#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি
#পার্টঃ৩৪
#রুবাইদা_হৃদি(sheikh ridy)
একা থাকলে কতশত ভয় মনের মাঝে জানান দেয়৷ গুমোট অনুভূতি গুলো উঁপচে পড়া ভয় দেয়৷ শিহরণ জাগানো কিছু অনুভূতির সাথে ঠোঁটের কোণে কিছু মূহুর্তের ভালোলাগার হাসিরা মেতে উঠে৷ সারাদিন সে ফেরে নি আজ৷ আজ আমার ক্লাস নেই যার জন্য নিজেকে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে৷ হঠাৎ করেই কান্না পাচ্ছে৷ উনি ফোন রিসিভ করছেন না৷ শুধু যাওয়ার পর ফোন দিয়ে বলেছেন, ‘ খেয়ে নিবি! আমি জলদি ফিরে আসবো৷ ‘
সেই ফিরে আসাটা, ঘন্টা পেরিয়ে দুপুর পেরিয়ে যাবে ভাবতেই পারি নি৷ বই গুলো উল্টেপাল্টে দেখেও পড়ায় মনোযোগ দিতে পারলাম না৷ শুধু তাকে দেখার বাহানা খুজে চলেছি৷ জ্বরের জন্য মুখের তেতো ভাবটা এখনো রয়েছে৷ গত দুইদিন সে আমাকে সামলাতে গিয়ে অফিস বা ক্লাস কিছুই করতে পারেন নি৷ তাই কাজের চাপ পড়েছে আজ৷ আমি এই রুমে থেকে ওই রুমে সব জায়গায় পায়চারি করছি৷ ফোন হাতে নিয়ে কবিতা আপুকে ফোন দিলাম৷ বহুদিন তার সাথে কথা হয় না৷ এতোবড় ঘটনা হলো তাতেও তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই৷ একদিন কথা হয়েছিলো তাও অল্প৷ বাসার সবার সাথে ফোন আলাপ করলেও আপুকে ফোন দেওয়া হয় না৷ আপু প্রচুর ব্যস্ত৷ তার কাজ আর সংসার নিয়ে৷ তার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠার আগেই বিয়ে আর দেশ ছেড়ে চলে গেছেন উনি৷ ফোন রিসিভ হতেই আমি হাসি মুখ নিয়ে ক্যামেরা মুখের সামনে ধরে বললাম,
–‘ তোমাকে দেখবো না,আমার বাবা টাকে দেখবো৷’
আপু হাসলেন৷ দুষ্টুমি করে পেটের কাছে ক্যামেরা ধরে বললো,
–‘ বাবার বউ আসবে কবে৷ সেই খেয়াল কি তার মামানির আছে? ‘
আমি কথা বুঝতে না পেরে লজ্জা পেলাম৷ আমাকে চুপ থাকতে দেখে আবার আপু বললো,
–‘ লজ্জা পেলে তো তোকে দারুণ লাগে নীতু৷ এইজন্যই বুঝি আমার ভাই এতো পাগল হয়েছে৷ ‘
–‘ ভালো আছো? ‘
–‘ কথা ঘুরানোর জন্য বলছিস বুঝি? ‘
–‘ তুমি না আমার বড় আপু৷ ‘
আপু জোরে হেসে উঠলেন৷ আমি লজ্জা পেলাম আবারো৷ সব গুলা এক ধাঁচের৷ লাজ লজ্জা কিছু নেই৷ হঠাৎ আপু সিরিয়াস ভাবে বলে উঠলো,
–‘ শোন নীতু, ‘
–‘ হু৷ ‘
–‘ সব কিছুর পাশাপাশি কাব্যকে সময় দে৷ ওকে বুঝতে চেষ্টা করবি৷ আর ছোট একটা অতিথি অতি জলদি আমাদের মাঝে দরকার৷ ‘
আমি তাকালাম আপুর দিকে৷ সত্যি তো, উনাকে পুরোপুরি বুঝার চেষ্টা এখনো আমি করি নি৷ আমার আবেগ গুলো নিয়েই তাকে বাধতে চাইছি৷ সে কি ফীল করে? কি চায়? সেটা তো আমি জানি না৷ চেনাজানার সম্পর্ক হয় নি আমাদের মাঝে৷ সে আমাকে যতটা বুঝে আমি কি তাকে বুঝি? না একদম না৷ সব সময় দূরে থাকার আর কাছে পাওয়ার মাঝের মনের মিল টা তো দরকার৷ সেটা তার মাঝে থাকলেও আমার মাঝে যে নেই৷
________________________
ছোট কিছু করার মাঝেও যে এতোটা আনন্দ থাকে তা বললে কম হয়ে যাবে৷ দুপুরের লাঞ্চ আমি করি নি উনাকে ফোন দিয়েও পেলাম না৷ তার প্রিয়, গরুর কালা ভুণা আর বিরিয়ানি৷ ফুঁপিকে ফোনে রেখে রেঁধে চলেছি৷ নিজের হাতের বানানো কিছু নিয়ে গিয়ে আজ চমকে দিবো৷ ভেবেই মনের ভেতরে খুশির প্রজাপতি ডানা মেলছে৷
–‘ দমে ফেল এখন৷ ‘
আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম৷ এইটা আবার কি৷ ফুঁপি আমার মুখভঙ্গি বুঝতে পেরে বুঝিয়ে দিলেন৷ সাধারণ একটা বিষয় পারি না৷ ভেবেই কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে হলো৷ পেয়াজ কাটতে গিয়ে আবার বিপত্তিতে পড়লাম৷ কেঁদে ভাসানোর জোগাড়৷ একটু আগে কেটেছি আবার কাটছি৷ এই পেয়াজ নামক জিনিস টা না দিলে হয় না? আল্লাহ জানেন,কে এই পেয়াজ দেওয়ার নিয়ম আবিষ্কার করেছিলো৷ বিরিয়ানি নামাতেই ফুঁপিকে আবার ফোন দিলাম৷ রীতিমতো ফুঁপি আর জিনিয়া হাসতে হাসতে শেষ৷ প্রায় চার ঘন্টা ধরে রান্না ঘরেই রান্নার কাজে ব্যস্ত৷ কিভাবে কি করবো ফুঁপি বলতেই আমি ফোন কেটে দেই৷ এরা আবার হাসিতে লুটোপুটি খাবে৷
ডিম বেগুনের ভাজি৷ বিরিয়ানির সাথে সে খায়৷ ডিম প্রথমে ভেঙে লবণ আর মরিচের গুড়ো দিয়ে ফেটিয়ে কেটে রাখা বেগুন তার মাঝে গুলিয়ে গরম তেলে ভেজে নিলাম৷ এই একটা জিনিস ভালো মতো পারি৷ ভেবেই যুদ্ধক্ষেত্র জয়ের হাসি হাসলাম৷ এইবার অপেক্ষা তার আসার৷
আমি ফ্রেশ হয়ে বসে আছি৷ ফোন হাতে নিয়ে৷ এইবার টেনশন হচ্ছে৷ বারবার ফোন দেওয়ার পর কেন ফোন রিসিভ করছেন না৷ খাবার টেবিলের সাজিয়ে রাখা খাবারে কেমন শূন্যতা৷ আমি আলুথালু পায়ে উঠে দাঁড়ালাম৷ হঠাৎ করেই ভীষণ জ্বর উঠলো মনে হচ্ছে৷ কিচেনে গিয়ে লাঞ্চবক্স এনে সব গোছালাম৷ রুমে গিয়ে অফিসের ঠিকানা খুজে চলেছি৷ সব কেমন লাগছে৷ টেনশন করার মতো সময় নেই৷ তাকে অফিসেই পাবো৷
বার্লিনের জায়গা অচেনা ,বড্ড অচেনা আমার কাছে৷ জানি না কিভাবে যাবো কিন্তু যাবো এইটা নিশ্চিত৷ হাতে লাঞ্চবক্সের সাথে ঠিকানা দেখে চলেছি৷ উনি বলেছিলেন,বেশি দূরে না৷হাইওয়ের সামনে কতগুলো গাড়ি দেখতে পেলাম৷ ভাগ্যবশত ক্রুজকে দেখলাম৷ গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে৷ আমি উনার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ফোন রেখে কিছু একটা বললেন৷ আজও তার ভাষা বুঝতে পারলাম না৷ তবে তাকে চিনি এইটাই বড় কারণ লাগছে আমার৷ কার্ড তার দিকে বাড়িয়ে দিতেই উনি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন৷ গাড়ির দরজা খুলে দিতেই আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম৷ ফোন না ধরার অপরাধে আজ তাকে শাস্তি পেতেই হবে৷ বারবার ফোন না ধরে আমাকে টেনশনে ফেলে দেন৷ মাথার রগ ছিড়ে যাচ্ছে৷ জ্বর হঠাৎ করে বাড়ছে কেন৷ ফোন হাতে নিয়ে আবার ফোন দিলাম৷ অবশেষে টানা চল্লিশ বার ফোন দেওয়ার পর সে রিসিভ করলো৷ ক্লান্ত গলায় আমি বললাম,
–‘ আপনাকে খুন করবো আমি৷ অনেক কষ্ট দেন আপনি আমাকে৷ মেরে ফেলবো৷ ‘
উনি উত্তেজিত গলায় বললেন,
–‘ কি হয়েছে৷ তোর গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? ‘
–‘ অফিসের বাইরে দাঁড়ান৷ আমার হেটে যাওয়ার শক্তি যে নেই৷’
অনেক কষ্টে চোখ খুলে রেখেছি৷ ফোনের লাইন কাটতে পারছি না৷ ক্রুজও উত্তেজিত গলায় কিছু একটা বলছে৷ গাড়ি থামিয়ে আমার হাত থেকে ফোন নিয়ে উনার সাথে কিছু একটা বললেন৷ তারপর.. তারপর……
–‘ আমি আর কখনো তোকে ফেলে যাবো না৷ ‘
কাঁপা কন্ঠের আওয়াজে ভারী হচ্ছে চারপাশ৷ হাতে ইঞ্জেকশন দেওয়ার ব্যাথায় চোখ-মুখ কুঁচকে উনার হাত শক্ত করে ধরলাম৷ মাথা ঝিমঝিম করছে৷ আমি সব ভুলে ঠোঁট ভিজিয়ে আলতো করে বললাম,
–‘ জানেন? আপ আপনার জন্য রান্না করেছি৷ ‘
উনি আমায় বসে থেকেই জড়িয়ে ধরলেন৷ আমি চোখ মেলে তাকিয়ে নিজেকে রুমে আবিষ্কার করলাম৷ তার শরীরের গন্ধে প্রাণ ফিরে পাচ্ছি৷ আমি তার শার্ট খাঁমচে ধরলাম৷ উনি আমাকে ছেড়ে ভারাক্রান্ত গলায় বললেন,
–‘ জ্বর শরীরে কেন বেরিয়েছিস? ‘
–‘ আপনি কেন ফোন ধরেন নি?’
–‘ আরে বাবা,আমি ব্যাস্ত ছিলাম৷ আজ প্রেজেন্টেশন ছিলো মিটিংয়ে ফোন সাইলেন্ট ছিলো৷ তারপর ক্লাসের এসাইনমেন্টের প্রেজেন্টেশন৷ ‘
আমি উঠে বসলাম৷ উনার কলার ধরে আমার কাছে টেনে নিয়ে বললাম,
–‘ এই, আপনি আমাকে এভোইড করছেন? পুরোনো হয়ে গিয়েছি তাই তো৷ ‘
উনি নিজে থেকে আরো কাছে এগিয়ে আসলেন৷ আমি নিজের কঁপাল তার কঁপালে ঠেকিয়ে দিলাম৷ আমার শরীরের উষ্ণতায় সে বোধহয় কেঁপে উঠলো৷ স্নিগ্ধ গলায় বললো,
–‘ ভালোবাসা বুঝি পুরোনো হয়? ভালোবাসা বয়সের সাথে বৃদ্ধি পায়৷ সেই সাথে অনুভূতি গুলো আরো জোড়ালো হয়৷ যতটা জোড়ালো হলে,দূরে থেকেও অনুভব করা যায় ঠিক ততটা৷’
–‘ আমি কেন করি না অনুভব? তবে কি আমার ভালোবাসা জোড়ালো নয়..! ‘
উনি আমার ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালেন৷ আমি ছাড়লাম না৷ নিজে থেকেই আজ রেসপন্স করলাম৷ কিছুক্ষণ,কিছু মূহুর্ত৷
–‘ তোর ভালোবাসা আমার ভালোবাসার থেকে গভীর৷ এর জন্যই তো শূন্যতা অনুভব করিস আমার না থাকার৷ আমার হিংসে হয় নীতু৷ তুই কেন আমার থেকে বেশি ভালোবাসিস আমায়? ‘
উনার কথায় থমকে গেলাম৷ বলেন কি উনি৷ আমি শুয়ে পড়লাম৷ উনিও আমার পাশে শুয়ে পড়লেন৷ আমি তার বুকে মুখ গুজে দিলাম৷ বললাম,
–‘ আমি কিছু জানি না৷ আমি আপনাকে একমূহুর্ত না দেখে থাকতে পারি না৷ দরকার হলে চব্বিশ ঘন্টা আপনার সাথেই থাকবো, একদম বিরক্ত করবো না৷ তবুও আপনাকে চাই৷ সব সময় আশেপাশে চাই৷ ‘
–‘ হুট করে মারা গেলে কিভাবে থাকবি? ‘
তার কথায় হু হু করে উঠলো বুকের মাঝে৷ সেটা আমি ভাবতেও চাই না৷ কান্না করে উঠলাম ফুঁপিয়ে৷ ভালোবাসায় এতোটা আকৃষ্ট সত্যি কি মানায় না? যদি না মানায় তাহলে কেন ভালোবাসা নামক শব্দটা আছে? জানি না তবে আমি এতোটাই আকৃষ্টতা নিয়ে থাকতে চাই,ভালোবাসতে চাই৷
পরিপূর্ণ একটা সকাল৷ আবেশের আদরে ঢাকা মোহনা৷ সে শাওয়ার নিচ্ছে আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি৷ মোট কথা কিছুতেই উনার থেকে দূরে যাওয়া যাবে না৷ দরজা খুলে বের হয়ে আসতেই আমি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলি৷ ছিঃ! শুধু তোয়ালে পড়ে কেও আসে৷ ফর্সা শরীরে মুক্তোর মতো পানি গুলো লেগে আছে৷ আমার চোখ বড্ড বেহায়া..! না চাইতেও আঙুলের ফাঁক দিয়ে চুপিচুপি দেখে চলেছে৷
–‘ দেখা শেষ?’
–‘ না তো৷ ‘
কথার পৃষ্ঠে জবাব দিতে গিয়ে সত্যিটা বলে দিয়েছি৷ আমি মুখ ঢেকেই ঘুরে গেলাম৷ উনি আমার পিঠের উপর আলতো ছোয়া দিতেই কেঁপে উঠলাম৷ দৌড়ে বাইরে চলে আসলাম৷ উনি জোরে জোরে বললেন,
–‘ চব্বিশ ঘন্টার একঘন্টাও হয় নি৷ এখনি দৌড়ে পালাচ্ছিস৷ সারাদিনের কি হবে ভেবে দেখেছিস? ‘
উনি কি আমাকে থ্রেট করছেন? আমি অন্য রুমে এসে পড়লাম৷ এখানে থেকে চিৎকার করে বললাম,
–‘ চব্বিশ ঘন্টার প্রথম প্রহর এখনো যায় নি মিস্টার. আর আপনাকে ভয় পায় কে শুনি? ‘
–‘ তাই তো৷ কে পায়৷ দেখা যাবে মিসেস. প্রথম প্রহরের ডোজ নিতে পারো নি…! ‘
তুমি৷ শব্দটা ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে৷ আমি চোখ বন্ধ করে উপভোগ করলাম৷ মিষ্টি শব্দ,মিষ্টতার মতো লাগে….!
চলবে…
(ভুল-ক্রটি ক্ষমার চোখে দেখবেন৷)