডিটোরিয়ামের দিকে এগিয়ে গেলাম৷ হঠাৎ পেছন থেকে হাতে টান অনুভব হতেই স্বস্থির নিশ্বাস ফেলি৷ তার হাতের ছোঁয়া বড্ড চেনা৷ আমি সামনে ঘুরে থেকেই উদাস ভাবে বললাম,

–‘ আপনি এখানে? ‘

উনি আমাকে সামনে ঘুরালেন৷ ছুটে চলা চুল গুলো কানের পিঠে গুজে দিলেন৷ আমি স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম৷ উনার ঠোঁটে হাসি নেই৷ গায়ে ধূসর বর্ণের শার্টটার বোতাম গুলো বুকের উপর দুইটা খোলা৷ বরফ ঠান্ডা দিনে এইভাবে রয়েছেন ভেবেই অস্থির ভাবে বললাম,

–‘ ঠান্ডা লাগে না আপনার? ‘

–‘ চোখে পড়লো তোর? ‘
তার নির্মল কথার রেশে কেঁপে উঠলাম৷ তার শার্টের বোতাম লাগিয়ে দেওয়ার জন্য আগাতেই আমার হাত আঁকড়ে ধরেন উনি৷ আমার হাত তার বুকের উপর শক্ত করে ধরে বললেন,

–‘ কবে পাবো আমার সেই ভীতু চোখের চঞ্চল নীতুকে৷ যে লজ্জায় সিটিয়ে থাকবে৷ আর লজ্জায় রাঙা হয়ে আমার বুকেই মুখ লুকাবে৷ ‘

আমি নিস্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম৷ চুল গুলো বেখেয়ালি ভাবে উড়ে চলেছে৷ আমি জোর করেই তার খুলে রাখা বোতাম গুলো আটকানোর জন্য একদম কাছে গেলাম৷ তার শরীর থেকে উন্মাদনার সুবাস বইছে৷ হঠাৎ কেমন জড়িয়ে ধরার ইচ্ছা তীব্র হলো৷ আমি নিজেকে স্বাভাবিক করতে চেয়েও পারছি না যে৷ আটকে দিয়েই দূরে সরে আসতে গেলে উনি আমার হাত দুটো আগের ন্যায় ধরে রাখেন বুকের বা পাশে৷

আমি মাথা নীচু করে বললাম,
–‘ কাজ শেষ? ‘
–‘ আর কিছু বলার নেই?’
উনার কন্ঠে অভিযোগ৷ আমি তার থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে বললাম,

–‘ আমার সময় চাই৷ বুঝেন তো আপনি? ‘

উনি আমার হাত ধরেই গাড়ির সামনে এনে বসতে বলে বললেন,

–‘ রৌদ্দুরের প্রেমের বৃষ্টি হঠাৎ হচ্ছে না৷ কেন হচ্ছে না? তারা কেন নামছে না আকাশ ভেদ করে? তাদের কি ছুটে চলার প্রয়াস নেই? ‘

— ‘ রৌদ্দুরের আকাশে যে মেঘ ঢাকা পড়েছে৷ কান্নার বৃষ্টি গুলো নামছে৷ ‘ কথাটা বলতে চেয়েও পারলাম না৷ কিছু কথা এখন উহ্য রাখতে ইচ্ছা হয়৷

কোনো এক সুপ্ত সকালে মিষ্টি রোদের সকালে ঘুমের রেশ যখন গভীর তখন পেছনে থেকে কারো বলিষ্ঠ হাত জোড়া কোমর আঁকড়ে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়৷ উষ্ণতার আলিঙ্গন ভেদ করে ঘুম জড়ানো কন্ঠে, ‘ ভালোবাসি ‘ শব্দটাও মোহনীয় লাগে৷ জীবন বহমান৷ সময়ের স্রোতে প্রিয়জনের মায়া ত্যাগ করেই বাঁচতে হয়৷ কখনো ডুকরে কেঁদে উঠেও অকারণেই হাসতে হয়৷ ওইযে, ‘ জীবন যে থমকে থাকে না৷ ‘
এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াসে এগিয়ে যায়৷ সাথে বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস গুলোও হাওয়ার তালে তালে মিলিয়ে যায়৷ কখনো উজ্জ্বল আলো প্রতিফলিত হয়ে সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েও একরাশ কান্না দিয়ে যায়৷ একজনের জায়গার শূন্যতা পূরণের জন্য আরেকজন ঠিক এসে যায়৷ হয়তো শূন্যতা পূরণ হয় না, তবে বাঁচার,বেঁচে থাকার আগ্রহ তৈরি হয়৷ আব্বুকে হারানোর তিন মাস কেটে গেছে৷ এই তিনটা মাস, একটা মানুষ আমাকে সামলিয়েছে সে নিজেই জানেন৷ রুড বিহেভ আমি করেছি কিন্তু সে হাসি মুখে আমাকে সামলিয়েছে৷ তার করা দুষ্টুমি গুলো হঠাৎ করেই হারিয়ে গেছে৷ মানিয়ে নেওয়া আর মেনে নিতে নিতে অন্ধকার ময় তিনটা মাস কেটে গেছে৷ আব্বু নামক ছায়া হয়তো নেই কিন্তু,আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার একজন মানুষ আছেন৷ আমার ঘুমের রেশ কেটে গেছে৷ আলতো চোখে উনার দিকে তাকালাম,তিন মাসে তাকিয়ে দেখা পর্যন্ত হয় নি৷ মুখের আদল পালটিয়ে কেমন দায়িত্বশীল পুরুষের ছাপ পড়েছে৷ ক্লান্তি আর চিন্তায় মুখের রঙ কেমন ফ্যাঁকাসে হয়ে গেছে৷ হঠাৎ করেই বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠলো৷ কতদিন নিজের যত্ন নেয় না সেই জানে৷ আমি নিজের শোকে কাতর হয়ে তাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি৷ আমি নিজের হাত দুটো তার গালের মাঝে রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলাম৷ ঘুমের মাঝে উনি ভয় পেয়ে উঠে বসতে গেলেন আমি দিলাম না৷ উনি ভয় পাওয়া শীতল সুরে বললেন,
–‘ কি হয়েছে৷ মামুকে সপ্নে দেখেছিস? ‘
–‘ না৷ ‘
–‘ তাহলে? মনে পড়েছে মামুর কথা? এমন করে কাঁদে না বউ৷ আমি আছি তো৷ ‘

উনার আদুরে কথায় কান্নার বেগ আরো বৃদ্ধি পেলো৷ আমি শক্ত করে উনার জড়িয়ে ধরলাম৷ উনি একহাতে জড়িয়ে রেখে আরেক হাতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন৷ আমি ফুঁপিয়ে বললাম,

–‘ আমার জন্য আপনার কষ্ট হচ্ছে তাই না? ‘

–‘ কেন কষ্ট হবে বাবু? তুই তো আমার৷ তোর কষ্টের কারণ তো আমি৷ অপরাধী আমি৷ তোকে না নিয়ে আসলে হয়তো শেষ দেখা টা দেখতে পারতি৷ ‘

উনি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন৷ আমি উনার বুক থেকে মাথা উঠিয়ে অপরাধ বোধ কন্ঠে বললাম,

–‘ নতুন করে বাঁচতে চাওয়া অপরাধ নয়৷ ‘

–‘ হ্যাঁ, কিন্তু প্র‍য়োজনের জন্য স্বার্থপর হওয়া টা বিরাট অপরাধ৷ তোর চুপ থাকা তার বড় প্রমাণ৷ লাস্ট কয়েকটা দিন আমার সাথে থেকেও নিজেকে গুটিয়ে রাখাটা কি অনেক দরকার ছিলো? আমি যে মরমে মরে যাচ্ছি তোর দহনে৷ ‘

আমি উনার বুকে মাথা রেখেই অনবরত কেঁদে চলেছি৷ উনি আমার মাথা উঠিকে গাঢ় চুমু খেলেন৷ আমি কেঁপে উঠলাম৷ উনার শার্ট খাঁমচে ধরে অবিরাম কেঁদে চলার মাঝেও আজ তৃপ্তি পাচ্ছি৷ অনেক টা দিন ঠিক হওয়ার জন্য নিলেও মনের কোণে যে তার নামক ভালোবাসার খাতা পূর্ণ৷ রৌদ্দুরে প্রেমের বৃষ্টির নব্য সূচনা৷
____________________
বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে৷ অস্থির পায়ে আমি বাইরে দিকে এগিয়ে আবার ফিরে ফিরে আসছি৷ অন্ধকার ময় ঘরের মাঝে হঠাৎ করেই তার সেই রৌদ্দুরে প্রেমের বৃষ্টির ডায়েরি টা বের করে বুকে আঁকড়ে ধরলাম৷ এতেও তার ছোয়া আছে৷ ডায়েরির পাতায় তার আর আমার ছোট ছোট অনুভূতি গুলো সাজাচ্ছি৷ আজ আরেকটা পাতায় লিখবো তার আর আমার কাহিনি৷ প্রেমের কাহিনি৷ শত বাধার পরেও যে,ভালোবাসার অংশ থাকে সেই কাহিনি৷ বাইরে গাড়ির আওয়াজ পেতেই দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলাম৷ কফি কালারের শার্ট পড়ে ভিজে চুপসে আছেন উনি৷ হাত দিয়ে পানি ঝারতে ঝারতে এগিয়ে আসছেন৷ আমি শাড়ির কুঁচি ধরে লাফিয়ে উনার সামনে গেলাম৷ উনি অমায়িক হাসলেন৷ শাড়ির ফাঁকে বেরিয়ে থাকা কোমর ধরে কাছে নিলেন তার৷ আমি লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললাম,

–‘ ভিজে যাচ্ছি তো৷ ‘

–‘ ভেজার জন্যই তো এসেছো৷ ‘

তুমি৷ আবার সেই তুমি ডাকে চুপসে গেলাম৷ আমি মুখ লুকালাম তার বুকের মাঝে৷ উনি চুল গুলো খুলে দিলেন টুপ টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে৷ উনি আমার গালে চুমু খেয়ে বললেন,

–‘ রৌদ্দুরে প্রেমের বৃষ্টির পাতা কিন্তু শেষ হয়েও হয় নি৷ ‘
আমি মুখ তুলে তাকালাম৷ উনি আমার ঠোঁট ছুয়ে বললেন,
–‘ সেই প্রেমের বৃষ্টিতে আরো কাহিনী থাকবে৷ ‘

আমি আজও তার শার্টের বোতাম আটকে দিলাম৷ বৃষ্টির মাঝে একফালি রোদ উঁকি দিতেই চমকে উঠলাম দুজনেই৷ উনি ঝট করে কোলে উঠিয়ে পা বাড়ালেন৷ আমি আজও ভয় পেয়ে তার শার্টের কলার আঁকড়ে ধরে আছি৷ গাঢ় চুমু খেলেন আমার ঠোঁট জোড়তে৷ বৃষ্টির পানি ছুয়ে যাচ্ছে সব৷ প্রগাঢ় হাওয়া বইছে সাথে সোনালি রোদ৷ আকৃষ্টতা হয়ে উঠলো কিছু মূহুর্ত৷ সাথে সাক্ষী রৌদ্দুরে বৃষ্টি৷ আমাদের প্রেমের বৃষ্টি৷ রৌদ্দুরে প্রেমের বৃষ্টি৷
সমাপ্ত
(শেষ! সবার কথা মেনেছি৷ হ্যাপি এন্ড না স্যাড এটা জানি না৷ তবে রৌদ্দুরে প্রেমের বৃষ্টিময় শেষ৷ হয়তো গল্পটা কারো মন ছুঁয়ে যায় নি৷ কাঁচা হাতের লেখা আমার ভুল হয়েছে ক্ষমা করবেন৷ আমি রোম্যান্টিক দিয়েছি এইটুকুই যথেষ্ট৷ জানি খারাপ হয়েছে অনেকে অনেক কিছু আশা করেছিলেন আমি দিতে পারি নি৷ দীর্ঘ এই জার্নিতে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি৷ আজকে গঠনমূলক কিছু বলবেন ইভেন কি কি চেয়েছিলেন তাও বলবেন৷ সবশেষ,ভুল হলে ক্ষমার চোখে দেখবেন…!)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে