রূপকথা পর্ব-০৬

0
705

#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৬

[১২]
প্রতিদিন নিয়ম করে বকুল তলায় যাওয়া হয় না। তবে সুযোগ পেলেই একছুটে পাখি উড়ে এসে আঁচড়ে পড়ে। ইদানীং রূপকথাদের বাড়িতে মামুন ভাইয়ের আনাগোনা বেড়েই চলেছে। তার ভাবভঙ্গি বলছে সে বিশেষ কিছু চায়। নয়তো বেকার খাটার মতো লোক মামুন নয়। খোরশেদের খোঁজ নেওয়ার নাম করে রূপকথার সাথে চোখেচোখে আলাপন বেশ ভালোই চলছে।

আজ সময় মিলতেই সন্ধ্যা নামার পূর্বে বকুল তলায় হাজির হলো রূপকথা। এই একটা জায়গা আসলে মন ভালো না হয়ে থাকতেই পারেনা। বকুল সই যে তার মন খারাপের সঙ্গী। বাতাসের দাপটে ঝরঝরে পুষ্পবৃষ্টি মনে আনন্দের সঞ্চার করে। একমুঠো ঝরা বকুল ফুল হাতের তালুতে নিয়ে খানিক সময় তাকিয়ে রইলো রূপকথা।
-“তোর মতো কইরা আমি ও একদিন ঝইরা যামু। শুধু আমি ক্যান? এই দুনিয়ার সব মাইনষেই ঝইরা যাইবো। মিষ্সা যাইবো মাটির তলায়। তবুও তাদের কি অহং’কার।”

বকুল ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকতেই পেছন থেকে কারো পদধ্বনি শুনতে পেলো রূপকথা। পায়ের শব্দ ক্রমশ নিকটে শুনতে পাচ্ছে। একবার পেছন ঘুরে তাকালো। দেখতে পেলো মামুন ভাইকে। তাকে দেখতে পেয়েই জড়োসড়ো হয়ে বসলো রূপকথা। মামুন পাশে এসেই ধপ করে শক্ত শেকড়ে অবস্থান নিলো। একগাল হেসে বলল,

-“কোকিল পাখির সন্ধানে আমার মেলা কাঠখড় পোহাইতে হইলো।”

রূপকথা মাথায় ওড়না টেনে বাঁকা সুরেই শুধালো,
-“কেউ লাগে কইছিলো আমার খোঁজ করতে।”

হাসলো মামুন। ঠোঁট প্রসারিত হলো, চোখ হাসলো। কিন্তু শব্দ হলোনা। নিশ্চুপে পেছন থেকে হাত সামনে নিয়ে আসলো। রূপকথার সামনে একটা প্যাকেট ধরলো।

রূপকথার চোখের দৃষ্টি প্যাকেট থেকে সরে মামুনের উপর পড়লো। তার দৃষ্টির অর্থ বোঝাতে মামুন বলল,
-“খুইলা দ্যাহো কি আছে।”

একবার মামুনের দিকে তাকিয়ে ফের প্যাকেটে চোখ রাখলো। কাগজে মোড়ানো প্যাকেট একটানে ছিঁড়ে ফেললো। শক্ত শেকড়ের সামনে নরম ঘাসের ওপর শব্দ করে কিছু জিনিস পড়লো ঝনঝন শব্দে। অবাকের শীর্ষে পৌঁছে একে একে জিনিসগুলো হাতে তুলে নিলো রূপকথা। দশটাকা দামের একটা কাজল, একটা আলতার শিশি আর এক মুঠো লাল রেশমি চুড়ি। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো রূপকথা।
মামুন অভিভূত নজরে তাকিয়ে রইলো। রূপকথা জানতে চাইলো,
-“বেকার মানুষ টেহা পাইলেন কই?”

-“হেইডা তোমার না ভাবলেও চলবো।”

রূপকথা ছেঁড়া কাগজে জিনিসগুলো মুড়িয়ে নিলো। মামুনের হাতে ফেরত দিয়ে বলল,
-“কালা ঠ্যাং এ আলতা মানায় না, কালা চোখে কাজল মানায় না, কালা হাতে লাল রং মানায়না।”

ক্ষুব্ধ হলো মামুন। ক্ষ্যাপাটে গলায় বলল,
-“কে কইলো তোমারে? আমি চাই তুমি এগুলা দিয়া আমার সামনে আসো। আমি তোমার কৃষ্ণ ঝলকানি রূপে মুগ্ধ হইয়া চাইয়া থাকতে চাই।”

রূপকথা কঠিন হয়ে উঠলো। কাঠকাঠ গলায় বলল,
-“ক্যান? ক্যান আমার আমনের কথা হুনা লাগবো? কেডা আমনে?”

-“আমি তোমার সুখ কোকিল পাখি?”

মামুনের এমন উত্তরে চমকে উঠলো রূপকথা। বিমূঢ় হলো। কি ভয়া’নক কথা। কেউ একবার শুনলেই সর্ব’নাশ হতো। বিষ্ময় কাটিয়ে উঠলো রূপকথা। মনে মনে সেও মামুন ভাইকে চায়। মানুষটা তার সাথে কত বিনয়ের সাথে মধুর সুর দিয়ে কথা বলে। লজ্জা হলো রূপকথার। কিন্তু মূহুর্তেই মনে পড়লো সমাজ, পরিবার। আর যাইহোক কোনো পরিবারে কালো বউয়ের স্থান কেমন হয় তার একটা ধারণা হয়ে গিয়েছে তার। ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে বিলের জলে তাকিয়ে রইলো।

মামুন বিচলিত হলো রূপকথাকে দেখে। উৎকন্ঠা নিয়েই জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হইছে কোকিল পাখি?”

রূপকথা ঢোক গিললো।
-“পিরিতে আমার ভীষণ ড’র।”

ঝট করেই রূপকথার হাত চেপে ধরলো মামুন।
গায়ে কাঁ’টা দিয়ে উঠলে রূপকথার। গ্রামে গঞ্জে এমন হাত ধ’রাধ’রি দেখা গেলেই কেলেঙ্কারি বাঁধে। ভাগ্যিস এটা নির্জন জায়গা। মানুষের আনাগোনা চলেনা বললেই চলে। তাইতো এমন শান্ত, কোলাহলহীন, স্বজল পরিবেশে একটু সুখ খুঁজতে আসে রূপকথা। চারদিকে আধার নামছে একটু একটু করে। রূপকথা ঝট করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
-“আমি বাড়িত যাই। আযান দিয়া দিলে মায়ে মা’র’বো।”

মামুন আর একবার হাত ধরার সাহস করে ফেললো। রূপকথার চোখে চোখ রেখে অভ’য় দিলো,
-“আমি সব সামলাইয়া নিমু। তুমি খালি আমার সুখের কারণ হও।”

মুহূর্তেই চোখজোড়া ভিজে উঠলো রূপকথার। প্রচন্ড আবেগ কাজ করলো। ইচ্ছে করলো মানুষটার বুক ছিঁড়ে লুকিয়ে পড়তে।

[১৩]
পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসছে। মাস তিনেক পরই টেষ্ট পরীক্ষা। নকশিকাঁথার ফোঁড়ন গুনতে গুনতেই আর পড়ায় মনযোগ দেওয়া হয়না রূপকথার। তবে রীতিমতো স্কুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। মা ঘরে নেই। কোনো দরকারে পাশের বাড়িতে গিয়েছে। ভাইয়া শুয়ে আছে। উপমা ও বোধহয় হাঁটতে বেরিয়েছে। সারাদিন বসে বসে নকশিকাঁথার সেলাই করতে করতে কোমর আর হাতের দ’ফার’ফা অবস্থা। মোক্ষম সুযোগ পেয়ে হাত ছাড়া করলোনা রূপকথা। একটুকরো কাপড়ে কলম চালিয়ে নিলো। সেই কলমের আঁকিবুঁকিতে সুঁই-সুতো চালিয়ে তৈরি করে নিলো ছোট্ট রুমাল। সম্পূর্ণ রুমালে চোখ বুলিয়ে আনন্দে হাসলো সে। ঝটপট জামাকাপড়ের ভেতর লুকিয়ে রাখলো।

উপমা একটু স্বস্তির জন্য বেরিয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্বস্তি পেলোনা। অস্বস্তিরা ঝাঁকুনি দিয়ে চেপে ধরলো তাকে। আশরাফুল ছেলেটা তাকে চোখের তৃষ্ণায় জ্বালিয়ে মা’রছে। এমন বেয়া’দব বাড়ির ছেলে হয়ে সে কি আর ভালো হবে?
আসলেই কি বাড়ি কখনো খা’রাপ হয়? বাড়ির মানুষগুলোর কর্মের উপর নির্ভর করে মানুষ বাড়ি নিয়ে ইচ্ছে মতো একটা মন্তব্য করে ফেলে। উপমা আশরাফুলকে দেখেই বাড়িমুখো হলো। পা চালিয়ে আশরাফুল তার সাথ ধরলো। পুরুষের সাথে পা চালিয়ে টেকা মুশকিল। উপমাও পারলোনা আগে আগে বাড়ি ফিরতে। পথিমধ্যে ঝটপট উপমার হাত চেপে ধরলো আশরাফুল। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে কাঠ হলো। ধড়ফড় শব্দ ক্রমশ বাড়তে লাগলো। দূরে দুজন লোককে আসতে দেখা যাচ্ছে। উপমা ভ’য়ে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে আকস্মিক এক কাজ করে বসলো। আশরাফুলের গালে চ’ড় বসিয়ে দিলো।
চ’ড় দেওয়ার পর তার মনে পড়লো সে কি করেছে। বি’পদ বুঝি ঘা’ড়ে চেপেছে? কিন্তু খানিক পরেই অবাক হলো উপমা। আশরাফুল রা’গ করলোনা। বরং গালে হাত চেপে দুপাটি দাঁত বের করে হাসলো। যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে।
বুকের বাঁ পাশে হাত চেপে রেখে বলল,
-“এই ছোঁয়া পাওয়ার লাগি জনম ভর চ’ড় খাইতে রাজি আছি।”

উপমা এটা ভেবেই রেগে যাচ্ছে ছেলেটা কেনো রাগলোনা? কেনো তার পিছু ছাড়লোনা?
ততক্ষণে মানুষগুলোর চোখে পড়ে গিয়েছে তারা দুজন। একজন মধ্যেবয়স্ক লোক বললেন,
-“কি চলে এইহানে? এইডা আকাম-কুকাম করনের জায়গা না। এই গেরামে এসব চলবোনা।”

উপমার চোখে পানি টলমল করছে। লোকগুলো তাকে খা’রাপ ভাবছে? দুজন ছেলেমেয়েকে একসাথে দেখলেই তাদের ধারণা একজায়গাতে গিয়েই আটকা পড়ে।
আশরাফুল উপমার জলভরা চোখের দিকে তাকিয়ে লোকটির দিকে তাকালো। বেয়া’দবির সুরে বলল,
-“চাচা গেরামে সুন্দর সুন্দর মাইয়া মানষ বাইড়া যাইতাছে। কি করুম কন? পাত্তা দিতাছেনা, তাই জোর কইরা পাত্তা পাইবার চাইতাছি। কি খেমটি মাইয়া মাইনষের। আমার গালে থা’বড়া মারলো?”

লোকদুটো আড়চোখে উপমাকে দেখলেন। আশরাফুল জমরদ বাড়ির ছেলে। তারা ভালো না। তাই লোকদুটোর মতিগতি এবার ঘুরলো। উপমাকে বাড়ি যেতে বলে আশরাফুলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“গেরামের মাইয়াগো লগে এসব না করলে তোমগো বাড়ির পোলাগো ভাত হজম হয়না?”

আশরাফুল তার জবাব না দিয়ে বলল,
-” কি করলেন চাচা? পাখি যাইতে দিলেন গা? এহন তো পাখির খোঁজে আমনের বাড়ি যাওন লাগবো।”

লোকদুটো ঘৃণার দৃষ্টি ফেলে বিড়বিড় করে বললেন,
-“অস’ইভ্য পোলা।”

আশরাফুল দুর্বোধ্য হাসলো। কাকে কোথায় কি বলে থামাতে হয় তা আশরাফুলের জানা আছে। তাদের দুজনকে একসাথে দেখেই লোকদুটো আজ কি কান্ড বাঁধিয়ে দিতো। নিজেদের খুঁটিই এখনো শক্ত করতে পারেনি আসে জমরদ বাড়ির পোলাপানের খুঁটি নিয়ে কথা বলতে।

[১৪]
দুপুরের জমানো থালাবাসন ধুয়ে বসতেই মা ডাকদিলেন তার মাথায় তেল দিয়ে দিতে। উপমা বলে দিয়েছে সে পারবেনা। মাথায় তেল দিয়ে সিঁথি দেওয়ার চেয়ে কোমর ব্যথা করে নকশিকাঁথা সেলাই করা ঢের ভালো মনে হয় তার কাছে। তাই উপায়ন্তর না পেয়ে রূপকথাকে ডাকলেন আলেয়া বেগম। মায়ের মাথায় তেল দিয়ে নকশিকাঁথা নিয়ে বসে পড়লো। কতদিন একাজ করতে হবে কে জানে? বিরক্তি ধরে যায়। কিন্তু মায়ের ভ’য়ে টু শব্দ করতে পারেনা দুবোন। মুখ খুললেই চ্যালাকাঠ দিয়ে উত্তম মধ্যম পড়বে দুজনের পিঠে। এখন ভাই ও সুস্থ নয় যে সে দৌঁড়ে এসে মাকে বাঁধা দেবে। আলেয়া বেগমের রা’গটা খুবই খা’রাপ। পান থেকে চুন খসলেই মেয়েদের গায়ে হাত তোলেন। আবার রাতে চুপি চুপি দরদ দেখিয়ে গাল ভাসিয়ে কাঁদেন।

আলেয়া বেগম নিজেও নকশিকাঁথা নিয়ে বসলেন। এত এত নকশিকাঁথার অর্ডার পাওয়ার কারণ হলো এখন মানুষ এসব কাজ করতে চায়না। হাতে দুটো টাকা হলেই কাজ করাতে লোক খুঁজে বেড়ায়। এক দিক দিয়ে বেশ ভালোই হলো আলেয়া বেগমের। দুটো পয়সা বেশি হাতে আসবে। ছেলের ঔষধের খরচ, সংসার খরচ এসবের তুলনায় এই টাকা অতি নগন্য। মা উঠে ঘরে যেতেই উপমা, রূপকথা হাত ছেড়ে বসলো। টনটন করছে প্রতিটি আঙ্গুলের শিরায় শিরায়।
মামুন আজ আবার তাদের বাড়ি আসলো। আলেয়া বেগমের সাথে মামুনের এখন বেশ খাতির হয়েছে। একবার যদি টের পান তার বাড়িতে কোন লো’ভে মামুন আসে তাহলে বাড়ির দরজায় কাঁ’টা ফেলতেও দুবার ভাববেননা। মেয়ে কালো হয়েছে তো কি হয়েছে? বেকার ছেলের কাছে কেনো বিয়ে দিতে হবে?

আমাদের বর্তমান সমাজটাই এমন। নিজের বেলায় আমরা ষোলো আনা বুঝি। ছেলে বেকার হলেও কালো মেয়ে বিয়ে করাবেনা পরিবার। আবার মেয়ে কালো হয়েছে তো কি হয়েছে? বেকার ছেলের কাছে বিয়ে দেওয়া যাবেনা। এই বিভেদ আমরা মানুষরাই সৃষ্টি করেছি। আমার যতটুকু আছে, আমি চাইবো তারচেয়ে উঁচুতে ছেলে কিংবা মেয়েকে বিয়ে দিতে। পৃথিবীর মানুষগুলো টাকা আর রূপের দাস।

মামুন একবার লুকোচুরি করে রূপকথাকে দেখলো। তারপরই আলেয়া বেগমের কথায় কান দিলো, কিন্তু মন দিলোনা। রূপকথা উঠে ঘরে গেলো। রুমালটা লুকিয়ে এসে আগের জায়গায় বসলো।
মাকে বলল,
-“ভাইয়া মনে হয় তোমারে ডাকছিলো মা।”

আলেয়া বেগম দ্রুত পা ফেলে ঘরে গেলেন। উপমা নিচ দিকে তাকিয়ে সেলাই করছে। রূপকথা সুযোগ পেয়ে রুমালটা মামুনের হাতে গুঁজে দিলো। সে চুপচাপ পকেটে রুমাল গুঁজে বসে রইলো। উপমা টের পেলেও বুবুকে বিব্রত করতে চাইলোনা। আলেয়া বেগম এসে বললেন,
-“কই খোরশেদ ডাকলো আমারে? হেয় তো ঘুমে।”

-“মনে হয় আমি ভুল হুনছি।”

মামুন বিদায় নিলো। রূপকথাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রুমালখানা খুলে ধরলো। মুহূর্তেই তার অধর কোনে এক চিলতে হাসি ফুটলো। একটুকরো খয়েরী কাপড়ে সাদা সুতোর বুনন। রূপকথা আঁকিবুঁকি শেষে রুমালের মাঝখানে লিখে দিয়েছে “আমনে আমার অন্তরের মানুষ”।

#চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে