রূপকথা পর্ব-০৪

0
787

#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৪

[৭]
আইরিনের বিয়ের পূর্বে হলুদের দিন বিকেলেই ফুফুর বাড়িতে উপস্থিত হয় রূপকথা আর উপমা। সাথে মা ও এসেছেন। ভাইয়া আগামীকাল আসবেন। আইরিনের বিয়েতে রূপকথাকে দেখে উপস্থিত লোকজন তাকে বাঁকা চোখে দেখছে। আইরিন রূপকথার ছোট, উপমার সমবয়সী। তার আগে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে অথচ রূপকথা ড্যাং ড্যাং করে বিয়েতে চলে এসেছে। একজন তো সব জানার পরও টিট’কিরি করে বলেই বসলো,

-“তোমার তো এহনো বিয়া হয়নাই, তাইনা?”

মহিলাটি সঠিক জায়গায় তীর ছুঁড়ে মনে মনে বেশ আনন্দ আস্বাদন করছেন। রূপকথা কষ্টগুলো পি’ষে ফে’লে কৃত্রিম হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলল,
-“না, আমি তো এহনো পড়তাছি।”

মহিলাটি চরম বিষ্ময় প্রকাশ করলেন। মুখ হা করে মুখে হাত দিয়ে বসলেন। যেনো রূপকথা এক বেফাঁস কথা বলে গুরুতর অন্যায় করে ফেলেছে। চোখ দুখানা ঈষৎ বড় করে বললেন,
-“এহনো পড়ালেহা করো? মাইয়া মাইনষের এত বেশি পড়ালেহা করণ ভালা না। এহন যুগ ভালা না। কত অঘটন আজকালকার জামানার পোলামাইয়ারা ঘটায় তা কইতে ও শরম করে।”

-“সবাই কি আর এক হইলো?”
রূপকথার উত্তরে মহিলাটি মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
-“যারা বেশি পড়ালেহা করে তাগো স্বভাব আর ভালা হয়না। সবই এক। মাইয়া মাইনষের এত পড়ন ভালা না।”

চলে গেলেন মহিলাটি। তার বিড়বিড় করে বলা কথাটি কান এড়ালোনা রূপকথার।

-“নাই রূপের ছিঁ’ড়ি। আবার পড়ালেহার ভাব দেহাইতে আহে।”

আর কত? কত হজম করবে রূপকথা? ভেতরে ভেতরে বিধ্বস্ত হলো, আ’ঘাতে আ’ঘা’তে রক্তক্ষরণ হলো। সত্যি সে আর শক্তি পাচ্ছেনা। তার দুঃখগুলো বলার জন্য মায়ের কোলকে ও পূঁজি করতে পারছেনা। চোখের পানি আর কত ঝরাবে? রূপকথা মনে মনে এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলো। অন্তত তার সন্তানকে সে তার মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে দেবেনা। পরক্ষণেই তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
-“কপালে বিয়াই জুটলোনা, পোলাপান আইবো কই থেইকা?”

হলুদের অনুষ্ঠানে সবাই হলুদ রঙা শাড়ি পড়বে। রূপকথা তাহমিনার কাছ থেকে একটি হলুদ শাড়ি নিয়ে এসেছিলো পড়ার জন্য। হলুদ শাড়ি পড়ার শখ তার বহুদিনের। বিয়ের উছিলায় তার শখ ও পূরণ হবে। মাঝ বরাবর সিঁথি করে ঘাড়ের কাছে খোঁপা করলো। চোখের রেখায় গাঢ় কাজল টানলো। উপমার থেকে নিয়ে কটকটে লাল রঙা লিপস্টিক ঠোঁটে ছোঁয়ানোর আগেই আলেয়া বেগম চরম বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,
-“ঠোঁটে এগুলা কি দিতাছস? কেমন দেহা যায়? হালকা রঙের কিছু দে ঠোঁটে। আর কাজল এত গাঢ় করলি ক্যান? তোর চোক্ষের নিচ এ্যামনিতেই কালা। কাজল ছড়াইলে আরও বি’চ্ছিরি দেহা যাইবো।”

নিজের হাতে সুতি শাড়ির আঁচল দিয়ে রূপকথার চোখের কাজল মুছে দিলেন আলেয়া বেগম।
তিক্ত বিষাদে মন ডুবে গেলো। নিজের মন মতো সাজ টুকু ও তার কপালে জুটলোনা। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রূপকথা। সে খুব ভালো শাড়ি পড়াতে জানে। উপমাকে শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে দাঁড়াতেই কয়েকজন মেয়ে এসে তাকে ঘিরে ধরলো শাড়ি পড়িয়ে দিতে। রূপকথা স্বাচ্ছন্দে তাদের শাড়িতে হাত রাখলো। একজন জিজ্ঞেস করলো,
-“তুমি কি পিনবা?”

রূপকথা মিষ্টি হেসে বলল,
-“ওই যে হলুদ কাপড় আছে।”

মেয়েটা চোখমুখ কুঁচকে বলল,
-“হলুদ? তোমার চামড়ার রং একেবারে ফকফকা হইয়া দেহা যাইবো। হলুদ রং কি আর কালা মাইনষেরে মানায়? তুমি আমার কাছ থেইকা একটা নিয়া পিনবা।”

রূপকথা কিছু বলার আগেই উপমা জবাব দিলো,
-“ক্যান? হলুদ রঙ এ কি হইছে? আমার বুবুরে সব রঙেই মানায়। আমার তো বুবুরে সব রকমেই ভালা লাগে।”

শাড়ি পড়িয়ে দিতেই সবাই বেরিয়ে যায়। উপমা বলল,
-“তুমি যাইবা না বুবু? তাড়াতাড়ি কাপড় পিন্দা লও। আমি খাড়াইতাছি।”

রূপকথা স্বাভাবিক গলায় বলল,
-“তুই যা, আমি আইতাছি। বেশি দেরি হইবোনা।”

উপমা সায় জানিয়ে বেরিয়ে গেলো। রূপকথা আর বের হলোনা। হলুদ শাড়িটির ভাঁজ ও খুললোনা। আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। বালিশে মাথা রেখে নেত্রপল্লব বন্ধ করতেই চোখের কার্ণিশ বেয়ে দু’ফোটা জল গড়ালো। ভিজিয়ে দিলো নরম গাল জোড়া।
“আব্বা ক্যান আমার নাম রূপকথা রাখলা? সবাই আমার রূপ নিয়া ক্যান প্রশ্ন তোলে?”

সবাই বাইরে কত আনন্দ করছে। সবাই উপস্থিত থাকলেও রূপকথাকে দেখতে পেলেননা আলেয়া বেগম। তার চোখ জোড়া হন্যে হয়ে মেয়েকে খুঁজছে। অবশেষে উপমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
-“তোর বুবু কই?”

-“বুবু আইবো কইয়া এহনো আইলোনা। আমি যাইয়া দেইখা আসি।”

উপমাকে থামিয়ে দিলেন আলেয়া বেগম।
-“তুই থাক। আমি যাইয়া দেহি।”

আলেয়া বেগম কয়েকটা রুম খুঁজে রূপকথাকে পেলেন। শুয়ে আছে মেয়েটা। গালজোড়া ভেজা। বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠলো আলেয়া বেগমের। মেয়েটা পোড়াকপালি। তার রংটাই তার জন্য অভি’শাপ। আলেয়া বেগমের ভ’য় হয় মেয়েটাকে নিয়ে। এই বুঝি কেউ তার মেয়েটাকে কুৎ’সিত বলল, ক’ষ্ট দিয়ে কথা বলল, তাই তিনি নিজ থেকেই মেয়েকে সেসব থেকে দূরে রাখেন। যেসব রঙে দেখলে মানুষ টিটকিরি করবে। মেয়েটা কোন কারণে বাইরে গেলোনা?
আলেয়া বেগম ডান হাতে মেয়ের গাল ছুঁয়ে দিলেন। মায়ের শরীরের ঘ্রাণ যে প্রতিটি সন্তানের বড্ড চেনা। রূপকথার ও চিনতে ভুল হলোনা। চোখ বন্ধ করেই শুয়েছিল সে। মায়ের ছোঁয়া পেয়ে ঝট করে চোখ খুলে তাকায়। চোখের সাদা অংশে লাল বর্ণ ছড়িয়েছে। আলেয়া বেগম আৎকে উঠে কোমল গলায় শুধালেন,
-“কি হইছে আম্মা? নিচে গেলিনা ক্যান? শরীল খারাপ?”

রূপকথা উঠার চেষ্টা করলোনা। বলতে ইচ্ছে করলো “আমার ভীষণ মন খারাপ।” কিন্তু বলতে পারলোনা।
মিথ্যার আশ্রয় নিলো। সেভাবেই শুয়ে থেকে বললো,
-“মাথাডা ধরসে। এর লাইগাই গেলামনা।”

আলেয়া বেগম তড়িঘড়ি করে বললেন,
-“আচমকা মাথা ধরলো ক্যান? আইচ্ছা আমি নাপা টেবলেট পাই কিনা দেইখা আসি।”

রূপকথা ফিসফিস করে বলল,
-“মাথা ব্যথার ঔষধ না আইনা, অন্তর ব্যথার ঔষধ আইনো।”

আলেয়া বেগমের কর্ণধারে পৌঁছালোনা কথাটি। তিনি ঔষধের খোঁজে চলে গেলেন।

[৮]
বিয়ে বাড়ি থেকে বিকেলেই ফিরেছে সবাই। মন ভালো করার একমাত্র সঙ্গী বকুল সই। রূপকথা দেরি করলোনা। ছুটে চলে গেলো বকুল তলায়। প্রাণভরে শ্বাস নিলো। এ দুদিন যেনো দমবন্ধকর পরিবেশে মন পাখির বেড়ে ওঠা বাঁধা পেয়েছিলো। খোলা আকাশের নিচে নিজেকে এখন মুক্ত এক ছোট্ট পাখি মনে হচ্ছে। দুটো ডানা থাকলেই উড়ে যেতো। একে একে মানুষের নিন্দাগুলো মনে পড়তেই কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো রূপকথা। নীলাম্বরের দিকে তাকিয়ে বলল,

-“ওই আকাশ তুই এই মানুষগুলারে বুঝাইতে পারবি? তাগোরে কইয়া দিবি? আমার চামড়া কালা কিন্তু অন্তর কালা না।”

থামলো রূপকথা। বেরিয়ে আসলো তান্ডবহীন এক শান্ত দীর্ঘশ্বাস।
“আমার কল্পনায় আমিই সেরা সুন্দরী”
নেত্রপল্লব বন্ধ করে নিলো রূপকথা। কল্পনা জগতে তার পদচারণ ঘটলো। সে অনুভব করলো কল্পনায় সে বড্ড সুখী মানুষ। বিলের জলে ভাসা লাল পদ্ম।
আলতা পায়ে হলুদ রঙা শাড়ি পড়ে চোখে মোটা কাজল, ঠোঁটে টকটকে রং এর বাহার, হাতে বকুল ফুলের একখানা মালা, লম্বা আঁচল মাটিতে ছড়িয়ে বিলের পাড় ঘেষে ছুটে চলে যাচ্ছে কৃষ্ণবতী। ছোটার তালে তালে কৃষ্ণ কেশরের খোঁপাটি আলগা হয়ে পিঠ ছুঁয়ে কোমর ছুঁয়ে দিলো। বকুলতলায় এসে থামতেই শুরু হলো ঝরঝরে পুষ্পবৃষ্টি। আবিষ্ট হয়ে রইলো নিজ কল্পনায়। সত্যিই তো সে সুখী। রূপকথা সে, রূপকথার রাজকন্যা। রাজকুমার নেই, তবে আসবে। একদিন ঘোড়ার পিঠে চড়ে রাজকুমার ঠিকই আসবে।

-“কই ছিলা কোকিল পাখি? দুইডা দিন কোকিলা কন্ঠস্বর না শুনতে পাইরা আমার বুকের উতালপাতাল ঝড় কি টের পাওনাই?”

মোহনীয় ব্যাকুল কন্ঠস্বরে কল্পনা জগতের ইতি ঘটালো রূপকথা। বিধ্বস্ত রমণীর মনে ঈষৎ ঢেউ খেলে গেলো। কি চায় মানুষটা? রূপকথা চোখে চোখ রাখলো। নির্নিমেষ চেয়ে রইলো। নিরবতা কাটাতে ঢিমে স্বরে খানিকটা দ্বিধা নিয়েই শুধালো,
-“আমনের উদ্দেশ্য কী?”

হাসলো মামুন। ভুবন ভোলানো চওড়া হাসি। চোখজোড়া ক্রমশ সরু হয়ে আসলো। তাকে ভীষণ চমৎকার দেখালো। মাদকতায় আসক্ত চোখজোড়া চেয়ে রইলো কৃষ্ণবতীর পানে। আবিষ্ট কন্ঠে শুধালো,
-“প্রার্থনায় কেবল কোকিল পাখি।”

রূপকথা চমকালো, থমকালো, ভড়কালো। ঘোর লাগলো মনে। অন্তঃকরণে আইঢাই শুরু হলো। অস্থির, ব্যাকুল, চঞ্চল হয়ে উঠলো চোখজোড়া। খানিক পরেই বাস্তবতা তাকে স্মরণ করিয়ে দিলো,

“মি’থ্যের বোনা জালে পা দিও না সই,
বাস্তবতা ভীষণ কঠিন, তোমার জায়গা কই?
সৌন্দর্যে মন ভোলানো পুরুষজাতির স্বভাব,
নতুন খাঁচায় চোখ জুড়াবে, পিরিতিতে জমবে ধুলো,
ভালোবাসায় বুঝবে তুমি অভাব।
নারীই তোমার পরম শ’ত্রু, নিন্দে তার বাণী,
ধরার বুকে আছড়ে পড়া তুমিই বিষাদিনী।”

মলিন হাসলো রূপকথা। অকপটে,নির্দ্বিধায় শুধালো,
-“বাস্তবতা ভীষণ চেনা।”

সুগভীর, নির্মল মামুনের দৃষ্টি। নিমেষহারা চোখজোড়া চনমনে ভঙ্গিতে হাসলো। জোরালো কন্ঠে শুধালো,
-“প্রার্থনা একদিন ঠাঁই পাবে বাস্তবতায়।”

রূপকথার মনে ভয়ঙ্কর এক ইচ্ছে জাগলো। শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ হাতখানা তার পেলব হাতের স্পর্শে আঁকড়ে ধরতে চাইলো। মনে মনে চাইলো,”প্রার্থনায় মানুষটা সফল হোক।”

বকুল গাছের শক্ত শেকড়ে বসে পড়লো রূপকথা। পাশে বেশ খানিক জায়গা রাখলো। মামুন ভনিতা ছাড়াই পাশে বসলো। দুজনের বয়সে বিস্তর ফারাক। কিন্তু মনে? আদৌ কি ফারাক আছে? রূপকথা আড়চোখে একবার তাকালো মামুনের দিকে। মামুন তার দিকেই চেয়ে আছে নিমেষহীনভাবে। রূপকথার দৃষ্টি থামলো বিলের জলে। সুর হয়ে বেরিয়ে আসলো মনের কিছু সুপ্ত কথন।

“কিছুদিন মনে মনে..,
কিছুদিন মনে মনে ঘরের কোণে,
কিছুদিন মনে মনে ঘরের কোণে,
শ্যামের পিরিত রাখ গোপনে।
কিছুদিন মনে মনে…..”

“ইশারায় কইবি কথা ঘোটে-মাঠে…
ইশারায় কইবি কথা ঘোটে-মাঠে,
দেখিস যেনো কেউ না জানে, কেউ না বোঝে, কেউ না শোনে……
কিছুদিন মনে মনে…..”

“শ্যামকে যখন পড়বে মনে,
চাইবি কালো মেঘের পানে,
ওরে শ্যামকে যখন পড়বে মনে…..
ও তুই চাইবি কালো মেঘের পানে……”

হুট করেই বিনা বার্তায় বৃষ্টি নামলো। রয়েসয়ে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। রূপকথার চরণ দুখানা ছুটে চললো বাড়ি পথে। রহস্যময় হেসে শুধালো,
-“সুখ যে মরিচীকা।”

মামুনের চোখ দুখানা স্থির রইলো রমণীর যাত্রাপথে।

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে