রৌদ্দুরে প্রেমের বৃষ্টি পর্ব-৩৬

0
2386

#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি
#পার্টঃ৩৬
#রুবাইদা_হৃদি(sheikh ridy)

ঝড়ো হাওয়ার মতো জীবনের পাতায় যখন উত্তাল বাতাসের দাপট আসে তখন জীবনের মানেটা হঠাৎ করেই থমকে যায়৷ সব কিছুর আগে একটুকরো আশার আলো থাকলেও হয়তো কিছু সময় সেটাও থাকে না৷ গাড়িতে মন উদাস করে বাইরে ঝড়ো হাওয়া দেখে চলেছি৷ কিছু একটা হয়েছে যার জন্য,রোজ ভিউ থেকে এই রাতের আঁধারে উনি চলে এসেছেন৷ হঠাৎ করেই সে চুপসে গিয়েছে৷ আমি তার দিকে তাকালাম উনি ড্রাইভ করছেন৷ আমি তার হাতের উপর হাত রাখতেই সে আমার দিকে তাকালো৷ তার চোখ দুটো অসম্ভব লাল৷ ভয় করছে হঠাৎ৷ বাসায় ফেরার জন্য কিসের তাড়া এতো৷ আমি নীচু স্বরে বললাম,

–‘ কি হয়েছে? ‘

–‘ ইমিডিয়েটলি বাসায় ফিরতে হবে৷ ‘ উনি নিজেও মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললেন৷ কিছু একটা আছে যা খারাপ৷ হঠাৎ করেই কান্না পাচ্ছে৷ উনি আমার হাত উঠিয়ে দিলেন৷ আমি নিস্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম৷ বুকের মাঝে অজানা সুর গাইছে৷ কি এমন হয়েছে! যার জন্য সমস্ত কিছু ফেলে ছুটে চলে আসছি আমরা?

–‘ বি স্ট্রং৷ ‘

তার কথার আওয়াজে ঘোর ভাঙলো৷ বাসায় এসে পড়েছি৷ হাত বাড়িয়ে দিলেন উনি আমি নেমে দাঁড়ালাম৷ তার হাঁত ঠান্ডা৷ আমি কেঁপে উঠে তার দিকে তাকালাম উনি বাসায় যাওয়ার জন্য ইশারা করলেন৷ আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি৷ উনি নিজেই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন৷ আমি তার সাথে পায়ে পাঁ মিলিয়ে যাচ্ছি৷ প্রশ্ন করলাম,
–‘ দেখুন..! আমি সব মেনে নিতে পারি কিন্তু নীরবতা না৷ কি হয়েছে বলবেন কি? ‘

–‘ যাচ্ছি তো৷ তবে যা হয়ে যাক তুই স্ট্রোং থাকবি৷ আর মাথায় রাখবি, আমি আছি৷ ‘
আমার বুকের মাঝে আমার ভয় এসে জমা হলো৷ কি হবে?কি হয়েছে? এই সব প্রশ্নে ভারী হয়ে উঠছে আমার মন৷ বাসায় ঢোকার আগে আরেকটু অবাক হলাম কারণ,মেইন গেইট খোলা৷ উনি তাড়াতাড়ি আমাকে নিয়েই রুমে এলেন৷ ঘরময় অন্ধকার৷ আমাদের রুমে থেকে আওয়াজ আসছে৷ চাঁপা কান্নার আওয়াজ৷ ভড়কে গেলাম আরো৷ কে কাঁদছে এইভাবে? আমাদের চেনা তো কেও নেই এখানে৷ আমি ভয়ে আরেকটু সিটিয়ে গেলাম৷ অস্থির পায়ে এগিয়ে চলেছি রুমের দিকে সাথে উনিও৷ আবছা আলোয় তার মুখের রঙ পাল্টিয়ে ভয়ের ছাঁপ পড়েছে সাথে বিষাদের৷ রুমে ঢুকেই সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেলাম কবিতা আপুকে দেখে৷ থমকে দাঁড়ালাম৷ আপু অবিরাম কেঁদে চলেছে৷ আজমীর ভাইয়া তাকে জড়িয়ে রেখেছে৷ কাব্য ভাইয়া আমার হাত ছেড়ে আপুর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই আপু বিলাপ করে কেঁদে উঠে৷ উনারা এখানে কিভাবে? আমি দরজা ধরে থমকে দাঁড়িয়ে আছি৷ হঠাৎ আমাকে দেখেই আপু তার ভারী শরীর নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো৷ তার কান্না দেখে আমার চোখেও পানি এসেছে৷ আমি অশ্রুসিক্ত চোখে কাব্য ভাইয়ার দিকে তাকালাম উনি মাথা নীচু করে ফেললেন৷ কবিতা আপুকে আমি নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিতেই সে কান্নার সুরে বললো,
–‘ মামু.. মামু নেই নীতু৷ সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে৷ ‘
আমি ধাক্কা খেলাম৷ মাথায় কেও জোরে আঘাত করলে যেমন চিনচিনে ব্যাথা হয় ঠিক তেমনটা ব্যাথা অনুভব করলাম৷ হঠাৎ করেই পৃথীবি নিস্তব্ধ লাগতে শুরু করলো৷ চারদিকে অন্ধকার হয়ে উঠলো৷ আব্বুর হাসি মাখা মুখ টা হঠাৎ করেই দূরে বহু দূরে যেতে লাগলো৷ চিৎকার করে কান্না আসছে না৷ দম আটকে আসছে৷ চোখ দিয়ে পানি বের হয়েও হচ্ছে না৷ নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে৷ হঠাৎ উনি আমায় ধরতেই আমার সমস্ত কান্না গুলো বেরিয়ে আসলো৷ আব্বুর চেহারা মনে পড়তেই নিজেকে পাগল মনে হলো৷ কিভাবে কি? কোথায় কীভাবে হলো সেটা জানার চেয়ে হঠাৎ করেই মনে হলো উনারা মিথ্যা বলছে৷ আমি চিৎকার করে বললাম,
–‘ ছাড়ুন আমায়৷ মিথ্যা বলছেন আপনারা৷ আব্বুকে নিয়ে মিথ্যা বলতে বুক কাঁপলো না আপনাদের৷ ‘

