#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#শেষ_পর্ব
“স্বামীর উপর এতো অত্যাচার করলে পাপ হবে রূপ।”
ভ্রুক্ষেপ করলো না রূপকথা। মুখ ঘুরিয়ে রইল পূর্বের মতোই। আনমনে বালুর ওপর আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুকি করছে সে। তার ঠিক সামনেই আরজান দাঁড়িয়ে আছে কান ধরে। রূপ অবশ্য বলেনি তাকে কানে ধরতে। সে নিজ উদ্বেগে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাত থেকে। কান থেকে হাত সরাচ্ছেও না আবার রূপকথাকে শান্তিতে থাকতেও দিচ্ছে না। আজগুবি গাঁজাখুরি কথাবার্তা বলে বলে তার মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে বিরক্ত রূপ হয়ে বলে উঠছে, “কষ্ট হলে হাত নামিয়ে নিন। আমি কি বলেছি কানে ধরতে? শুধু শুধু বাজে কথা বলবেন না তো।”
পূর্বের ন্যায় আরজানের সেই একই উত্তর, “ক্ষমা করে দিচ্ছ তাহলে?”
“মোটেই না।”
“তাহলে আমিও কান ছাড়ব না।”
“না ছাড়লে ধরে থাকুন। আমার কী?”
বিস্ময়ে চোখদুটো বড়বড় করল আরজান। বিস্মিত কন্ঠে শুধাল, “আমি কান ধরে থাকলে তোমার কিছুই না! নিষ্ঠুর নারী, মায়া-দয়া কি সব পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছ? হায়! এই ছিলো আমার কপালে!”
বড্ড বিরক্ত হলো রূপকথা। এই লোকটা এতো ঢং কীভাবে করতে পারে আল্লাহ মালুম! ফালতু কথার তো অভাব নেই তার শব্দভাণ্ডারে। অন্য কেউ শুনলে হয়তো এতোক্ষনে এই সমুদ্রে ডুবে মরত। রাত থেকে এসব শুনতে শুনতে তার কান সয়ে গেছে। আরজান পুনরায় শুধাল, “তাহলে তুমি ক্ষমা করবে না?”
“না।” সোজাসাপ্টা উত্তর রূপকথার। মুখটা ভোঁতা হয়ে যায় আরজানের। শাস্তিও দিচ্ছে না, ক্ষমাও করছে না। শুধু সেকেন্ডে তিনবার করে বলছে দূরে থাকুন, দূরে থাকুন। এভাবে দূরে থাকতে থাকতে তার পুনরায় তরতর করে রাগ উঠে যাচ্ছে মৎস সমাজের লোকজনের উপর। ইচ্ছা করছে সবগুলোকে উত্তপ্ত কড়াইতে ছেড়ে তেল ঢেলে নেড়ে নেড়ে চপ বানাতে। একটু বেসন দিলে স্বাদ ভালো হতো।
তাকে এভাবে চুপচাপ থাকতে দেখে ভ্রু কুচকাল রূপকথা। এভাবে চুপ করে কী ভাবছে? নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলব এঁটেছে! হুট করে দাঁড়িয়ে পড়লো রূপকথা। গলা খাকারি দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, শাস্তিই দিব। কিন্তু শর্ত আছে।”
ধপ করে কান ছেড়ে দিলো আরজান। খুশিতে বাকবাকুক হয়ে শুধাল, “কী শাস্তি? বলো, সব শর্ত মঞ্জুর শুধু দূরে যাওয়ার মতো বিদঘুটে কথাবার্তা বলো না দয়া করে। তুমি চলে গেলে আর কেউ বিয়ে করবে না আমাকে। সবাই ভাববে আমি…………।”
“থামুন, শুনবো না আমি।”
বিরস মুখে তাকালো আরজান। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাকে স্বাভাবিক মনে হলেও ভিতরে ভিতরে সে প্রচন্ড ভীত হয়ে পড়েছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস শাস্তি হিসেবে রূপ তাকে ছেড়ে যাওয়ার কথাই বলবে। অতঃপর নিজ মনকেই সে ধমকে উঠল, “বললে বলুক। সে বললেই তাকে শুনতে হবে এমন কোনো অঙ্গীকারনামায় তো সে সই করেনি। রূপের কাণ্ডজ্ঞান এমনিতেই কম। সে তো চলে যেতে চাইতেই পারে তা বলে তাকে ছেড়ে দিতে হবে নাকি? উঁহু, কিছুতেই না।”
তাকে ভুল প্রমাণিত করে রূপ বলে উঠলো, “আপনার শাস্তি একটাই। সেটা হলো আমি এখন আপনাকে একটা কথা বলবো। কথাটা আপনি শুধু শুনবেন কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে পারবেন না এমনকি তার বিপরীতে কোনো প্রশ্নও করতে পারবেন না। মোট কথা এই প্রসঙ্গে আপনি কিছুই বলতে পারবেন না। শুধু চুপচাপ শুনবেন। উল্টা-পাল্টা কথা বলে আমাকে বিভ্রান্ত করবেন না খবরদার।”
“কী এমন কথা যে এতো শর্ত জুড়ে দিচ্ছ?” কৌতূহলী নয়নে শুধাল আরজান।
“শুনলে শুনুন নাহলে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকুন।”
ঘাবড়াল আরজান। সত্যিই কি চলে চাইছে রূপ? সে কারনেই কী এমন শর্ত? সে বিরস মুখে বলল, “ঠিক আছে। বলো, শুনছি কিন্তু চলে যাওয়ার কথা বলো না। সেটা মানতে পারবো না।”
অতঃপর কিছুক্ষণ নীরবে কাটল। কিছু একটা বলতে গিয়েও বারবার থেমে যাচ্ছে রূপকথা। বারংবার বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে কথাখানা। বাক্যটা বোধহয় কন্ঠনালী চিরে বেরোতে চাইছে না। গলা শুকিয়ে এসেছে অজানা কারনে। চঞ্চল তার দৃষ্টি। আরজানের দিকে চেয়ে দেখল সে এখনো আগ্রহী নয়নে চেয়ে আছে তার দিকে। খানিক ভীত হয়েছে তার মুখভঙ্গি। ঢোক গিলল রূপকথা। চোখদুটো বন্ধ করে বড়বড় শ্বাস নিলো কয়েকবার। অতঃপর চোখ মেলে হুট করে বলে উঠলো, “ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমায় ম্যাজিশিয়ান।”
বিনা মেঘে যেন বজ্রপাত ঘটাল বাক্যখানা। চকিতে তাকালো আরজান। বিস্ময়ে শ্বাস নিতেও ভুলে গেল সে। হৃদস্পন্দন মিস হলো বোধহয় কয়েকবার। বুকের মধ্যে একাধারে ধ্বক ধ্বক শব্দটার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে কি সঠিক শুনলো? রূপ তাকে ভালোবাসি বলল! হ্যাঁ, ভালোবাসি বলেছে সে! নাকি সে স্বপ্ন দেখছে অথবা ভুল শুনছে? দ্বিধান্বিত হয়ে সে আগ্রহী নয়নে তাকালো রূপকথার দিকে। শুকিয়ে যাওয়া কন্ঠে আমতা আমতা করে শুধাল, “তততুমি সসসত্যি আআমাকে………।”
কথা সম্পূর্ণ করা হলো না তার। থামিয়ে দিলো রূপকথা। কপট রাগ দেখিয়ে বলল, “শর্ত ভুলে গিয়েছো? প্রশ্ন করা যাবে না।”
“কিন্তু আমি সঠিক শুনেছি নাকি ভুল শুনেছি সেটা তো কনফার্ম হতে দাও।” উত্তেজিত কন্ঠ আরজানের।
ভ্রু কুচকাল রূপকথা। ব্যঙ্গ করে শুধাল, “কেন? ভুল শুনলে খুশি হতে বুঝি?”
ভ্রূযুগল উচিয়ে ধরলো আরজান। মেয়েটা আবার ত্যাড়া কথা বলছে! তারমানে সে সঠিকই শুনেছে। সে স্বস্তি পেল কিছুটা। এমন শ্রুতিমধুর বাক্য সে আগে কখনো শুনেছে বলে মনে পড়লো না। একগাল হেসে রূপকথার দিকে এগিয়ে যেতেই সরে দাঁড়ালো সে। হাত সামনে বাড়িয়ে বলল, “আবার কাছে আসছো? দূরে সরে দাঁড়াও।”
বিরক্ত হলো আরজান। এই মেয়ে তো বড় ধুরন্ধর হয়েছে! কাছে আসতে দেবে না, ভালোবাসতে দেবে না। শেষমেশ ভালোবাসি বলল সেটাও শর্ত জুড়ে দিয়ে! এ কেমন অবিচার তার মতো অসহায় যুবকের উপর! সামান্যতম মায়া-দয়া নেই! আশ্চর্য! মায়া-মোহব্বত জমিন চিরে চলে যাচ্ছে নাকি দিনদিন! এমন সুখময় মুহুর্তে এমন নিষ্ঠুরতা মোটেই মেনে নেওয়া যায় না! সে আবদারের সুরে বলল, “একটু কাছে আসি? বিশ্বাস করো একটা চুমু দিয়েই সরে আসবো। বেশি হলেও একটু জড়িয়ে ধরবো। এর চেয়ে তো বেশি কিছু না। আসি?”
“না।” পূর্বের ন্যায় কঠিন তার কন্ঠস্বর।
অতিশয় রাগান্বিত হলো আরজান। রূপকথার দিকে বিরস মুখে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। পরক্ষণেই হুট করে হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে রূপকথার গাল টিপে দিলো দু’হাতে। চমকাল রূপকথা। হতবাক নয়নে তাকালো তার দিকে। তার দৃষ্টি আরজান খুব একটা আমলে নিলো বলে মনে হলো না। দায়সারাভাবে বলল, “এখন আবার চিৎকার করে কান্নাকাটি জুরে দিও না। দূরেই আছি আমি। জড়িয়েও ধরিনি, চুমুও দেইনি।”
কটমট করে তাকালো রূপকথা। এর মতো ফাজিল লোক কী করে হুট করে গম্ভীর হয়ে যেতে পারে! মাথায় তো যত রকম কুচক্রী বুদ্ধির কারখানা! তার চাহনি লক্ষ্য করে আরজান বলে উঠলো, “এভাবে তাকানোর মতোও ভালোবাসিনি আমি। এমন একটা মুখভঙ্গি করছো যেন বাচ্চা পয়দা করে ফেলেছি তোমাকে না জানিয়ে।”
নির্লজ্জের মতো গড়গড়িয়ে বলা কথাগুলোও হজম করে নিলো রূপকথা। ভড়কাল না সে। আরজানকে চিনতে আর বাকি নেই তার। হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে দ্রুত মোবাইল বের করলো আরজান। সময় দেখে নিয়ে তাড়া দিয়ে বলল, “এখনি যাওয়া উঠিত আমাদের। নাহলে সকালের বাস ছুটে যাবে।”
“হুম, চলো।” ছোট করে উত্তর দিলো রূপকথা।
তারা হাঁটতে শুরু করলো রাস্তার দিকে। একটু পরেই হয়তো আলো ফুটবে আঁধারের অন্ত হয়ে। দিনের সাথে পাল্লা দিয়ে তারাও ছুটবে বাড়ির উদ্দেশ্যে। রাস্তায় এসে কোনো গাড়ির দেখা পাওয়া গেল না। এ পাশটা অধিক নির্জন হওয়ায় গাড়ি চলাচল করে না খুব একটা। লোকজনও নেই বললেই চলে। তাদের আরো কিছুটা এগিয়ে যেতে হবে মেইন রাস্তার দিকে। তবে ক্লান্ত রূপকথা। তার হেঁটে চলতে খানিক কসরত করতে হচ্ছে বটে। তার ক্লান্ত মুখখানা দেখেই যা বোঝার বুঝে নিলো আরজান। রাস্তায় মাঝে মাঝে দু’য়েকজন লোকজন দেখা যাচ্ছে। তাই হুট করে তাকে কোলে তুলে নিতে পারলো না সে। মানুষের সামনে ভালোবাসা প্রকাশ করার কোনো মানেই হয় না। তাছাড়া জনসম্মুখে কোলে তুলে নেওয়াটা খানিক দৃষ্টিকটু লাগে। রূপকথার ক্লান্ত মুখের দিকে চেয়ে তার হাত চেপে ধরলো সে। চিন্তিত স্বরে বলল, “এখানে নাহয় দাঁড়িয়ে একটু জিরিয়ে নাও।”
থামল রূপকথা। হুট করে ক্লান্তিভরা মুখটাতে হাসি ফুটে উঠলো। হাতে থাকা হাতটা আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো সে। কতটা ভরসা মিশে আছে এই হাতে তার হিসেব করা দায়! সে গাঢ় দৃষ্টিতে চাইল আরজানের দিকে। কেন যেন এই মানুষটার প্রতিটা পদক্ষেপ নিখুঁতভাবে তার হৃদয় ছুঁয়ে যায়! হৃদয়ে আঁচড় কেটে যায় তার বলা প্রতিটা বাক্য! আরজান অবাক কন্ঠে শুধাল, “হাসছো যে?”
ঠোঁটদুটো আরো কিছুটা প্রসারিত করলো রূপকথা। কাঁটা ঠোঁটটা নাড়িয়ে বলল, “হাসতেও কি অনুমতি প্রয়োজন ম্যাজিশিয়ান?”
চমকাল আরজান। কতগুলো দিন বাদে আবার সেই ডাক শুনতে পেল। এই ডাক যে তাকে নেশার মতোই টানে। প্রথম থেকেই এই ডাক সে অগ্রাহ্য করতে পারে না। রূপকথার দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসল সে। গাড়ির শব্দে ধ্যান ভাঙলো তার। দ্রুত রাস্তার দিকে চেয়ে দেখতে পেল একটা অটো আসছে তাদের দিকে। হাত বাড়িয়ে থামতে বলল সে। অটোচালক তাদের দেখে কিঞ্চিত অবাক হলো বটে। এ রাস্তায় এমন একটা ভোর সকালে কোনো লোকজন পাবে বলে হয়তো সে আশা করেনি। এগিয়ে এসে দাঁড়ালো তাদের সামনে। আরজান দ্রুত এগিয়ে গিয়ে অটোচালকের সঙ্গে গন্তব্য এবং ভাড়া সম্পর্কিত কথোপকথন সেরে নিলো। অতঃপর রূপকথার কাছে এগিয়ে এসে পুনরায় তার হাত ধরে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি ছেড়ে কিছুদূর যাওয়ার পরেই অটোচালক মিররে আড়চোখে একবার তাকালো রূপকথার দিকে। হয়তো তার শরীরের ক্ষতস্থানগুলোর জন্য অথবা তার বালু মিশ্রিত সোনালি চুলগুলোর জন্য। এতে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলো রূপকথা। আরো এগিয়ে গিয়ে সেটে বসলো আরজানের শরীর ঘেষে। বিষয়টা লক্ষ্য করেছে আরজান। সে রাগান্বিত দৃষ্টিতে অটোচালকের দিকে চেয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, “রাস্তা কি সামনে নাকি পেছনে?”
ভড়কাল অটোচালক। তুতলিয়ে বলল, “নননা মানে…………।”
“যেতে হবে না আপনার। নামিয়ে দিন আমাদের।”
“আপনি কিন্তু ভুল ভাবছেন। আমি শুধু………”
কথা সম্পূর্ণ করা হলো না অটোচালকের। অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে ধমকে উঠলো আরজান, “কী বলেছি শুনতে পারছেন না?”
দ্রুত ব্রেক কসে থেমে গেল গাড়ি। আরজান নেমে আসলো রূপকথাকে নিয়ে। ভাড়ার টাকা অটোচালকের হাতে দিয়ে বলল, “যেতে পারেন এখন।”
তার দৃষ্টির অগোচরেই মুচকি হাসলো রূপকথা। চলে গেল অটোচালক। রূপকথার দিকে চেয়ে তাকে হাসতে দেখে ভ্রু কুচকাল আরজান। মেয়েটা কি আজ একটু বেশিই হাসছে! তার হুটহাট হাসি কীসের ইঙ্গিত বহন করছে? সে কি বেশিই আনন্দিত আজ? নাকি নতুন জীবনের সূচনাতেই তার এই আনন্দ!
পুনরায় গাড়ির শব্দে ফিরে তাকালো আরজান। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো অটোচালকের দিকে। লোকটাকে ঠিক সুবিধার মনে হলো না তার। তাই আর ডাকলো না সে। একে একে ঠিক কতগুলো অটো চলে গেল তার হিসেব নেই। অথচ কাউকেই থামাচ্ছে না আরজান। অটো দেখলেই আগে চালকের দিকে তাকাচ্ছে সে। অতঃপর চোখ-মুখ কুচকে নিচ্ছে বিরক্তিতে। অনেক সময় পর বুঝি একটা অটো সুবিধার মতো পেল সে। ডেকে দাঁড় করিয়ে দ্রুত উঠে বসলো। ব্যস্ত স্বরে বলল, “বাস স্ট্যান্ড যাবো। তাড়াতাড়ি চালাবে, ছয়টার বাস আর এখন বাজে পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ।”
খানিক অবাক হলো অটোচালক। বাস স্ট্যান্ড এর দূরত্ব কম নয় এখান থেকে। অন্তত চল্লিশ মিনিট তো লাগবেই। সেখানে এই লোক বলছে পনেরো মিনিটে পৌঁছাতে। কীভাবে সম্ভব! তবুও সে যতটা দ্রুত সম্ভব চালাতে শুরু করলো তবে মেইন রাস্তায় উঠতেই সে গতি কমাতে বাধ্য হলো। বোধহয় ট্রাফিক পুলিশের ভয়ে। একবার ধরলেই দুই/তিন হাজার টাকা জরিমানা। চিন্তিত হলো আরজান। বাস ছেড়ে দিলেই সর্বনাশ। আবার অপেক্ষা করতে হবে এগারোটা পর্যন্ত। কারন পরবর্তী বাস এগারোটায় ছাড়বে। বেশ খানিকটা সময় পর তারা বাস স্ট্যান্ডে এসে পৌঁছালো। তেত্রিশ মিনিট পার হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। ভাড়া মিটিয়ে হন্তদন্ত হয়ে তারা ছুটলো বাসের দিকে। মোবাইল বের করে বাসের নম্বর মিলিয়ে দেখলো গ্রামের দিকে যাওয়ার বাসটা এখনো দাঁড়িয়েই আছে। খুশি হলো সে। রূপকথাকে নিয়ে দ্রুত উঠে বসলো নির্ধারিত স্থানে। রূপকথাকে জানালার দিকে বসিয়ে তার পাশে ধপ করে বসে পড়লো। তবে অনলাইন টিকেটের অনেক ঝামেলা। সুবিধা মতো সিট পায়নি সে। একদম ‘ডি’ সারির টিকিট পেয়েছে।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচতেই শুনতে পেল যাত্রীদের রাগান্বিত কন্ঠস্বর। তারা চিৎকার-চেঁচামেচি করছে বাস ছাড়তে দেরি হবার কারনে। সবার অভিযোগের মাঝেও শান্তি পেল আরজান। ভাগ্যিস বাস ছাড়তে দেরি করছে! তখনই একজন সাহেববেশি লোক উঠে এলো বাসের মধ্যে। যাত্রীদের শান্ত করতে বলল, “আপনারা চিন্তিত হবেন না। এখনি বাস ছাড়া হবে। আমাদের কিছু ত্রুটির কারনে বিশ মিনিট মতো দেরি হয়েছে। তবে আপনারা দ্রুতই পৌঁছাতে পারবেন আশা করি।”
কমে এলো যাত্রীদের হৈ-চৈ। লোকটা নেমে যেতেই বাস যাত্রা শুরু করলো নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। তখনই বেজে উঠলো আরজানের মোবাইল। স্ক্রিনে বড়বড় অক্ষরে ভেসে উঠছে ‘শা’লাবাবু’ লেখাটা। রিসিভ করে কানে ধরতেই ভেসে এলো পলাশের উত্তেজিত কন্ঠস্বর, “দুলাভাই, আপনে কাউরে কিছু না কইয়া কই চইলা গেছেন? রাইতে বাড়িও আসেন নাই। চাচি তো চিন্তায় শ্যাষ। পোলাপান নিয়া সারা গেরাম খুঁজছি আপনেরে তাও পাই নাই।”
“আরেহ শা’লাবাবু যে! আমি শহরে আছি। এতো খোঁজাখুঁজির কী হয়েছে? সারা গ্রাম আমাকে না খুঁজে যদি সুন্দরী মেয়ে খুঁজতে তাহলে আজ আর তোমাকে সিঙ্গেল থাকতে হতো না। কবেই বিয়েসাদি করে চার-পাঁচটা বাচ্চা পয়দা করে ফেলতে পারতে।”
এবার বুঝি মহা বিরক্ত হলো পলাশ। চোখ-মুখ কুচকে রাগান্বিত স্বরে বলল, “আপনে কি ভালা কতা কইতে পারেন না? আল্লাহর ত্রিশটা দিন খালি ফা’উল কতা কন।”
“খারাপ কী বলেছি? তোমার নাহয় ইচ্ছা করে না কিন্তু আমার শশুরের তো দাদু ডাক শোনার ইচ্ছা হয় নাকি? নিজের জন্য না হলেও অন্তত বাপের কথা চিন্তা করে তোমার বিয়েটা করে নেওয়া উঠিত।”
পলাশ কটমট করে তাকালো আকরাম মিঞার দিকে। দাদা ডাক শোনার এতো ইচ্ছে হইলে তারে কইতে পারতো। তা না এই মানুষটারে কইছে এইসব ফা’উল কতাবার্তা শুনবার লিগা। লাউডস্পিকার অন ছিলো। সব শুনে আকরাম মিঞা অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সে কবে এইসব কতা কইছে!
পলাশ পুনরায় শুধাল, “কবে আসতাছেন তাই কন?”
“আরে আসছি, আসছি। বাসের মধ্যে এখন। এতো তাড়াহুড়োর কী হয়েছে? বিয়ে দেবো বলেছি বলে কি এখনি দিয়ে দেবো নাকি? সবুর করো। মেয়েও তো খুঁজতে হবে, নাকি?”
অতিশয় বিরক্ত হলো পলাশ। রেগেমেগে কল কেটে দিতে গেলেই আরজান বলে উঠলো, “তোমার বোনকে নিতে এসেছিলাম। বাসেই আছি এখন আমরা।”
বিস্ময়ে হা হয়ে গেল পলাশের মুখ। আগ্রহের সাথে তার দিকে এগিয়ে এলো সোফিয়া শিকদার ও রোজিনা বেগম। পলাশ বিস্মিত কন্ঠে শুধাল, “হাছা কইতাছেন? বোনরে সাথে নিয়া আসতাছেন?”
“হুম, সে আছে আমার পাশেই। আচ্ছা রাখো। বাড়ি এসে বাকি কথা হবে। এখন বউয়ের সাথে একটু সময় কাটাতে দাও তো শান্তিমতো। কল দিয়ে বিরক্ত করবে না একদম।”
কথা সম্পূর্ণ করেই হুট করে কল বিচ্ছিন্ন করে দিলো আরজান। দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পেলো না পলাশ। তবে তার চোখ-মুখ থেকে বিস্ময় মুছে গিয়ে সেখানে স্থান পেয়েছে একরাশ খুশি। সোফিয়া শিকদার ও রোজিনা বেগমের ঠোঁট জুরে শোভা পাচ্ছে মিষ্টি হাসি। বিস্ময় কাটতে খানিক সময় লাগলো আকরাম মিঞার। বিস্ময় কাটতেই সে চেঁচিয়ে বললেন, “কই রে? পলাশের মা, বাজারের ব্যাগডা দে দেখি। ওরা আইলে আইজ এইহানেই থাকবার কবি। আর বিয়ানও আইজ এইহানেই থাকুক।”
চেয়ারম্যান বাড়ির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়লো খুশির আমেজ। হারিয়ে যাওয়া খুশি যেন ফিরে এলো এবার! রোজিনা বেগম হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বাজারের ব্যাগটা বের করে দিলো। পলাশও বাপের সাথে ছুটলো বাজারের উদ্দেশ্যে। সোফিয়া শিকদার মুখে আঁচল চেপে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন। এ অশ্রু খুশির অশ্রু। রোজিনা বেগম দুটো টুল নিয়ে এলো। দু’জন বসলো একসাথে। রোজিনা বেগম হাসিমুখে বললেন, “কাইন্দেন না আপা। মাইয়াডা কতগুলা দিন পর বাড়িত আইব।”
অপরদিকে ইতিমধ্যে বাসের সিটে নিজের মাথা এলিয়ে দিয়েছে রূপকথা। ঘুম পাচ্ছে তার। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ভ্রু কুচকাল আরজান। রূপকথাকে এভাবে ঘুমাতে দেখে ভীষণ রাগ হলো তার। স্বামী এদিকে ভালোবাসার অভাবে চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে আর বউ কি-না আরামে ঘুমাচ্ছে! কী মর্মান্তিক দৃশ্য! এরচেয়ে অধিক নিষ্ঠুরতা আর কিছু হতে পারে বলে তার মনে পড়লো না। সে সাবধানী দৃষ্টিতে তাকালো চারদিকে। নাহ, সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। কেউ তাদের দিকে চেয়ে নেই নিশ্চিত হয়ে টুপ করে চুমু বসিয়ে দিলো রূপকথার গালে। অমনি ধরফরিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়লো রূপকথা। গালে হাত দিয়ে হতবাক নয়নে তাকালো আরজানের দিকে। পাত্তা দিলো না আরজান। পুনরায় চুমু বসিয়ে দিলো তার অপর গালটাতে। এবার দু’গালে হাত রাখলো রূপকথা। হতবুদ্ধির ন্যায় চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। অতঃপর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলো চারপাশ। নাহ, কেউ দেখেনি। স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে কটমট করে তাকালো আরজানের দিকে। ঝাঁঝালো গলায় বলল, “কাণ্ডজ্ঞান সব বিকিয়ে দিয়েছো?”
“না তো, চুমু দিয়েছি।” গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলল আরজান।
তেতে উঠলো রূপকথা। রেগেমেগে আরো কিছু বলার পূর্বেই আরজান বলল, “রাগারাগি করো না প্লিজ। তুমি রেগে গেলে তোমাকে আরো বেশি সুন্দর লাগে। আমি উল্টা-পাল্টা কিছু করে বসলে তখন দোষ তো আমাকেই দেবে।”
রূপকথার আর কথা বলার ইচ্ছা হলো না। সে পুনরায় মাথা এলিয়ে দিলো সিটের উপর। কপাল কুচকে তাকালো আরজান। তাকে কি অগ্রাহ্য করলো! সে পুনরায় এগিয়ে গেল রূপকথার মূখের দিকে। মুখের সামনে উড়ে আসা সোনালি চুলগুলো সরিয়ে দিতেই চোখ মেললো রূপকথা। ভ্রু কুচকে শুধাল, “আবার?”
চোখদুটো ছোট ছোট করলো আরজান। তার মুখের কাছ থেকে সরে নিজের সিটে বসলো ঠিকঠাক করে। অতঃপর বিরক্ত স্বরে বলল, “আবার কী? একটু চুমুই তো দিতে চেয়েছি।”
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রূপকথার। হুট করে আরজান বলে উঠলো, “আমি তোমাকে ভালোবাসি কি-না শুনবে না?”
“জানি আমি।”
“কীভাবে?”
“একটা ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তির কানের কাছে যদি কেউ অবিরত নিজের ভালোবাসার স্বীকারোক্তি প্রকাশ করতে থাকে তাহলে না জেনে উপায় আছে কি?”
“তারমানে সেদিন তুমি জেগে ছিলে?” চোখদুটো বড়বড় করে বলল আরজান।
“জেগে ছিলাম না। তোমার কথার শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।”
“তাহলে আবার শোনো। ভালোবাসি আমার জলরূপসীকে, অনেক বেশি ভালোবাসি।”
আচমকা এমন স্বীকারোক্তিতে চমকাল রূপকথা। অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আরজানের মুখের দিকে চেয়ে থেকে মুচকি হেসে মিশে গেল তার বুকের সাথে। বুকের বা’পাশটাতে হাত রাখলো আলতো করে। অতঃপর দুষ্টু হেসে বলল, “কিন্তু আমি ভালোবাসি না। অত্যন্ত ফা’উল একজন মানুষ তুমি।”
বুকের সাথে তার হাতটা চেপে ধরলো আরজান। অন্য হাতে তাকে নিজের সাথে আরো মিশিয়ে নিলো আষ্টে-পিষ্টে। ভ্রু কুচকে বলল, “আচ্ছা? ভালোবাসতে হবে না তোমাকে। আমার একার ভালোবাসাই যথেষ্ট। তুমি নাহয় চার-পাঁচটা বাচ্চা পয়দা করার পরেই ভালোবেসো।”
বুকের কাছের শার্টটুকু আঁকড়ে ধরলো রূপকথা। ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠলো, “আমার ম্যাজিশিয়ান।”
বিশালাকার জায়গা জুরে বিস্তৃত রাস্তাটার উপর দিয়ে শাঁ শাঁ করে ছুটে চলেছে নীল রঙা একটি মরচে পড়া বাস। তার সাথে ছুটে চলেছে কোনো প্রেমিক যুগলের নতুন জীবনের স্বপ্ন। ভালোবেসে সারাটা জীবন আঁকড়ে রাখার অঙ্গীকার। ঠিক তখনই রাস্তার ধারের টং দোকান থেকে সুরেলা কন্ঠে ভেসে আসলো,
‘এ জীবনে যারে চেয়েছি,
আজ আমি তারে পেয়েছি।
তুমি আমার, সেই তুমি আমার।
তোমারে খুঁজে পেয়েছি।’
(সমাপ্ত)
সত্যি অসাধারণ হইছে বলার বাইরে