রুপালি মেঘের খামে পর্ব-১১

0
411

#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz

১১.
অরার চলে যাওয়ার খবর শুনে আর কেউ খুশি না হলেও ফুলবানু খুব খুশি হয়েছেন। তিনি নীলিমাকে ডেকে আনন্দিত গলায় বললেন,” এতোদিনে একটা কামের কাম করছে আমার নাতি। আমি খুব খুশি হইছি। আমার পোলা ওই ডাইনির বিচার করে নাই। কিন্তু আমার ভাই করছে। পু*ন্দের মধ্যে লাত্থি মাইরা শয়তানিরে ভাগাইছে।”

” আম্মা, এমনিও ছেলেটার মন-মেজাজ ভালো নেই। আপনি দয়া করে এসব বলা বন্ধ করুন।”

” অলক্ষী বাড়ি থেকা বিদায় হইছে না? এখন সবই ভালো থাকব। তুমি যাও, আমি এখন শুকরানার নামায আদায় করব। ওই মাইয়া যেন কখনও এই বাড়িতে ঢুকতে না পারে সেই জন্য দোয়া করব। আর আমার নাতির জন্যেও দোয়া করব। সে আমার সম্মান রাখছে। আমি তারে আবার বিয়ে করাব। তুমি দেইখো নিলু, হাজার গুণ সুন্দর আর ভালো নাতবউ নিয়া আসব। যদি তা করতে না পারি, তাইলে আমার নামও ফুলবানু বেগম না।”

ফুলবানু সত্যিই অযূ করে নামাযে দাঁড়ালেন। হাসি হাসি মুখে তিনি নামায আদায় করতে লাগলেন। শাশুড়ীকে এতো খুশি হতে নীলিমা অনেকদিন পরে দেখলেন।

বাড়ি এসে অরা লম্বা সময়ের জন্য ঘুমিয়েছে। বাবা-মায়ের সাথে তার তেমন কথা হয়নি। সায়ানকে খুব আপ্যায়ন করা হচ্ছে। সকালের নাস্তা হিসেবে সে যা খেয়েছে, তা বাড়িতে সারাদিনেও খায় না। নানরুটি, চালের রুটি, গরুর মাংস ভুনা, আস্তো চিকেন ফ্রাই, ডিম, কেক, মাংসে কিমা ভর্তি মোগলাই, দই, মিষ্টি আইসক্রিম। এতোকিছু খেয়ে তার এতো পেট ভরে গেছে যে মনে হচ্ছে আগামী সাত দিন না খেয়ে থাকলেও চলবে।

অথচ দুপুরের মেন্যুতে কাচ্চি দেখে তার আবারও ক্ষিদে পেয়ে গেছে। বিকালে রূপা অরার সাথে দেখা করতে এসেছিল। দরজা খুলেছে সায়ান। তাকে দেখে রূপার চোখ ছানাবড়া।

সায়ান হাসি মুখে বলল,” ওয়েলকাম, ডার্লিং। তোমার জন্যই ওয়েট করছিলাম। হোয়াই সো লেইট?”

রূপা হতভম্ব হয়ে বলল,” তুমি এখানে কি করছো?”

সায়ান হাত ভাঁজ করে উত্তর দিল,” বলেছিলাম না, সারপ্রাইজ আছে?”

এই কথা বলেই বাম চোখটা টিপল সে। রূপার মুখটা লজ্জায় লালচে আভায় ভরে উঠল। এই কয়েকদিন ফোনে কথা বলে তাদের মধ্যে হালকা-পাতলা ভাব জমে গেছে। একে-অপরকে ‘তুমি’ করে ডাকার অভ্যাসটাও হয়েছে৷ যদিও রূপা এখনও মৌখিকভাবে তাদের সম্পর্ককে ‘প্রেম’ বলে স্বীকৃতি দেয়নি। অথচ সায়ান তাকে প্রতি বাক্যে তাকে ডার্লিং বলে ডাকছে। মোবাইলে কথা বলার সময় কিছু মনে হয়নি, কিন্তু এখন সামনা-সামনি দেখা হওয়ায় রূপার খুব লজ্জা লাগছে।

” সামনে থেকে সরো। আমি অরার সাথে দেখা করতে এসেছি।”

সায়ান তার পথরোধ করে বলল,” আর আমি? আমাকে দেখবে না?”