–‘ নীতু, মামু নেই৷ আজ সকালে হঠাৎ করেই ব্রেন স্ট্রোক করেছে৷ কবিতা আপুরা উইকেন্ডের জন্যই আসছিলো আমাদের এখানে৷ মাঝে আব্বু ওদের ফোন দিয়ে খবর টা দেয়৷ আমার ফোন অফ ছিলো যার জন্য যোগাযোগ করতে পারে নি৷ মোবাইল অন করতেই,আপুর মেসেজ দেখলাম মামুকে আইসিউতে রাখা হয়েছে৷ কিন্তু আমি সত্যিই জানতাম না মামু নেই৷ ‘

উনার কাঁপা গলার আওয়াজে বলা কথায় হঠাৎ সবকিছু সত্যি মনে হলো৷ কান্না গুলো উঁপচে আসছে৷ আমি ধপ করে বসে পড়লাম৷ হঠাৎ করেই নিজেকে এতিমের খাতায় ফেললাম৷ উনি আমার সামনে বসে দুই হাতে জড়িয়ে নিলেন৷ আমি চিৎকার করে কান্না করছি৷ চারদিকে মানুষজন বিহীন মনে হলো৷ কান্নার ফলে কথা বের হচ্ছে না৷ শুধু উনার কলার ধরে বললাম,

— ‘ আমি আব্বুর কাছে যাবো৷ কেন আমাকে ফেলে চলে গেলো৷ প্লিজ নিয়ে চলুন৷ আমি যাবো৷ ‘

–‘ কাম ডাউন৷ আমি ব্যাবস্থা করছি৷ আম আছি তো৷ আছি আমি৷ ‘
উনার কথাটুকু শুধু কানের মাঝে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে৷ সে থাকলেও আমার আব্বু যে নেই৷ কবিতা আপুর কান্নার আওয়াজ পাচ্ছি৷ আমার জিনিয়া৷ ছোট জিনয়া ও কেমন আছে৷ মেয়েটা যে কেও নেই৷ আমি কান্নার জন্য কথা বলতে পারছি না৷ উনার চোখেও পানি৷ তার চোখের পানিতে কান্না আরো বেড়ে গেলো৷ আব্বুর থেকে দূরে থাকি নি কখনো৷ ভয় পেয়েছি কিন্তু ছেড়ে থাকতে পারি নি৷ আমার আব্বু,কেন এমন হলো৷ হেঁচকি উঠে গেছে৷ উনার পায়ে ধরে বললাম,
–‘ নিয়ে চলুন৷ আমার আব্বু৷ আমি ছুঁয়ে দেখবো৷ কেন চলে গেলো আমায় ছেড়ে৷ সবাই চলে যায়৷ আম্মুও ছেড়ে চলে গেছে৷ আব্বু কে কেন কেড়ে নিলো৷ আমায় নিয়ে যান৷ আমি বাংলাদেশে যাবো৷ কেন নিয়ে গেলো আমার আব্বুকে? ‘
উনি আমাকে টেনে উঠালেন৷ আমার চিৎকারর ভারী হচ্ছে পরিবেশ৷ আশেপাশের সবাই এসেছে চিৎকার শুনে৷ উনি শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছেন আমার৷ হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া সব ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে৷
________________
মাথার উপর বাবা নামক ছায়ার অভাব মনে হতেই আমি কান্নায় ভেঙে পড়ছি৷ জিনিয়ার হুশ নেই৷ ওর সাথে কথা বলার মতো অবস্থা যে নেই৷ আমি বিছানার চাঁদর খাঁমচে ধরর কেঁদে চলেছি৷ বুক ফাটা হাহাকার৷ কবিতা আপুর অবস্থা আরো খারাপ৷ খিচুনি উঠে বাবুর প্রবলেম হচ্ছে৷ আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য ইতালি থেকে ছুটে এসে নিজেরাই সারপ্রাইজড হয়ে গেছে৷ ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন উনি৷ আমার দিকে তাকিয়ে আছেন অনুভূতি শূন্য চোখে৷ আমার অবস্থা হয়তো মেনে নিতে পারছেন না৷আমার কাছে এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখলেন৷ আমি তার ছোঁয়া পেতেই উনার হাত আঁকড়ে ধরে বললাম,
–‘ নিয়ে যান না আমায়৷ আমি যে মরেই যাবো৷ কতো কথা বলার ছিলো আব্বুকে৷ আমি পারি নি বলতে৷ সেদিন যখন আমাকে বুকে টেনে নিলো তখন তখন…!’
উনি নিজের কান্না আটকানোর জন্য মুখ ঘুরিয়ে নিলেন৷ আমার মাথা তার বুকের সাথে চেঁপে ধরে বললেন,

–‘ সবাই সবার সাথে চিরজীবন থাকে না নীতু৷ তোকে শক্ত হতে হবে৷ মামুর জন্য দোয়া করতে হবে৷ ‘

–‘ আমি যে পারছি না৷ আমায় নিয়ে চলুন৷ আমি যাবো৷ আমার জিনিয়া যে আব্বুর লাশ দেখে পাগল হয়ে যাবে৷ ‘

–‘ ইমার্জেন্সি টিকেট পাচ্ছি না কাব্য৷ ‘ আজমীর ভাইয়া বললেন রুমে ঢুকতে ঢুকতে৷ কাব্য ভাইয়া উদাস চোখে তাকালেন৷ আমায় জড়িয়ে রেখেই মিনতির সুরে বললেন,

–‘ দুলাভাই দেখেন একটু৷ কবিতা আপু আর ওকে সামলানো দায় হয়ে যাচ্ছে৷ ‘

–‘ সাত দিন পরের টিকিট পেয়েছি তাও একটা৷ এতোদিন পর্যন্ত লাশ রাখা যে আজাব হবে৷ ‘

আজমীর ভাইয়ার কথা শুনে কান্নার পরিমাণ বেড়ে গেলো আরো৷ শেষ আশাও কি পূর্ণ হবে না৷ আমার আব্বুকে দেখতে পাবো না? ভেবেই চোখ ঝাপসা হয়ে উঠলো৷ ওইতো সামনে আব্বু দাঁড়িয়ে হাসি মাখা মুখে আমায় ডাকছে….!

সব কিছুর পরে একটা কষ্টের অধ্যায় থাকে সেইটা আমি পার করছি৷ আমি সেই সন্তান যে,আব্বুর লাশ শেষ দেখাটাও দেখতে পারি নি৷ আজ সাতদিন পার হয়ে গেছে আব্বু মারা যাওয়ার৷ ডুকরে কেঁদে উঠছি৷ উনি ক্লান্ত পায়ে আমার পাশে এসে বসলেন৷ আমার দৃষ্টি সামনে স্থির৷ হয়তো এখানে না আসলে আমি আব্বুকে দেখতে পারতাম৷ আজ বাসায় মিলাদ পড়ানো হচ্ছে৷ আমি নামাজ পড়ে চুপ মেরে বসে আছি৷ শুধু মনে হচ্ছে, আমি অপরাধী৷ উন্মনা ভাবে বললেন,
–‘ সব কিছুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে শিখ৷ ‘

আমি জবাব দিলাম না৷ উনি আমাকে টেনে নিলেন৷ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন৷ চোখের পানি আবার গড়িয়ে পড়লো৷ উনি আমার মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,

–‘ মামু নেই..! কখনো আমিও ছেড়ে চলে যেতে পারি৷ নিয়তিতে কি লেখা আছে সেটা আমরা কেও জানি না৷ ‘

–‘ আমি যে মরে যাবো৷ ‘

–‘ মরে গেলে তো ভালোই৷ কিন্তু,বাঁচতে হয়৷ সব সময় সবাই থাকবে না পাশে৷ সব কিছুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখ৷ ‘

উনি চুপ হয়ে গেলেন৷ কিছু ফোঁটা পানি আমার মাথায় পড়লো৷ নিঃশব্দের কান্নার সুর গুলো করুন৷ ঠিক তেমনটা৷ আমি নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় আছি৷ প্রিয় মানুষ গুলো হারানোর বেদনা ছুটে চলে রাতের আঁধারেও৷ শক্ত হতে হবে৷ সব কিছুর বিনিময়ে নিজেকে ঠিক রাখতে হবে৷ পাশে থাকা মানুষটার চেহারাটা দেখে হলেও আমি সব পারবো৷ সত্যি পারবো কি?
চলবে…!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে