#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি
#পার্টঃ২২
#রুবাইদা_হৃদি(sheikh ridy)
জানালার পর্দা ফাঁকে একটুকরো রোদ গলে রুমের মাঝে পড়ছে৷ রোদের আলো তীর্যক৷ অন্ধকার ঘরে হাঁটু মুড়ে মুখ গুজে বসে আছি৷ রোদটুকরো আমার উপরে পড়তেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি আবার৷ আজ দুইদিন হয়ে গেছে কাব্য ভাইয়ার কোনো খোজ খবর কেও পায় নি৷ দূর্বল শরীর নিয়ে আমাকে যখন বলেছিলো, ‘ যাবি আমার সাথে? ‘সেই টুকু কথা মনে পড়তেই চাঁপা কান্নার মাএা সারা ঘর ময় তীব্র শব্দে পরিণত হলো৷ কোথায় উনি? কোনো খোজ নেই কেন৷ পাশে থাকা মোবাইলে সময় দেখলাম আটটা বেজে পঁচিশ মিনিট৷ আবার ফোন দিলাম তার মোবাইলে৷ কিন্তু..! কিন্তু..! সেই এক কথা ভেসে আসছে.. মোবাইল অফ৷ অস্থির লাগছে৷ মোস্তাকিম ভাইয়ারা সাথে সাথে গেলেও তার গাড়ি আর পায় নি৷ বারবার ফোন দেওয়া সত্বেও ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না৷ অজানা এক ভয়ে মনের মাঝে ধুকপুক করছে৷ কিছু হয়ে নি তো? আর চলে গেলে? যদি গিয়েও থাকেন ফোন তো করবেন৷ আমি অস্থির পায়ে উঠে দাঁড়ালাম৷ চুল এলোমেলো..! এক ড্রেস৷ সেদিনের পর থেকে না খাওয়া৷ ফুঁপিও অসুস্থ হয়ে পড়েছে৷ আব্বু এসেছে..! আমায় হাজার বার ডাকলেও সাড়া দেই নি৷ না খাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে উঠলো৷ টাল সামলাতে না পেরে পড়তেই বেডের কোণায় মাথা লাগতেই তীব্র ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলাম৷ মাথা ঘুরছে..! চোখ ঝাঁপসা হয়ে উঠছে৷ আমার চিৎকারে বাইরে রাহুল ভাইয়া, জিনিয়া ছুটে এসেছে৷ দরজা ধাক্কাচ্ছে৷ উঠে খুলে দেওয়ার বা মুখে বলার শক্তি যোগাতে পারলাম না৷ মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে শুধু বললাম, ‘ আমি আপনার সাথে যাবো..! কোথায় আপনি? আপনাকে ছাড়া যে নিজেকে হারিয়ে ফেলছি৷ আমি কথা শুনবো, প্লিজ আমার কাছে ফিরে আসুন৷ ‘
________________________
— ‘ নীতু, এই নীতু..! ‘
ক্ষীণ স্বরে কেও একজন ডাকছে৷ আমি ঘুমের ঘোরেই, ‘ হু ‘ বলতে কঁপালে উষ্ণ ছোঁয়া পেলাম৷ শান্তির বাতাস বয়ে গেলো৷ এ যে তার ছোঁয়া..! কাব্য ভাই৷ চোখ খুলতে চেয়েও পারলাম না৷ চোখ বন্ধ করেই শুয়ে আছি৷ আবারও সেই স্নিগ্ধ আওয়াজ,
–‘ এতোটা অবুঝ কেন তুই? আমি কি চাই বুঝিস না? ‘
উত্তর দিলাম না৷ হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁতে চাইলাম৷ তার হাতের উপর হাত পড়তেই আলতো ভাবে আঁকড়ে ধরেন৷ আবার থমথমে গলার আওয়াজ,
–‘ আমি যে তোর মাঝেই থাকতে চাই৷ বি স্ট্রং..!’
আমি ফুঁপিয়ে উঠলাম৷ থেমে থেমে দূর্বল গলায় বললাম,
–‘ আপনি আমায় কেন বুঝেন না? আপনাকে ছাড়া আমার থাকতে কেন কষ্ট হয় বলতে পারবেন? আপনার মাঝে এতোটা ডুবে কি করে গিয়েছি? আপনি জানেন..! আমি দুটো দিন চোখের পাতা এক করতে পারি নি৷ এতো কষ্ট কেন হচ্ছিলো আপনার খোজ না পেয়ে? ‘
উনি বোধহয় সেই মন মাতানো হাসি হাসলেন৷ আমি চোখ বন্ধ করেই সেই হাসি যেন দেখতে পাচ্ছি৷
–‘ তোকে ছাড়া আমি কি করে যেতে পারি বল তো? তুই ছাড়া আমি অচল যে..! ‘
আমি অনুরোধের গলায় বললাম,
–‘ আমি যাবো আপনার সাথে৷ আমায় ফেলে যাবেন না..! আপনাকে না দেখলে যে আমার বুকের মাঝে কষ্ট হয়৷ শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে৷ মনে হয় মরেই যাবো৷ ‘
আমার ঠোঁটের উপর তার হাতের ছোঁয়া পেলাম৷ উনি রাগমিশ্রিত গলায় বলল,
–‘ আমার মাঝে এতো টা বিভোর হলি কবে? আমার চেয়ে তুই বেশি বিভোর তা কি জানিস? তুই তো আমার ভালোবাসার চেয়ে আমাকে বেশি ভালোবেসে ফেলেছিস৷ ‘
আমি উনায় আবার আঁকড়ে ধরতে চাইলাম৷ পাশে জিনিয়ার কথা শুনেই চোখ খুলে তাকালাম৷ জিনিয়া আমায় বলছে,
–‘ আপু..! ঠিক আছিস তুই? ‘
চোখ খুলতেই একঝাক ব্যাথা আমার মাথা সহ চোখেমুখে আছড়ে পড়লো৷ আমি মাথায় হাত দিতেই ও হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
–‘ মাথায় হাত দিস না..! ব্যান্ডেজ করা৷ আর ওইভাবে পড়লি কি করে আপু? জানিস আমরা কতোটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম৷ ‘
আমি চারদিকে চোখ বুলিয়ে বললাম,
–‘ উনি কই? জিনিয়া উনি কই? আমি উনাকে দেখবো৷ মাএ আমার কাছে ছিলেন৷ কোথায় গেলেন উনি? আমার কাছে আসতে বল৷ আমি যাবো উনার সাথে৷ ‘
–‘ মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছে না এখনো৷ ও যায় নি কোথাও৷ কারণ ওর নাম নেই ফ্লাইটের৷ তোর ফুঁপা আর মোস্তাকিম ওরা খুজছে৷ ‘
ফুঁপি আমার পাশে এসে বসে বলল৷ আমি আবার কেঁদে ফুঁপির হাত ধরে বললাম,
–‘ ফুঁপি..! আমি যাবো৷ প্লিজ তুমি আব্বু আর ফুঁপাকে বুঝাও৷ আমার যে কষ্ট হচ্ছে৷ ‘
ফুঁপি নিজের চোখের পানি মুছে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
–‘ হ্যাঁ, কাব্য আসুক ওকে মারবো তারপরে তোকে আর ওকে একবারে বেঁধে দিবো৷ নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ,কি হাল বানিয়েছিস৷ স্যালাইন আরো একটা দেওয়া লাগবে এতোটা দূর্বল হয়ে গেছিস৷ ‘
সপ্নে এসেছিলো সে৷ তাকে অনুভব করছি সব সময়৷ আর ফিরিয়ে দিবো না আপনাকে৷ কিন্তু আপনাকে লাগবে আমার৷ কোথায় পাবো আপনাকে?
মাথা ব্যাথা হালকা হয়েছে৷ এখন নিজেকে আরো পাগল পাগল লাগছে৷ বাইরে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যা নেমেছে৷ পাখিরা নীড়ে ফিরছে৷ এই পাখিদের মতোই উড়ে চলে আসুন না কাব্য ভাই৷ আমার যে আপনাকে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে৷ শুয়ে শুয়ে কাঁদছি৷ হঠাৎ সামনের ড্রেসিং টেবিলের উপর যত্ন করে রাখা ডায়েরি নজরে পড়তেই কিজন্য যেন মনে হয়, হয়তো কোথায় গিয়েছে সেটা পাবো৷ আমি ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াই৷ ডায়েরি হাতে নিতেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে৷ সে জার্মান এখনো যায় নি৷ তারমানে তাকে পাবো৷ আমি ডায়েরিটা নিয়ে বেডে বসে পড়লাম৷ প্রথম পাতা উল্টতেই তার সুন্দর হাতের লিখা গান,
~ ” ভালোবাসার মোহনায়, ভালোবাসার মোহনায়,
অনুভূতির যাতনায়, তুমি আছো প্রিয় আমার মোহনায়..! ”
~” অকারণের ভালোবাসায়.. বেঁধেছি তোমায়..!
এই অবেলায়..! ”
এসেছিলে কোনো এক বেলায়…
ভালোবাসার মোহনায়….! ”
~ ” ভালোবাসি প্রিয়,ভালোবাসি প্রিয়,
তোমার মাঝের ভালোবাসায়…! ”
তার লিখা হাত বুলিয়ে দেখলাম৷ তার ছোঁয়া আছে এতে৷ কান্না পাচ্ছে৷ চোখ মুছে নতুন পাতা উল্টাতেই আমার পাঁচ বছর আগের ঘুমন্ত একটা ছবি }পেলাম৷ তার নীচে লেখা,
সপ্নের মতো বাস্তব তুই নীতু..! তোর প্রতি অন্যধরণের ফিলিংস কাজ করে কেন আমার? তবে তুই তো পিচ্চি৷ আমার হঠাৎ করে ভালোলেগে যাওয়া প্রেম তুই৷ তোর মাঝে আমি রৌদ্দুরে প্রেমের বৃষ্টি খুজে পাই৷ এই জানিস তুই? আমি প্রেম খুজে বেড়াই তোর মাঝে৷
আমি সুপ্ত হাসলাম৷
” প্রেম হয় ধীরে ধীরে, তবে ভালোবাসা সেটা তো সারাজীবন বেঁধে রাখার সম্পদ৷ ”
হ্যাঁ,তার লিখা কথাটা বাস্তব৷ প্রেম হয় ধীরে ধীরে৷ সেই প্রেমে সুপ্ত বাসনা থাকে৷ আঁকড়ে রাখার প্রেরণা থাকে৷ এই জন্যই তার মনে আমার জন্য উঁপচে পড়া প্রেম আছে৷ সেটা অনেক আগের থেকেই তার মাঝে সে পুষে রেখেছে৷
ডায়েরি হাতে নিয়ে উঠতেই একটা কাগজ উড়ে যায়৷ আমি ডায়েরি রেখে সেটা হাতে নিয়ে খুলে দেখি,
” এই জানিস? তোকে কেন ডায়েরি দিয়েছি?আমি কখনো হুট করে হারিয়ে গেলে আমায় যেন খুজে পাস৷ আমি তো তোর কাছে, তোর পাশে থাকতে চাই৷ হারিয়ে গেলে খুজবি অচেনা শহরে৷ তোর মনের অচেনা শহরে৷ সেখানে আমায় পাবি৷ হাত বাড়িয়ে তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকবো৷ তুই বোকা..! বড্ড বোকা৷ আমি হারিয়ে গেলে কেঁদে কেটে সমুদ্র বানাবি৷ ইশ! তুই পাগল৷ আমি যে তোকে ছাড়া থাকতেই পারি না৷ সে আবার হারিয়ে যাবে এইটা কখনো হয়? ”
আমার মনের মাঝে হাজার প্রজাতি ডানা মেলে উঁড়ে গেলো৷ ইশ! সত্যি আমি বড্ড বোকা৷ সে আছে৷ আমার মনের অচেনা শহরে৷ আমি কাগজ হাতেই দৌড়ে বের হয়ে এলাম ঘর ছেড়ে৷ এখন মাথা ব্যাথা করছে না একদম৷ সে আছে..! আমি তাকে দেখতে পাবো৷ আমাকে দৌঁড়ে বের হয়ে আসতে দেখেই ফুঁপি আর জিনিয়া এগিয়ে এসে আমায় ধরে শাসনের সুরে বলল,
–‘ কোথায় যাচ্ছিস? তোকে রেস্ট নিতে বলেছে৷ ‘
–‘ তোমার অবাধ্য ছেলেকে খুজতে৷ প্লিজ বারণ করো না৷ আজ তাকে নিয়েই ফিরবো৷ ‘
আমার হাসি মুখ দেখে ফুঁপি মনে হয় ভরসা পেলো৷ আমাকে ছেড়ে দিতেই আমি আবার দৌড়ে আবার বেরিয়ে যাই৷ তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা৷ ভার্সিটির পাশের রিসোর্ট৷ আমি সিউর সেখানেই উনি আছেন৷ এইটা কি করে ভুলে গেলাম আমরা৷ সে রাগ করে ওইখানেই চলে যায়৷ আমি রিক্সা নিতে চেয়েও নিলাম না৷ তাড়াহুড়োতে টাকা আনি নি৷ কাব্য ভাইয়াদের বাসা থেকে ভার্সিটি যেতে কতক্ষণ লাগে আমি জানি না৷ আমি শুধু হাটছি৷ মাঝে মাঝে মাথা চেঁপে দৌড়ে যাচ্ছি৷
রিসোর্টের সামনে এসে হাঁফ ছাড়লাম৷ মাথা আর পাঁ ব্যাথায় টনটন করছে৷ আমি গেইট দিয়ে ঢুকলাম৷ রিসেপশন থেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ কাব্য মেহেরাজ এসেছে কি না৷ ‘ উনারা জবাব দিলেন না৷ বুকের মাঝের শূন্যতা আবার ছাঁপিয়ে পড়লো৷ তার মানে আমি কি ভুল? একজন আমার পাশে এসে বলল,
–‘ বাগানের সাইডে কেও একজন আপনার অপেক্ষায় আছে৷ ‘
আমার মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো৷ তারমানে সে আছে৷ আমি মুচকি হেসে পাঁ বাড়ালাম৷ আমি নিজে থেকে তাকে বলবো আজ,
–‘ আমায় কি আপনার প্রেমের বৃষ্টি বানাবেন? শুধুই প্রেমের বৃষ্টি৷ যেখানে রোদ থাকলেও স্নিগ্ধতা থাকবে৷ ‘
বাগানের দিকে যেতেই সব লাইট গুলো হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেলো৷ আমি ভয় পেলেও এগিয়ে গেলাম৷ হুট করেই আবার একঝাক আলো জ্বেলে উঠলো৷ আমি চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলাম৷ পিটপিট করে চোখ খুলতেই এতো বড় একটা সারপ্রাইজ পাবো সত্যিই ভাবতে পারি নি…!
চলবে..!
( ভালো হয়েছে কিনা অবশ্যই জানাবেন..!, ভুল গুলো ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন৷)
#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি
#পার্টঃ২৩
#রুবাইদা_হৃদি(sheikh ridy)
সন্ধ্যার নিজস্ব লালচে আলো বাগানের পুকুরের উপর আছড়ে পড়ছে৷ সন্ধ্যা মালতি গাছে থেকে সুন্দর সৌরভ ভেঁসে আসছে৷ আমার পাঁ একদম চলছে না৷ পিছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা যে আমার বড্ড চেনা৷ পুরো বাগান ফাঁকা..! আমি আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা ছাড়া আর কেও নেই৷ আমি ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম৷ কান্না উঁপচে আসছে৷ ব্লু কালারের শার্টে হালকা লালচে আলোয় তাকে পিছনে থেকে সুপুরুষ লাগছে৷ আমি পিছনে দাঁড়িয়ে আছি৷ হুট করে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠি৷ সে হাসছে..! হাসির শব্দ আমার কানে আসছে৷ আমার রাগ হলো৷ আমি কিনা তাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে মরমে মরে যাচ্ছি আর সে কিনা হাসছে৷ আমি তাকে ছেড়ে দিতে নিলেই আমার হাতের উপর তার হাত রাখলেন৷ আমি ছুটতে চেয়েও পারলাম না৷ ফুঁপিয়ে কান্না করেই যাচ্ছি৷
–‘ দুদিন পরে বুঝি আমার কথা মনে পড়েছে? ‘
উনার কথা শুনে উনায় আমি আরেকটু জোড়ে আঁকড়ে ধরি৷ তার পিঠে মাথা ঠেকিয়ে কান্নারত অবস্থায় বললাম,
–‘ আ..পনি আমার সাথে যোগাযোগ কেন করেন নি? আপনি কি বুঝেন না.. আমার কষ্ট হয়৷ ‘
উনি আমাকে সামনে নিয়ে এলেন৷ হুট করে টান দেওয়ায় ভয় পেয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে উনার কাছে থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করি৷ বড্ড অভিমান লাগছে৷ এতো এমন কেন উনি? আমি উনার দিকে একদম তাকাচ্ছি না৷ আমার গালের উপর তার ঠান্ডা শীতল হাত রাখেন৷ আমি কেঁপে উঠে তার দিকে তাকাই৷ মুখ শুকনো লাগছে..! জাম রাঙা ঠোঁটের কোণে এখনো রক্তের দাগ আছে৷ চুল গুলো উষ্কখুষ্ক৷ কিন্তু মুখে তার সেই মন ভুলানো হাসি৷ আমার চোখের পানির দিকে সে তাকিয়ে আছে৷ একদৃষ্টিতে..! সে অস্থির কন্ঠে বলল,
–‘ মাথায় কি হয়েছে..! ‘
তার বলা কথায় এতোক্ষণে ঝিমিয়ে থাকা ব্যাথা হুট করেই বেড়ে গেল৷ তীব্র ব্যাথা৷ আমি মাথায় হাত দিয়ে বললাম,
–‘ পড়ে গিয়েছিলাম..! ‘
উনি আমার ব্যান্ডেজের উপর হাত রাখলেন৷ তার চোখেমুখে আতংকের ছাঁপ৷
–‘ এতো লাফালাফি করিস কেন তুই? সাবধানে চলতে জানিস না? আমি দুইদিন বাড়িতে নেই এতেই মাথা ফাটিয়ে দুভাগ করে ফেলেছিস৷ আল্লাহ মালুম আমি না থাকলে তুই নিজেই বোধহয় নাই হয়ে যাবি৷ ‘
উনার কথা শুনে নিজের ভেতরের রাগ হঠাৎ করেই উঁপচে পড়লো৷ উঁচু হয়ে উনার কলার টেনে ধরে ঝাঁঝালো কন্ঠে বললাম,
–‘ নিজেকে কি মনে করেন আপনি? কি মনে করেন? আমাকে খেলনার পুতুল পেয়েছেন? আমার অনুভূতি না বুঝেই একা ফেলে চলে এসেছেন৷ কেন ফেলে চলে এসেছেন? আমার মাথা ফেঁটে গুড়াগুড়া হয়ে মশলা হয়ে যাক৷ তাতে আপনার কি? আমাকে কাঁদিয়ে মজা পান তাই না? চলে যান..! দরকার নেই আপনাকে আমার৷ খুব তো ফেলে একা হারিয়ে গিয়েছিলেন৷ ‘
উনি নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন৷ রাগে হাঁত পা কাঁপছে আমার৷ অসভ্য লোক একটা৷ এখন এসেছে দরদ দেখাতে৷
–‘ খুজতে কেন এসেছিস তাহলে? ‘
উনার গা ছাড়া কথা শুনে আরো রাগ হলো৷ হাতের মুঠোয় থাকা কাগজ উনার দিকে ছুড়ে দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে বললাম,
–‘ বয়েই গেছে তোকে খুজতে আসার৷ তুই যা..! যেখানে ইচ্ছা যা৷ বাড়ির সবার কথা চিন্তা করেই তোকে খুজতে এসেছিলাম৷ আর তোর ডায়েরি..! কেন দিয়েছিস আমাকে? যা চলে যা..! ‘
উনি আমার কথা শুনে স্তব্দ হয়ে ফাটাফাটা চোখে তাকিয়ে আছেন৷ আমার সেইদিকে কোনো হুশ নেই৷ আমি উনার বুকের পাশে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বললাম,
–‘ যা চলে যা..! আবার এখানে সারপ্রাইজের ব্যবস্থা করেছে৷ তোর সব প্ল্যান করা৷ তুই ইচ্ছা করে কষ্ট দিয়ে আমাকে ভুলাতে এসেছিস৷ দরকার নেই তোকে৷ আমি তোর প্রেমের বৃষ্টি হবো না৷ তুই কাঠফাটা রোদ..সেই রোদেই তোকে মানায়৷ ‘
–‘ নীতু,..! ‘
উনার গম্ভীর আওয়াজে ডাক শুনে রাগী দৃষ্টিতে তাকালাম উনার দিকে৷ উনি আমার চোখ দেখে ভয় পেলেন কিনা জানি না৷ সে তার ভালো হাত দিয়ে আমাকে পিছন দিকে ঘুরিয়ে তার বুকের সাথে একদম মিশিয়ে নিলেন৷ আমি মূহুর্তেই নিজের কথা মনে করে বড়সড় একটা ঢোক গিললাম৷ নীতু ইউ ফিনিশ..! ইমোশনাল মোমেন্টে শেষে কিনা তুই বলে ফেলেছিস?
–‘ তারপর.?’
উনি আমার ঘাড়ে থুতনি রেখে বললেন৷ আমার শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো৷ ভাষা খুজে পেলাম না৷ উনি কোমড়ে এক হাত দিয়ে আবার আমাকে সামনে ঘুরালেন৷ আমি চোখ খিঁচে বন্ধ করে তার শার্ট খাঁচমে ধরলাম৷ আমার কঁপালে তার কঁপাল ঠেকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
–‘ কষ্টে পেয়েছিস? ‘
আমি উনার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলাম৷ ভেবেছিলাম চড় টর খাবো তুই বলার অপরাধে৷ কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণিত করে দিলেন উনি৷ আমি কি বলবো খুজে পেলাম না৷ আবার কান্না পাচ্ছে৷ তাকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা করা কেন দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে আমার জন্য? আমি চোখ বন্ধ করেই উত্তর দিলাম,
–‘ আপনাকে না দেখলে আমার বুকের বাঁ পাশে তীব্র ব্যাথা হয়..! আপনাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলি৷ কেন? আপনি এমন করে কষ্ট কেন দেন? আমার জন্য মায়া হয় না আপনার?’
উনি স্লো ভয়েসে বললেন,
–‘ আমার ঠিকানা তো তোর মাঝে..! হারিয়ে গেলে খুজে বেড়াবি৷ তোর জন্য আমার ভালোবাসার চিরকুট থাকবে৷ সেই চিরকুটে আমার হারানোর মধ্যেও খুজে পাবি তুই৷ ‘
কান্নার মাএা বাড়ছে৷ তাকে পেয়ে শূন্য বুক পূর্ণ লাগছে এখন৷ আমি তাকে নিজে থেকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েও ধরলাম না৷ শুধু থেমে থেমে বললাম,
–‘ আপনি জানতেন আমি আসবো?’
উনি আবার হাসলেন,
–‘ হ্যাঁ, জানতাম..!কিন্তু মহারাণী দুইদিন পরে আসবে সেটা জানতাম না৷ আর একটু পর বেরিয়ে পড়তাম ফ্লাইটের উদ্দেশ্য..! ‘
আমার বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো৷ সত্যি যদি চলে যেতেন তাহলে পেতাম কোথায়৷
–‘ আমি যাবো আপনার সাথে..! ‘
–‘ উহু..! নিবো না৷ ‘
আমি কেঁদে উঠলাম আবার৷ এখন নিবেন না? আর তখন যেতে চাই নি বলে ফেলে চলে এসেছিলেন৷ কথাই বলবো না আর৷ উনি আবার গম্ভীর ভাবে বলল,
–‘ তুই তুকারি করার শাস্তি তুই নিবি? না আমি দিবো..!’
এতোক্ষণে টনক নড়লো আমার৷ ইশ..! আমি কিভাবে পারলাম তুই বলতে? আমি লজ্জায় তাকাতে পারলাম না তার দিকে৷ উনি ঠোঁট কামড়ে ধরে ফিসফিস করে বললেন,
–‘ তোকে শাস্তির দুটো অপশন দিচ্ছি..!’
আমি ভ্রুকুচকে ফেললাম৷ শাস্তির আবার অপশন আছে বুঝি? উনি আমার কুচকানো ভ্রুতে তার আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিতেই আমি ঝটপট করে বললাম,
–‘ ক.. কি শাস্তি? আর অপশন টপশন আবার কি?’
উনি আমায় ওইভাবেই রেখেই সামনে এগিয়ে গেলেন৷ আমিও পাঁ য়ে পা মিলিয়ে পিছাতে লাগলাম৷ উনি এখনো আমার কঁপালে তার প
কঁপাল ঠেকিয়ে আছেন৷ উনার কি ভয় হচ্ছে না?দুজনের মাথা ফাঁটা পড়লে নির্ঘাত আজ আর রক্ষা থাকবে না৷ উনি এগুতে এগুতেই বললেন,
–‘ ফার্স্ট অপশন, আমাকে চুমু দিবি..! ‘
–‘ নো.. সেকেন্ড অপশন..! ‘ আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলতেই উনি দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ পাশে থাকা ফুল দিয়ে সাজানো দোলনায় আমাকে বসতে বললেন৷ আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি৷ রজনীগন্ধা, গোঁলাপ আর টিউলিপ দিয়ে অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো দোলনা৷ পাশেই বেলুন আর ফেইরি লাইট দিয়ে সাজানো একটা কটেজ..! আমি চোখ ঘুরিয়ে সব দেখছি৷
–‘ এইগুলা..? ‘
উনি আমার কানের কাছে এসে বললেন,
–‘ আমার প্রেমের বৃষ্টির জন্য৷ ‘
আমি ঘুরে উনাকে আমার একদম সামনে পেলাম৷ তার বুকের মাঝে আমার মাথা৷ এতো লম্বা কেন উনি৷ ভেবেই আবার ভ্রু কুচকে ফেললাম৷ পাশে থাকা একটা রজনীগন্ধা আমায় দিয়ে বললেন,
–‘ গত দুই দিন ধরে ফুল পঁচে যাচ্ছে,,আবার পাল্টিয়েছি..! আজ অবশেষে আমার সে এসেছে৷ ‘
আমার খুশি হওয়ার দরকার কিন্তু হতে পারলাম না মনের মাঝে সেই খুশি উঁপচে পড়ছে৷ ইশ! আগে কেন আসলাম না? উহু..! আগে আসলে সেটা আজ সেদিনের ঘটনা হয়ে যেত৷ অপেক্ষার ফল মিষ্টি..! সেটার আক্ষেপ থাকলেও কষ্টে মিশ্রিত ভালোলাগা থাকে৷ উনি আবার আমার কানের পিছনে একটা লাল গোলাপ গুজে দিলেন৷ আমি দোলনায় বসতেই উনিও আমার পাশে এসে বসলেন৷ আমি সরে যেতেই আমার কোমরে ধরে কাছে টেনে নিয়ে এলেন৷ আমার কাঁধে মাথা রাখতেই আমার হৃদপিন্ডের মাঝে ঢেউ খেলে যায়৷
~” পূর্ণিমা সন্ধ্যায়, তোমার রজনীগন্ধ্যায়
রুপসাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়…!
~ ” পূর্ণিমা সন্ধ্যায়,তোমার রজনীগন্ধ্যায়,
রুপ সাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়..!
তোমার প্রজাপতির পাখা..আমার আঁকাশ চাওয়া মুগ্ধ চোখে রঙিন সপ্ন মাখা…!(২)
~” তোমার চাঁদের আলো… মিলায় আমার দুঃখ সুখের সকল অবসান…!”
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে গান…!
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে গান…!
~” আমার আপন হারা প্রাণ…আমার বাঁধন ছেড়া প্রাণ…
ফাগুন………! ”
আমি চোখ বুজে তার গান উপভোগ করছি৷ উনি আমার গালে চুমু দিতেই আমি তাড়াহুড়ো করে চোখ খুলে ফেলি৷ উনি মাথা উঠিয়ে বললেন,
–‘ এই..! তোকে শাস্তি দেওয়ার বদলে আমি গান শুনাচ্ছি কেন? ‘
–‘ আপনার গানের গলা এতো ভালো কেন? ‘ আমি কথা ঘুরানোর জন্য বলতেই উনি হাসলেন৷ আমি ধরা পড়ে গেলাম৷ শুকনো ঢোক গিলে আবার বললাম,
–‘ হাঁতে হাত ধরে হাটবেন? পূর্ণিমা চাঁদ.. রজনীগন্ধ্যা..! ‘
আমি আর কিছু বলার আগেই উনি আমার কাছে একদম ঘেষে রইলেন৷ আমি সরতে চাইলে উনি বললেন,
–‘ সব হবে..! তার আগে তুই তোকারির করার শাস্তির সেকেন্ড অপশন শুনে নে..!’
আমি সাহস জুগিয়ে বললাম,
–‘ শাস্তি দেওয়ার জন্য আপনার দুদিন হারিয়ে যাওয়া কি যথেষ্ট নয়? ‘
–‘ আর আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া কি অপরাধ নয়? ‘
আমি যাই বলি সেটার গুছানো উত্তর উনার কাছে আছেই৷ আমি হার না মেনে আবার বললাম,
–‘ আমায় কষ্ট দেওয়া এইটা কি অন্যায় নয়? ‘
উনি আমার গালে আবার চুমু দিলেন৷ আমি ভড়কে গেলাম৷ নিজের কামিজ আঁকড়ে ধরে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় আছি৷ উনি আমার হাতের আঙুল তার হাতের আঙুলে আবদ্ধ করে বলল,
–‘ প্রেমে পড়েছি..! সেই লাজুকলতার..! তাই শাস্তির সেকেন্ড অপশন বাসর ঘরের জন্য তুলে রাখলাম..! ‘
আমি উনার কথা শুনে রাগ করবো না লজ্জায় পড়বো ভাবতেই উনি আমার হাঁত ধরে উঠে দাঁড়ালেন৷ রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে পিচ ঢালা রাস্তা,,পূর্ণিমার মস্ত চাঁত আর রজনীগন্ধ্যার ফাগুন হাওয়া..!
______________________
পূর্ণিমার সন্ধ্যার ঘুরে রাতের আঁধার ঠিকরে পড়ছে৷ আমি আর সে বাসায় ঢুকতেই সবাইকে ড্রয়িংরুমে বসে থাকতে দেখেই একটু ভয় পেয়ে যাই৷ বাবা আর রেদুয়ান ফুঁপার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি উনার হাত ছেড়ে জিনিয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াই৷ ফুঁপি উনাকে শাসন করলেন আবার নিজেই কেঁদে উঠে জড়িয়ে ধরলেন৷ আমার চোখের কোণে পানির আভাস পাচ্ছি৷
–‘ এতো রাগ কেন তোর? আমার বুঝি টেনশন হয় না? ‘
ফুঁপির কথার জবান দিতে পারলেন না উনি৷ ফুঁপা উঠে গিয়ে তার গালে থাপ্পড় মারলেন৷ থাপ্পড়ের শব্দে কেঁপে উঠলাম৷ ফুঁপি রেগে কিছু বলার আগেই ফুঁপা থামিয়ে দিয়ে বলল,
–‘ ওর প্রাপ্য এইটা..! এতোটা অবুঝ কেন ও? ‘
উনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন৷
–‘ নীতু এইদিকে আয়..! ‘ ফুঁপার ডাকে ভয় পেয়ে কাব্য ভাইয়া আর আব্বুর মুখের দিকে তাকালাম৷ তাদের কাছে থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তার হাতে থাকা একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে রাগী স্বরে বলল,
–‘ সাইন কর..! ‘
আমি ভয় পেয়ে গেলাম..! কিসের পেঁপার এইটা? আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আব্বু পিছনে থেকে বলল,
–‘ কাব্য তোর শাস্তি এইটা..! কথা না মানার শাস্তি৷ ‘
আমি ছলছল চোখে উনার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম ভয়ে তার মুখ অন্যধরনের এক রঙ নিয়েছে..! কি আছে কাগজে?এতো ভয় পাচ্ছেন কেন উনি?
চলবে..
( ভালো হয়েছে কিনা জানাবেন..! ভুল গুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন..!)