রূপা তার বড় নখ দিয়ে সায়ানের পেটে খোঁচা মারল৷ সায়ান চমকে উঠল। তাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত ভেতরে চলে এলো রূপা। তার হৃৎস্পন্দন অনেক বেড়ে গেছে। শ্বাস পড়ছে দ্রুত। ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। অরা বিছানায় ঘুমাচ্ছিল। দরজা আটকানোর শব্দেই সে জেগে উঠল। তার ঘুম খুব পাতলা।

” রূপা।”

রূপা কাছে এসে অরাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ” হঠাৎ না জানিয়ে এভাবে চলে এলি যে? কিছু হয়েছে নাকি?”

অরা বলতে নিয়েও বলতে পারল না। কষ্টের কথা সে কাউকে বলে না। মনের মধ্যে সব চেপে রাখা তার ছোটবেলার স্বভাব।

” তেমন কিছু না। সবার কথা মনে পড়ছিল। তাই চলে এসেছি।”

” তোর আর ভাইয়ার মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে তো?”

” হুম৷ এভ্রিথিং ইজ অলরাইট।”

অরা হাসলেও চোখ দেখেই রূপা বুঝতে পারল, নাথিং ইজ অলরাইট। তবুও তাকে কিছু বলার জন্য জোর করল না। আরও একবার জড়িয়ে ধরল।

” আচ্ছা, ড্রয়িংরুমে তোর দেবর গাঁধাটাকে দেখলাম। সে যে এসেছে আমাকে বলিসনি কেন?”

অরা মুচকি হেসে বলল,” তোর জন্যই তো এসেছে।”

” উফ, বিরক্তিকর! দরজার সামনেই আমাকে ডার্লিং বলে ডাকছিল জানিস? আন্টি শুনে ফেললে কি হতো?”

অরা ফিক করে হেসে উঠল। রূপা আসার পর তার মন অনেকটাই ভালো হয়ে গেল। সাবিরা খুব চিন্তিত ছিলেন। কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে বলেই অরা এসেছে। তাও দেবরের সাথে। জামাইয়ের সাথে কেন আসেনি? তাহলে কি সামির এখনও তাকে মাফ করেনি? এই ব্যাপারে সাবিরা মনে মনে খুব দুশ্চিন্তা করতে লাগলেন। অরাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ হলো না।

ডিনারে সবাই একসাথে খেতে বসেছে৷ তখন আরিফ সাহেব প্রশ্ন করলেন,” সামির কেন এলো না সায়ান? সে কি বেশি ব্যস্ত ছিল? অরাকে তোমার সাথে পাঠাল যে?”

সায়ান বলল,”ভাইয়ার ডিপার্টমেন্টে স্টুডেন্টদের পরীক্ষা চলছে। সেজন্যই ব্যস্ত। তবে ভাবিকে নেওয়ার জন্য হয়তো ভাইয়া আসবে।”

সাবিরা বললেন,” অবশ্যই আসতে হবে। সামির না এলে কিন্তু আমি আমার মেয়েকে যেতে দিবো না।”

সাবিরা কথাটা সিরিয়াসলি বলেছেন। কিন্তু সায়ান মজা ভেবে হাসল। অরার মুখ চুপসে গেল হঠাৎ। সামির কি আসলেই তাকে নিতে আসবে? মনে তো হয় না!

রূপা চুপচাপ খাচ্ছিল। সে এমনিতে অনেক কথা বলে। কিন্তু আজকে সায়ানের সামনে একদম চুপ হয়ে আছে। নর্ভাসনেসে গলা দিয়ে খাবারই নামছে না৷ সায়ান বার-বার তার দিকে তাকাচ্ছে। চোখে-মুখে দুষ্টমি ভাব। একটু পরপরই টেবিলের নিচে পা দিয়ে তাকে খোঁচা মারছে। এতে রূপা আরও বিব্রতবোধ করছে।

হঠাৎ সায়ান তাকে ঠোঁট উঁচু করে ফ্লায়িং কিস দিল৷ রূপার হিঁচকি উঠে গেল তখন। সাবিরা দ্রুত হাতে পানি ঢেলে দিলেন৷ তিনি সমস্ত ব্যাপার খেয়াল করেছেন।

রাতে অরা জেদ করল, রূপাকে তার সাথে থাকতেই হবে। সে আজ বাড়ি যেতে পারবে না। সাবিরা বললেন,” ওর মামা-মামী কি বলবে অরা? ওকে যেতে দে।”

অরা মুখ গোমরা করে বলল,” এমনভাবে বলছো, যেন রূপা আগে কখনও আমাদের বাড়িতে রাতে থাকেনি? ওর মামীর সাথে আমি কথা বলে নিবো।”

রূপা ফিসফিস করে বলল,” আমি রাতে বাড়ি না ফিরলে মামী খুশিই হবে। যদি কোনোদিন না ফিরি তাহলে আরও খুশি হবে।”

অরা বলল,” আমার দেবরের সাথে ঢাকায় পালিয়ে যা। তোর মামীও খুশি হয়ে যাবে আর আমার দেবরও।”

” মাথা খারাপ?”

দু’জনেই হেসে উঠল। সাবিরা তাদের ফিসফিসানি শুনতে না পেলেও আন্দাজ করতে পারলেন৷ রূপা আর সায়ানের মধ্যে কিছু চলছে; ব্যাপারটা বুঝতে তার অসুবিধা হচ্ছে না।

রূপা রাতে অরার সাথেই থেকে গেল। এদিকে সায়ানের ঘুম আসছে না। সে অনবরত রূপাকে মেসেজ করছে বাইরে আসার জন্য। এতোক্ষণ রূপা অপেক্ষা করছিল কখন অরা ঘুমাবে। একটু পর যখন সত্যিই অরা ঘুমিয়ে গেল, তখন সে সাবধানে বের হলো।

সায়ান ড্রয়িংরুমে পায়চারি করছিল। রূপাকে দেখেই হাত ধরে হেঁচকা টান মেরে ঘরে এনে দরজা আটকে দিল। রূপার বুক ঢিপঢিপ করছিল। আতঙ্কে চোখ দু’টো বড় বড়, ডাঙায় তোলা মাছের মতো ছটফট করে উঠল,” দরজা বন্ধ করলে কেন? মেরে নাক ফাটিয়ে দিবো কিন্তু। দরজা খোলো!”

সায়ান ঘোরের মতো রূপাকে দেখছে। তার কপালের চুলগুলো সরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ঠোঁটের দিকে। সায়ানের ভারী নিশ্বাস টের পেয়ে রূপাও কেমন খেই হারিয়ে ফেলল এক মুহূর্তের জন্য! তারপর হঠাৎ বলে উঠল,” কি হচ্ছে এসব? ছাড়ো।”

” প্লিজ রূপা, একবার!” সায়ানের কণ্ঠে অনুরোধ। রূপা কঠিন গলায় বলল,” উহুম। একবারও না।”

সায়ান নিষেধ শুনল না। রূপার খুব ভয় লাগছিল। মাত্র কয়েকদিনের সম্পর্কে এতো কাছাকাছি আসা কি ঠিক? সায়ান কিছুটা ছেলেমানুষ। তার পাল্লায় পড়ে রূপাও ভুল করে ফেলছে না তো? সে সায়ানকে জোরে একটা ধাক্কা মেরে বলল,”আমিও কিন্তু অরার মতো চড় মারতে পারি।”

সায়ান হতচকিত। রূপা মুখ ফসকে এই কথা বলে ফেলার পর নিজেও বোকা হয়ে গেল। সায়ান বলল,” মানে?”

রূপা আমতা-আমতা করে বলল,” কিছু না।”

সে দরজা খুলে চলে যেতে নিচ্ছিল। সায়ান তাকে হাত ধরে থামাল। কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করল,” অরার মতো চড় মারতে পারো মানে? কাকে চড় মেরেছে অরা? ভাইয়াকে?”

রূপা নিশ্চুপ। সায়ান নীরবতাকেই সম্মতির লক্ষণ বুঝে নিল। বিস্ময় নিয়ে বলল,” ও… এজন্যই তাহলে ভাইয়া এতো রেগে আছে?”

” তোমার ভাইয়াকে ডিফেন্ড করার কিছু নেই। এখানে অরার দোষ ছিল না।”

” তাহলে কার দোষ ছিল? ভাইয়ার?”

” বাদ দাও। তাদের পারসোনাল ব্যাপার নিয়ে আমরা আলোচনা না করি।”

” কিন্তু টপিক যেহেতু উঠেই গেছে, ব্যাপারটা ক্লিয়ার করা ভালো।”

রূপা বলল,” হ্যাঁ তোমার ভাইয়ারই দোষ। সে অরাকে ফোর্স করেছিল।”

সায়ান এই কথা বিশ্বাস করল না। শক্ত গলায় বলল,” এটা ইম্পসিবল।”

” কেন? তোমার ভাইয়ার দোষ থাকতে পারে না? সে কি ধোঁয়া তুলসী পাতা?”

” তার চেয়েও বিশুদ্ধ। ” সায়ানের কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস।

রূপা উপহাসের ভঙ্গিতে বলল,” ও তাই?”

” হ্যাঁ তাই। বিয়ের প্রথমরাতে অরা অসুস্থ হয়ে গেল না? তখন ভাইয়াই ব্যবস্থা করেছিল যাতে সে কিছুদিন সামিয়ার ঘরে থাকতে পারে। আর তুমি বলছো ভাইয়া ফোর্স করবে?”

” অরা আমার কাছে মিথ্যা বলবে না। তার নিজের দোষ থাকলে সে স্বীকার করতো৷ তোমার ভাইয়া প্রথমে আয়নায় লিখে তাকে ছাদে ডেকেছিল। সে যায়নি। এটাও একটা রিজেকশন। তখনি তার বোঝা উচিৎ ছিল। অরাকে আরেকটু সময় দেওয়া উচিৎ। কিন্তু সেটা না করে উনি…”

এই পর্যায় সায়ান থামাল রূপাকে,” আচ্ছা ওয়েট, ওইদিন আমিও তো তোমাকে ছাদে ডেকেছিলাম। তুমি আসোনি কেন? সেটাও কি রিজেকশন?”

” তুমি আমাকে কখন ডেকেছো?”

” লিভিংরুমের বেসিনে যখন দেখা হলো, তখনি তো আয়নায় লিখলাম। তুমি দেখোনি?”

” লিভিংরুমের বেসিনে ওইটা তুমি লিখেছিলে?”

সায়ান স্তম্ভিত হলো। তার ছাদের ঘটনাটা মনে পড়ল। সেদিন সামির কারো জন্য অপেক্ষা করছিল মনে হয়। সেজন্যই তাকেও ছাদ থেকে বের করে দিয়েছিল। ব্যাপারটা বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলো না।

সায়ান বিহ্বল হয়ে বলল,” এমনও তো হতে পারে যে ভাবি ওই লেখাটাই দেখেছিল। ”

” তার মানে ওটা তুমি লিখেছিলে?”

” হ্যাঁ। হয়তো ভাইয়াও ওই লেখা দেখে ভেবেছে ওটা ভাবির লেখা! ও মাই গড,সেজন্যই ভাইয়া ছাদে অপেক্ষা করছিল।সেদিন আমার ভাইয়ার সাথে দেখা হয়েছিল রূপা। আমিও তোমার অপেক্ষা করছিলাম। বাট তুমি আসোনি।”

রূপা কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থেকে বলল,” ইডিয়েট, আয়নাতে কেন লিখতে হবে তোমার? মেসেজ করা যেতো না?”

” তখন তোমার ফোন নাম্বার ছিল না আমার কাছে।”

বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল রূপা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,”তোমার জন্যই সব ঝামেলা হয়েছে। এখনি ভাইয়াকে ফোন করে বলো যে আয়নায় সেটা তুমি লিখেছিলে, অরা লিখেনি। তোমার জন্য ওদের মধ্যে মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হচ্ছে। তোমার ভাই না জানি অরার ব্যাপারে কি কি ভাবছে। অথচ সে কিছুই করেনি।”

সায়ান অপরাধী গলায় বলল,” কিন্তু আমি এখন ভাইয়াকে কিছু বলতে পারব না রূপা।”

রূপা রেগে গেল,” কেন পারবে না? ব্লেন্ডার তুমি করেছো। তোমাকেই সব ঠিক করতে হবে।”

” ভাইয়া এটা জানলে আমাকে মেরে ফেলবে!”

সায়ানের চেহারা ইতোমধ্যে ভয়ে শুকিয়ে গেছে। রূপা কিড়মিড় করে বলল,” তোমাকে মেরেই ফেলা উচিৎ। ডাফার! এখনি ফোন করো, আমার সামনে।”

সায়ান অসহায়ের মতো বলল,” এখন তো ভাইয়া ঘুমাচ্ছে।”

” তবুও ফোন করো৷ এই প্রবলেম সোলভ না হলে আমার ঘুম আসবে না।”

সায়ান অনেকক্ষণ সাত-পাঁচ ভেবে মোবাইল হাতে নিল৷ তাকে বিব্রত দেখাচ্ছে। রূপা খটমট করে বলল,” ফোন করো।”

” কি বলব?”

” সেটাও আমি শিখিয়ে দিবো?”

সায়ান সামিরের নাম্বার ডায়াল করল এবং মনে মনে দোয়া করতে লাগল যেন ফোনটা রিসিভ না হয়। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত অতি দ্রুতই ফোন রিসিভ হয়ে গেল।

” হ্যালো।”

সামিরের ভরাট কণ্ঠ শুনেই সায়ান ফোন কেটে দিল। রূপা ধমক দিয়ে বলল,”এটা কি করলে তুমি? ভীতুর ডিম কোথাকার! খবরদার আমার সাথে আর জীবনেও কথা বলবে না।”

সে রাগে বের হয়ে যেতে নিল। সায়ান বলল,”আচ্ছা, আচ্ছা, এবার শিউর বলব।”

ততক্ষণে সামির নিজেই কলব্যাক করেছে। সায়ান নিভু নিভু গলায় বলল,” হ্যালো ভাইয়া।”

” কি ব্যাপার? ফোন দিয়ে আবার কেটে দিলি যে?”

” ভুলে ভাইয়া। স্যরি। তোমাকে একটা জরুরী কথা বলার ছিল।”

” এতোরাতে? অরার কিছু হয়নি তো?”

সামিরের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা৷ রূপা হেসে ফেলল। বিড়বিড় করে বলল,” বাহ, কত চিন্তা!”

সায়ান খুব সাবধানে রূপাকে চুপ থাকতে বলল। যেন রূপার কণ্ঠ সামির শুনে ফেললে তার গর্দান চলে যাবে।

” না ভাইয়া, কারো কিছু হয়নি। কথাটা একটু অন্যরকম বিষয় নিয়ে।”

” কি রকম বিষয়?”

সায়ান জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। তার অপ্রস্তুত লাগছে। রূপা আগুন চোখে তাকাল,” বলছো না কেন?”

সায়ান ইতি-উতি করে বলল,” ভাইয়া ওইদিনের কথা মনে আছে তোমার?”

” ওইদিন মানে কোনদিন আবার?”

” ওইতো, রিসিপশনের দিন।”

সেদিনের কথা মনে পড়তেই সামির একটু ক্ষেপে গেল যেন। ধারালো গলায় বলল,” কি হয়েছে ওইদিন?”

” ওইদিন যে তোমার সাথে আমার ছাদে দেখা হলো…”

” হ্যাঁ। তো?”

” তুমি কেন ছাদে গিয়েছিলে সেটা কি মনে আছে?”

তার বোকার মতো প্রশ্ন শুনে রূপা বিরক্ত হয়ে গেল। এতো কথা বাড়ানোর কি আছে? সারাসরি আসল কথা বললেই তো হয়। ওইপাশ থেকে সামিরও চরম বিরক্তি নিয়ে বলল,” কি বলতে চাস সেটা বল।”

” আমি বলতে চাইছি, ওইদিন তুমি যে কারণে ছাদে গিয়েছিলে… সেটা একটা ধোঁকা।”

” মানে?”

” লিভিংরুমের আয়নায় কেউ প্র্যাংক করে লিখেছিল ছাদে যাওয়ার কথা। আমিও সেজন্যই গিয়েছিলাম, চেক করতে।”

সামির কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল ,”কে লিখেছে? এতোবড় ফাজলামিটা কে করল?”

সায়ান ভীত গলায় বলল,” সেটা তো আমিও জানি না।”

সামির বলল,” হঠাৎ এই কথা বলার জন্য তুই রাতের বেলা ফোন দিয়েছিস?”

” হ্যাঁ। হঠাৎ করেই ব্যাপারটা মনে পড়ল….. ভাবলাম তোমাকে বলি। ”

” ঠিকাছে। ঘুমা এবার। ” সামির এই কথা বলে ফোন রেখে দিল।

রূপা ঝাঁজালো স্বরে বলল,” তোমার প্রবলেম কি সায়ান? সত্যিটা কেন বললে না? আমার তো মনে হচ্ছে উনি বিশ্বাসই করেনি তোমার কথা।”

” সত্যি কথা জানলে ভাইয়া আমাকে আস্তো রাখবে না।”

” এতো ভয় পাও? ছি, শেইম অন ইউ। কাওয়ার্ড!”

রাগে সায়নের বাহুতে কয়েকটা চাপড় মেরে রূপা বের হয়ে গেল। তখন ঘড়িতে রাত দেড়টা বাজছে। সাবিরা ইঁদুরের আওয়াজ শুনে রান্নাঘরে এসেছিলেন। তখনি রূপাকে সায়ানের ঘর থেকে বের হয়ে যেতে দেখলেন। অনাকাঙ্ক্ষিত সর্বনাশের আশঙ্কায় তার বুক ধ্বক করে উঠল।

এসব চলতে দেওয়া যাবে না৷ সকালে তিনি অরাকে নিজের ঘরে ডেকে বললেন,” এসব কি শুরু হয়েছে অরা? তুই কি নিজের সংসারে আগুন লাগাতে চাস?”

অরা বিস্মিত হয়ে বলল,” মানে? এই কথা কেন বলছো?”

ভয় পেয়ে গেল সে৷ মা কি কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে? সাবিরা বললেন,” রূপা আর সায়ানের কথা বলছি। রাতে আমি রূপাকে সায়ানের ঘর থেকে বের হতে দেখেছিলাম।ওদের মধ্যে কি চলছে?”

অরা সামান্য হেসে বলল,”ও এই ব্যাপার? এটা তেমন কিছু না মা। তুমি অযথাই টেনশন করছো।”

” তুই হাসছিস মানে? এটা তেমন কিছু না? রূপাকে যত দ্রুত সম্ভব এসব বন্ধ করতে বল। নাহলে যখন ওর জন্য তোর সংসারের সুখ নষ্ট হবে,তখন কিন্তু কেঁদেও কুল পাবি না।”

” রূপার জন্য আমার সুখ কেন নষ্ট হবে? কি আশ্চর্য! আর এখানে রূপার তো কোনো দোষ নেই। সায়ান ভাই-ই ওর পেছনে ঘুরেছে।”

” কিভাবে ঘুরল ও যদি আশকারা না দেয়?”

অরা বিরক্ত গলায় বলল,” তোমার আসল টেনশন কি নিয়ে বলোতো?”

” এসব তোর শ্বশুরবাড়িতে জানাজানি হলে কি হবে? রূপার বাপ-মা নেই৷ এতিম মেয়ে মামা-মামীর কাছে থাকে। সায়ানদের মতো পরিবার কি ওকে কখনও গ্রহণ করবে?”

” সেটা ওরা বুঝবে মা। তুমি কেন এতো হাইপার হচ্ছো?”

” কারণ আমি জানি ওদের বিয়ে সম্ভব না৷ এখন ওরা যেটা করছে সেটা হলো নষ্টামি। এসব আমার বাড়িতে চলবে না। সায়ান যতদিন এখানে আছে ততদিন যেন রূপা না আসে। ওকে বলে দে।”

” আমি রূপাকে এই কথা কিভাবে বলব? পাগল? তাছাড়া সায়ান ভাই আজরাতেই চলে যাচ্ছে। তুমি শান্ত হও।”

সেদিন রাতেই সায়ান ঢাকায় ফিরে গেছিল৷ তারপর অনেকদিন কেটে গেল, কিন্তু সামির অরার কোনো খোঁজই করল না। অরার দিনগুলো খুব অপেক্ষায় অতিবাহিত হচ্ছিল। তাকে ফিরিয়ে নিতে কেউ এলো না। সামির না এলে সাবিরাও অরাকে যেতে দিবেন না। শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রায়ই সামিয়া অথবা নীলিমা অরাকে ফোন করে। সবার সাথেই অরার কথা হয়৷ শুধু সামির ছাড়া।

অপেক্ষা, ব্যাপারটা বড্ড কষ্টের।একদিন অরার অপেক্ষার শেষ প্রহর উপস্থিত হলো। কিন্তু সেদিন অরার মনে হলো এই অক্লান্ত অপেক্ষার অবসান না ঘটলেই বুঝি ভালো ছিল। এতোদিন অপেক্ষা ছিল, একটা আশাও ছিল। কিন্তু আজ অপেক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথে আশার শেষ প্রদ্বীপটাও যেন দপ করে নিভে গেছে।

ঢাকা থেকে অরার জন্য একটি পার্সেল পাঠানো হয়েছে। কুরিয়ার অফিস থেকে ফোন এলো। ডেলিভারি ম্যান বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আছে। অরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে সেই পার্সেল রিসিভ করল। বেশ বড় একটা কার্টুন। অরা ঘরে এসে জিনিসপত্র বের করে হতভম্ব হয়ে গেল। সামিরদের বাড়িতে তার ফেলে আসা জিনিসগুলোই একটা ব্যাগে ভরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাথে আছে একটা চিঠি। অরা চিঠির খাম খুলতে গিয়ে ঘেমে-নেয়ে একাকার হলো। হাত-পা কাঁপতে লাগল। পানি খেয়ে শুকনো গলা ভিজিয়ে নিল। নিজেকে শান্ত করে ধীরে-সুস্থে সে চিঠি খুলল। গোটা গোটা অক্ষরের ঝকঝকে লেখাগুলো পড়তে গিয়ে ক্রমশ শ্বাসরোধ হয়ে আসার উপক্রম হলো।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে