#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_2
(নায়কের নাম বদলে আরজান দেওয়া হলো।)
শ্যামবর্ণের সোনালি চুলের মেয়েটার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে আরজান। মেয়েটা দিব্যি বিলের মাঝে কোমড় পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে কী অবলীলায় ভেসে আছে। তার সোনালি চুল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরে ঝরে পড়ছে। পরীধেয় বস্ত্র বদলে নতুন এক ঝলসানো রূপ ধারন করেছে। অবাক হয় আরজান, আচমকা এক অদ্ভুত ভাবনা মস্তিষ্কে হানা দেয়, “মেয়েটা কি জলপরি?”
পরক্ষণেই ভাবে জলপরি কী আর শ্যামবর্ণের হয়! কতোই তো রূপকথার গল্প পড়েছে। সব জায়গায় জলপরির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সফেদ রঙা জলরূপসী হিসেবে। রূপকথার গল্পের জলপরির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছে কতো পুরুষ। আর যাই হোক না কেন, মেয়েটা জলপরি তো নয়। ধুর! কী সব ভাবছে সে। এসব জলপরি টলপরি কিচ্ছু হয় না।
সে কিছুটা রাগান্বিত স্বরে শুধায়, “এই মেয়ে, এই ভর সন্ধ্যায় তুমি পানিতে কি করছো? তাও এই সুনসান জায়গায়।”
চোখ পিটপিট করে তাকায় মেয়েটা। তার দিকে চেয়ে থাকা ব্যতীত কোনো বাক্য উচ্চারণ করেনা সে। নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় শুধুই ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শ্রবণগোচর হচ্ছে। পরিবেশের নিস্তব্ধতা যেন মুহূর্তেই বেড়ে গেছে। এবার খানিকটা ভয় ভয় করছে আরজানের। এটা জ্বীন না তো? আকরাম চাচার কথা না শুনে ভুল করলো নাকি।
সাহস জুগিয়ে পুনরায় বলে, “এই মেয়ে, কথা বলছো না কেন? তুমি কি আমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছো?”
মেয়েটা এবারো নিশ্চুপ। যেন তার মুখ কেউ সুঁই সুতা দিয়ে সেলাই করে দিয়েছে। মেয়েটার এই আজব নীরবতা আরজানের মনে হাজারটা ভাবনার সৃষ্টি করছে। তাকে ভয় দেখাতে কি ইচ্ছে করে চুপ করে আছে? মেয়েটা বোবা নয়তো?
নিজেকে সংবরণ করে শুধায়, “মেয়ে তুমি কী কথা বলতে পারোনা?”
বরাবরের মতোই নিশ্চুপ মেয়েটা। অতিশয় বিরক্ত হয় আরজান। একবার ভাবে সে চলে যাবে, আবার ভাবে মেয়েটাকে একা রেখে যাওয়া উচিত হবে কি?
নিজের ভাবনাতে নিজেই বিরক্ত আরজান। সে কেন ভাবছে এসব নিয়ে। তার ভেতর তো মানবতার ছিটেফোঁটাও ছিলো না। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই তো সে নিজেকে শক্ত লোহার আবরনে আবৃত করে নিয়েছে। যেই দেয়াল ভাঙতে ব্যর্থ দুনিয়ার সকল মায়া, ভালোবাসা।
সমস্ত ভাবনা মস্তিষ্ক থেকে ঝেড়ে ফেলে মেয়েটার দিকে চেয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে, “মেলায় ফ্রক পড়ে তো বড় নিষ্পাপ লাগছিল তোমাকে। তখন কেমন বাচ্চা বাচ্চা লাগছিল এখন তো বেশ বড় লাগছে। পানি থেকে উঠবে নাকি চলে যাবো?”
মেয়েটা কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। রাগান্বিত হয় আরজান। এতটুকু মেয়ে তাকে কি না ভাব দেখাচ্ছে! সে গটগট পায়ে হাঁটা ধরে মাঠের দিকে। অমনি পেছন থেকে ভেসে আসে সুমধুর কন্ঠস্বর,
‘ম্যাজিশিয়ান’
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে আরজান। মেয়েটা তাকে ডাকলো মনে হলো। ভুল শুনেছে ভেবে পুনরায় পা চালায় সে।
আবারো ভেসে আসে সেই ডাক,
‘ম্যাজিশিয়ান’
এবার আর কোনো ভুল নয়, স্পষ্ট শুনেছে সে। দ্রুত পেছনে ফিরে তাকায়। ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে যায় বিলের পাড়ে। ধমকের সুরে শুধায়, “এখন ডাকছো কেন? এতক্ষণ তো বড় ভাব দেখালে।”
মেয়েটা গলা নামিয়ে ভীত স্বরে বলে ওঠে, “ধীরে কথা বলো, কেউ চলে আসবে।”
“ধীরে কথা বলতে হবে কেন? কেউ আসলে সমস্যা কী?আর এই সময় কে আসবে এই সুনসান জায়গায়, কেউ আসবেনা।” বেশ রাগান্বিত স্বরে জবাব দেয় আরজান।
মেয়েটা অন্যমনস্ক হয়ে বলে, “ওরা আসবে আমাকে ধরতে।”
ভ্রু কুচকায় আরজান, “কারা আসবে?”
দ্রুত যেন কথা বদলে নেয় মেয়েটা। মুচকি হেসে বলে, “আমি তোমার জাদু দেখতে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখেছিলে তুমি?”
গ্রামের মেয়ের এমন সাবলীল, সুন্দর ভাষা কিছুটা অবাক করে আরজানকে। পরবর্তীতে ভাবে এখন সবাই পড়ালেখা করছে, ভাষা তো শুদ্ধ হবেই। সে চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে সন্ধ্যার শেষ আলোটুকুও ফুরিয়ে আসছে। ব্যস্ত স্বরে শুধায়, “তোমার বাসা কোথায়?”
মেয়েটাকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতে দেখে পুনরায় শুধায়, “আমি জিজ্ঞেস করছি তুমি কোন বাড়ির মেয়ে?”
উত্তর দেয় না মেয়েটা। তার মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছে এই প্রশ্নে সে কিছুটা ঘাবড়ে গেছে। চোখ ছোট করে তাকায় আরজান, তাকে কি ভয় পাচ্ছে মেয়েটা!
তাকে আশ্বস্ত করতে বলে, “উঠে এসো, আমি তোমাকে বাড়িতে পৌছে দিচ্ছি।”
ডানে-বামে মাথা নাড়ায় মেয়েটা। নরম স্বরে বলে, “আমি একাই চলে যাবো, তুমি ফিরে যাও।”
ধমকে ওঠে আরজান, “তাহলে খামোখা ডাকলে কেন আমাকে?”
মেয়েটা বারবার যেন কিছু বলতে চেয়েও বলছেনা। তার সোনালি চুলগুলো কিছুটা লালচে রঙ ধারন করেছে। মেলায় যেমন চকচকে সোনালি রঙ মনে হয়েছিল আদতে তা পুরোপুরি সোনালি নয়, অনেকটাই লালচে। তবে বেশ মানিয়েছে তাকে। বয়সটাও কেমন যেন পূর্বের তুলনায় বেশি লাগছে। মেলায় দেখে বাচ্চা ভাবলেও এখন তাকে প্রাপ্তবয়স্কা কোনো নারীর মতো লাগছে। কিছু সময়েই এতো ব্যবধান! তার চোখ কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে?
ভাবনা ছেড়ে সটান দাঁড়িয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে, “চললাম আমি।”
ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই আবারো ডেকে ওঠে মেয়েটা, “শোনো।”
ফিরে তাকায় আরজান। ব্যস্ত স্বরে বলে, “যা বলার দ্রুত বলো। তোমার জন্য এখানে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খেতে পারবোনা আমি।”
“কালকেও কি জাদু দেখাবে তুমি?”
“হ্যাঁ।” ছোট করে উত্তর দেয় আরজান।
মেয়েটা আগ্রহ নিয়ে শুধায়, “এখানেও কি আসবে?”
“রোজ রোজ এখানে কোন সুখে আসবো? এসেছিলাম স্মৃতিচারণ করতে, তা আর হলো কই!”
“তাহলে কালকেও এসো।”
“কাল কেন আসতে যাবো?” শুধায় আরজান।
“তুমি বললে যে স্মৃতিচারণ করতে এসেছিলে, কাল নাহয় সেটাই করতে এসো।”
গম্ভীর হয়ে ওঠে আরজানের মুখভঙ্গি, “তার আর প্রয়োজন নেই।”
বাক্য সম্পূর্ণ করেই আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে যায় মাঠের দিকে। অন্ধকারে পথ দেখতে অসুবিধা হওয়ায় মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে করে নেয়। কি আর করার! বড্ড দেরি করে ফেলেছে সে। সবুজ শার্টের হাতাটা ভালো করে গুটিয়ে নিয়ে গলায় পেঁচানো কালো মাফলারটা টেনে একটু ঢিল করে করে নেয়। একহাতে মোবাইল ধরে অন্যহাতে চুলগুলো ঠিক করতে করতে সাদাবিল’কে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলে সে।
পেছন থেকে কেউ ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে মাঠের প্রান্তরে মিশে যাওয়া ম্যাজিশিয়ানের দিকে। ধীরে ধীরে দূরান্তে মিলিয়ে যায় পুরুষটার অবয়ব। অমনি পানিতে ঝুপ করে এক শব্দ হয়। সেই সাথে পানির মাঝে বিলীন হয়ে যায় কারোর অস্তিত্ব।
চেয়ারম্যানের বাড়িটা খুব বেশি বড় নয়। নিচ দিয়ে ইট গেঁথে উপরে টিন দেওয়া। সেখানে চারটা কামরা হবে হয়তো। রান্নাঘর আর টয়লেট বাইরে উঠোনে। টয়লেটের পাশেই টিউবওয়েল বসানো। মাঝারি আকারের উঠোনের একপাশে আবার হাস-মুরগির ঘর। তার পাশ দিয়ে কয়েকটা আম-কাঁঠালের গাছ লাগানো।
বাড়িতে ঢুকে উঠোনে চেয়ারম্যানকে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে দেখে ভ্রু কুচকায় আরজান। এগিয়ে গিয়ে শুধায়, “কি হয়েছে চাচা? কোনো সমস্যা?”
চকিতে তাকায় আকরাম মিঞা। স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলে, “তুমি আইছো বাজান। আমার তো ডর করতাছিল কী না কী হয়!”
“কী হবে?”
কথা ঘুরিয়ে নেয় আকরাম মিঞা। তাড়া দিয়ে বলে, “ঘরে চলো বাজান, তোমার চাচি তোমার লিগা মুরগি রানছে।”
মাথা ঘামায় না আরজান। যা হয় হোক, এসব নিয়ে ভেবে তার লাভ কী?
খাওয়ার জন্য ঘরে ঢুকতেই দেখা হয় আকরাম মিঞার ছেলে পলাশের সাথে। সে খেজুর পাতার পাটিতে বসে স্টিলের একটা থালায় করে ভাত খাচ্ছে। সামনেই একজন মহিলা বসে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে। পলাশ একবার মাথা তুলে তাকায় আরজানের দিকে। কোনো প্রকার বাক্য বিনিময় না করেই আবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। ভ্রুক্ষেপ করেনা আরজান, চুপচাপ তার পাশেই পাটিতে বসে যায় হাঁটু ভেঙে।
সামনের মহিলাটি যত্ন সহকারে ভাত বেড়ে দেয় তার জন্য। মুরগির মাংস বাটিতে তুলে দিয়ে আবার বাতাস করতে থাকে। খাবারের মাঝে হটাৎ চিল্লিয়ে ওঠে পলাশ, “এতো নুন ক্যান গোস্তে?”
চেয়ারম্যানের বউ রোজিনা বেগম নরম মনের মানুষ। দ্রুত একটু ঝোল মুখে নিয়ে পরখ করে দেখে বলে, “ঠিকই তো আছে বাপ।”
ভাতের থালায় পানি ঢেলে উঠে পড়ে পলাশ। বড়বড় পা ফেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আরজান কিন্তু মুখে কিছুই বলেনা। উল্টে নজর সরিয়ে আবার খেতে শুরু করে। রোজিনা বেগম বাতাস করতে করতে বলে, “তুমি কিছু মনে কইরো না বাপ। আমার পোলাডার মন মিজাজ একটু গরম।”
“সমস্যা নেই।” থমথমে গলায় উত্তর দেয় আরজান।
______________________________
সকাল করে শোরগোলের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আরজানের। আড়মোড়া ছেড়ে উঠে বসে বালিশের পাশ থেকে হাতরিয়ে মোবাইলটা নিয়ে দেখে মাত্র সাতটা বাজে। শোরগোলের শব্দ অনুসরণ করে বাইরে গিয়ে দেখতে পায় চেয়ারম্যান আর তার ছেলে কিছু একটা নিয়ে কথা কাটাকাটি করছে।
তখনই চেয়ারম্যান রাগান্বিত স্বরে বলে, “তোরে আর একটা ট্যাকাও দিবার পারমুনা আমি। কানাকড়ি তো রোজগার করবার ক্ষেমতা নাই। আমার ট্যাকাগুলা লইয়া পাড়ার চোর-ছেচর সবগুলার লগে মিল্লা গান্জা টানস।”
পলাশ শক্ত চোখে তাকিয়ে চিল্লিয়ে বলে, “তোর ট্যাকার গু’ষ্টি মা’রি, আমি পলাশ তোর ট্যাকা ছাড়াও চলবার পারমু।”
রাগে সামনে থাকা কাঠের বেঞ্চিতে লাথি মেরে হনহন পায়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। আকরাম মিঞা রাগান্বিত চোখ নিয়ে ফিরে তাকাতেই আরজানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। পাত্তা দেয় না আরজান, সোজা হাঁটতে হাঁটতে কলপাড়ে চলে যায়। যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব।
ফ্রেশ হয়ে ঘরে এসে আগে মা’কে কল লাগায়। কাল আসার পর থেকে আর কথা বলা হয়নি। কয়েকবার রিং বাজার পর রিসিভ হয়। ভেসে আসে সোফিয়া শিকদারের উত্তেজিত কন্ঠস্বর, “বাপের দেশে গিয়ে মাকে ভুলে গেলি?”
মুচকি হাসে আরজান, “তোমাকে কী করে ভুলি বলো? ওষুধ খাচ্ছো তো ঠিক মতো? নাকি ভুলে বসেছো?”
“খাচ্ছি খাচ্ছি, এতো মনে করে দিতে হবেনা। লামিয়া এখানে থেকে আমার দেখাশোনা করছে। তুই কবে আসবি তাই বল? লামিয়ার বাবা-মা আর দেরি করতে চাইছে না।”
অমনি মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় আরজানের। কোথায় ছেলের একটু খোঁজ খবর নেবে তা না ঐ মেয়েটাকে নিয়ে পড়ে আছে। তার বয়স মাত্র পঁচিশ হলো, লেখাপড়া তো সে প্রায় বাদই দিয়ে দিয়েছে কাজের জন্য। আর এদিকে তার মা শুধু বিয়ে বিয়ে লাগিয়েছে। কিছু না বলেই কল কেটে দেয় সে।
ওপার থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফিয়া শিকদার। ছেলেটা তার হাসে না কতোকাল। বাবার মৃত্যু কতোটা বদলে দিয়েছে তার হাসিখুশি আরজানকে। সে খুব করে চায় তার সেই আগের চিল্লাচিল্লি করে বাড়ি মাতিয়ে রাখা আরজানকে। যার উল্টো-পাল্টা কথাতে মাথা ধরে যেত যে কারোর। ছেলেটাকে বিয়ে দিতে পারলে সে শান্তিতে মরতে পারবে। ক্যান্সারের রোগী সে, আর কয়দিনই বা বাঁচবে। ছেলেটাকে এরকম একলা একা রেখে তো সে মরেও শান্তি পাবেনা। লামিয়া তার ছোটবোনের মেয়ে। বোনকে বলতেই সে রাজি হয়ে গেছে মেয়ে দিতে। মেয়েটা ভারী সুন্দর, গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা। কাজল কালো চোখ, ঘন কালো চুল, নম্র ব্যবহার, পড়ালেখাও করছে। সব মিলিয়ে মেয়েটাকে তার খুব পছন্দ। তার ছেলের সাথে মানাবেও ভালো। ছেলে তার শ্যামলা হলেও রাজপুত্রের মতো দেখতে। লম্বা-চওড়া কোন দিক দিয়ে কম তার ছেলে? সবদিক দিয়েই সম্পূর্ণ সে। কিন্তু ছেলে তো এসবের ধার ধারেনা, তাকেই দেখতে হয়। কোনোমতে ছেলেকে রাজি করিয়েছে বিয়ের জন্য।
বিকেলের দিকে আরজান আজ আগে আগেই পৌছে যায় মেলার মাঠে। ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে চারপাশটা। ছোট-বড় সকলেই তাকে কেমন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। আবার কেউ কেউ এসে বলছে, “আপনের জাদু ম্যালা ভালা।”
মুচকি হাসে আরজান। উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। আশেপাশে কোথাও কালকের সেই মেয়েটা নজরে আসছেনা। হয়তো আজ আসেনি জাদু দেখতে। সে এসব কেন ভাবছে? বিরক্ত হয় আরজান।
জাদুর সময়কাল এগিয়ে এসেছে দেখে স্টেজের দিকে যেতেই দেখা হয় রজত হাওলাদারের সাথে। সে তার পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো বের করে বলে, “আইছো? আর দাঁড়ায় থাইকো না, জাদু শুরু করো।”
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় আরজান। জাদুর সরঞ্জাম হাতে উঠে আসে স্টেজে। অমনি কেউ তার দিকে সজোরে ঢিল ছুঁড়ে মারে। মুখে এসে পড়ার আগেই তা ধরে নেয় আরজান। দূরে দাঁড়ানো পলাশের দিকে চেয়ে বাঁকা হাসে। এই কাজ সে ছাড়া আর কে করতে পারে! উপস্থিত জনতা অবাক হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। কেউ কেউ উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে কাজটা কে করলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আচমকা আরজান সেই ঢিলটা ছুড়ে মারে দর্শকদের দিকে। সকলে দৌড়ে সরে পড়তে গেলে হটাৎ ঢিলের বদলে গোলাপের পাপড়ি ঝরতে থাকে তাদের মাথার উপর। সবাই হাত বাড়িয়ে ধরতে নেয় সেই পাপড়ি।
পলাশ রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে। আরজান শান্তি পায় তার হেরে যাওয়া মুখখানা দেখে। আবার শুরু করে জাদু প্রদর্শন। হটাৎ তার চোখ পড়ে দূরে দাঁড়ানো কালকের সেই কন্যার দিকে। মেয়েটা একধ্যানে চেয়ে আছে স্টেজের দিকে। তবে আজকেও তার পড়নে সেই সবুজ ফ্রক, গতকালের মতো খালি পা। আজকেও তাকে দেখতে সেই আগের মতোই বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। অবাক হয় আরজান, সে কি কাল সন্ধ্যায় ভুল দেখেছিলো!
ভাবনা ছেড়ে সে পুনরায় জাদুতে মনোনিবেশ করে। কিছুক্ষণ পরেই আবার সেদিকে তাকায়। তার মন বলছে জাদু শেষ হয়ে গেলে সে আর দেখতে পাবেনা মেয়েটাকে। হ্যাঁ, মেয়েটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে পলাশ, সাথে আরো তিনটা ছেলে আছে। সকলের মুখেই শয়তানি হাসি। ভ্রু কুচকায় আরজান, “উদ্দেশ্য কী তাদের?”
ছেলেগুলো একটু একটু করে এগিয়ে আসছে তার দিকে অথচ মেয়েটার কোনো হেলদোল নেই। সে একধ্যানে চেয়ে আছে স্টেজের দিকে।
আচমকা পলাশ মেয়েটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বিদঘুটে হাসি হাসে। চমকে উঠে পিছিয়ে যায় মেয়েটা তবে খুব বেশি পেছনে যেতে পারেনা। সেই তিনটা ছেলে ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে। মেয়েটার মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছে সে বেশ ঘাবড়ে গেছে। চিৎকার চেঁচামেচি করার বদলে সে নিজের ফ্রক চেপে ধরে আরজানের দিকে মায়াভরা নজরে তাকায়। চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয় আরজান। মেয়েটা এভাবে তার দিকে কোন আশাতে তাকাচ্ছে?
পুনরায় তাকিয়ে দেখে পলাশ রীতিমতো মেয়েটার হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে। এবার ভয়ে বেশ জোরেই চিৎকার করছে মেয়েটা। এই মেলার এতো এতো মানুষের মধ্য থেকে কেন যেন একটা মানুষও এগিয়ে আসছেনা তাকে বাঁচাতে। মেয়েটার চিৎকার যেন কারোর কানেই ঢুকছে না।
আরজান একপা এগিয়ে আবার পিছিয়ে আসে। সে কেন বাঁচাবে? তার কী লাভ? উঁহু, কিছুতেই বাঁচাবেনা। জাদুর সরঞ্জামের ব্যাগ হাতে নিয়ে নেমে আসে স্টেজ থেকে। মেয়েটা এখনো তার দিকে চেয়েই চিৎকার করছে। তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে বড়বড় পা ফেলে মেলার মাঠ ত্যাগ করে আরজান। এসব কোলাহল তার মোটেই পছন্দ নয়। শুধু শুধু মেয়েটার জন্য ঝামেলায় জড়ানোর কোনো মানেই হয় না।
চলবে???
#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_3
(নায়কের নাম বদলে আরজান দেওয়া হয়েছে)
মেলার মাঠের বাইরে এসে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে আরজান। পা দু’টো যেন আর আগাতেই চাইছেনা। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে মেয়েটার অসহায় মুখশ্রী। কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে মনের সাথে যুদ্ধ করে আবার ফিরে আসে মেলার মাঠে। দূর থেকেই শুনতে পায় মেয়েটার করুন আকুতি সেই সাথে পলাশের অট্টহাসি।
তখনই পলাশ শয়তানি হেসে পাশের ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে বলে, “এতো ভালা মা’ল এই গেরামে আছে, কইছ নাই ক্যান তোরা?”
পাশ থেকে একটা ছেলে লোভাতুর দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে চেয়ে বলে ওঠে, “নজরে আইলে কি আর ছাইড়া দিতাম মা’লটারে?”
অজান্তেই চোখগুলো লাল হয়ে উঠেছে আরজানের।
বড়বড় পা ফেলে সেদিকে এগিয়ে যেতে নিয়েও থেমে যায়। তার যাওয়ার কী প্রয়োজন?
বাঁকা হেসে জাদুর সরঞ্জামের মধ্য থেকে একটা ছোট লাঠি তুলে নিয়ে ছুড়ে মারে পলাশের দিকে। লাঠিটা সোজা গিয়ে পলাশের মাথার পেছনে আঘাত করে। আহ্ করে শব্দ করে মেয়েটার হাত ছেড়ে দেয় পলাশ। কিন্তু তাকে আরো অবাক করে লাঠিটা শূন্যে ভেসে ভেসে তাকে একের পর এক আঘাত করতেই থাকে। আশেপাশের লোকজন সকলে হা করে চেয়ে আছে সেদিকেই। সকলের চোখ যেন কপালে উঠতে চাইছে।
আচমকা পলাশের সাথে থাকা একটা ছেলে তোতলাতে তোতলাতে বলে ওঠে, “ভূত, ভূত আইছে গেরামে।”
অমনি শুরু হয়ে যায় সকলের চিল্লাচিল্লি। সকলে হুরমুর করে দৌড়ে মেলার মাঠ ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে। বর্তমানে মেলার মাঠে একটামাত্র শব্দই শ্রবণগোচর হচ্ছে, তা হলো, ভূত ভূত, ভূত আইছে গেরামে।”
মূহুর্তেই ভরা মাঠ শূন্য হয়ে যায়। পলাশ মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে, তার মাথা বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত ঝরছে। এই অবস্থায় তার উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পর্যন্ত নেই। পলাশের সাথে থাকা ছেলেগুলো সবার আগেই মাঠ ত্যাগ করেছে। আরজানের এখন পেট ফেটে হাসি আসছে। কিন্তু তার মুখে হাসি? সে তো বড়ই দুর্লভ জিনিস! সে তাচ্ছিল্য স্বরে বিড়বিড়িয়ে বলে, “ইশ বেচারা!”
লাঠিটা আবার তার হাতে পৌঁছাতেই সে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। মেয়েটার দিকে একবার ঘুরে তাকানোর প্রয়োজন মনে করে না। পলাশের উপর তার রাগ জন্মেছিল বিধায় সে এসেছিল, মেয়েটাকে বাঁচাতে মোটেও নয়। মেয়েটা বাঁচলো না মরলো তাতে তার কী এসে যায়?
মাঠ থেকে বেরিয়ে কোনো ভ্যান বা অন্য যানবাহন কিছুই দেখতে না পেয়ে বিরক্ত হয়। ভিতুগুলো সব পালিয়েছে, এখন তাকে হেঁটেই যেতে হবে। এদিকে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে, বেশিক্ষণ আর আলো থাকবেনা। মোবাইলটাও আনেনি সে।
বিরক্ত হয়ে পা বাড়ায় মাঠের দিকে। মাঠ দিয়ে গেলে দ্রুত পৌঁছাতে পারবে। কিছুদূর হাঁটার পরেই শুনতে পায় সেই মধুর কন্ঠস্বর। কেউ যেন খুব নরম স্বরে ডাকছে, “ম্যাজিশিয়ান”
থমকে দাঁড়ায় আরজান, এই ডাক এতো মধুর কেন তা তার জানা নেই। এই ডাক কানে আসার পর তা উপেক্ষা করা বড়ই কঠিন হয়ে পড়েছে। নিজের কাজে নিজেই বিরক্ত আরজান, নিজেকে সংবরণ করে আবার পা চালায়। একপা এগোতেই আবারো সেই ডাক, “ম্যাজিশিয়ান”
রাগান্বিত হয়ে পেছনে ফিরে তাকায় আরজান। মেয়েটা জমির আইল দিয়ে হেঁটে হেঁটে তার দিকেই আসছে। তার কাছে মনে হচ্ছে কোনো বাচ্চা মেয়ে হেঁটে আসছে। তাহলে কাল সন্ধ্যায় কি ভূল দেখেছিল সে?
আরজান রাগান্বিত স্বরে শুধায়, “কী সমস্যা তোমার?”
তার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ায় মেয়েটা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে শুধায়, “ভূত কী?”
চোখ বড়বড় করে তাকায় আরজান। আশ্চর্য কন্ঠে শুধায়, “ভূত চেনোনা তুমি?”
“না, তুমি কি ভূত দেখেছো? দেখতে কেমন হয়?” মেয়েটার স্বাভাবিক উত্তর।
হকচকিয়ে যায় আরজান। আসলেই তো! সে তো ভূত দেখেইনি তাহলে বলবে কিভাবে ভূত দেখতে কেমন হয়। আমতা আমতা করে বলে, “ভূত মানে ভূত। মানে এইটা শুধু বলা হয়, দেখা যায় না।”
কথা সম্পন্ন করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে তার মুখভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করে যে তার কথা বুঝতে পেরেছে কি না?
তখনই মেয়েটা ভাবুক স্বরে শুধায়, “কেন বলা হয়? দেখা যায় না কেন?”
আরজানের মনে হচ্ছে আশেপাশে যদি কোনো গাছ থাকতো, তাহলে সে মাথা ঠুকে নিজে নিজে অজ্ঞান হয়ে যেতো। অন্তত এই মেয়ের ফালতু প্রশ্ন থেকে তো মুক্তি পেতো। কথা ঘোরাতে মেয়েটার দিকে চেয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে, “কেন বিরক্ত করছো আমাকে?”
“আমি তোমাকে বিরক্ত করবো কেন? আমি জানিনা তাই জিজ্ঞেস করলাম, তুমি না জানলে বলবে জানিনা আমাকে রাগ করছো কেন?”
“আমাকে কেন জিজ্ঞেস করবে তুমি?” ধমকে ওঠে আরজান।
তার ধমকের কোনো আছরই পড়ে না মেয়েটার উপর। তার প্রতিক্রিয়া একদম স্বাভাবিক। সে চুপচাপ মাঠের এদিক-ওদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনও মনে করে না। কিছুক্ষণ পর নিজ থেকেই বলে ওঠে, “জানো আজ আমাকে একটা ভূত বাঁচিয়েছে। তোমার দিকে কতো করে চেয়ে থাকলাম কিন্তু তুমি এলেই না। আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে, কেন এলে না?”
রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আরজান। একেতো তাকে ভূত বলছে আবার তাকেই জিজ্ঞেস করছে সে কেন আসেনি। সে বিরক্ত স্বরে বলে, “কেন আসতে যাবো আমি? আর তুমিই বা কেন আশা করো যে আমি আসবো?”
অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে মেয়েটা। আনমনে বলে ওঠে, “আর কেউ তো আমাকে চেনে না। আমি শুধু তোমার সাথেই কথা বলি।”
ভ্রু কুচকে তাকায় আরজান। অবাক স্বরে শুধায়, “মানে? তুমি এই গ্রামের মেয়ে না?”
ডানে-বামে মাথা নাড়ায় মেয়েটা। আরজান পুনরায় শুধায়, “বাসা কোথায় তোমার? এই গ্রামে কার বাড়িতে থাকো?”
উত্তর দেয় না মেয়েটা। হাঁটতে শুরু করে বিলের দিকে। অবাক হয় আরজান, “এই মেয়ে কি আজও এই সন্ধ্যাবেলা বিলে যাবে? ভয় টয় পায় না নাকি?”
যেখানে ইচ্ছা যাক, তার কী? এমনিতেও দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে। সে দ্রুত পা চালায় চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে। শেষ আলোটুকু বিলীন হওয়ার আগেই ফিরতে হবে। শুধু শুধু মেয়েটার জন্য দেরি হয়ে গেল।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই শুনতে পায় রোজিনা বেগমের কান্নাভরা চিৎকার। দ্রুত পায়ে ভেতরে ঢুকে দেখতে পায় বাড়িতে অনেক লোকজনের ভীর। এতো ভীরের কারন তার বোধগম্য হয় না। আপনা আপনি কপাল কুচকে যায় তার। বিড়বিড়িয়ে বলে, “এই লোকগুলোও না! একটু থেকে একটু কিছু পেলেই একজায়গায় জড়ো হয়ে হট্টগোল লাগিয়ে ফেলে।
সে ঘরের ভেতর ঢুকে বুঝতে পারে ভীরের আসল কারন। বিছানায় অসাড় হয়ে শুয়ে আছে পলাশ, তার পাশেই গ্রাম্য ডাক্তার বসে তাকে চিকিৎসা করছে। বিছানার পাশে চেয়ারম্যান দাঁড়িয়ে আছে চিন্তিত মুখে। রোজিনা বেগম মুখে আঁচল চেপে সমানে কেঁদে চলেছে। এমন কুলাঙ্গার ছেলের জন্য এই মরা কান্নার কোনো মানে পায়না সে।
তাদের চোখের অগোচরেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। নিজের জন্য নির্ধারণ করা ঘরের দিকে যেতে যেতে শুনতে পায় লোকজনের কথোপকথন। ভীরের মধ্য থেকে কেউ একজন খুব উত্তেজনা নিয়ে বলছে, “চেয়ারম্যানের পোলাডার ভূতে কী হাল করছে। ভূত হইলো রাইতের জিনিস, আর আইজ দিনেও চইলা আইছে।”
পাশ থেকে কেউ তার সাথে সুর মিলিয়ে বলছে, “হ, তা যা কইছেন। আইজ তো আমার বাড়িত যাইতেই ডর করতাছে।”
কটমট করে তাকায় আরজান। সবাই তাকে ভূত বলছে। সে কোন দিক দিয়ে ভূতের মতো দেখতে। মেয়েটার জন্য শুধু শুধু তাকে এসব সহ্য করতে হচ্ছে। মেয়েটা নিজেও তো তাকে ভূত বলেছে।
মনেমনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে সে আর কখনো ঐ মেয়ের ছায়াও মাড়াবে না। মেলা শেষ হলে সে এখান থেকে যেতে পারলেই বাঁচে। তার কাছে অসহ্য লাগে এই গ্রাম। তার উপর জুটেছে ঐ মেয়েটা, উটকো ঝামেলা।
ঘরে গিয়ে জাদু সরঞ্জাম রেখে বিছানায় আরাম করে বসে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে একবার ভাবে মাকে কল দেবে। পরক্ষণেই আবার ভাবে না থাক, কল দিলেই সেই তো আবার শুরু করবে বিয়ের প্যাঁচাল।
তখনই মোবাইল ভাইব্রেট হতে শুরু করে। স্ক্রিনে বড়বড় অক্ষরে লেখা উঠেছে ‘মা’। কপাল চাপড়ায় আরজান। আফসোস করে বলে, “একেই বোধহয় বলে ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়’।”
কল ধরবেনা ধরবেনা করেও আবার কী ভেবে রিসিভ করে। মোবাইল কানের সাথে ধরতেই ভেসে আসে সোফিয়া শিকদারের রাগান্বিত কন্ঠস্বর, “কল কেটে দিলি কেন সকালে? তারপর কতবার কল করেছি, কোথায় ছিলি এতোক্ষন?”
“আমি এখানে কাজে এসেছি মা। মেলার মাঠে ছিলাম। এক্ষুনি আসলাম আর তুমি কল দিলে।”
“আসবি কবে?” শুধায় সোফিয়া শিকদার।
“আরো তিনদিন আছে। এখানে থাকতে আসিনি আমি।মেলা শেষ হলেই দ্রুত চলে আসবো আমি।” গম্ভীর স্বরে উত্তর দেয় আরজান।
সোফিয়া শিকদার কিছুক্ষণ দম নিয়ে নেয়। হূট করে কিছু বলা যাবে না। তাকে বুঝতে হবে এটা তার সেই আগের হাসিখুশি, চঞ্চল আরজান নয়। যার কথা শুনে কেউ না হেসে থাকতে পারতো না। তবে এই আরজান গম্ভীর, রাগি। সে ধীর স্বরে বলে, “তোর খালামণি বলছিলো,,,,,,,,,,”
“দ্রুত তার মেয়েকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিতে, তাইতো?” কথার মাঝেই ফোড়ন কেটে বলে আরজান।
ছেলের ঠাসঠাস করে দেওয়া কটু জবাবে চমকে যায় সোফিয়া শিকদার। অসহায় চোখে তাকায় পাশে বসে থাকা লামিয়ার দিকে। মেয়েটার হাসি-খুশি মুখটাতে যেন নিমেষেই রাজ্যের আঁধার নেমে এসেছে। তারই ভুল, ছেলেকে তো চেনে সে। বাবার মৃত্যুর পর সেই যে ছেলেটা বদলে গেল আজও তার কোনো পরিবর্তন হলো না। তবুও লামিয়ার দিকে চেয়ে ছেলেকে কিছু কড়া কথা বলতে উদ্যত হতেই পুনরায় ভেসে আসে আরজানের বিরক্তভরা কন্ঠ, “বারবার এসব বলবেনা আমাকে। তুমি তো জানো আমি এসব নিতে পারি না।
বিয়ে, সংসারের জন্য এখনো প্রস্তুত নই আমি। তুমি প্লিজ আর এসব বলোনা।”
কথাটা বলেই ঠাস করে কল কেটে দেয় আরজান। এদিকে লামিয়ার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। চোখদুটো পানিতে টইটম্বুর। একসময় চোখ মুছতে মুছতে দৌড়ে বেরিয়ে যায় লামিয়া। বড় আফসোস হয় সোফিয়া শিকদারের। তার জন্য মেয়েটা এখন কাঁদতে বসবে। ছেলেটা যে কবে শোধরাবে? তবে লামিয়ার সাথে বিয়ে হলে তার ছেলে শুধরে যাবে, এটা তার বিশ্বাস। সুন্দরী বউ ঘরে থাকলে সব ছেলেই ঘর ধরে যায়।
চলবে???