#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি
#পর্বঃ২৬
#রুবাইদা_হৃদি(sheikh ridy)
বার্লিনের সৌন্দর্য অপূর্ব.. জনবহুল এই রাজ্যে সব কিছুই মনোমুগ্ধকর৷ জার্মানের রাজধানী বার্লিন৷ এতোটা আকৃষ্ট হবে জানলে আমি আরো আগেই চলে আসতাম৷ গাড়ি ছুটে চলেছে হাই স্পিডে৷ আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সুন্দর সুন্দর ঘর আর নাম না জানা গাছের ছুটোছুটি দেখে চলেছি৷ আর উনি আমার খোলা চুলের ছুটোছুটি সামলাতে ব্যস্ত৷ আমার চুল ভিজে গিয়েছিলো বলেই সে খুলে দিয়েছে৷ আমার সেদিকে পাত্তা নেই৷ আমি বাইরে তাকিয়ে থাকতে ব্যাস্ত আর সে আমার দিকে ব্যস্ত৷ আমার চুল গুলো তার হাতে প্যাচিয়ে নিচ্ছেন৷ সেদিকে আমার কোনো দ্রুক্ষেপ নেই৷ অন্য সময় হলে চুলের টান সহ্য না করতে পেরে কেঁদে উঠতাম৷ কোমর ছাড়ানো চুল৷ উনি হঠাৎ চুল ধরে টান দিতেই আমি তার বুকের উপর ঝুঁকে পড়ি৷ ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠতেই সে তাড়াহুড়ো করে ছেড়ে দেন৷ উনি ব্যস্ত হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
–‘ ব্যাথা পেয়েছিস? আমি তো আলতো হাতে টান দিতে চেয়েছিলাম৷ ইশ..! এখনো আগের মতোই চুলের টান সহ্য করতে পারিস না..! ‘
আমি উনার বুকে থেকে মাথা উঠিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম,
–‘ আপনি কি করে জানলেন? ‘
উনি বোধহয় আমার কথা শুনে কিছুটা লুকোনোর চেষ্টা করলেন৷ কথা ঘুরানোর জন্য বললেন,
–‘ চুল গুলো বেঁধে ফেল..! আমায় বড্ড জ্বালাতন করছে৷ ‘
আমি ইচ্ছা করেই তার কথা না শুনে চুল গুলো আরো উড়িয়ে দিলাম৷ যাতে উনার চোখে মুখে আছড়ে পরে৷ আমি তার থেকে খানিকটা সরে বসলাম যাতে আরো ভালো ভাবে তাকে জ্বালাতন করতে পারে৷ আমার কাজ দেখে উনি কিছুই বললেন না৷ উল্টো হাওয়ার তালে চুলের ঝাপটা না সামলে নিজের মুখ ডুবিয়ে দিলেন৷ আমার কাছে নিজে এগিয়ে এলেন তারপর জোরে জোরেই বললেন,
–‘ গাড়ির মধ্যে তোর প্রেম পাচ্ছে? ওকে নো প্রব্লেম আ’ম রেডি৷ ‘
আমি উনার কথা শুনে ড্রাইভারের দিকে তাকাই তারপর উনার দিকে৷ ড্রাইভার ছেলেটা কি ভাবছে? উনার আসলেই লজ্জা নেই৷ একদম নেই৷ আমি চুল গোছাতে নিলে উনি একদম গোছাতে দিলেন না৷ আমি যতবার চুল খোঁপা করছি৷ উনি বিগড়ে দিচ্ছেন৷ লুকিং গ্লাসে উনার আর আমার স্তব্ধ ঝগড়া দেখে জার্মানি ড্রাইভার ছেলেটা হাসছে৷ উনিও তার হাসির সাথে তাল মিলালেন৷ আমি আবার চুল বাঁধতে গেলে উনি আমার হাত টেনে ধরে তার সাথে হেসেই চলেছে৷ এইবার বিরক্ত সাথে প্রচুর রাগ লাগছে৷ আমি রেগে বললাম,
–‘ ছাড়ুন..! ও কি ভাবছে বলুন তো৷ ‘
উনি হাসতে হাসতেই জবাব দিলেন,
–‘ ওদের অভ্যাস এর চেয়েও বেশি আছে..! ‘
–‘ মানে কিসের অভ্যাস..? ‘ আমি অবাক সুরে জিজ্ঞেস করতেই উনি বললেন,
–‘ PK অভ্যাস..! ‘ আমি ঘুরে তাকাতেই উনি আবার হাসলেন৷ ব্যাপারটা বুঝতে কিছুক্ষণ লাগতেই আমি উনার থেকে হাত ছাড়িয়ে দূরে সরে গিয়ে বললাম,
–‘ ইয়াক ছিঃ! আপনি এতো অসভ্য কেন? সারাদিন কি কি বলেন৷ আমার কাছে একদম আসবেন না৷ ‘
উনি আমার দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে জার্মানি ছেলেটাকে বললেন,
–‘ ক্রুজ.. ডু ইউ নো এনিথিং এবাউট রোম্যান্স? ‘
জার্মানি ছেলেটা কি বলল তা বুঝলাম না৷ কারণ সে জার্মানি ভাষায় কি সব বলে দিলো৷ তার কথা শুনে কাব্য ভাইয়া হু হা করে হেসে উঠলেন৷ আমি গাড়ির দরজার সাথে একদম মিশে বসে আছি৷ না জানি কি উল্টাপাল্টা বলেছেন৷ আমাকে টেনে তার কাছে নিয়ে এসে বললেন,
–‘ ডু ইউ নো ? ‘
আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে থেমে থেমে বললাম,
–‘ না.. না এ একদম জানি না.! ‘
উনি মুচকি হেসে আমার বাঁধা চুল গুলো খুলে দিয়ে বললেন,
–‘ আচ্ছা শিখিয়ে দিবো..! ‘
আমি বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছি৷ উনি চোখের পাতায় ফুঁ দিয়ে বললেন,
–‘ খাঁটি বাংলা ভাষায় বলছি তাই উনার বোঝার উপায় নেই..! অন্য সময় না হয় প্রাক্টিক্যালি শিখিয়ে দিবো৷ ‘
আমি উনার মুখে হাত দিয়ে ঢেকে ফেললাম৷ হাত দিয়ে ঢেকেও শান্তি নেই৷ উনি হাতের তালুতে চুমু দিচ্ছেন৷ উফফ! কি অসহ্য ব্যাক্তি..! হাত দিয়ে ঢেকে রাখা অবস্থাই উনি বললেন,
–‘ অসহ্য হই আর অসভ্য সহ্য কিন্তু তোকেই করতে হবে..! ‘
_____________________________
রাস্তায় পড়ে আছে হলুদ রাঙা ফুল৷ সম্পূর্ণ রাস্তা যেন আগমণ জানাচ্ছে আমাদের৷ মৃদু হাওয়ার তালে দুলে চলেছে নাম না জানা হলুদ ফুলের গাছটা৷ আমি বিছানো ফুলের উপর পা রাখতেই একদফা ভালোলাগার ছোঁয়া মনে প্রাণে গেঁথে যায়৷ অচেনা শহরে এই উন্মাদ কাব্য ভাইয়াকে নিয়ে থাকতে খুব একটা খারাপ লাগবে না বোধহয়৷ লাগেজ গুলো ক্রুজ আর উনি সাদা ডুপ্লেক্স বাড়ির আউটডোরে রেখে আসলেন৷ আমি ঘুরে ঘুরে বিশাল বাগানের সারি সারি গাছ আর ফুল দেখে চলেছি৷ বাগানের এককোণায় টিউলিপ দেখতেই মন টা জুঁড়িয়ে যায়৷ হয়তো তাকে চিনি বলেই এতোটা আনন্দ লাগছে৷ আমি টিউলিপ ছুঁতে এসে ভুলেই গিয়েছিলাম কাব্য নামক মানুষটা আমার সাথে আছে৷ এতোটা বিভোর হয়ে গিয়েছে সে কখন আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন টের পাই নি৷ লাল রাঙা টিউলিপটা ছিড়তেই উনি ঝট করে আমায় কোলে তুলে নেন৷ আমি আবারো ভয় পেয়ে তার শার্ট খাঁমচে ধরি৷ এইভাবে কেউ কোলে উঠায়৷ আর একটু হলেই আমার আত্মা মনে হউ উঁড়ে যেত৷ আমাকে ভয় পেতে দেখে উনি কঁপাল কুচকে ফেলেন৷ বললেন,
–‘ এমন ভাব করিস যেন আমি তোকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছি..!’
উনার কথাতে কিছুটা অভিযোগের আভাস৷ আমি কি সত্যিই বেশি করছি? আমি উনার শার্ট ছেড়ে দিয়ে লাল টিউলিপ উনার মুখের সামনে ধরে বললাম ,
–‘ লাল টিউলিপ, লাল গোলাপ, ভালোবাসার প্রতীক..! ‘
উনার মুখে হাসির রেখা ফুঁটে উঠেছে৷ সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
–‘ আর বরকে হুটহাট চুমু দেওয়া পবিত্রতার প্রতীক৷ ‘
আমি মূহুর্তেই উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
–‘ ওইটা ভুল,, বরের জায়গায় বউ হবে..!’
ওহহহ শীট..কি বললাম এইটা৷ আমি মুখ কাঁচুমাচু করতেই উনি মুচকি হেসে এগিয়ে গেলেন৷
বাসার সামনে এসে নামিয়ে দিলেন আমায়৷ ঘরে যাওয়ার আগে আমার হাত আঁকড়ে ধরে বললেন,
–‘ নতুন শুরু, নতুন পথ চলা
একেটা দিন তোকে যত্ন করে আমার মঝে রাখতে চাই..! সব কিছুতে তোকে চাই৷ ‘
আমি কি বলবো খুজে পেলাম না৷ শুধু উনার হাতটা শক্ত করে ধরলাম৷ অনেক সময় নীরবতার চেয়ে সুখের উত্তর আর কিছুই নেই…!
দুটো বেড রুম৷ প্রত্যেকটা রুম সাদা রঙের ছড়াছড়ি৷ গ্লাস দিয়ে মোড়ানো রুম গুলো৷ ভেতর থেকে বাইরে দেখা গেলেও বাইরে থেকে ভেতরে দেখা যায় না৷ সব কিছুরে আভিজাত্যের আধুনিক ছাঁপ৷ ফার্ণিচারগুলো কাঁচের৷ কাঁচ বলেই হয়তো এতোটা শোভা পেয়েছে সব কিঁছু৷ আমি ফ্রেশ হয়ে এসেই চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছি৷ বেড রুমের সাথেই পাশে সুইমিং পুল৷ আর সেখানে দাঁড়ালেই সমুদ্রের গর্জন৷ এতোসুন্দর হয়তো না হলেই পারতো৷ আমি পুলের পানিতে হাত ছোঁয়াতেই কোথা থেকে এসে আমার হাত সরিয়ে নিলেন উনি৷ কিছু না বলেই টেনে রুমের ভেতর নিয়ে এলেন৷ এতো জলদি সব কিছু হওয়াতে আমি কিছু বলার সুযোগ পেলাম না৷ উনি আবার আমাকে বেডের মধ্যে বসিয়ে মাথায় হাত দিলেন৷ আমি ব্যাথা পেতেই শব্দ করে উঠি৷ উনি ব্যস্ত হয়ে ফুঁ দিতে লাগলেন৷ আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে সেদিনের মতো উনার কথা কপি করে বলালাম,
–‘ আমার চেয়ে আপনি ব্যাথা পেয়েছেন বেশি সেটা কি জানেন.?’
উনি আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে মলন লাগিয়ে দিলেন৷ আমি উনাকে জ্বালানোর জন্য বললাম,
–‘ আহ..! লাগছে তো৷ ‘
উনি আবার ব্যস্ত হয়ে উঠে বললেন,
–‘ আর লাগবে না আর একটু..!’
আমি মুখ টিপে হেসে উঠলাম৷ সে অনেকটা পসেসিভ৷ এতোটা সুখ আমার কাছে না আসলে আমার জীবন বোধহয় অন্য হতো৷ আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
–‘ এতো সুন্দর বাড়ি কার? ‘
–‘ আমাদের..! ‘
আমাদের ছোট একটা শব্দ হলেও মনের ভেতরের সমস্ত ভালোলাগা গুলো ডানা মেলে উড়তে শুরু করলো৷ আমি অনেক বার আমাদের শব্দটা আওড়ালাম৷ আর বার বার আমার মনে জোয়ার বইছে৷ এতোটা ভালো কেন সে?
___________
ডিনার করেই সিম পাল্টিয়ে সবার সাথে কথা বলে এইবার শান্তি লাগছে৷ আমি পানসে মুখ নিয়ে সারা ঘর সাজাচ্ছি৷ উনি কোথাও একটা গিয়েছেন আমাকে একা রেখে৷ যাওয়ার আগে শুধু বলে গিয়েছেন অফিসের কিছু একটা কাজে যেতে হবে ইমিডিয়েটলি৷ আমিও প্রশ্ন করি নি৷ এখন বিরক্ত লাগছে৷ সারা ঘরে আমি ছাড়া কেও নেই৷ একরাশ মন খারাপ নিয়ে আমার আর তার বিয়ের একটা ছবি দেখছি৷ নিঁখুত সাজ..নিজেকে দেখলে হিংসে লাগে৷ সারাদিনের জার্নিতে ক্লান্ত লাগছে সাথে ঘুম৷ বাইরে সোডিয়ামের আলোয় বোঝার উপায় নেই দিন না রাত৷ হলুদ ফুল গুলোর উপর সাদা আলো পড়ছে৷ মোহময় লাগছে..! একগুচ্ছো রাতের আঁধারে হাত ধরে হাটার মতো সুন্দর পরিবেশ৷ গাড়ির আওয়াজ পেতেই আমি দৌড়ে গেটের কাছে যাই৷ আজ হাতে হাত রেখে হাটবো সব ক্লান্তিকে ছুড়ে ফেলে৷ দরজা খুলে দিতেই তার মুখ দেখে আমার মুখে হাসি ফুঁটে উঠে৷ আমি আদুরে ভাবে বললাম,
–‘ শুনেন,, আমি রাস্তায় হাঁটবো হলুদ ফুলের উপর৷’
উনি কিছু না বলে ঘরে ঢুকতেই পাশে একজন মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি৷ আমি অবাক চোখে তাকাতেই উনি বললেন,
–‘ রাই আসো..!’
আমি থমকে দাঁড়ালাম নামটা শুনে৷ আমাকে সরতে না দেখে উনি আবার বললেন,
–‘ রাই কে বাসায় ঢুকতে দে নীতু..! ‘
চলবে….
( কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না..ভুল গুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন..!)
#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি
#পার্টঃ২৭
#রুবাইদা_হৃদি(sheikh ridy)
বন্ধ ঘরের গুমোট ভাবটা আমায় অনুভূতি শূন্য করে দিচ্ছে৷ একটা নাম আমার জীবনটা থেকে মুছে ফেলতে পারলে বোধহয় শান্তি লাগতো৷ এতোটা তীব্র ব্যাথা কেন হচ্ছে বুঝতে পারছি না৷ বার্লিনে রাই কেন এসেছে সেটার থেকে বড় কথা সে কাব্য ভাইয়ার সাথে কেন৷ যদিও আমি রাই কে আগে কখনো দেখি নি তবুও নামটা তো আর অজানা নয়৷ আমার বুকের ভেতরের কষ্ট গুলো দলা পাকিয়ে গলার মাঝে আটকে আসছে৷ তার কেন আসতে হবে? আর কেনই বা আমাকে বেঁধে রাখতে হবে৷ সব কিছু তে কি আমাকে ব্যবহার করেছেন উনি? আমার কি দোষ? আমি তো আর নিজে থেকে বলি নি, আমায় বিয়ে করুন৷ আমিরের সাথে বিয়ে হলেই বা কি হতো৷ নিজে থেকে সব কিছু ঠিক করে আবার পুরোনো অতীত টেনে নিয়ে আসছেন৷ আমি রুমের মাঝে বসে আছি৷ রাতের আঁধার শেষ হতেই রাই নামটা আরো তীব্র ভাবে আমার কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷ আমাদের পাশের রুম তাকে দেখিয়ে দিতে গিয়েছেন উনি৷ আমি প্রশ্ন করি নি৷ করতে ইচ্ছা হচ্ছে না৷ সে রাই..! তার অতীত..! তবে আমি কি ছিলাম? কিছু না। আমাকে এখানে নিয়ে আসার কারণ কি তার? সে একা আসলেই তো পারতো৷ এতো পাগলামি,উন্মাদনা এইগুলা কি ছিলো তবে? দরজায় টোকা পড়তেই আমি চুপ মেরে থাকি৷ হুট করে মনে হলো রাই’য়ের সাথে সে আছে..! মনে হতেই দরজা খুলে দিতেই তার হাসি মুখ নজরে পড়ে৷ আজ সেই হাসিতে আমার মাঝে মুগ্ধতা বিরাজ করছে না৷ শুধু মনে হচ্ছে হাসির পেছনে রাই আছে৷ আমার থমথমে মুখ দেখে উনি আমার দিকে ভ্রু কুচকে বললেন,
–‘ মেঘ জমেছে কেন? ‘
উনার কথা শুনে আমি জ্বলে উঠলাম৷ উত্তর না দিয়ে উনাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলাম৷ উনি অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন..! আচ্ছা উনি কি জানেন না আমি রাইয়ের কথা জানি? নাকি ভুলে গেছেন৷ তাহলে এমন স্বাভাবিক ব্যবহার কেন করছেন..! কাঁন্না গুলো উঁপচে পড়েও ফিরে যাচ্ছে৷ নিস্তব্ধ জায়গায় কান্না করার মাঝেও শান্তি আছে৷ তবে কান্না করার জন্য নিদিষ্ট কারণ গুলো শক্তপোক্ত হলে গলার মাঝে আটকে থাকা কান্নারা বেরিয়ে আসে৷ আমার কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কান্না আসছে না৷ কান্না না আসার ফলে রাগ হচ্ছে৷ সেই রাগ টা অভিমানে জড়িয়ে যাচ্ছে সাথে হতাশায়৷ আমি নির্লিপ্ত ভাবে কিচেনে এগিয়ে গেলাম৷ উনার সামনে যেতে কেন যেন বাঁধছে আমার৷ আমি তো প্রশ্নের উত্তর তার কাছেই পাবো৷ তাহলে পালিয়ে বেড়াচ্ছি কেন? হয়তো বা তার মুখ থেকে কথাটা শুনতে পারবো না৷ ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানি বের করলাম৷ ইচ্ছা হচ্ছে পানি গুলো নিজের মাথায় ঢেলে দেই৷ হয়তো এতে জট গুলো খুলবে৷ বোতল খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, ” রাই কেন এলো?” তার সাথে তো উনার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন সেই অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে৷ ফুঁপি কি জানে তার ছেলে প্রাক্তন কে নিয়ে এসেছে? হয়তো কেও কিছুই জানে না..! আবার হয়তো জানে৷ তার সাথে হয়তো রাইয়ের সম্পর্ক ছিলো৷ কিন্তু রাইয়ের তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে আর সে ধোঁকা দিয়েছিলো৷ তাহলে? সব কথা তাহলে হয়ে ঘুরেফিরে যাচ্ছে৷ মাথায় ব্যাথা হচ্ছে৷ বোতলে থেকে সম্পূর্ণ ঠান্ডা পানি খেতেই উনি ঝড়ের গতিতে এসে হাত থেকে বোতল কেড়ে নিয়ে বললেন,
–‘ ঠান্ডা পানি কেন খাচ্ছিস? পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারছিস নি তার উপর ঠান্ডা পানি৷ পাগল হয়ে গিয়েছিস?’
আমি আবারো উনাকে উপেক্ষা করলাম৷ পাশে থাকা নরমাল পানি নিয়ে বসে খেলাম৷ উনি দাঁড়িয়ে আছেন৷ আমি পানির গ্লাস রেখে আবার ফ্রিজ খুলে ডিম বের করলাম৷ উনি আবার আমার হাত থেকে ডিম নিয়ে বললেন,
–‘ খিদে পেয়েছে..? এর জন্য বুঝি আষাঢ়ে মেঘ জমেছে মহারাণীর মুখে? আমি ভাবলাম হয়তো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে..! ‘
উনার কথার কোনো কিছু কানে নিলাম না৷ আমি উনাকে এভোয়েড করছি সেকি বোজার চেষ্টা করছে না? আর এতো বড় একটা কাহিনি করে স্বাভাবিক আছেন কি করে সেটা ভেবেই আমার ভ্রু কুচকে এলো৷ অন্যমনস্ক থাকার জন্য ডিম ভেঙে দেওয়ার সময় তেলে হাত ডুবিয়ে দিয়েছে৷ জোরে চিৎকার করে হাত সরাতেই উনি দ্রুত আমার কাছে আসেন হাত নিয়ে বোতল থেকে ঠান্ডা পানি ঢালতে ঢালতে আতংক নিয়ে বললেন,
–‘ এতো কেয়ারলেস কেন তুই? ইশ..! হাত তো পুড়লে তোর পুড়েছে৷ কারো কিছু হয়েছে? ‘
–‘ হাত পুড়েছে কিন্তু হৃদয়? সেইটা পুড়ছে আপনি কি দেখছেন?’
উনি পানি ঢালা বন্ধ করে দিয়ে আমার দিকে অবাক চোখে তাকালেন৷ তার দৃষ্টিতে স্পষ্ট সে আমার বলা কথার মানে কিছু বুঝতে পারে নি৷ বোঝা না বোঝা তার ব্যাপার..! সে কষ্ট দিয়েছে আমায়৷ এই অজানা অচেনা শহর বার্লিনে এনে তীব্র কষ্ট দিয়েছে রাই নামক মেয়েটাকে এনে৷ অতীত নামক শব্দটা অতীত বলতেই মানায়৷ বর্তমানে সেই অতীত নামক শব্দটা বড্ডা বেমানান৷
____________________
কখনো মনের সাথে যুদ্ধ করেছেন? টিকে থাকার যুদ্ধ৷ সেই যুদ্ধ অনেক কঠিন..! পাহাড়ে উঠার উঁচু চূড়ার থেকে কঠিন৷ সেখানে কোনো সমতল ভূমি নেই। আর মনের যুদ্ধে কোনো ভূমি নেই৷ আছে শুধু একরাশ হাহাকার৷ না বলা, না জানা হাজার খানিক কষ্টের সমুদ্র৷ আমি দগ্ধ হাত নিয়ে ডিভানে বসে আছি৷ রাতের আঁধার কুচকুচে কালো.. সেই সাথে আমার মনের উজ্জ্বল আলো গুলো এই আঁধারে মিশিয়ে যাচ্ছে৷ দৃষ্টি আকাশের দিকে..! আমার অন্যদিকে মন নেই৷ শুধু রাই নামটা মনে হচ্ছে৷ সে কি আমার থেকে সুন্দরি? এতো বছর পরও তাকে নিয়ে কাব্য ভাইয়ের আগমণ৷ আমার হাতে টান অনুভব হতেই ভয় পেয়ে পাশে তাকিয়ে তার রক্তলাল চোখদুটো দেখতে পাই৷ আমি হাত টেনে সরিয়ে নিতে গেলেই উনি ধমকে উঠে বললেন,
–‘ কি সমস্যা? কি সমস্যা তোর? এমন করছিস কেন..! হাত পুড়িয়ে ভাব দেখাচ্ছিস? কাকে দেখাচ্ছিস? তোর ভাবের ধার কে ধারণা করে..! ‘
–‘ আমার হাত পুড়ে যাক,, সব পুড়ে যাক তাতে কাওকে ধার
ধারণ করতে আমি বলি নি৷ ‘ আমি নির্লিপ্ত গলায় বললাম৷
উনি আবার চিল্লিয়ে বললেন,
–‘ টেল মি হোয়ের ইউর প্রব্লেম ইজ..ড্যাম ইট…! ‘
আমি কেঁপে উঠলাম এইবার৷ রেগে গিয়েছেন উনি৷ ভয়টা উনার সামনে আনলাম না৷ আমিও সমান তালে চিৎকার করে বললাম,
–‘ আমার কোনো প্রব্লেম নেই..নেই কোনো প্রব্লেম৷ শুনেছেন কোনো প্রব্লেম নেই৷ আপনি হচ্ছেন আমার প্রব্লেম৷ ‘
উনি গম্ভীর গলায় বললেন,
–‘ বেশি বারাবাড়ি করছিস তুই..! ভুলে যাস না আমি তোর স্বামী..! ‘
উনার এতোটুকু কথা শুনে রাগ হুর হুর করে বেড়ে গেলো৷ পুড়ে যাওয়া হাতটা নিজেই শক্ত করে ধরলাম৷ ধরার ফলে জ্বলে উঠছে৷ ব্যাথা সহ্য করে নিয়ে বললাম,
–‘ এই পুড়ে যাওয়া ব্যাথা আমি সহ্য করতে পারছি কিন্তু আপনি নামক মানুষটার কাজ গুলো আমি সহ্য করতে পারছি না৷ কি চান আপনি? দোটানায় কেন রাখেন৷ আমাকে কি জন্য এনেছেন এখানে? আপনার আর তার প্রেম কাহিনি দেখাতে?’
উনি তাড়াতাড়ি আমার হাত উনার হাতে আবদ্ধ করে নিলেন৷ ফুঁ দিচ্ছেন৷ উঠে গেলেন যাওয়ার আগে শুধু বললেন,
–‘ হাত যদি আবার ওইভাবে ধরিস আমি তোকে কিছু বলবো না..! তোর সব কিছু আমার অংশের সাথে মিলে গেছে৷ ব্যাথা তুই নিজেকে দিচ্ছিস না আমাকে দিচ্ছিস..! ‘
আমি উনার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছি৷ আমার জন্য উনার কেন কষ্ট হচ্ছে? তার তো রাই আছে৷ তবে মেয়েটা কোথায়? ওর কি ফ্যামিলি নেই? কাব্যকে কোথায় খুজে পেলো৷ আমি হাতের দিকে তাকিয়ে আছি ছিলে গেছে অনেকটা জায়গা৷ উনি হাতে করে সব কিছু নিয়ে আসলেন৷ আমি কিছুই বললাম না৷ হাতে মেডিসিন লাগিয়ে দিচ্ছেন৷ আমার আজ ব্যাথার অনুভব হচ্ছে না৷ উনি এতোটা যত্ন করে মেডিসিন দিচ্ছেন মনে হচ্ছে,কোনো বাচ্চাকে ধরছেন৷ হুট করে সব ভুলে তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম৷ আমাকে কোনো কথার সুযোগ না দিয়ে উনি বক্স হাতে উঠে আমাকেও কোলে উঠিয়ে নিলেন৷ এখন উনার মাঝে গম্ভীরতার ছাঁপ৷ আমি নিজের মনের কথায় অবিচল থাকলেও তার মুখ দেখে টলতে বাধ্য হলাম৷ উনি আমাকে বেডে শুয়িয়ে দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেলেন৷ কিছুক্ষণ পর হাতে খাবারের প্লেট এনে মুখের সামনে বসলেন৷ খাবার মুখের সামনে ধরে বললেন,
–‘ হা কর..! ‘
আমি নিজের গম্ভীরতা প্রকাশ করে বললাম,
–‘ খিদে নেই..! আমি খাবো না৷ ‘
উনি খাবার মুখের সামনে নিয়েই বসে আছেন৷ হাতের খাবারটুকু নিজের মুখে দিলেন৷ আমি একটু অবাক হলাম৷ কোথায় আমাকে খাওয়াবেন না সেই খাচ্ছে৷ ওহহ..!এখন আর আমাকে জোর করবেন কেন৷ তার এই কাজে অভিমান আর অভিযোগ আরো একধাপ বেরে গেলো৷ এখন চোখের কোণ বেয়ে পানি নেমে পড়লো৷ উনি চিবুতে চিবুতে আমার মুখের সামনে আসতেই আমি ভ্রুকুটি করে ফেলি৷ কি করছেন উনি? একদম আমার মুখের সামনে এসে আমার গালে আলতো চাঁপ দিয়ে আরেকটু এগিয়ে আসতেই তার করা কাজ বুঝতে পেরে আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম,
–‘ আমি খাবো..! প্লিজ ছাড়ুন৷ ‘
উনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে৷ আমার বলা কথা শুনে উঠে গিয়ে নিজেও বাঁকা হেসে বললেন,
–‘ If the ghee does not rise straight on the finger, the finger has to be bent..!’
আমি হা করতেই উনি যত্ন নিয়ে খাওয়াতে শুরু করলেন৷ আমিও চুপচাপ খেয়ে নিতেই উনি আমাকে শুতে বলেন৷ আমি শুয়ে পড়তেই উনি আমার পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়েন৷ আমি কিছু না বলে পাশ ফিরে শুতে গেলেই উনি হাত দিয়ে আমাকে টেনে তার দিকে ঘুরিয়ে বললেন,
–‘ আমার কাজের বারোটা বাজিয়ে এখন পাশ ফিরে শোয়া হচ্ছে? আমার দিকে ঘুরে শুয়ে থাকবি,, একফোঁটা ঘুরলে কাঁচা ঘুম থেকে বারবার উঠাবো৷ আমি যতক্ষণ কাজ করবো আমার দিকে ফিরেই ঘুমাতে হবে তোকে৷ ‘
আমি উনার কথা শুনে আবার ঘুরতে গেলে উনি একহাতে আমাকে ধরে ফাইল ঘাটছেন৷ আমি বিরক্ত হয়ে উনার দিকে ফিরেই শুয়ে রইলাম৷ অসহ্য! আমি ঘুমাবো কি করে এইভাবে থাকলে? তবে বারেবারে ঘুরেফিরে মনে হচ্ছে আচ্ছা, ওই মেয়েটা কি তার অতীত? না আমি ভুল করছি..! মেয়েটার চেহারায় ফরেনার দের ছাঁপ,,যদি তাই হয়ে থাকে রাই কেন তার নাম?
চলবে….
(নেক্সট না পড়ে বিবেচনা করবেন না কেও,,আর ভুল গুলো ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন..!)